মনস্বী চৌধুরী
‘নববর্ষ’, শব্দটি উচ্চারিত হলেই কত কী মনে পড়ে যায়! ‘বাঙালিয়ানা’, ‘একত্র যাপন’ আরও কত কিছুই না জুড়ে রয়েছে এই চতুক্ষরা শব্দটির সঙ্গে। নববর্ষ সবার কিন্তু বাঙালির নববর্ষ একান্তভাবে বাঙালিরই। তা শুধু একটি দিন নয়, একটি উৎসব নয়, কিছু আচারের সমষ্টি নয়-বরং তাকে বলা যায় প্রত্যেক বাঙালির জন্মদিন, একটি জাতির হয়ে ওঠা, তার যাপন-নির্ণায়ক একটি উদযাপন। আমাদের ইতিহাসের আলো-আঁধারির ধাঁধাঁকে সঙ্গী করে, নানান মতদ্বৈধতাকে মান্যতা দিয়েই ফিরে তাকাতে হবে সেই সপ্তম শতকের দিকে। কৃষিনির্ভর গৌড়দেশে গৌড়ীয়দের কাছে ‘ফসলি’ সনের পরিচয় প্রথমে গৌড়াধিপতি শশাঙ্কদেব এবং তার পর সম্রাট আকবরের আদেশে ‘বঙ্গাব্দ’ এর মোড়কে নবরূপ পরিগ্রহণ করে। বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় একেকজন সম্রাট তাঁর রাজ্যস্থাপনার সময়ের মানদণ্ডে ‘সন’ নির্ণয় করেছেন। বঙ্গদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ‘অগ্রহায়ণ’, ‘ভাদ্র’ মাস বর্ষশুরুর অধিকার ৬৯৩ খ্রীষ্টাব্দে তুলে দিল বৈশাখের হাতে। আমাদের চান্দ্রসৌর দিনপঞ্জীর সূচনা হয় ‘গ্রেগরীয়’ দিনপঞ্জীর মতে এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ থেকে। রাজ্যশাসন ও খাজনার দাবীতে সম্রাট আকবর ‘পহেলা বৈশাখ’ কে বিশেষ মর্যাদা দিলেন কৃষক-শ্রমের মূল্যে। শুরু হল আমাদের নতুন হিসেব বঙ্গাব্দের হাত ধরে। আঠারো শতকে মুর্শিদকুলি খাঁ এই হিসেবকেই ‘পুণ্যাহ’ অর্থাৎ পুণ্যের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিলে তার সঙ্গে যুক্ত হল উৎসব। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মহাসমারোহে বর্ষসূচনার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রাগাধুনিক কালের পালাপার্বণের ইতিহাসে–
‘এই ক্ষণে (নববর্ষের প্রথম প্রাতে) সুসজ্জিত রাজপ্রাসাদ, অতিথিশালা, খাজাঞ্চিখানা, নহবতখানা, তোষাখানা, মহাফেজখানার শোভা দেখিয়া বড়োই আহ্লাদ হইল… রাজপ্রাসাদের দাস-দাসী, পাইক-পেয়াদা, এমনকি অতিথিশালার অতিথিবৃন্দ সকলেই আজিকার দিনে নববস্ত্র পরিধান করিয়াছে।’
উনিশ শতকে রাজনৈতিক পালাবদলে পরদেশীদের নববর্ষ পালনের চমকে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটল ‘নেটিভ’ পাড়ার। আকবরের আমল থেকে চলে আসা রীতিতে এবার রঙ লাগল উদযাপনের। ‘Let’s celebrate’ এই ইংরেজি হুজুগেপনার রসে মজল উনিশ শতকের আধুনিক হয়ে উঠতে চাওয়া বাঙালি। আঠারো শতকের বাঙালির আটপৌরে সাদা-কালো ছবিটা গগনচুম্বী রঙিন ইচ্ছার স্পর্শসুখ উপভোগ করল উনিশ শতকের দো-আঁশলা চারিত্র্যপূজায়। স্থানিক ও শ্রেণিগত উচ্চাবচতায় বিভক্ত শহর কলকাতায় নেটিভ-কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পেলেন–‘কট্ কট্ কটাকট্, টক্ টক্ টক্।/ ঠুনো, ঠুনো ঠুন্ ঠুন্, ঢক্ ঢক্ ঢক্।।/ চুপু চুপু চুপ্ চুপ্, চপ্ চপ্ চপ্।’ সাহেবটোলার রমণীয় খাদ্য আস্বাদনের কমণীয় চিত্র। এই নানাবিধ ধ্বনি যাতে কালো চামড়াদের পাড়াতেও শোনা যায় তারই একটা ব্যবস্থা করে ফেললেন গুপ্তকবি। আজকের বর্ষবরণ, তার চেহারা, আকার-প্রকার কালের দাবীতে যতই পরিবর্তিত হোক না কেন তার শিকড়টি প্রোথিত রয়েছে উনিশের সেই রঙের-রসের ভূমিতে। ঈশ্বর গুপ্ত এর উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন আমাদের। উনিশ শতকে বাংলা নববর্ষের যে উৎসবের সূচনা হয় তার মধ্যে মিশে গেল সাহেবিয়ানার গন্ধ তবে স্থানিকতাকে পরিহার করে নয়। উৎসব কখনো কখনো উদযাপন হয়ে ওঠে যখন তার মধ্যে মিলনের আনন্দ-রাগিণী বেজে ওঠে। উৎসবের একত্র যাপন হল এই মিলনের সুরের উৎসভূমি। উনিশ শতকের মিলনে কোথাও অভিশাপ ছিল। ঘরানা ও বাহিরায়ানার যে বাঞ্ছিত মিলন তা থেকে দূরত্ব রচনা করেছিল সেই অজ্ঞাত অভিশাপ। নববর্ষ যদি মহামিলনের গান হয় তবে এ কথা বলতেই হবে যে সে মিলনের গানে পুরুষদের কন্ঠস্বর যতটা স্পষ্ট ও জোরালো, নারীদের কন্ঠস্বর ছিল অশ্রুতপ্রায়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বৈশাখের ভোরের হাওয়ায় খাদসপ্তকের কোমল নিষাদে চৈত্রের স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে মধুর করে তোলবার অনেক আগেই তাঁর পরিবার আমাদের এই মহামিলনের গানের সুরটি শিখিয়ে দিয়েছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয় পাদেই। মাতৃভাষার অকৃত্রিম পূজারী ঈশ্বর গুপ্ত ১২৫৭ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ নববর্ষের যে অনুষ্ঠানের প্রচলন করেছিলেন সেই অনুষ্ঠান-সভার সভাপতি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাবু-বাড়ির অন্দরমহলে মালিনীর পসরার তাঁতের শাড়ি, খেমটা নাচ ও নিজস্ব মজলিসি আড্ডা ব্যতীত অন্য কোনো বিনোদন ছিল না আর বাহিরমহলে বাবুদের রঙিন মজলিসে বাইনাচ-গানের ফোয়ারা-সুর আর সুরায় এক স্বপ্নালু আবহ যেন। এই আবহের বিবাদী স্বর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরপরিবার। আমরা দেখেছি নারীকে তথাকথিত বাবু-সংস্কৃতির উল্লাসের নায়িকা হতে, সঙ্গিনী হতে কিন্তু আমরা এই বর্ষবরণের মহামিলন মেলার পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁদের স্থপতির পদ গ্রহণ করতে দেখিনি। মনেপ্রাণে ব্রাহ্ম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়িতে দ্বারকানাথ-অনুসারী চটুল সংস্কৃতিকে পরিহার করে ব্রাহ্ম-সংস্কৃতায়িত জন্মদিন, জামাই ষষ্ঠী, মাঘোৎসব, ভাদ্রোৎসবের মত বেশ কিছু অনুষ্ঠান। মাঘোৎসবের সমান্তরালে এই পরিবার বর্ষবরণকেও স্বতন্ত্র একটি অনুষ্ঠান তথা উদযাপনের স্থান দিলেন, সেকালের কলকাতায় অভিজাত সংস্কৃতির বাতাবরণেই যেটি ছিল একটি আশ্চর্য ঘটনা। নববর্ষের রূপ প্রকৃষ্ট অর্থে পারিবারিক মিলনোৎসবের মধ্যেই ধরা পড়ে তা মহর্ষির শিক্ষা, সুশাসন ও শৃঙ্খলিত যাপনের স্নেহে প্রতিফলিত হয়ে শুরু হল ঠাকুরবাড়ির নতুন যাপন। মহর্ষির জ্যেষ্ঠা কন্যা সৌদামিনী দেবী (১৮৪৭-১৯২০) রচিত তর্পণ-গ্রন্থ ‘পিতৃস্মৃতি’ তে মেলে বর্ষ-মিলনের শ্রদ্ধা সাক্ষ্য –‘১ লা বৈশাখ বর্ষারম্ভের উপাসনার পর আমরা তাঁহাকে (মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে) প্রণাম করিলে তিনি আমাদের প্রত্যেককে একটি করিয়া গিনি দিয়া আশীর্বাদ করিতেন। সেদিন দুপুর বেলায় বাদামের কুলফির বরফ তৈরী করাইয়া আমাদের জন্য পাঠাইয়া দিতেন, তাহা সকলে আনন্দে ভাগ করিয়া খাইতাম।’ এই পারিবারিক মিলনোৎসবে কলাপাতায় ভাত আর মাটির খুঁড়িতে কাঁচা ইলিশের ঝোল, শুক্তো, চালতা দিয়ে মুগডাল, আম দিয়ে শোলমাছ, মাংসের পোলাও, মৃণালিনী-উদ্ভাবিত ‘এলোঝেলো’ এবং বড়দা দ্বিজেন্দ্র-প্রিয় পাঁঠার হাড়ের অম্বলের রসিকতার পাশাপাশি গীতরসের সুপরিবন্ধে মিলল বাহির ও অন্দর সমানতালে। ‘ভারতী’ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হল স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘নববর্ষে’ কবিতা। বাবু-সংস্কৃতির চটুল নারীসঙ্গী বর্ষবরণের বিপ্রতীপে ঠাকুরবাড়ির অন্দরের সৃষ্টিতে মিলল আদর্শস্থাপক প্রার্থনা–‘বিরাট এ পুরাতন মাসে, শুনিয়াছি তুমি আদিভূপ!/ বিশ্বব্যাপী মূরতি তোমার–অতুল সুন্দর মূরতি তোমার–অতুল সুন্দর মহারূপ!/ কেন তবে করিছ ছলনা, প্রকাশ হে প্রচ্ছন্ন মহিমা,/পুণ্যমঙ্গল- নবালোকে ভরি দাও স্বর্গমর্ত্যসীমা।’ তেমনি হেমেন্দ্র-কন্যা বিদূষী প্রতিভাসুন্দরী দেবীর প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সুরমিলনে ব্রহ্মের প্রতি ‘প্রীতি উপহার’ মিলল–‘নববর্ষ ফিরে এল অভিনব সাজে, আজিকে হৃদয় তন্ত্রী নব সুরে বাজে।।’ রবীন্দ্রনাথের কোমল ভৈরবীর মাহলে ঝাঁপতালের মন্দ্রতায় ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার গানের দয়াভিক্ষা রূপ পেল। বঙ্গভঙ্গের সমকালে জ্যোতিরিন্দ্রের বর্ষবরণের প্রার্থনায় মিলে গেল নববঙ্গ গঠনের প্রত্যাশা আর স্বর্ণকুমারীর কলমে ‘আহুতি ঢাল মানব-সবে আজি এ মিলন আহবে/ বল মঙ্গল, জয় মঙ্গল, মঙ্গলে দিক ভাসিছে!’ প্রচারিত মঙ্গলবাণী এবং মানব-কর্মের আদর্শ স্থাপনাই তো মহামিলনের উৎসব নববর্ষের আঁতের কথাটি উন্মোচিত করে আর সেই যজ্ঞে ঠাকুরবাড়ির আঙিনাতেই ঘটল প্রথম মধুর অসাম্প্রদায়িকতা, আলম্বনে রইল সুর।তথ্যঋণ—
১ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির জীবনধারা ও গান–মানস বসু
২ ঠাকুরবাড়ির বাবু মজলিস–শান্তা শ্রীমানী
৩ মধ্যযুগের বাঙালি ও তদীয় পালাপার্বণ–কৈলাসচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৫ ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা – সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর
