রাজা চট্টোপাধ্যায়
শৈশবে বইমেলা শব্দটা আমার কাছে ছিল একটা আবেগ, একটা বিস্ময়ের। দীর্ঘদিনের তালা বন্ধ রাখা ধূসর স্মৃতি আজ হাতড়াতে বসেছি। আমি একটা মফস্বল শহরের শতাব্দী প্রাচীন স্কুলে পড়েছি। সেই স্কুলের মাঠেই দেখেছিলাম, জীবনের প্রথম বইমেলা। আমার বয়স তখন হয়তো বছর দশেক। বাবা মায়ের হাত ধরে, রবিবারের সেই মিলনমেলায় যাবার আগে, সকাল থেকেই মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা অনুভব করেছিলাম। শুধু মাত্র বই নিয়ে যে আস্ত একটা মেলা হতে পারে, সেটা কোনোদিনই কল্পনাতেও আসেনি তখন। সেইসময় বাড়িতে সংবাদপত্রের সাথে নিয়মিত ভাবে আসতো শুকতারা, চাঁদমামা আর কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান। একবার জন্মদিনে দিদা উপহার দিয়েছিলো, বিক্রম বেতাল আর রূপকথার গল্প। আলাদা করে খুব বেশি অন্যান্য গল্পের বই পড়ার সুযোগ ঘটেনি। শীতের অনুভূতি মাখানো সেদিনের বেলা, বাড়তেই প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে প্রেশার কুকারের সিটি আর সুগন্ধ জানান দিতো কারুর বাড়িতে পাঁঠার মাংস হচ্ছে। আমাদের ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ি। তখনও প্রত্যেক রোববারে কুকারে সিটি দিয়ে, খাসির মাংসের সুগন্ধ ছড়াতো না। বাড়িতে নারায়ণের অধিষ্ঠান ছিল, তাই সহজলোভ্য মুরগীর মাংস রান্না ঘরে কোনোভাবেই আশ্রয় পায়নি। অনেকদিন পর যেহেতু সপরিবারে মেলায় যাবো, তাই বাবা সকাল থেকেই ছিল বেজায় খুশি। তাই আমাদের ঘরেও সেদিন কচি পাঁঠা রান্নার সুগন্ধ নাকে ঝাপটা মেরেছিলো। সবাইমিলে দুপুরে জমিয়ে গরম ভাত আর কচি পাঁঠার ঝোল, বেশ তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলাম। বাড়িতে মাংস ভাত রান্না হলেই, সেদিন ঠাকুমার কাছে কুচো সুপারী, ভাজা মশলা এবং সামান্য চমন বাহারে মোড়া একটা পান আমার বরাদ্দ থাকতো। ঠাকুমার দাঁত ছিলোনা তাই ছোট্ট হামালদিস্তায় থেঁতো করে পান খেতো। এই থেঁতো করে মিষ্টি পান খাওয়ার ব্যাপারটা আমারও দারুন লাগতো। বাবা খেয়ে উঠে, একটা মাদুর নিয়ে বাড়ির ছাদে রোদ পোহাতে যাবার সময় জানান দিয়েছিলো, ঠিক দুপুর তিনটেয় সবাই বেরুবো, সেইমতো তৈরী হয়ে থাকতে হবে।
নুরুল কাকুর রিক্সায় চেপে বইমেলার গেটে যখন নামলাম, বাবা মায়ের হাত ধরে একঝাঁক শিশু কিশোরের ভিড় দেখলাম। তখন আমাদের মফস্বল শহরে বইমেলায় ঢুকতে কোনো প্রবেশ মূল্য লাগতো না। লাইন দিয়ে মেলা প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেই এক আশ্চর্য্য অনুভূতি হলো। টিনের আর ত্রিপলের বেড়া দিয়ে, সারি সারি বইয়ের স্টল, আমাদের স্কুলের বিশাল মাঠের চারপাশ ঘিরে দিয়েছে। মাঠের মাঝখানে মধ্যমনি হয়ে বিরাজমান একটা খোলা মঞ্চ। সুদূর কলকাতা থেকে লেখক সাহিত্যকারগণ এসেছেন, নানা বিষয়ে আড্ডা আলোচনা বসেছে। সামনের সারিবদ্ধ চেয়ারে মঞ্চের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে মনোনিবেশ করা উৎসাহী মানুষের ভীড়। কিছুক্ষন পর, বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে, আমি একছুটে চলে গিয়েছিলাম শিশু কিশোর সাহিত্যের স্টলে। সারি সারি নতুন বইয়ের গন্ধ মাখা পাহাড় ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি আজ হয়তো ঠিকমতো প্রকাশে অক্ষম আমি। আমার দেখা জীবনের প্রথম বইমেলায়, বাবা কিনে দিয়েছিলো ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পান্ডব গোয়েন্দা সিরিজ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় এবং অনিল ভৌমিকের লেখা সোনার ঘন্টা। বাড়িতে এসে গোগ্রাসে গিলেছিলাম বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্চু এবং তাদের পোষ্য কুকুর পঞ্চুর দুঃসাহসিক কাহিনী। এদের কাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে নিজেকে ওদেরই বন্ধু ভেবে হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে জায়গা দিয়েছিলাম। এখন ভাবলে হাসি পায়, সেই সময় একবার মনে হয়েছিল ঠিক ওদের মতোই একটা নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী গড়ে তুলবো এবং প্রতিবেশীদের বাড়িতে ছিঁচকে চোরের উপদ্রব রুখতে ব্যবস্থা নেবো। তবে অনিল ভৌমিকের সোনার ঘন্টা পড়তে বসলে, স্পেন দেশের সমুদ্রের ধারে ছোট্ট ডিমেলো শহরে, গির্জার পাদ্রীদের রাতের বেলায় পোশাক বদলে, লুঠপাট চালিয়ে সোনা সংগ্রহের কাহিনী, গল্পের নায়ক ফ্রান্সিস এবং তার বন্ধুদের দুঃসাহসী কাহিনী আমাকে ভীষণ ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখতো। পরবর্তী কালে হীরের পাহাড়, মুক্তোর সমুদ্র, রুপোর নদী এইসব সিরিজের প্রায় সব বই একে একে কিনে খিদে মিটিয়েছিলাম। তখনকার দিনে ইন্টারনেট ছিল না, গুগল করে জানা সম্ভব ছিল না বিদেশ বিভুঁইয়ের রাস্তা ঘাট, পোশাক পরিচ্ছদ, জীবন শৈলী। আজও সময় পেলে বসে ভাবি, তখনকার দিনে একজন স্কুল শিক্ষকের পক্ষে ইউরোপের প্রখ্যাত জলদস্যু ভাইকিংদের এতো নিখুঁত বর্ণনা কিভাবে সম্ভব ছিল।
এরপর যত উঁচু ক্লাসে উঠেছি, নানা লেখকের বই পড়ার সাথে সাথে থ্রিলার বা গোয়েন্দা সিরিজ পড়ার নেশা চেপে বসেছিল। স্বপন কুমার থেকে শুরু করে ফেলুদার সব কাহিনী প্রায় নিঃশেষ। হঠাৎই আমার গৃহশিক্ষকের কাছে খোঁজ পেলাম জেলা গ্রন্থগারের কথা যেখানে বিনামূল্যে পড়া যায় হাজার হাজার ভিন্ন স্বাদের গল্পের বই। রাজার নামাঙ্কিত সেই গ্রন্থাগার দেখাশোনা করতেন রাজারই বংশধর এক অশীতিপর বৃদ্ধ। ভীষণ রকমের খ্যাঁক খ্যাঁকে স্বভাবের। প্রথম দিনে বিনামূল্যে কার্ড বানিয়ে বই নিতে গিয়ে দেখি প্রচুর পরিমানে অনুবাদ গল্পের সম্ভার। গোয়েন্দা রহস্য গল্পের লেখক আগাথা ক্রিস্টি, আর্থার কোনান ডয়েল, শার্লক হোমস থেকে শুরু করে এডগার অ্যালান পো সহ বহু বিখ্যাত লেখকের বই শোভা পাচ্ছে। বুক শেলফ থেকে একটা বই টানতেই সেই বৃদ্ধের তীক্ষ্ণ ভৎসনা কানে এসেছিলো। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, সবার আগে জীবনীমূলক বই পড়ো, চরিত্র গঠন করো ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, জীবনীমূলক বই পড়লে জ্ঞান বৃদ্ধি সহ জীবনের অনেক গভীরে পৌঁছানো যায়। কিন্তু আমার কিশোর চোখ শুধুমাত্র আত্মজীবনী মূলক বইয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাই যত দিন যায়, সেই বৃদ্ধ দাদুর সাথে আমার সখ্যতা বেড়েছিল। পরের দিকে পনেরো দিনে একবার জীবনীমূলক বই নিলেই দাদু খুশি হতেন। সাথে ছাড়পত্র পেয়েছিলাম সবরকম বই পড়ার। তাই কিছুদিন পর শুরু করলাম শেক্সপীয়ারের লেখা প্রায় সমস্ত অনুবাদ বই। একবার আগাথা ক্রিস্টির একটা বই পড়তে গিয়ে নেশা এমন পেয়ে বসলো, লুকিয়ে স্কুলে গল্পের বই নিতে যেতে শুরু করলাম। স্কুলে পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্যবই রাখা নিষিদ্ধ থাকলেও, স্কুল শেষে লাইব্রেরী যেতে হতো। একবার কোনো একটা রহস্যের বই প্রায় শেষের দিকে। স্কুলের টিফিন টাইমে কিছুটা পড়েও খুনের কিনারা অবধি যাওয়া গেলো না, এদিকে নেশা চেপে বসেছে। ক্লাসের মধ্যেই স্কুল ব্যাগের তলায় রেখে চুপি চুপি শুরু করে দিলাম পড়া। খুনের রহস্যের খোঁজ আমি না পেলেও ক্লাস টিচার আমার লুকিয়ে বই পড়ার খোঁজ ঠিক পেয়ে গেলেন। শাস্তি হিসাবে পেতে হয়েছিল, ক্লাসের বাইরে কান ধরে নীল ডাউন।
নানা ধরণের গল্পের বই পড়ার সাথে সাথে হঠাৎ একটু আধটু লিখতে ইচ্ছে হলো। লিখতে শুরু করে ভাবছি, এই সব কাঁচা হাতের লেখা ছাপবে কে? ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় একবার আমার একটা লেখা, স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনে ছাপা হলো। নিজের লেখা ছাপা বইয়ে প্রথম দেখে, সে যে কি আনন্দ পেয়েছিলাম, অবর্ণনীয়। ক্লাস এইটে পড়ার সময় নিজ উদ্যোগে কিছু করার ভূত চাপলো। নিজের লেখা গল্প, সাথে পাড়ার বন্ধুদের সেরা লেখা, সংগ্রহ করে ক্লাস নাইনে পড়তেই, একটা উদ্যোগ নিলাম, নিজ দায়িত্বে একটা লিটিল ম্যাগাজিন বের করবো। যদিও তখন মফস্বল শহরে সেভাবে অফসেট প্রিন্টিং এর ব্যবস্থা ছিল না, অনেকে কলকাতা থেকেই প্রিন্ট করে আনতো। তবুও শহরের নামকরা একটি ছাপাখানার গিয়ে কথা বললাম। দু ফর্মার একটা ম্যাগাজিন ছাপতে তখনকার দিনে প্রায় দুহাজার টাকা চাইলো। ছাপার খরচ তোলার জন্য নিজেই পাড়ার বেশ কয়েকটা দোকানে গিয়ে অনুরোধ করে ম্যাগাজিনের জন্য বিজ্ঞাপন চাইলাম। পাড়ার দোকানে, শহরে আমার একটা ভালো ইমেজ ছিল, তাই মাসখানেকের কড়া মেহনতে, প্রায় পনেরোশো টাকা উঠে এলো। টাকার ব্যবস্থা হতেই এবার লিটিল ম্যাগাজিনের একটা নাম ঠিক করে ব্লক বানাতে দিলাম। দিনের পর দিন প্রিন্টিং প্রেসে গিয়ে আমার সৃষ্টিকে একটু একটু করে প্রাণ পেতে দেখে মুগ্ধ হতাম। ম্যাগাজিন প্রিন্ট হয়ে বেরুনোর পর যাদের লেখা থাকতো তারা সবাই উদ্যোগ নিয়ে ম্যাগাজিন বিক্রির ব্যবস্থা করতো। এইভাবে বেশ কয়েকটা সংখ্যা প্রকাশের পর অনেকটা পরিচিতি বাড়লো। আমার লেখা বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশ হতে লাগলো। বেশ কয়েকবার, আকাশবাণীর প্রাত্যহিকী অনুষ্ঠানে আমার লেখা স্বীকৃতি পেয়ে, যখন পাঠ শুরু হলো, শহর ছাড়িয়ে নানা গুণী মানুষের নানা ধরণের লেখা, আমার লিটিল ম্যাগাজিনের জন্য হাতে আসতে শুরু হলো, আবার শুরু হলো নতুন করে পথ চলা। সেইসময় আমার এক স্কুল সহপাঠী বন্ধু, কবিতা লেখা শুরু করেছে। সে আমার এই কাজকে ভালোবেসে, একদিন এগিয়ে এলো একসাথে কাজ করবে বলে। আমাদের দুজনের চিন্তাধারাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কলেবরে একটা কবিতার সংখ্যার প্রকাশ হলো। নতুনভাবে পত্রিকার নামকরণ করার পর প্রচ্ছদ এঁকে দিলেন শহরের অন্যতম এক চিত্রকর। শহরের এক নামী চিকিৎসকের অনুপ্রেরণায়, আমার জেলার "বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা বিভাগ" সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো বিজ্ঞাপনের ডালি নিয়ে। আমি তখন শহরের একটা কলেজে ভর্তি হয়েছি, আমার বন্ধুটি তখন প্রেসিডেন্সী কলেজে বাংলা নিয়ে পড়তে ঢুকলো। তারই হাত ধরে কলকাতা তথা রাজ্যের বহু নামী কবির লেখায় সজ্জিত হলো, আমাদের বহু প্রতীক্ষিত সেই লিটিল ম্যাগাজিন। আত্মজ কে সাথে করে, নিজের জেলা ছাড়িয়ে, প্রথম পা রাখলাম কলকাতা বইমেলায়। কলকাতা বইমেলা তখনও আন্তর্জাতিক হয়ে না উঠলেও, মফস্বলের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। শুধুমাত্র বইকে কেন্দ্র করে কল্পনা ও স্বপ্নের মেলবন্ধন। এই মিলনমেলায় তরুণ কবিদের অস্থায়ী আড্ডা, উদ্দাত্ত কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ, নিজের টাকায় স্বরচিত কবিতার বই প্রিন্ট করে মেলায় নতুন পাঠকের অন্নেষণ ও দৃষ্টি আকর্ষণ দেখে মনে হয়েছিল, এই কলকাতার বইমেলা যেন প্রকৃতই বাংলার একটা উৎসব।
এরপর আর কোনোদিন কলকাতা বইমেলা দেখার সুযোগ হয়নি। তবে কর্মসূত্রে দিল্লি এসে, এখানকার বাংলা বইমেলার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার সুযোগ পেয়েছি। বিগত ২৫ বছরে প্রবাসে বইমেলার রূপ অনেকটাই বদলাতে দেখেছি। কিন্তু ছোটবেলার মফস্বল শহরে, আমার দেখা বইমেলার প্রতি পাঠকের সেই আবেগ, ভালোবাসা, একাত্ম করে নেওয়া আজ আর তেমনভাবে খুঁজে পাইনা।