আধেকজান
(পর্ব # ৯)
॥ ৩ ॥
লিফটটা সাততলায় তাকে উগরে দিলে উদ্দালক তাদের ফ্ল্যাটের সামনে দু-জোড়া চটি-জুতোকে জড়াজড়ি করে পড়ে থাকতে দেখে। ভ্রূ কুঁচকে বেল বাজায় সে। ভেতর থেকে সাড়া মেলে মালতী মাসির। একটা স্নেহের স্বর, যা উদ্দালকের জন্যই নির্দিষ্ট। তার কোঁচকানো ভ্রূ স্বাভাবিক রূপ পায়। একই ঘণ্টা, একই আওয়াজ তার—তবু একেকজনের আঙুলের ছোঁয়ায় আলাদা আলাদা স্বরে বেজে ওঠে যেন তা, ভিন্ন কম্পাঙ্কে। পরিচিত জনের হাতের ছোঁয়া চেনা যায় সে ডাকে। তাদের লেকের পুরনো বাড়িতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়া মানুষকে চিনে নিত সে ঘরের ভেতর থেকেই পদধ্বনির হরেক ছন্দে। উদ্দালক ভাবে। আর তক্ষুনি দরজা খুলে যায়। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস মালতী মাসির হাসি মেখে ডেকে নেয় তাকে। দরজার খোলাপড়ার ক্ষণিক আন্দোলনেই ঝলসে ওঠে পেতলের ঝকঝকে নামফলকটি—এস॰ কে॰ মুখার্জী। সুজিত কুমার মুখার্জী, সুজিতের ঠাকুরদা। উদ্দালক সেঁধিয়ে যায় উজ্জ্বল ঘেরাটোপে।
হ্যাঁ, উদ্দালক যা ভেবেছে তাই-ই। মাসি-মেসো এসেছে তার। সে বাথরুমের দিকে যেতে যেতেই ছুঁড়ে দেয় দেঁতো পোশাকী সৌজন্য—ভালো আছ তোমরা?
--আরে সাহেব? তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।
--একটুখানি। আগে স্যানিটাইজ করি নিজেকে।
--সত্যই, যা দিনকাল এলো!
উদ্দালক ততক্ষণে বদ্ধ বাথরুমের চৌখুপিতে। ফলে নেহাত্ই এ কথারকথা তার প্রত্যুত্তরের প্রয়োজনীয়তা হারায়। সাহেব! সে একদম পছন্দ করে না এ সম্বোধন। ছোটোবেলায় আপত্তিও জানিয়েছে কতবার। কিন্তু অশিক্ষিত তারা কিছুতেই তার আপত্তিকে পাত্তা দেয় নি। এখন সে নিজেই পাত্তা দেয় না ওদের। সাহেব! আরে, সাহেব তো তোর ছেলে। সাততারা হোটেলের ম্যানেজার। মুম্বাই প্রবাসী। কথায় কথায় ফরেন ট্যুর। মুম্বাই না ছাই! দাদার-ভাসি মুম্বাই হলে, আদিসপ্তগ্রাম-লক্ষ্মীকান্তপুরও কলকাতা! হাতে-পায়ে সাবান ঘষতেই থাকে সে। জীবাণুর সঙ্গে মনের বিরক্তিকেও ধুইয়ে ফেলতে চেয়েই যেন। ছোটো থেকেই এই মাসি-মেসোকে পছন্দ করতে পারে না উদ্দালক। এখন বোঝে তা তাদের অমার্জিত ব্যবহারের জন্যই। তাদের ভালোবাসার প্রকট দেখানেপনায়। এবং এও বোঝে যে ছোটোবেলায় থেকেই কোথায় তার প্রতি তাদের একটা চোরা সবুজ ঈর্ষা কাজ করতো, এখনো করে। তার কারণ তার ঠাকুরদার বৈভব, নাম। তার জন্য সে কি দায়ী? আবার একটু বড় হলে পড়াশোনায় তার একটু সুনাম ছড়ালে তাদের ছেলের তুলনায়, সে ঈর্ষা আরও শ্যাওলা-সবুজ, থকথকে। তার বাবার জিনের ওপরও তো তার কোনো হাত নেই! বাবা...! একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে উদ্দালক। মনে পড়ে খুব ছোটোবেলার একটা ঘটনা। তখন সে ভালোবাসা-অভালোবাসার তফাত্ বুঝতে শিখেছে। অবশ্য সে পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা বোধহয় জন্মগতই। কোন কোলে আদর আছে, কোন কোলে নেই একটা দুধের শিশুও বুঝতে পারে তা। যথারীতি সেদিনও মেসো বারণ করা সত্ত্বেও তাকে সাহেব বলা থামায় নি।
--তা, সাহেব এবার ফাইনাল টার্মে তো শুনছি তুমি নাকি সেকেন্ড বয়কে হানড্রেড মার্কস-এ বিট করছ।
একে সাহেব-ডাক, তার ওপরে কথার চিমটি—নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি সে সেদিন।
--বলেছি না, আমাকে সাহেব বলে ডাকবে না। আমি বাঙালি। সাহেব নই।
ফলে তখন ঘরে যেন ঝড় ওঠার আগের স্তব্ধতা। তার ওপর তার বাবাও নিজস্ব গুহা থেকে উঁকি মেরে বলেছিল তার মেসকে, নম্র সুরেই—দেখুন বাচ্চা ছেলে। ওর যখন পছন্দ নয়, তখন...
এ কথা তত্ক্ষণাত ঝড় ডেকেছিল। হিসহিসিয়ে উঠেছিল তার মায়ের গলা। রান্নাঘর থেকে আছড়ে পড়েছিল বজ্র ডাইনিং তথা ড্রয়িংরুমে—মুখে মুখে কথা! কার রক্ত দেখতে হবে না! রক্তের দোষ যাবে কোথায়! সরি বলো আঙ্কলকে।
বিপন্ন ছোট্ট উদ্দালক তার বাবাকে আবার গুহার অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দেখেছিল। তখনই অন্য ঘর থেকে তার দাদু, তার বাবার বাবা যে, বেরিয়ে এসেছিল অন্য ঘর থেকে।
--দাদা, তুমি আমার ঘরে এসো। বৌমা, ও তো অন্যায় কিছু বলেনি।
ঝড় না উঠতেই থেমে গিয়েছিল আচমকা বৃষ্টি নামিয়ে মা ও ছেলের চোখে। অভিমানের-অপমানের।
তখন তারা ভবানীপুরের বাড়িতে থাকত। দোতলা বাড়ি। নিচে তার দাদুর অফিস। ভাগ্যিস সেদিন রবিবার ছিল। ভাবে উদ্দালক। কিন্তু সেদিন থেকে মা যেন আরও তাকে আঁকড়ে ধরেছিল। তার বাবা-জগত, তখনও কিঞ্চিত লেগে থাকা সে শিকড়ের বন্ধন থেকে তাকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করেছিল। তার বাবাও তো... । বুকে মোচড় দিয়ে উঠে আসা একটা দীর্ঘশ্বাসকে গিলে নেয় উদ্দালক। মুখে দেঁতোহাসি আবারও ঝুলিয়ে নেয় সুসভ্য সে।
--তারপর, তোমরা সব ভালো তো! অবশ্য ভালো যে আছ সে খবর দুই বোনের নিত্য সকাল-বিকেল ফোনাঘাত থেকেই মালুম হয়।
হাসির সঙ্গে কথাগুলো ছুঁড়ে দেয় সে অতিথি দু-জনের দিকে। তার মা তার দিকে একবার কটাক্ষ হানে। ততক্ষণে মালতীমাসি গরম গরম লুচি, আলুর তরকারি দিয়ে যায়। উদ্দালক বোঝে যে এরা খুব বেশিক্ষণ আসে নি। হয়তো আসার কারণ সেই-ই। হ্যাঁ, তাই-ই।
--তোমার সঙ্গে একটু পরামর্শ ছিল। মাসি বলে।
উদ্দালক মুখের লুচি-তরকারি একটু সামলে খেই ধরে,-- তা, ফোন করলেই তো পারতে। করোনার সময়, বয়স্ক তোমরা।
--ওরা এসেছে বলে তোমার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে। তার মা শেষ অবধি ঝামরে ওঠে।
--না, তা কেন? করোনা... তাই।
--তুই থাম তো দিদি। ছেলে বড় হলে তার সঙ্গে সমানে-সমানে ব্যবহার করতে হয়। এখনো তোর গার্জেনি গেল না।
থমকায় উদ্দালক। ব্যাপারটা বুঝতে পারে না সে। এটুকু বোঝে যে নিশ্চয় কোনো ধান্দা আছে। হাড়ে-হাড়ে চেনে সে এই দুই মালকে। না, এখনো সে পছন্দ করে না তার মাসি-মেসোকে।
--আসলে রকি একটু অসুবিধায় পড়েছে। একটু থামে মাসি।
চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থমকায় উদ্দালকও। রকি, রাকেশ ওর মাসতুতো ভাই। বছরখানেকের ছোটো। হোটেলে চাকরি করে। চাকরি চলে গেল নাকি! করোনাকালে হোটেল-ট্যুরিজমশিল্পই তো সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছে। ভাবনা উঁকি মারে চকিতে তার মনে। সেই সঙ্গে অদ্ভুতভাবে ঘাই মারে ছোটোবেলা থেকে পুষে রাখা অস্বস্তিটাও। রাকেশ বাঙালি নাম তো নয়। বিহারিদের নাম। আর রকি তো বাড়ির পোষা কুকুরের নাম হয় বলেই জানত সে।
--কেন কী হল?
--আরে গত বছর থেকেই ওদের হোটেল তো বন্ধই প্রায়। গোটা পঞ্চাশেক মতো নাকি স্টাফ আছে। বাকি সবারই চাকরি চলে গেছে। নেহাতই ও এফিসিয়েণ্ট ম্যানেজার, তাই ওর চাকরি যায় নি। কিন্তু মাইনে হাফ হয়ে গেছে... যদিও কমেও এক লাখ পঁচাত্তর পায় এখনো।
উদ্দালক মনে মনে হাসে। কী সুন্দর শুনিয়ে দিল মাসি—এ দুর্দিনেও তার ছেলে উদ্দালকের চেয়ে বেশি কামাই করে! তবু মুখে উদ্বেগ আঁকে সে।
--যাক নিশ্চিন্ত। এ বাজারে চাকরি চলে গেলে... করোনায় সবচেয়ে বেশি এফেক্টেড তো হোটেল-ট্যুরিজম, হসপিটালিটি ইনডাসট্রিই।
--না, আসলে...। কথারা অন্যদিকে পাছে মোড় নেয়, তাই তার মেসো হাল ধরে। ... রকি একটু অসুবিধায় পড়েছে। দুবছর আগে তখন তো আর জানত না করোনা আসবে, একটা ফ্ল্যাট বুক করেছিল। ওখানকার দাম তো জানো... এক কোটির ওপর। তার ইএমআই-ই তো একলাখ প্লাস। তারপর সংসার চালানো... স্ট্যাটাস... বাচ্চাটার স্কুলের মাইনেই তো দশ হাজার।
উদ্দালক মনে মনে ভাবে ফ্ল্যাটটা সারেন্ডার করলেই তো পারে। আবার সময় ভালো হলে না হয় কিনবে। বাচ্চা তো সবে নার্সারি। কম দামী স্কুলে দিলেই পারে। স্ট্যাটাস দেখানো! কিন্তু মুখে সান্ত্বনা দেয় সে। এছাড়া কী-ই বা করার আছে তার?
--তাহলে তো খুবই মুশকিল দেখছি। কবে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে!
--সেটাই তো! গত বছর তোমার মাসির গয়না বিক্রি করে টাকা পাঠিয়েছি লোনের কিস্তির জন্যে। বয়স হয়েছে, গয়নার আর কিসের দরকার এখন। তুমি তো জানো আমার পেনশন নেই। সুদের টাকায় খাই। আর সুদের হারও যেভাবে কমছে! তাও তো নাতনির পড়ার খরচটা আমি পাঠিয়ে দিই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসো তার। মাসি মুখ নিচু করে মোবাইলে আঙুল চালাচ্ছে। আনমনেই। উদ্দালক বোঝে তা। হ্যাঁ, এটা ঠিক মেসোর পেনশন নেই। যদিও মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানীর জিএম ছিল। প্রচুর টাকা নিয়ে রিটায়ার করেছে। ভাবে উদ্দালক। তার মায়ের দিকে তাকায়। মা উদাস চোখ মেলে শব্দহীন টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। যে চোখে কোনো দৃষ্টি নেই। ও চোখ ফেরায় টিভির দিকে। টিভিটা শুধু ঝলকে ঝলকে রঙ বমি করে নিঃশব্দে। তাদের সাজানো ড্রয়িং রুমে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা কায়েম হয় যেন। অস্বস্তিকর এ নৈঃশব্দে ডুবে যেতে যেতে উদ্দালক ভেবে পায় না তার করনীয় কী? কী জন্য এসেছে তারা তার কাছে? অবশেষে তার মেসোই এ শব্দহীনতাকে ভেঙে বেজে ওঠে।
--তোমার কাছে এলাম... ব্যাঙ্কের লোন পাওয়া যাবে কিনা জানতে।
উদ্দালক সিধে হয়ে বসে। এই ধান্দা! ভাবে সে । তবুও সবটা পরিষ্কার হয় না তার কাছে।
--আমার ব্যাঙ্কে কিছু হবে না। এখানে তো তোমার অ্যাকাউন্ট নেই। উদ্দালক প্রথমেই নিজের কাঁধ সরিয়ে নেয়। ...তবে তোমার ব্যাঙ্কে লোন পাবে, সোনা বা ফিক্সড জমা রেখে। ফিক্সড জমা রাখলে তো মাসিক সুদ বন্ধ হয়ে যাবে। সোনাও তো নেই বলছ। এক আছে ফ্ল্যাট... তার এগেনস্টে পেতে পার। একবার কথা বলে দেখো। রকির তো অত টাকার লোন নেওয়া আছে অলরেডি। ও আর পাবে না। এখন সব আধারলিঙ্কড। এক ক্লিকেই সব তথ্য হাতের মুঠোয়। আর তাছাড়া ইএমআই-ও তো শুধতে হবে।
মাসি-মেসো নিমেষে চোখে-চোখে কথা বলে উঠল। উদ্দালকের তেমনই মনে হল যেন। মুহূর্তে ভেঙে পড়ে ভদ্রমহিলা। চোখে জলের আভাস।
--তুমি যদি কিছু দাও। তুমি ছাড়া ওর আর তো কোনও ভাই-বোন নেই। তাই...।
ভদ্রমহিলা নাক টানেন। চোখের জল মোছেন। এলইডি টিভিটা রঙ বমি করতেই থাকে নিঃশব্দে। রঙের আলোছায়া খেলা করে আপন মনে চারটি আপাত নির্বাক মানুষের মুখে। সে রঙের খেলায় কারও মুখে মন ফোটে না যেন। শুধু রান্নাঘরের আড়ালে থাকা মালতীমাসির মনে আলো মুছে ছায়া ঘনায়।
অনেকক্ষণ অথবা ক্ষণিকই—কাল বয়ে গেলে উদ্দালক স্নায়ু টান-টান খাড়া। নাটক! ঠাকুরদার টাকায় লোভ! মনে মনে বলে সে। তার মুখ ছিটকে বেরিয়ে আসে আনুগত্যহীন শব্দেরা, কাটা-কাটা।
--তা কেন? ওর তো আপন খুড়তুতো ভাই আছে। পিসতুতো বোন। বিশ-পঞ্চাশ হাজার হলে, তাহলে নয়... তা ছাড়া এটা তো রেকারিং প্রবলেম... ওর শ্বশুরের তো শুনেছি প্রচুর টাকা! আইএএস, জাঠ...
ফলে নিস্তব্ধতা ঘন হয় পরক্ষণে খান খান ভেঙে যাবে বলেই। অপর্ণাদেবী, উদ্দালকের মা মুহূর্তে ফেটে পড়ে।
--বড়দের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না! হিস-হিস শব্দ ছোবল হানে। অনেক শীতঘুমের পরই যেন, ফলে বিষনীল তা। --রক্তের দোষ... জিন... যাবে কোথায়?
প্রত্যুত্তরে উদ্দালক চকিতে তার মায়ের দিকে অ-বাক তাকায়। দুজন দুজনের দিকে পলকহীন চেয়ে থাকে। কেউ কাউকে পাঠ করতে পারে না। এই-ই প্রথম, নাকি এর উত্স সুদূর অতীতেই? দুজনেই উত্তর হাতড়ায় আপাতত।