সাগ্নিক সিনহা
(১)
"ভাগ্যটাই আমার…"
সিঁড়ির মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তিস্তা। সিঁড়িটা সোজা নেমে গিয়েছে, নিচে বেসমেন্টের দিকে। যেন পাতালের শর্টকাট। কপালে শনি না নাচলে সম্ভবত এখানে খুব একটা কারোর আসার প্রয়োজন পড়ে না, তাই কোম্পানি আর লিফট লাগিয়ে খামোখা পয়সা নষ্ট করেনি। কিন্তু তাকে ঠিক এখানেই আসতে হল, তাও আবার এই শেষ বিকেলে। বেসমেন্টের অন্ধকার অতলে তাকে নামতে হবে না অবশ্য, আপাতত কয়েক ধাপ নেমে ল্যান্ডিংয়ের বাঁদিকের ঘরটায় যাওয়ার দরকার।
এদিকটা সবদিক থেকেই বিশ বছর পুরোনো সরকারী দপ্তরমার্কা এঁদো ঝুপসিপনা মেলে ধরেছে বেশ করে। এই বিল্ডিংটা আদ্যিকালে তাই ছিল অবশ্য। তারপর নাকি অনেকদিন বেবাক ফাঁকা পড়েছিল, হঠাৎ কয়েক বছর আগের কোনো এক দুর্ভাগ্যজনক দিনে ম্যানেজমেন্টের স্বভাবসিদ্ধ বেঁড়েপাকামির ফলে রেনোভেশনের কাজ শুরু হয়, আর মাস ছয়েকের মধ্যেই পার্ক স্ট্রিটের আলো ঠিকরানো মিনিমালিস্ট অফিস কমপ্লেক্স থেকে বার করে, এক নোটিশে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের এই ছদ্মআধুনিক বহুতলের কঙ্কালে একরকম ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল তিস্তাদের ডিপার্টমেন্টকে।
একেই মাথার উপরে ফসিলসম ঝুলমাখা বাল্বটা সস্তা হরর ফিল্মের ওপেনিং সীনের মতো দেখাচ্ছে, সেখানে স্মার্ট কি কার্ড আর আসবে কোত্থেকে! জিন্সের পকেট থেকে চাবিটা বের করে ঝনঝন করে নেমে গেল তিস্তা। এই নরকে সার্ভার রুম বানানোর আইডিয়াটা কোন পাঁঠার মাথা থেকে বেরিয়েছিল ভাবতে ভাবতেই চাবি লাগিয়ে কব্জির জোরালো মোচড় দিল একখানা, তবে মনে মনে সে দরজার সাথে কুস্তি করার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল।
দরজাটা কিন্তু খুলল দিব্যি। খোলারই কথা। পুরনো বাড়ির টিপিক্যাল ক্যাঁচ ক্যাঁচ করা ঘুণ ধরা দরজা নেই এখানে, তার জায়গা নিয়েছে হলদে ভিনাইল বোর্ডে 'অথরাইজড পার্সোনেল ওনলি ' লেখা একটা লাল স্টিল ডোর। ঠিকই আছে। সার্ভার রুমে এমনই সিকিউরিটি থাকা দরকার। অফিসে গত কয়েকদিন ধরে খুব নেটওয়ার্কের সমস্যা, যখন তখন জরুরি ফাইল উড়ে যাচ্ছে মেশিন থেকে, কাজ করতে করতে অ্যাকাউন্ট লগ আউট হয়ে যাচ্ছে, মাঝেমাঝে ইন্টারনেট কানেক্ট হচ্ছে না এটসেট্রা। তাই সার্ভার চেক করতে পাঠানো হয়েছে আইটি টিমের জুনিয়রমোস্ট সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তিস্তাকে।
দরজাটা খুলতেই সামনের অন্ধকারের দেওয়ালটা দৃষ্টি আড়াল করে দাঁড়াল তিস্তার সামনে, নাকে এল বহুদিনের অব্যবহৃত এঁদো ঘরের ভ্যাপসা, সোঁদা গন্ধ। ঘরটা অনেক লম্বা, পিছনের দেওয়াল দেখা যায় না। কালো কুয়াশার মতো অন্ধকারের মাঝে মাঝে বিশালাকার কিছু জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে সার্ভার মেশিনগুলোর লাল নীল হলুদ ইন্ডিকেটর আলো। ঢুকে এল তিস্তা। প্রথমে হাতড়ে হাতড়ে তারপর মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে দেওয়ালে লাগানো ছোট্ট সুইচবোর্ডটা খুঁজে বার করল সে। মাত্র একটা সুইচ, আলোরই হবে নিশ্চয়ই।
এক, দুই, তিন…
খট, খট, খট…
আবছা প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল প্লাস্টিকের যান্ত্রিক শব্দ। আলো জ্বলল না।
"শালা, আমাকেই পাঠাতে হল…শিট, অ্যালার্জি না হয়ে যায়। ভাগাড় কোথাকার…"মনে মনে টিম লিডার মুখার্জিকে আরেকবার খিস্তি দিয়ে ঘরে ঢুকেই পড়ল তিস্তা, হাতে মোবাইলের সরু সাদা আলো।
সামনের মেইনফ্রেম কম্পিউটারটা তেমন বেয়াড়ামো করল না, একবারেই পাওয়ার অন হয়ে গেল। ওয়ার্কস্টেশনে সাইন ইন করে প্রত্যেকটা সার্ভার অ্যাক্টিভিটির লগ চেক করতে বসল তিস্তা।
কিন্তু কাজে মন বসাতে পারছিল না সে। সারাক্ষণ কেমন একটা অস্বস্তি বোধ কাজ করছে ভিতরে।
কেউ কি দেখছে?…মৃদু পায়ের শব্দ হল কি?… ওই যে, ওই একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল না?
তিস্তা ভীতুর ডিম না। ও খুব ভালো করেই জানে এগুলো স্রেফ এই ঘরের অদ্ভুতুড়ে পরিবেশের দোষ। অন্ধকারের ভয় মানুষের আদিম এক প্রবৃত্তি, আর তার ঠেলায় ওর অবচেতন মন ইচ্ছে করে যত রাজ্যের বোগাস কল্পনা এনে ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। সব বোঝে তিস্তা। তবু উসখুস করতে থাকে টুলে বসে। কাজে ডুব দিতে পারে না। কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনার চেষ্টা করে। বিশেষ লাভ হয় না। একটা ইন্দ্রিয়ের অভাবে আরো বেশি সতর্ক হয়ে ওঠে ওর মন, বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখতে থাকে তিস্তা।
আর ঠিক তখনই দেখতে পায় তিস্তা, ওকে…
মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ঘন অন্ধকারের সাথে মিশে ছিল সে। তাই প্রথমে বুঝতে পারেনি তিস্তা। তার চেহারা দেখতে পায় না তিস্তা। স্রেফ চারপাশের লাল সবুজের আভা মেশানো ঘোলাটে অন্ধকারের মধ্যে গাঢ় একটা অন্ধকারতম মানুষের অবয়ব। প্রথমে দেখে তিস্তা ভাবে ছায়া। কানে জোরালো শব্দ করে বাজছে গ্রিন মাইল, তাই মাথা কাজ করে না চটপট, বুঝতে দেরি হয়ে যায়।
তারপরই নড়ে চড়ে ওঠে ছায়াটা এগিয়ে আসতে থাকে। সোজা তিস্তার দিকে…
একটানে কান থেকে হেডফোনটা খুলে টুল থেকে উঠে দাঁড়াতে যায় তিস্তা, স্বাভাবিক প্রতিবর্তের বশে লাফিয়ে দরজার দিকে যেতে যায়। কিন্তু তাড়াহুড়োয় পা জড়িয়ে যায় টুলের পায়ায়। টাল সামলাতে না পেরে টুল শুদ্ধ হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে তিস্তা। উপুড় হয়ে পড়ে, তারপর দুহাতে মাথা গুঁজে সেভাবেই পড়ে থাকে। এত তাড়াতাড়ি ঘটে যায় পুরোটা, তাতে কি হল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ওর আতঙ্কিত মস্তিষ্ক, শুধু অজানা এক বহু পরিচিত আশঙ্কায় থরথর করে কাঁপতে থাকে শরীর। যেন তিস্তা দেখতে না পেলেই তিস্তাকেও দেখতে পাবে না পিছনের অবয়বটা!
