দোঁহা

ইমাদের আজ কাল পরশুর গল্প



সুমি দত্তগুপ্ত

'দূরে দূরে গ্রাম দশ বারোখানি মাঝে একখানি হাট,

সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ, প্রভাতে পড়ে না ঝাঁট,

বেচাকেনা সেরে বিকেলবেলায়

যে যাহা সবে ঘরে ফিরে যায়'

 
এ এমন এক বাজারের কাহিনী, যার সাথে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর হাট কবিতার চিরায়ত ছবির কোনও মিল নেই, আবার আছে ও। কারণ পুব আকাশে আলো ফোটার সাথে সাথেই  দূরান্তের বাসিখউ, জিরিরাম, আন্দ্রে থেকে ফানেক, ইনাফি পরিহিত, কপালে চন্দনের তিলক আঁকা মৈতে সমাজের  বিভিন্ন বয়সের মহিলারা তাদের পসরা নিয়ে টোটো, ভ্যান রিকশায় করে ভিড় জমাতে থাকেন, কাংলা ফোর্ট এর ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, বীর টিকেন্দ্রজিত রোডে, খোয়াইরিমবন্ধ বাজারে। আবার সূর্য পশ্চিম গগনে ঢলে পড়ার সাথে সাথেই ঝাঁপ বন্ধ করে, তারা আবার পাড়ি জমান বাড়ির পথে।

শোনপুরের  বাজারে মানুষ বিক্রী হত, মীনাবাজারে  হরেক কিসিমের বাঁদী কেনা বেচা চলত, মনুষ্যত্বের চরম অপমানের সেই কাহিনী আমাদের অজানা নয়। কিন্তু যে বাজারের কথা আজ বলবো, সে এক ভিন্ন মেরুর কথা। যে বাজার কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মানুষের অধিকার রক্ষা, দাবি পূরণের, সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার এক স্বতন্ত্র অধ্যায়। যদিও মূলত: অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই এই বাজারের সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু মণিপুরের নুপি কাইথাল বা ইমা অর্থাৎ মায়েদের বাজার মানুষকে যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করতে, প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে এক অনন্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

ষোড়শ শতকে মনিপুরে তখন রাজার শাসন। পরিবার বা কৌমে বিভক্ত মণিপুরী পুরুষটিকে বেশিরভাগ সময়েই রাজার আদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হত দূরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রে, মেয়েদের সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিতে হতো, শিশু প্রতিপালন, চাষের কাজ, ঘরকন্না, তাঁত বোনার কাজ সামলিয়ে তাকে ভাবতে হত, মাঠের ধান, বোনা কাপড় বিক্রি না হলে, তার সংসার চলবে কি করে? তখনই গড়ে ওঠে ইমা কাইথল। সম্পূর্ণ মহিলা বিক্রেতাদের নিয়ে মহিলা সংঘ পরিচালিত এই বাজার। ইমা কথার অর্থ মণিপুরী ভাষায় 'মা'। কইথল অর্থ বাজার। ইমা কাইথল হয়ে ওঠে মণিপুরী সংস্কৃতির অঙ্গ।

ঋক বৈদিক যুগের সমাজে সভা ও সমিতির মত দুটি প্রতিষ্ঠান রাজাকে পরামর্শ দান করতেন, সম্রাট অশোক তার সময় রাজুক নামে কর্মচারীদের দিয়ে সাম্রাজ্যের খবর সংগ্রহ করতেন, তারা ছিলেন রাজ্য কর্মচারী। তাই রাজার অনুগত ছিলেন তারা। কিন্তু ইমারা ছিলেন স্বাধীন, কারও অনুগত নয়, তারাও রাজাকে দূরান্তের খবর দিতেন, কাইথলে বিভিন্ন জায়গার খবর নিয়ে তারা আসতেন, কিন্তু রাজার সিদ্ধান্ত কোনও ব্যাপারে পছন্দ না হলে বিরোধিতা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। কইথলে জনগণের সমক্ষে বিচারসভা বসত, চলত সালিশি সভা, শলা পরামর্শ। তখন থেকেই সমাজ জীবনে ইমাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে।

 ১৮৯১ সালে তখন মনিপুর ব্রিটিশ অধিকৃত, সেই সময় ব্রিটিশ বিরোধী জনগন একটি সরকারি আবাস ধ্বংস করলে সরকারের তরফে মণিপুরের শ্রমিকদের বিনা পারিশ্রমিকে ওই আবাস পুনঃনির্মাণের আদেশ জারি করলে ,গর্জে ওঠেন ইমারা, আদেশ প্রত্যাহারের হুংকার তোলেন। সরকারের সাথে সরাসরি বিদ্রোহে সামিল হন, এটাই ছিল ইমাদের প্রথম নুপিলান বা যুদ্ধ। তারা বিজয়ী হন। ১৯২৫ সালে সরকার যখন জলকর বসানোর সিদ্ধান্ত নেন তখন ও প্রতিবাদ আসে ইমাদের কাছ থেকেই। নেমে পড়েন সম্মুখ সমরে বা দ্বিতীয় নুপিলানে। ১৯৩৯ সালে দুর্ভিক্ষের সময় যখন সরকার দেশের মানুষকে নিরন্ন রেখে, বিদেশে চল রফতানি অব্যাহত রাখেন, তখন ইমা কাইথেলে সমবেত হয়ে মহিলারা সিদ্ধান্ত নেন, চাল রফতানির সিদ্ধান্ত যতক্ষণ রাজা প্রত্যাহার করবেন তারা রাজদরবারের সামনে ধর্নায় বসবেন। প্রচুর মহিলা চাল বোঝাই লরির সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়েন। মণিপুরের বড়ো বড়ো চল কল গুলোর সামনে প্রায় দশ হাজার ইমা সমবেত প্রতিবাদ জানাতে থাকে। অবশেষে সরকার চাল রফতানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। 

১৯৫৮ সালে সরকার উত্তর পূর্বাঞ্চলে যে কঠোর আফস্পা আইন জারি করে, তা অনেক পরিমাণে ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বাধীনতা হরণ করায় তারা ক্ষুব্ধ হয়। 

চিত্রাঙ্গদার দেশে মহিলারাই যে সমাজে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। ইমা কাইথেল যেন যুগ যুগান্ত ধরে সেই ভূমিকাই পালন করে আসছে ,সে যে কোন সামাজিক সংকটেই হোক, আফসপার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনেই হোক, কিংবা মণিপুরী সংস্কৃতি রক্ষার ক্ষেত্রেই হোক। ২০০০ সালে যখন আসাম রাইফেলের ১২ জন জওয়ান একজন বৃদ্ধা ও যুবতীর ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করে, তখন শর্মিলা চানু তার গ্রাম থেকে ছুটে আসেন ইম্ফলের ইমা কাইথলে, অনশন আন্দোলন শুরু করার আগে ইমাদের আশীর্বাদ চাইতে। আফস্পার বিরুদ্ধে শর্মিলা চানুর আন্দোলন এক নতুন ইতিহাস রচনা করে।

২০০৪ সালে ইমফলের কাছের এক গ্রামের মেয়ে মনোরমাকে তুলে নিয়ে যায় আসাম রাইফেলের কয়েকজন সেনা, পরদিন মনোরমার বুলেটবিদ্ধ দেহ পাওয়া যায়। বন্ধ হয়ে যায় ইমা কাইথাল। কাইথলে সমবেত ইমারা এক হাতে মশাল, আরেক হাতে বস্ত্র বয়নের তেম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাস স্থানে প্রতিবাদ জানান। কিন্তু এই ঘটনায় তারা এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যাতে সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যায়। ইম্ফলের কাংলা ফোর্টের কাছে, অসম রাইফেলসের সদর দপ্তরের সামনে ১২ জন ইমা নগ্ন প্রতিবাদ জানান, তাদের প্রত্যেকের হাতের ব্যানারে লেখা ছিল," ভারতীয় সেনা,আমাদের ধর্ষণ করো, হত্যা করো। আমরা সবাই মনোরমার মা।"

আসলে মণিপুরী সমাজে ইমা কাইথেলের ভূমিকা বলে বোধহয় শেষ করা যাবে না। সমাজ সংস্কৃতি রক্ষায়, কৌমের ধারাবাহিকতা, মর্যাদার বহমানতায় ইমা কাইথল আজ ও অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে চলেছে, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
 
 
বিশ্বায়নের এইযুগে, কর্পোরেট দুনিয়ার হাতছানি, পরবর্তী প্রজন্মের ভিনরাজ্যে কিংবা ভিনদেশে পাড়ি, কাইথলের উত্তরাধিকারে অনীহা, বার্মা সীমান্ত দিয়ে অবিরত চীন, থাইল্যান্ডের কম দামী পসরার  বাজার দখলের প্রতিযোগিতা, তার সাথে রাজনীতির লম্বা হাত সবকিছুর সাথেই আজ লড়তে হচ্ছে ইমা কাইথল কে। সে লড়াই অস্তিত্বের লড়াই। ইমা কাইথল কি এশিয়ার বৃহত্তম ৫০০০ ইমা পরিচালিত বাজার হিসাবে টুরিস্ট আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই শুধু থেকে যাবে? কিন্তু ইমা কাইথল কে অস্বীকার করার অর্থ মণিপুরী কৌম সমাজ সংস্কৃতি,গণ আন্দোলনের প্রতীক, ইমাদের ভূমিকাকে ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।  যে মনিপুর রাজ্যে আলাদা করে কোনও নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রয়োজন হয় নি, ইমাদের রক্ষাকবচ ধারণ করে বেঁচেছিল এই রাজ্যের নারী সমাজ। তাই ইমাদের অস্তিত্ব হারানো তো তাদের কাছে নিজেকে হারানোর সামিল। সেটা কি তারা মেনে নেবে? এখন শুধুই  সময়ের অপেক্ষা। তবুও নারী দিবসের এই শুভক্ষণে আমাদের সবটুকু সমর্থন, ভালোবাসা থাকুক ইমা কাইথলের, ইমাদের প্রতি। যে লড়াইয়ের আগুন তারা জ্বালিয়ে দিয়েছেন, সেই মশালের যোগ্য বাহক হোক তাদের উত্তরসূরীরা, এটাই আমাদের চাওয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন