দোঁহা

বিরুদ্ধ কবিতার কথা

 


সব্যসাচী মজুমদার

কবিতা থেকে তথাকথিত কবিতাকে ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিলেন নিকানোর পাররা। অর্থাৎ কবিতা বলতে যে লিরিক্যাল চলন আর মেলাঙ্কলির প্রবাহকে বোঝা যায়, তাকে নতুন চেহারা দেওয়ার একটা চেষ্টা করেছিলেন বলেই আন্দাজ করতে পারি।একটা ব্যঞ্জনার অন্তরাল, কুট-কুহক কিংবা রূপকের সাহায্যে মানুষের বৌদ্ধিক বৃত্তিকে উত্তেজিত করার বদলে পাররা বেছে নিয়েছিলেন এমন একটি ভঙ্গিকে, যেখানে প্রত্যক্ষ বাস্তবের পর্যায়ক্রমিক ব্যবহার পাঠককে নিয়ে যেতে পারতো মানুষের অন্তর্গত স্বভাব-ধারার গভীরে। সম্পৃক্ত করতে পারতো আবহমানের সঙ্গে। তাঁর একটি অতিখ্যাত কবিতার নমুনা এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতেই পারে এই আলোচকের বক্তব্য পরিচ্ছন্ন করার জন্য,
USA
Where
Liberty is a statue.

এই ধরনের পাঠ্য বস্তুর দুটো দিক থাকে। বিপজ্জনক কিন্তু অভিনব দিক বিভাজন। প্রথমতঃ এই পঙক্তি তিনটিকে যদি তথ্য হিসেবে পড়ি, দেখব, 

ক) আমেরিকা নামক যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত; মনে পড়বে তার রাজনৈতিক ও ভৌগলিক ইতিহাস। প্রতিটি বিশ্বযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা মনে পড়বে।

খ) স্ট্যাচু অব লিবার্টি তখনই তীব্র তুলনাত্মকতায় এসে উপস্থিত হবে এবং তৈরি করবে এমন এক মানসিক অবস্থা,যাকে 'শ্লেষ' বলা যেতে পারে। 

দ্বিতীয় সহস্রাব্দেও আমরা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, আমেরিকা নামক যুক্তরাষ্ট্রের অভিঘাত কতটা পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের দৈনন্দিন অস্তিত্বে। বিগত কয়েক দশক ধরে এই পঙক্তি তিনটি পাঠককে আমেরিকার বাস্তব ও আরোপিত বাস্তবের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে সচেতন করে দিচ্ছে। আরও কয়েক দশক পর্যন্ত করে যাবেও। এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ কম। কিন্তু, এ কবিতাকেও ফুরিয়ে দেওয়া যায়। মানে,যেতেই পারে।দেখা গেল, হয়তো আগামী শতকে, এই আমেরিকার, এহেন প্রহসনের স্বাধীনতাই এমন একটি সিদ্ধান্তের দিকে গেল, যার ফলে সমাজবদ্ধ মানুষের 'স্বাধীনতা' নামক ইউটোপিয় ধারণাটাই বদলে গেল।বস্তত, মানুষ কী আদৌ 'স্বাধীনতা' বলে কোনও পরিস্থিতিকে যাপন করতে সক্ষম! দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক ভাবেও?

যা হোক, তখনও কিন্তু এ পঙক্তি তিনটি ফুরোবে না। আপাত বিরোধী মন্তব্য মনে হলে, আরেকবার পূর্বে উল্লিখিত প্রস্তাব স্মরণ করতে বলব, এবং চেষ্টা করব দ্বিতীয় দিকটির ধারণার কথা বলতে।

পাররা এ কবিতায় সাজিয়ে দিয়েছেন এমন একটি প্রত্যক্ষ নমুনা যা শব্দ সংযোজনার তাৎপর্যেই পিচ্ছিল হয়ে ওঠে।'লিবার্টি' আর 'স্ট্যাচু' শব্দদ্বয় এমন পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতায় উপস্থাপন করলেন যে, সমকালীন পাঠক চিহ্নিত পেল ফরাসী স্ট্যাচুর কালীক অবস্থান ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির দার্শনিক দ্বন্দ্বকে। আবার উত্তরকালের পাঠক, স্থিরমূর্তি আর স্বাধীনতার অভিপ্রায় অর্থে গ্রহণ করলেই আমেরিকা এমন একটি স্থান হয়ে যাচ্ছে, যেখানে মানুষ তার সামাজিক প্রবৃত্তিকে বড় করে তুলেছিল। সমাজবদ্ধ হওয়ার পর মানুষের তার নিজের তৈরি নিয়ম ও দায়বদ্ধতারই অধীনতা স্বীকার করে চলেছে। সমাজবদ্ধ হিসেবে তার বোধহয় আর দার্শনিক স্বাধীনতার কাছে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। কিংবা হয়তো সেটা এই সমাজের বিনির্মাণের পর সম্ভব। কিন্তু, আমেরিকা যে মানুষের সামাজিক স্বাধীনতার পথটাকেও গতিহীন করে রেখেছিল মানুষের সামাজিক স্বভাবের আরেকটি নমুনা হিসেবে, এই ব্যঞ্জিত চেতনা কিন্তু প্রজন্ম পরের পাঠকেও আচ্ছন্ন করতে সক্ষম। আমেরিকা কেন?ব্যঞ্জনার্থে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের মানুষই স্থাননাম ভেদে মানুষের অন্তর্গত স্বভাব বুঝতে সক্ষম হবে। সুদূরের পাঠকও।

 স্রেফ দুটো শব্দের পিনদ্ধ প্রয়োগ সম্ভব হলো সেটি। এমন দুটি শব্দ, যারা একই তাৎপর্যে দুটো কালগত অবস্থান নিতে পারে।
এ প্রস্তাবের বক্তব্যবস্তুও অ্যান্টি-পোয়েট্রির অভিজ্ঞান সম্বল করে সেই লক্ষ্যেই পৌঁছতে চাইছে। অ্যান্টি পোয়েট্রি হলো এমন একটি বিপজ্জনক আর্ট ফর্ম যে আপাত সারল্যের সংবেদনায় ধরে রাখে দুরূহ বিণ্যাস। যে মোহময় এবং সর্বগ্রাহী ধ্বংসের দিকে টেনেও নিয়ে যেতে পারে কবিতাকে।

তার সবচাইতে বড় কারণ এই ধরনের কবিতায় শব্দ ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে যায়। মানে, বলতে চাইছি, অন্তর্গত রস হয় রৌদ্র নয় শৃঙ্গার নয়তো করুণ বা মধুর যা খুশি হতে পারে, কিন্তু দেখুন আমার করুণ বা শৃঙ্গার যে রসই হোক না কেন তার মোক্ষণ কেমন হতে চলেছে বা কীভাবে আপনাকে স্পর্শ করবে অথবা আমার ক্ষেত্রে এই করুণের প্রকাশ কিরকম স্বতন্ত্র হতে চলেছে তা কিন্তু একান্তই শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝা যায়। তাছাড়া আমার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতও আমার শব্দের প্রবণতা গড়ে দেয়। আমাদের সমস্ত বিমূর্ত শেষ পর্যন্ত একটা মূর্তি পেতে চায়।স্ট্রাকচার দেওয়ার কাজটি করে শব্দ। যার ফলেই বিমূর্তে প্রবেশ ঘটে আমাদের।আর কথা, তো, আপনি, প্রাজ্ঞ, সমর্থন করবেনই যে সাধারণ ভাবেই কবিতায় শব্দ ব্যবহার একটা জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আপনি বিভিন্ন চরিত্রের শব্দকেই কবিতায় ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু, তার জন্য উপযুক্ত প্রতিবেশ গড়াটা আশু প্রয়োজন। নইলে সেই শব্দ সঞ্চার বিস্ফোটকের মতো প্রতিভাত হয়। এ অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই কম বেশি আছে।

এখন এই 'প্রতিবেশ' বলতে কী বোঝাতে চাইছি-এটা পরিস্ফুটনের প্রয়োজন। এর জন্য আমরা বেছে নেব বাংলা ভাষায় অ্যান্টি পোয়েট্রির ধারার সূচনাকারী সুবোধ সরকারের কবিতা,

"একজন মাফিয়া বিধায়ককে মেনে নেয় এসেম্বলি। কিন্তু
একজন টেররিস্টকে মেনে নেয়া যায়না।
কতদিন তোমার স্নান করা চুলের গন্ধ পাইনি।
চোখ ভরে আসে জলে। পাউরুটি খাওয়া শেষ করে
১১ বছরের ছেলেটি বলেছিল, আর আছে? আমি আর
একটা পাউরুটি কিনে দিয়ে বলেছিলাম; শোন্ তুই বড় হয়ে
কী করবি? সে বলেছিলঃ বদলা নেব।
ছেলেটার মুখ ভেসে ওঠে যেই মনে হয় আমার সামনে
অনেক অনেক কাজ। অনেকগুলো খারাপ কাজ। ভুল
বললাম,অনেক,অনেক,ভালো কাজ।"(একজন টেররিস্টের চিঠি)

একটি দীর্ঘ কবিতার খুব সামান্য অংশ হলেও যদি, আমরা অভিনিবেশ করি, সহজেই বুঝতে পারব বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের অন্তঃস্থলে যে ছন্দ স্পন্দ প্রবহমান তাকে, সার্থ আর ব্রেথ গ্রুপে বিন্যস্ত করে যেমন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন বাংলা গদ্যে, বাংলা কবিতায় সেই স্পন্দকেই ব্যবহার করলেন সুবোধ সরকার। মাফিয়া, টেররিস্ট, পাউরুটি, এসেম্বলি প্রভৃতি তথাকথিত 'অকাব্যিক শব্দ' হিসেবে পরিচিত শব্দগুলিকে কবিতার প্রাণবস্তু করে তুললেন। তুলতে পারলেন দুটো কারণে,

১) আখ্যানধর্মী কবিতার শুরুতেই প্রতিবেশকে আমাদের জনসমাজের একেবারে জায়মান পরিস্থিতিতে স্থাপন করলেন।

২) কবিতা থেকে কবিতার বিবিধ অঙ্গকে ছেঁটে ফেলে দিয়ে তাকে সর্বৈব অর্থেই মানুষের মৌখিক ছন্দের ওপর নির্ভর করতে শেখালেন।

মনে হয় এ দুটো কারণের অভিঘাতেই বাক্যবিণ্যাসে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে শব্দগুলি। অর্থাৎ এই প্রতি কবিতার ধারায় অত্যন্ত সচেতনভাবে শব্দ ব্যবহার করতে হয়। না, হলে তা বিষয়কে জ্যান্ত করার বদলে আরোপিত করে তোলে। এই বিপজ্জনক ধারায় পা রেখে একাধিক কবিরই সেই দশা ঘটেছে। কিন্তু, আলোচ্যমান কবি সুবোধ বাবুর কবিতায় উত্তর উত্তর পরিচিত কাব্যিক টুল কমেছে। শব্দের পিনদ্ধ তৈরি হয়েছে।তারও একটি কারণ রয়েছে বলে অনুমান করি। সুবোধ সরকারের কবিতা প্রথমে বাংলা কবিতার আবহমান ধারাকে আত্মস্থ করেছে। তারপর ধীরে ধীরে শল্কমোচন করছে, আর আবহমানের অভিঘাত কবিতায় এনেছে আত্মসম্পাদনার শক্তি। এই অর্জনটি কবিরই একান্ত। এই চর্চার নিরবচ্ছিন্নতায় প্রবেশ না করে যদি কেউ পরাত্মপ্রবণ হয়ে পড়ে অ্যান্টি পোয়েট্রি স্বয়ং তাকে নস্যাৎ করে। এ আলোচকের এই ধারণার পক্ষে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় এই নমুনাটি,

পালকির দরজা খোলা। মঠের আচার্য মারা গেছে।

রোদ উঠে আসে সিঁড়ি থেকে বিছানায়, কদমের

নীচে তার সাইকেল, ওষুধের বাক্স, পায়জামা

চুরি করে চেরির বাগান দিয়ে চলে যায় চোর। (আচার্যর পায়জামা)

অক্ষরবৃত্তের দাপুটে ব্যবহারেই বোঝা যায় কী অসীম ছন্দ দক্ষতা নিয়েই সুবোধ লিখছেন,

"প্রভুপত্নীর সামনে দু’বার মৈথুন করার পর—আমার একটি পায়ে পচন ধরে যায়। এক গুনিন ওই পা কেটে একটি ঘোড়ার পা লাগিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয় আমাকে। আমি কাক, মূষিক, কূর্ম ও মৃগ পরিবৃত হয়ে একদিন ভেলকি দেখিয়েছিলাম রাজসভায়।
আজ এক অন্ধের যষ্ঠি নিয়ে তার আগে আগে খুঁড়িয়ে চলেছি। তার স্ত্রীও সঙ্গে রয়েছে। তার তিনটি স্তনের একটিকে নিয়ে কুশবনে এরপর ব্যভিচার শুরু করি। কৃষ্ণসাপের বিষে অন্ধ চোখ ফিরে পেয়ে দেখে তার স্ত্রীর পেটের মধ্যে থেকে টেনে টেনে বের করছি আমার আটকে যাওয়া পা।"(ব্যাভিচার)

অক্ষরবৃত্তের চলনে ঢুকে পড়লো গদ্য।মুখের ভাষায় যে তথাকথিত ছন্দ মুক্তির স্পৃহা থাকে, সেই স্পৃহাকেই ছন্দের চলনে রেখে গৌণ করে দিলেন প্রত্যক্ষ স্পন্দকে।যার জন্য দুটো কারণ তীব্রভাবে দায়ি বলেই মনে করছি,

প্রথমতঃ গভীর লোকজ্ঞান

দ্বিতীয়তঃ ছন্দ বোধ ও 'স্টাইল ইজ দ্য ম্যান'এর আত্ম উন্মোচন।

সম্প্রতি 'বই সংখ্যা দেশ'- এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে শ্রীসরকার নিকানোর পাররার একটি মন্তব্য এইভাবে জানাচ্ছেন,

"পায়ে যদি ছন্দ না থাকে, তার হাতেও ছন্দ নেই। আমি জানি গোলকিপার কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানি তার পেছনে একটা নেট, একটা বল যখন নেটের ভেতর গিয়ে লুটোপুটি খায়, তখনই তৈরি হয় পতনের ছন্দ, উত্থানের উদযাপন। আমি জানি গোলকিপার কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। যে জানে না সে কোনওদিন কবি হতে পারবে না, যত ভালোই হোক তার ছন্দ ‌।"(অ্যান্টি পোয়েট্রির দেবদূত: সুবোধ সরকার:২০২৩)

অর্থাৎ উভমুখী ক্রিয়া। ছন্দ বোধ যেমন তৈরি করতে হবে, আবার গোলকিপার কোথায় আছে, সেটাও জানতে হবে। সেক্ষেত্রে পাররা গুরুত্ব দিয়েছেন পায়ের ছন্দের ওপর। যে ছন্দের ধারা বাংলা গদ্য ভাষায় সঞ্চার করেছিলেন বিদ্যাসাগর।আর তারই প্রবাহকে বাংলা অ্যান্টি পোয়েট্রির ঋত্বিকেরা।

অর্থদ্যোতনা আর শ্বাসস্পন্দকে একত্রিত করে মানুষের ক্রিয়াশীলতার ভারসাম্যকে কবিতায় বজায় রাখা এ কারণেই একটি দুরূহ শিল্পে পরিণত হয়েছে। আপাত সারল্যের আবরণে সে ঢেকে রাখে তার জটিল ও কূট নির্মাণকে। ওই প্রত্যক্ষ সারল্যই অ্যান্টি পোয়েট্রিকে জনপ্রিয় ও  একই সঙ্গে গহন এবং চোরাস্রোতময় করে তোলে। ছন্দ ও শব্দ দক্ষতার দৃঢ়তাই সে স্রোতপথে একমাত্র ভরসা। নচেৎ কবিতাকে শ্লোগানে পরিণত করে ফেলার প্রবণতা কী আমাদের পাঠ-পরিবেশে বিশেষ দুর্লভ?

কয়েকটি তথ্যের সহজ দর্শনকে পরপর সাজিয়ে প্রতি-কবিতা যে জটিল বিণ্যাস তৈরি তার প্রতিভাস কিন্তু কুহক দেখায়।আক্রান্ত করে। কিন্তু, তথ্যকে সত্য করার ক্ষমতা ব্যাতিত এ পর্যায়ের কবিতা জন্ম নিতে প্রায় অক্ষম বলেই অনুভূত হয়। 

এক্ষেত্রে সুবোধ সরকারের কবিতাই উদাহরণ হিসেবে যথার্থ হতে পারে। এবং এক্ষেত্রে 'একা নরকগামী' কাব্যটির সমগ্র অংশকেই উল্লেখ করা যায়। কী অনায়াস ছন্দ দক্ষতায় কবি লিখেছেন তাঁর যাপন সম্বলের উপাদান সমূহকে। এই কাব্যটি পড়লেই এই প্রস্তাবনার বক্তব্য পরিচ্ছন্ন হতে পারে। ছন্দ ও আবহমানের বাংলা কবিতাকে আত্মস্থ করার পরেই সুবোধ সরকার ধীরে ধীরে মোচন করেছেন যাবতীয় কাব্যিক অলংকার। এটা একটা প্রক্রিয়া।

 এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া কী খুবই জরুরি! কেউ কেউ তো স্বাভাবিক লিরিক প্রবণতার বাইরে বেরিয়েই শুরু করতে পারেন! অর্থাৎ কিছুটা এগিয়ে শুরু করলেন! সেক্ষেত্রে এই আলোচকের মনে হয় সম্ভব তখনই,যখন বাংলা লেখার ভাষার একটা বড় বিবর্তন হবে। কেননা, এখনও পর্যন্ত যে বাংলায় আমাদের লেখালিখি চলে, আপাদমস্তক লিরিক্যাল এবং তৎসম ও অর্ধতৎসম প্রবণ। আরবান শব্দের প্রয়োগ এখনও স্ল্যাং হিসেবে পরিচিত হয়, কিংবা হৈচৈ ফেলে দেয়। কিছুতেই আরবান শব্দ এখনও স্বাভাবিক ভাবে গ্রাহ্যতা পায়নি। তাছাড়া আমাদের ভাবনার ভাষাও কী লেখালিখির ভাষা থেকে আলাদা?
ফলতঃ এই বাংলা ভাষায় অ্যান্টি পোয়েট্রির দিকে যেতে গেলে সম্ভবতঃ এই ভাষায় ব্যবহৃত ছন্দ স্পন্দ ও ধ্বনিবোধকে সম্যক জানার প্রয়োজন।

অ্যান্টি পোয়েট্রি বলে দাবি করছি না, কিছুতেই না, তবুও এ প্রসঙ্গে অরুণ মিত্রের উদাহরণকে ব্যবহার করাই যায়, অন্ততঃ গদ্য ছন্দের প্রসঙ্গে। প্রথমাবধি অরুণ মিত্রকে পড়লেই পাঠকের সম্যক ধারণা হতে পারে, কীভাবে অরুণ মিত্রও প্রত্যক্ষ ছন্দকে 'অন্তশ্ছন্দ'-এ প্রবাহ দিলেন।

এই আলোচকের মনে হয়, প্রতি-কবিতা একটা বিনির্মাণের মধ্যবর্তী পর্ব। প্রতি মুহূর্তে কবিতার ভাষাকে যেমন পাল্টে দিতে চাইছে, একই সঙ্গে ঐতিহ্যের কবিতার স্ফিয়ারেও প্রবেশ করিয়ে চলছে নতুন অভিজ্ঞতা।

যদিও প্রতিটি সময় পর্বেই তার সাপেক্ষে একটা করে প্রতি-কবিতার ধারা থাকে বলেই অনুমিত হয়। যেমন দাশরথী রায়ের পাঁচালী, রামপ্রসাদের 'কড়াপাক' ভক্তি, বিদ্যাসুন্দরের বিলাস আবর্তে মাইকেল একটা বিনির্মাণের দিকে নিয়ে গেলেন বাংলা কবিতাকে। তারপর রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য সত্তর দশক থেকে এই বিনির্মাণের রূপটা পাল্টে গেল অনেক বেশি করে।কারণ তথ্য বিপ্লব ঘটতে শুরু করল। মানুষের হাতে এমন সব তথ্য আসতে শুরু করল, তার পূর্বের সমাজ ও তার জায়মানতা সম্পর্কে ধারণাই বদলে যেতে শুরু করে। কবিতাও সঙ্গত কারণেই এই মুহুর্মুহু বিবর্তনের ভাষ্য বহন করতে চায়।এই প্রসঙ্গে স্মৃতি তাড়িত হচ্ছে দেবদাস আচার্য রচিত 'মৃৎশকট' গ্রন্থের পঞ্চাশতম স্তবকটির জন্য,

"এই তো সংযোজক সময়, মানুষ ক্রমশঃ বিমূঢ় হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী, স্ফুরিত হচ্ছে ছড়িয়ে পড়ছে, ইতিহাসের ভিতর চঞ্চল চলাফেরা করছে।চুল ছড়িয়ে পা ছড়িয়ে সসাগরা মাটি বহন করে মহান ইন্দ্রজাল।"

ইন্দ্রজালের মতোই কাব্যগ্রন্থটি এবং তৎপরবর্তী সময়ের 'মানুষের মূর্তি' অবশ্যই তৎকালীন কবিতায় এমন একটি বিবর্তনের সঞ্চার করে, যার অভিঘাতে বাংলা কবিতা লেখার আরও কিছু চোরাস্রোতসংকুল মোহময় ধারার,

"আমার ছোট্ট আর মিষ্টি মা রুটি ভাজেন
এবং তাকিয়ে থাকেন বাবার সেলাইকলের দিকে
এবং আমরা সবাই চুপচাপ বসে থাকি
যেন কোনও একটা বিপদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে"(খিদে)

এ প্রসঙ্গে আপনার অবশ্য মনে পড়ে যেতে পারে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা বা শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বা তারাপদ রায়ের কবিতার কথা।

প্রস্তাব দীর্ঘ হয়ে গেলে প্রসঙ্গচ্যূত হয়ে পড়ে। সে পথে না গিয়ে বক্তব্যে ফিরে আসতে চাই। বাংলা কবিতা সব সময়ই মোচন ও মোক্ষণের পথে হেঁটে এগিয়েছে।চর্যাপদ থেকেই এই প্রবণতা জাগ্রত। তবে লোকজ্ঞান, ছন্দবোধ আর শব্দবোধের চর্চা ব্যাতীত এ অসম্ভব, তাও বুঝিয়েছেন এ পথের সাধকেরা। যাপিত জীবনের ঘনিষ্ঠতা এ কবিতার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য বলে মনে করি। নাহলে আবৃত্তিযোগ্যতার মাপকাঠিতেই সে হারিয়ে যেতে পারে।অর্থাৎ বিনোদনের কূপের মণ্ডুকতাই তার অভিপ্রায়ে পরিণত হবে। তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি কখনই প্রতি-কবিতার অবয়ব হতে পারে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন