অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
গা মা ধা ধা পা, ধা--, পা--, গা--, মা--, গ্রে--, সা--
গা মা ধা ধা পা...
...প্রবল এক গ্রীষ্মের দিন। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতুম বাইরের ওই কৃষ্ণচূড়ার গাছটাতেই। তখনও সকাল ভালো ভাবে ফুটে ওঠেনি। কিন্তু গরমের দাপটে ঘুমটাও চটকিয়ে গিয়েছে। আমি কান পেতে শুনতুম সেই সুর, সেই স্বর। বিরাজজেঠু রেওয়াজে বসেছেন। ভৈঁরোতে ধরেছেন গান। তখনও আমার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখার বয়স হয়নি। অথবা এ টি কাননের কালোয়াতি গান শোনারও সুযোগ হয়ে ওঠেনি। অথচ সেই তখন থেকেই বিরাজজেঠু আমার কানে গান দিয়েছিলেন। আমিই নিতে পারিনি কেবল ...হয়তো অনেকেই পারেনি...
হয়তো বা এমনই হয়।
এমনই নিস্তব্ধতা নেমে আসে হঠাৎ।
আমি অরিজিৎ মিত্র। কলকাতা ছেড়ে এসেছি অনেকদিন। আজ যে হঠাৎ করে এমন দিন তিনেকের নোটিশেই ইণ্ডিগোর এরোপ্লেনে চড়ে সপ্তাহান্তের সফরে কলকাতা ঘুরে আসতে চলেছি, তার কারণও ওই গান। ওই বিরাজসুন্দর ভট্টাচার্য। কণ্ঠসঙ্গীতে গোটা পূর্ব ভারতে এককালে যাঁর নামডাক হয়েছিল। অমন প্রচারবিমুখ মানুষ আর দেখা যাবে না। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেবল শুনে ভালো লাগা অবধি, সেইটুকুই। ঠাট, রাগ, তাল, লয়কারী, ইত্যাদির প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যাতে আমার কোনও বিদ্যে নেই। বিরাজজেঠুরা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। তখনও কলকাতা (অথবা পৃথিবী) এমনি ভাবেও যন্ত্রসভ্যতার দাস হয়ে পড়তে পারেনি। তখনও রোববারের ব্রেকফাস্ট মানে সাদা ময়দার লুচি আর সাদা আলুর তরকারি, বিকেলে ঘুরে আসার জায়গা বলতে গড়ের মাঠ, লাঠির মাথায় ঘণ্টি লাগানো ক্যাণ্ডিফ্লস, বড়দিনের কেক বলতে বড়ুয়ার মিষ্টতা আর গান বলতে রেডিওতে আকাশবাণীর ঘোষণা। টেপ রেকর্ডার আর দুপিঠে ঘোরানো ক্যাসেট কেনার যুগ। সিডি বা ডিভিডি তখনও মধ্যবিত্তের নাগালে আসতে পারেনি। হলুদ-কালো ট্যাক্সি চলত কলকাতায়। পাড়ায় দু’একজনের বাড়িতে ভিসিআর বা ভিডিও ক্যাসেটের দুএকটির যোগান থাকলেও থাকতে পারত। সেই সময়টায় কেমন যেন এক অদ্ভুৎ সিপিয়া-রঙ গন্ধ লেগে ছিল। চোখ বুজে ভাবলে পরে এখনও কেবল সেই গন্ধটাই নাকের মধ্যে পাই।
...এতবছর ধরে একসাথে কাজ করছি, কত শুক্র-শনিবারেই না একসাথে বসে আড্ডা দিয়েছি আমার বা ওদের ঠিকানাতেই, দিল্লী কালীবাড়ির কাছটাতেই বাসা ওদের; অথচ সন্দীপনের মেসোমশাই যে বিরাজজেঠুর সঙ্গে এস্রাজ বাজিয়েছেন তা জানতেও পারিনি কোনওদিন। অবশ্য জানার মতো সুযোগও ঘটেনি। ওদের বাড়িতে বেজেছে পুরনো ইংলিশ ব্লুজ, আমার বাড়িতে শাস্ত্রীয় গান। কিন্তু দুজনের কেউই টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ ছিলাম না। শনিবারের অলস দুপুরে মুখোমুখি দুপাত্র ঢেলে নিয়ে হঠাৎ, আবছা অন্ধকারের আড্ডাতেই রেকর্ড বাজিয়ে দিয়েছি। ওর স্ত্রী অবশ্য ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে। ওর ছেলের গলাতেও গান আছে। চিত্তরঞ্জন পার্কের পুজোয় ওদের দুইজনেরই বাঁধা পারফর্ম্যান্স। আমি জন্ম-বোহেমিয়ান। বিয়ে করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। নেশা বলতে রুকস্যাক কাঁধে তুলে বেরিয়ে পড়া। সঙ্গের মোবাইলে অবশ্য থাকতেই হবে নিখিল ব্যানার্জী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আর কিশোরী আমোনকর। উল্লাস কশলকর। ক্লাসিক, ভিন্টেজ, স্টারডম, এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। ভীমসেন যোশী অথবা বড়ে গুলাম আলির গান ঘরে বসে শুনতে হয়। পথে চলতে চাই আমোনকর, কশলকর– আমার ধারণা এমনটাই। খাপছাড়া, অযৌক্তিক, খামখেয়ালী গোছের।
সন্দীপন ওর মেসোমশাইকে দিল্লীতে নিয়ে এসেছে। মাসি মারা গিয়েছেন কয়েক মাস। কল্যাণীর দুকামরার ফ্ল্যাটে মেসোমশাইকে আর একা ফেলে রাখতে চায়নি সন্দীপন। তার নিকটাত্মীয় বলতে আজ কেবল এই মেসোই রয়েছেন। ঊর্মি, সন্দীপনের স্ত্রী, তারও বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন। মেসোকে তাই দিল্লি নিয়ে আসতে কারোর কোনও অসুবিধে হয়নি। বয়সকালীন কিছু অসুস্থতা থাকলেও, ভদ্রলোক এমনিতে বেশ সুস্থ সবল রয়েছেন, কিন্তু
...ছিলেন বলা উচিত। অন্ততপক্ষে দিন তিনেক আগেও তাই। তিন দিন আগেই ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক। এখন ভদ্রলোক আইসিইউতে। ডাক্তারেরাও যে বিশেষ আশার কথা শুনিয়েছেন, এমনটা নয়। ঠিক সেই কারণেই আমার এই যুদ্ধকালীন কলকাতা সফর।
“বৃন্দাবনী সারং,” কাঁপা কাঁপা গলায় বৃদ্ধ বলেছিলেন। সন্দীপনের মেসোমশাই, “আরোহণে শুদ্ধ স্বর, অবরোহণে কোমল। কোন স্বর বলো দেখি?” কথায় কথায় কিভাবে যেন ওঁর সামনে আমার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতপ্রিয়তার কথা বেরিয়ে পড়েছিল ওদের বাড়িতে আড্ডা চলাকালীন। যদিও তখন সাউণ্ডসিস্টেমে বেজে চলেছিল এরিক ক্ল্যাপটনের ‘সানশাইন অব ইওর লভ’, নাকি ‘হোয়াইট রুম’, মনে পড়ছে না এখন। তখনই বিরাজজেঠুর নামটা উঠে এসেছিল। “বিরাজসুন্দর ভট্টাচার্য, চেনো নাকি তাঁকে? শুনেছ তাঁর গান? এককালে বিরাজবাবুর সঙ্গে বাজিয়েছি। কত না জলসায় ঘুরে বেড়াতাম তখন!” সন্দীপনের মেসোমশাই বলছিলেন। এই সময়েই সন্দীপন খোলসা করে দেয় ওঁর এস্রাজ বাজানোর কথা। সেদিন বোধহয় প্রথম না দ্বিতীয় দিন দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে আমার। দিন দুয়েকেই ধরা পড়ে গিয়েছিল বিরাজসুন্দর ভট্টাচার্যের ইতিহাস। উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বিরাজবাবু তোমাদের প্রতিবেশী ছিলেন?” আমি নিশ্চুপে বসেছিলাম। কোনও কথা বলতে পারিনি। আমার কানে বিরাজজেঠুর গান ভেসে আসছিল।
“বৃন্দাবনী সারং"। আরোহণে শুদ্ধ স্বর, অবরোহণে কোমল, কাফি ঠাটের রাগ। নি, নি স্বরের কথা বলছিলাম। শুদ্ধতে লিখবে ন, কোমলে ণ লিখতে হয়। সরগম শেখা হয়নি?” আমি চুপটি করে শুনে যাচ্ছিলাম। “বৃন্দাবনী সারং, জানো অরিজিৎ-আমাদের শেষ অনুষ্ঠান, ওই বৃন্দাবনী সারং গেয়েছিলেন তিনি সেদিন। তখন বয়স হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতেও কিসব সমস্যা চলছিল। রাতের অনুষ্ঠানে গাইতেন না আর তখন। বিকেলের দিকে অনুষ্ঠান ছিল। কাঁচরাপাড়ার কাছে কোথাও। অমনটা আর শুনলাম না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেবল সঙ্গত করে গিয়েছিলাম। গাড়িতে ওঠার সময় বললেন বউমা নাকি রেকর্ড করে নিয়েছে। আমাকে পরে পাঠিয়ে দেবেন। সদ্য সদ্য ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। বছর দেড়েক বা দুয়েক হবে তখন। নাতি হয়েছে। নাতি কোলে বউমাকে নিয়েই এসেছিলেন অনুষ্ঠান করতে। ছেলে বোধহয় আসেনি, কি কারণে যেন। জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাও আজ প্রায় বারো বচ্ছরের কথা তো হবেই। পরদিন রাত্তিরেই!” আমিও মনে মনে হিসেব করছিলাম। কলকাতা ছেড়ে আমি চলে এসেছি যখন, সেও আজ প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। তখন বিরাজজেঠুর ছেলের বয়স দশ। দেরীতে বিয়ে করেছিলেন উনি। বিরাজজেঠুর নিজেরই বয়স তখন ছাপ্পান্ন বছর। আমার বাবা বিরাজজেঠুর থেকে বছর ছয়েকেরই ছোট ছিলেন। ডাকতেন বিরাজদা বলে। সেই থেকেই আমার বিরাজজেঠু। আমার কতকিছু মনে পড়ছিল। গভীর কোনও গরমের সন্ধ্যায় বিরাজজেঠু তানপুরা নিয়ে বসেছেন। আমার বাবা শুনতে শুনতে বলে উঠছেন, “আজ যে যোগ ধরেছেন বিরাজদা। আহা, চুপটি করে কান পেতে শোন। এমনটা আর পাবি না।" আমি আর মা বসে বসে শুনে যেতাম। রাত্তিরে খাবার বাড়তেও দেরী হয়ে যেত কখন। সেই নিয়েও এতটুকু ঝামেলা-অশান্তি হতো না।
মা যেবারে চলে গেলেন, আমি তখন অফিসের কাজে বিদেশে। ফিরতে ফিরতে তিন দিন লেগে গেল। দেহটা মর্গে রাখা ছিল। বাবাকে এসে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা বললেন, “খোকা কাঁদিসনে, তোর মা যখন গেল, বিরাজদা পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেহাগ ধরেছিলেন। শেষ নভেম্বরের রাত। হিমেল হাওয়া দিচ্ছিল। শ্বাস পড়া বন্ধ হয়ে যেতে দেখলাম, মুখটা কেমন হাসি হাসি হয়ে রয়েছে। বিরাজদাকে পরে বলতে আমার মুখ চেপে ধরেছিলেন। দেখেছিলাম বিরাজদার চোখে জল।”
“একবার ওই বৃন্দাবনী সারংয়ের রেকর্ডিংটুকু এনে দিতে পারো?”
মৃত্যুপথযাত্রী মেসোমশাইয়ের শেষ অনুরোধটুকু বুকে নিয়ে আমি চলেছি কলকাতায়। বাবা চলে যাবার পরও সাত বছর কেটে গেছে। বিরাজজেঠু আগেই মারা গিয়েছিলেন। বাবার কাজের বেলায় কলকাতা গিয়ে দেখেছিলাম বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। কেউ কোত্থাও নেই। শুনেছিলাম বিরাজজেঠু চলে যাওয়ার পর জেঠিমাও আর বেশীদিন বাঁচেননি। ছেলে-বউয়ের কথা তখন শুনতে পাইনি তেমন। বাবার কাজ সেরেই ফিরে এসেছিলাম। এত বছর পর পাড়ার কারও কাছ থেকেও কিছু পাবার আশা করিনি। কিন্তু ফেসবুকে পার্থদা, আমার পাড়ারই এক দাদা যখন জানালো বিরাজজেঠুরা চলে যাবার পর ওঁর ছেলে নাকি কিছুদিন লেক মার্কেটের কাছে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে ছিল, সেই ভরসাতেই এভাবে চলে এলাম। ছেলে নাকি ওই ফ্ল্যাটেই সেই সময় সংসার নিয়ে থাকত। বিরাজজেঠুর নাতিকেও পার্থদা দেখেছে ছোটবেলায়, কিন্তু ছেলে-বউ সংসার নিয়ে উঠে যাবার পর আর সেভাবে যোগাযোগ থাকেনি। সকালেরই ফ্লাইট নিয়েছি। কলকাতায় এসে নামলাম সাড়ে এগারোটায়। একটা গেস্ট হাউসে একটা ঘর নিয়েছিলাম। মুখটুকু ধুয়ে অল্প কিছু খেয়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়েছি।
দুপুরের কলকাতা। বেশ গরম পড়ে গিয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোয় ফুল আসতে শুরু করেছে। রাধাচূড়ায় আসবে আরও কদিন পর। ফুটপাথে আর পা ফেলা যাবে না তখন। লাল-হলুদ পাপড়িতে ঢেকে থাকবে এ্যাসফল্ট। এখনও কলকাতায় এমন কিছু কিছু রাস্তার খোঁজ মেলে। লেক মার্কেটের এই অংশটাও এই রকম। আমি খুঁজতে খুঁজতে সেই বাড়িটার সামনে এসে পড়েছি।
ঠিক বাড়ি নয়, এ্যাপার্টমেন্ট। ফ্ল্যাট নম্বর বলতে দরোয়ানটা কেমন অদ্ভুৎ চোখে তাকালো। বিরাজজেঠুর ছেলের নাম দীপক। বউয়ের নামটা আর পার্থদার থেকে জেনে নেওয়া হয়নি। আমি অবশ্য কেবল নম্বরটুকুই বলেছিলাম। ছেলের নাম বলিনি। বলেছিলাম, আমার এক আত্মীয় থাকেন। বয়স্ক দরোয়ান, ঘুম চোখে আমাকে একবার জরিপ করে নিয়ে বলল, “সোজা উঠে যান, তিনতলায় বাঁ-হাতের ফ্ল্যাট।” দরজায় নাম লেখা ছিল পিয়ালী রায়। খটকাটা তখনই লেগেছিল প্রথম।
“মাপ করবেন এই নামে আমি কারোকে চিনি না,” দোহারা চেহারা মেয়েটির, বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, ঋজু সুন্দর মুখ। অদ্ভুৎ এক আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করেছিলাম ওর মধ্যে। বিরাজজেঠুর ছেলের নামটা বলতেই এই প্রতিক্রিয়া এল যখন, বুঝতে পারিনি কি বলব। বিরাজজেঠুর নাম বললাম। আমার পরিচয় দিলাম। মেয়েটি তবুও জানালো, এমন কাউকে সে চেনে না। হয়তো আগে ওই নামে থাকত কেউ। আমার বয়স দেখে ভিতরে আসতে বলল। জল অফার করল। আমি এক গেলাস জল খেলাম। ভিতরে যাইনি। কোথাও যেন একটা খটকা লাগছিল। আমি নীচে নেমে এলাম।
নীচের ফুটপাথে চায়ের দোকান। এই দুপুরেও খোলা রয়েছে। সেই দোকানেরই বাঁশের কঞ্চি পাতা বসার জায়গার উপর আরাম করে একটু ঠেস দিয়ে বসলাম। এখানে এক ভাঁড় চা খেতে খেতে নাহয় ভেবে নেওয়া যাবে মেসোমশাইকে খবরটা কেমন করে দেওয়া যায়। বড় আশা করে তিনি অপেক্ষা করে আছেন। কিন্তু এত বড় কলকাতা শহরে আমিই বা কি করে সেই পরিবারের কাউকে এখন খুঁজে বের করব। যাঁদেরকে আমিই প্রায় বিশ-তিরিশ বছর আগে ভালো করে দেখেছিলাম। এভাবেই বোধহয় মানুষ হারিয়ে যায়। আমি চায়ে চুমুক দিই। একটা গানের সুর কানে ভেসে আসে।
মেয়েলী গলার স্বর। তার সঙ্গে সঙ্গে যেন কচি গলায় একটি ছেলেরও গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একটু পরে হঠাৎ করেই যেন বা আরেকটি গম্ভীর স্বর এই দুজনের গলার সঙ্গে যোগ হলো। তৃতীয় গলাটি রেকর্ডে বাজছে। বড় চেনা সেই গলার উষ্ণতা, আমার হঠাৎ করে হাত থেকে চা চলকে পড়ে খানিক। বিরাজজেঠু গাইছেন। বৃন্দাবনী সারং। সেই তিনতলাকার ফ্ল্যাট থেকেই। চায়ের দোকানদার আমার অবাক ভাব দেখে বলল, “দিদিমণি গাইছেন গো বাবু। ওই ফ্ল্যাটের যে দিদিমণি, তাঁরই যে গানের শখ। শুনেছি তেনার শ্বশুরমশাইও নাকি গাইতেন। তেনার নাতিবাবুও নাকি সেই গলা পেয়েছে। স্বামীটা এমন বদমায়েশ, খুব অত্যাচার করত দিদিমণির উপর। শেষমেশ আলাদা হয়ে যায়। শুনেছি নাকি এস্মাগলিংয়ের দলে ভিড়ে গিয়েছিল। তো, দিদিমণি তো এভাবে আলাদা হলই, তারও উপর একা লড়ে ছেলে আর এই ফেলাটটাকে নিজের নামে করে নিল। যাতে খোকাবাবুর ভবিষ্যৎ দিয়ে কোনও অসুবিধা না হয়।" লোকটা এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিল।
আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম এ্যাসফল্টের উপর টুপটুপিয়ে কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়ছে। লাল হয়ে যাচ্ছে জমির রঙ। আমার কানে বৃন্দাবনী সারংয়ের সুর। এই সুর আমি মেসোমশাইকে কেমন করে শোনাব আজ? আমি যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
সন্দীপন ফোন করছে। বৃন্দাবনী সারংয়ের গান। আমি জানি ফোন তুললেই কি শুনতে পাব এখন। উপরের গান শেষ হয়ে এসেছে। একটা নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। গরম হাওয়ার একটা বাষ্প আমার সারা শরীর জুড়ে বয়ে যেতে থাকে।
...আমি যেন আবারও এক ভোরের মুহূর্তে শান্ত সমুদ্রের হাওয়ায়, জলের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। আমি অবাক হয়ে শুনতে পাই, দিন শেষ হয়ে আসার পর, আবারও কোনও ভোরের মুহূর্তে বিরাজজেঠু গাইছেন, উদ্দাত্ত তাঁর কণ্ঠস্বর,
গা মা ধা ধা পা, ধা--, পা--, গা--, মা--, গ্রে--, সা---
