অরিত্র দ্বিবেদী
প্রশ্ন: আচ্ছা আপনি তো লেখেন। কবিতাই লেখেন। তবে, কি সত্যি কবিদেরও প্রসবযন্ত্রণা থাকে?
উ: নাহ্। থাকে না।
প: তবে? সবাই যে বলে! যদি না থাকে তো কী থাকে তবে।
উ: আমি বলিনা। আমি যেটা জানি তা হল মৃত্যুযন্ত্রণা। প্রসবযন্ত্রণা নয়।
প: কেন নয়? একটু যদি খুলে বলেন...
উ: আহা সৃষ্টির যন্ত্রণাই প্রসব যন্ত্রণা। কিন্তু কবিতা তো সৃষ্টি নয়।
)আমার বিস্মিতমুখে খানকতক ধোঁয়ার জটলা ছেড়ে...(
এই যেমন ধর এই যে ধোঁয়াটা ছাড়লাম তোমার মুখে, এটা তো ছাই-ভস্ম, কবরে পুঁতে থাকা হাড়। কারণ জীবনটা তো ভেতরে। জীবনটা সেটাই যেটা আমি ছাড়িনি। ছাড়তে হয়ত পারতাম তবে ভেতরে চেপে রেখেছি।
প: আপনার কথাবার্তা খুব ধোঁয়াটে....
উ: উত্তর তো নিজেই দিলে, আমার কথায় সেই না ছাড়া ধোঁয়ায়, না করা কাজের না লেখা শব্দের অংশ, বেশ বড় অংশই রয়ে গেছে। যেটার আঁচ তুমি পেয়েছ। কী করে জানিনা, তবে পেয়েছ!
(মিটিমিটি একটা হাসি, মনে হল ভেতর অব্দি কেউ স্ক্যান করে ফেলল)
প: আপনি তো মশাই যেন সেই জুয়াংজ়ি প্যারাডক্সের কথা বলছেন।
(একটা লোক একবার স্বপ্ন দেখছিল, যে সে প্রজাপতি, উড়ছে। উড়তে উড়তে একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল নীচে। তার চোখ বুজে এল অন্ধকার। চাপ চাপ অন্ধকার। চোখ খুলে দেখল যে সে এখন মানুষ।
কিন্তু সে এবার এটা বুঝতে পারছেনা যে সে আসলে কি সেই প্রজাপতি যে অজ্ঞান অবস্থায় এইসব দেখছে নাকি আসলে সেই মানুষটাই।
তার রিয়ালিটি পুরোটাই ঘেঁটে গেছে। গুলিয়ে গেছে সমস্তই।)
উ: উমমম্। হ্যাঁ খানিকটা বলতে পারো। এই যেমন ধরো আমি মনে করি আমি আসলে একজন আধার। এই তুমি আমি বই গাছ টিকটিকি সবকিছুই আমি ধরে রেখেছি। এসব আমার ভেতরেই হচ্ছে। তাই অন্য কারোর সুর শুনলেই অন্য কারোর লেখা বা ছবি দেখলেই অত চেনা চেনা অত ভালো লাগে...
মানে ধরো একটা বিরাট স্টেজ। সব চরিত্রই আমি। হ্যাঁ শুধুই আমি। কিন্তু এত ঢুকে পড়েছি নিজের ক্রাফ্টে যে, ভুলে গেছি এখানে অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, লাইটম্যান, দর্শক সব আমিই। এমনকি ওই স্টেজটিও আমিই...
প:কী বলছেন! তার মানে তো আপনিই ভগবান, খোদা, পয়গম্বর সবই আপনি...
উ: ঠিক। এমনকি তুমিও সেই আমিই। এর স্ক্রিপ্টও আমার। পরিচালনাও। তাই ভগবান বা বিধাতাও আমিই...
যেমন ধর সমুদ্র সমুদ্র কী? মানে কী দিয়ে তৈরী হয়?
প্রশ্নকর্তার উত্তর: বিন্দু, মানে জলের বিন্দু।
উত্তরদাতার প্রশ্ন কী(জানিনা): হ্যাঁ। সমুদ্র হল বিন্দু বিন্দু জল। বিন্দুতে কী থাকে জল তো?
: হ্যাঁ
: আর সমুদ্রে?
:আজ্ঞে সেখানেও জল।
: বুঝেছ? যে আধার, সেই সৃষ্টি। সেই সমুদ্র সেই ওই বিন্দু। সেই সব।
: বুঝলাম...
: যেমন ধর আমি যদি বলি ওই আমগাছটার মাথায় শূন্য বসে আছে। কী বুঝবে?
:আজ্ঞে, ইয়ে, মানে, কিছু নেই ফাঁকা...
:হুম। আবার এটাও তো ভাবা যায়, যে সমস্তই শূন্য, সমস্তই পূর্ণ। যেমন নদীতে খড়কুটো নোংরা ভেসে যায়, তেমনি এই জীবন, এই সৃষ্টি, এই সংসার সব এসে পড়েছে। আচ্ছা বলো দেখি তুমি কে?
:আমি? আজ্ঞে জানিনা। শুধু...শুধু আয়নায় তাকালে মনে হয়, এই শরীরটা এইরকমই, এইরকমই ব্যবহার করে যেতে হবে। এইটাই করা কাজ আমার। নিজের শরীরের দিকে তাকাতে তাকাতে অনুভব করি আত্ম। মনে হয়, বন্দি আমি অন্য শরীরে। এই শরীরটা আমার চেনা হলেও আপন নয়...
: যেমন, মেক আপ না তোলা অভিনেতা...ঠিক? তবে বলো দেখি, লেখালিখি করোনা কেন?
:সবাই আমার লুকোনো মানুষটাকে দেখে ফেলবে বলে। আমি তো অন্য। আমি তো আমি নই। বুঝেছেন কি বলছি?
:হ্যাঁ বুঝলাম।
:তবে এসবের শেষ কোথায়?
:শূন্যের তো শেষ নেই ভায়া। গোল তো। পূর্ণ সে তার শুরু নেই শেষ ও নেই। তুমি আগেও এরকম ভেবেছ আবারও ভাববে...তুমি না ভাবলে আমি ভাবব, নাহলে ওই লোকটা যে এখনি থুতু ফেলল রাস্তায়...
: আপনি আমাকে কী চোখে দেখেন তবে?
:দেখো এই শেষ প্রশ্ন আর নয়? বলো আর করবেনা তো জিজ্ঞাসা। এমনিতেও অনেক বলেছি!
:না না আর করব না। আপনি বলুন।
:সেভাবেই দেখি, যে ভাবে তুমি আয়না দেখো। বাইরে থেকে দেখতে শেখ। যেগুলো আছে তা তো বটেই যা নেই তা দেখার চেষ্টা করো। নাহ্ চলি, সিগারেট ফুরিয়ে গেছে কিনতে হবে...
দুটো মুখোমুখি চেয়ার। ওপর থেকে দেখছি বলে দেশলাই বাক্স মনে হচ্ছে। একজন উঠে চলে গেল। মাথা তার নীচে পা...আর একজন বসে রইল।
যে উঠে গেল তার অংশে খুব গরমকাল এসেছে।
আর যে বসে আছে, তার অংশে ভীষণ বৃষ্টি।