কাছে এসে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায় অবয়বের মালিক। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে তিস্তাকে, যেন প্রথমবার কোনো মানুষ বা নারী চোখে পড়েছে তার। তারপরই নিচু হয়ে বসে পড়ে সে, শক্ত হাতে দুই কাঁধ ধরে ঝটকা মেরে উল্টে দেয় তিস্তাকে, চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে তার উপর চেপে বসে সে। মরিয়া হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য হাত পা ছুঁড়তে থাকে তিস্তা, আর তখনই আতঙ্কের সাথে সে আবিষ্কার করে সামনের ছায়া মানুষটি নগ্ন। তার বলিষ্ঠ পুরুষ শরীরের প্রতিটা পেশী এই অন্ধকারেও আঙ্গুলের ডগায় স্পষ্ট বুঝতে পারে তিস্তা, হালকা ঘামে ভিজে রয়েছে শরীরটা। কিসের আঁচে কে জানে, যেন জ্বরে পড়ার মত প্রবল উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে সামনের মানুষটি। এতক্ষণ কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও স্থির হয়ে গিয়েছিল ছায়ামূর্তি, যেন অপেক্ষা করছিল তিস্তার জন্য, তিস্তার অস্থিরতা উপভোগ করছিল প্রাণ ভরে। এইবার হাত বাড়ায় সে।
প্রবল আগ্রহে আলোড়িত করে তিস্তার গভীর গোপনতা, পুরুষালি দংশনের সামনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার ধোপদুরস্ত কর্পোরেট পোশাক, রক্তাক্ত ঠোঁটের উপর চেপে বসে আরেক জোড়া পুরু, রুক্ষ শুকনো ঠোঁট। বুকের আবরণ সরে যায়, কোমল মসৃণতার মাঝে অদ্ভুত উদ্যমে অনধিকার প্রবেশ করে অবিন্যস্ত, খসখসে চুলে ঢাকা একটা আগ্রাসী মাথা। তিস্তা বাধা দেয়। ভারী শরীরের সমস্ত ভার নেমে আসে তিস্তার উপর, দমবন্ধ লাগে তার।
তিস্তা ভীষণভাবে বাধা দিতে যায়, সে সত্যিই বাধা দিতে চায়। তারপর মাথাটা চেপে ধরে বুকের মধ্যে।
মুহূর্ত কেটে যায়।
অনেকগুলো নি:শব্দ, অস্থির মুহূর্ত।
দামাল শরীরটার পেষণের নিচে রাগ, ঘৃনা আর অসহায়তার ঝাঁঝালো ককটেলে ভেসে যায় তিস্তা, খড়কুটো না পেয়ে ডুবতে থাকে ধীরে ধীরে।
টাটকা তৈরি হওয়া অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন লুকিয়ে পড়ে তিস্তার পেলবতার ভাঁজে ভাঁজে।
অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের সাক্ষী হয় না কেউ।
(২)
আজ তিনদিন পর অফিসে এসেছে তিস্তা। নিজের কিউবিকলে চুপ করে বসে আছে। সামনের ডেস্কটপ স্ক্রিনের রঙিন ছবি আর চলমান অক্ষরগুলোর কোনো অর্থ ফুটে উঠছে না তার বধির মস্তিষ্কে।
সেইদিন কতক্ষন ওই ঘরের মধ্যে সে পড়েছিল তা মনে পড়ে না। ঘন্টা দুয়েক? না চারেক? রাতে অফিস বন্ধ করতে এসে দারোয়ান মাধবদা অচেতন তিস্তাকে খুঁজে পায় সার্ভার রুমের মেঝেতে। মাধবদাই একটা ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে তাকে, একটাও প্রশ্ন করেনি লোকটা।
বাড়িতে ফেরার পথে জ্ঞান ফিরেছিল তিস্তার। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, দু পায়ের ফাঁকে আগুন জ্বলছে। সেখানে যেন করাত চালিয়েছে কেউ কিংবা নিপুণ হাতে ছেনি হাতুড়ি দিয়ে তুলে নিয়েছে যাবতীয় ছাল-চামড়া-মাংস। পা দুটো টেনে টেনে কোনরকমে নিজের ঘরে ঢুকতেই জ্ঞান হারায় আবার। সেদিন রাত থেকেই প্রচণ্ড জ্বর আর মাথা যন্ত্রণা। তারপর গত তিনদিন কিভাবে কেটেছে ঠিক স্পষ্ট না তার কাছে। একটা আঙ্গুল নাড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তার। ফ্ল্যাটমেট সৃজিতা এই কটাদিন এভাবে না সামলে নিলে তিস্তার কি হতো জানে না সে।
আরও অনেক কিছুই জানা বাকি তার। এই তিনদিনের স্মৃতি ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো আলগাভাবে লেগে রয়েছে তার স্মৃতিতে, জোর করলেই ফস্কে যাচ্ছে বেমালুম। তার চেয়েও আবছা সেদিন রাতটা। এই মাঝের কটা'দিনে যতবার জ্ঞান ফিরেছে তার, অনেকগুলো প্রশ্ন নিজেকে বারবার করেছে তিস্তা। শারীরিক না কি মানসিক, কোন নির্যাতন তাকে বেশি বিদ্ধস্ত করেছে, শুষে নিয়েছে সবটুকু প্রাণশক্তি? শরীর খারাপের জন্যই কি জ্ঞান নেই তার, না জ্ঞান ফেরাতে চায়না বলেই তার অবচেতন মন অসুস্থ করে রেখেছে তাকে? নিজেকে ঘৃনা হয় খুব, তারপর আর বেশি ভাবতে পারে না সে, জ্ঞান হারায় আবার।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তিস্তা, বেরিয়ে আসে ফ্লোর থেকে। তারপর সোজা লিফ্ট দিয়ে নেমে যায় গ্রাউন্ড ফ্লোরের দরজায়। তাকে সামনে দেখে একটু চমকে ওঠে মাধব।
কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে তিস্তাকে।
"মাধবদা, তুমি জানো ওখানে কে ছিল? জানো তাই না?"
চুপ করে থাকে মাধব। গটগট করে এগিয়ে এসে মাধবকে কলার ধরে দাঁড় করায় তিস্তা, তারপর চিৎকার করে উঠে বলে,
"তুমি জানতে? বলো জানতে না? একটাও প্রশ্ন করোনি কেন আমায়? একবারও জিজ্ঞেস করলে না কি হয়েছে আমার সাথে। সব জানতে তুমি। মাধবদা…মাধবদা তুমিই কি সেদিন ওখানে…”
"না না, ম্যাডাম। ভুল ভাবছ তিস্তা ম্যাডাম। আমি না। আর আমি জানিনা ও'কে। কেউ বলে কোনো এক পাগল, কেউ বলে ব্রিটিশ আমলের সাহেবের প্রেতাত্মা। আমি সত্যিই বুঝি না। তবে তোমার সাথে কি করেছে জানি আমি, তুমি প্রথম না। কম দিন তো আমার হল না এই বিল্ডিংয়ে", তিস্তাকে থামিয়ে দিয়ে চেনা উত্তর মুখস্ত পড়ার মত গড়গড় করে বলে যায় মাধব। তার চোখ মাটির দিকে, গলার স্বর শুনে ক্লান্ত মনে হয়।
বিশ্বাস হয় না তিস্তার। "ভূত-প্রেত আমি মানিনা। আর অশরীরী আত্মার ওরকম শরীর থাকে না মাধবদা। এটা দু'হাজার তেইশের কলকাতা। তালাবন্ধ মাটির নিচের ঘরে পাগলই বা কেমন করে ঢুকবে মাধবদা? মিথ্যে মিথ্যে, সব মিথ্যে বলছ তুমি। আমি বুঝেছি। অফিসেরই কেউ, আমি বুঝেছি মাধবদা। তোমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে তাই না?"
শেষের কথাগুলো ঠিক শোনা যায় না, চোখের জলে চাপা পড়ে যায় শব্দ, কান্নায় ঢেকে যায় ঘৃণ্য নিষিদ্ধ ভাবনাগুলো।
তিস্তা বুঝতে পারে না সেদিনের ঘটনাটা তাকে ঠিক কিভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। কিভাবেই বা ব্যাখ্যা করবে সে পুরোটা?
ব্যাপারটা একটা মোটা দাগের নোংরা ধর্ষণ ছাড়া আর কিই বা বলা যায়। কিন্তু তার শরীর তাহলে ওভাবে সাড়া দিল কেন সেদিন! গায়ের জোরে তাকে অধিকার করে যখন নিজের দৃপ্ত পৌরুষের আঘাতে আহত করে চলেছিল সেই ছায়ামানুষ, কেন তাকে আরো নিবিড় করে আঁকড়ে ধরেছিল সে?
সে কি চায়নি আরেকটু গভীরে প্রবেশ করুক সেই মানুষটি, আরো বিশদে ছিন্নভিন্ন হোক তার নারীত্ব। একবার নয়, পরপর দুবার উপগত হয়েছে সে, সুখের বিরল জোয়ারে ভেসে যাওয়ার মুহূর্তে ক্ষণিকের আত্মসমর্পণ করেছে অজানা আগন্তুকের হাতে। স্রেফ একটা ধর্ষণ নামের শব্দ কি সেই কয়েক লক্ষ নিউরোনের প্রান্তভাগ দিয়ে সেকেন্ডের ব্যবধানে আলোর বেগে ধাবমান অনুভূতির মিশ্রণকে যথাযথ ব্যাখ্যা করতে পারে? অথচ তার মাথায় এই চিন্তাগুলো আসা যে পাপ। অনুমতি ছাড়া তার শরীর স্পর্শ করার অধিকার কারোর নেই, কারোর।
সমাজ না, বরং প্রকৃতি তাকে নিজের উপর সেই মালিকানা দিয়েই পাঠিয়েছে এই পৃথিবীতে। সেই গণ্ডি লঙ্ঘন করার অপরাধের মাশুল দেবে কে? দ্বিধাবিভক্ত তিস্তা আবিষ্কার করে, অনুমতি শুধু মৌখিক কিংবা তাত্ত্বিক নাও তো হতে পারে। বরং কখনও কখনও অনেক বেশি দৈহিক নয় কি? শরীর যে ডাকে উল্লাসে সাড়া দেয় তার কি কোনো মূল্য নেই? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজে সে, খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়। সমাধান মেলে না। অথবা জেনে ফেলা সমাধানগুলো স্বীকার করার সাহস থাকে না তার, তাই উত্তর খুঁজে পেয়েও আদপে উত্তর গ্রহণ করে না সে। স্রেফ পাশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে চলে, আরও বেশি করে হারিয়ে যায় রহস্যের জালে। সেটাই তার মুক্তি। অন্তহীন সময় আরেকটু দ্রুত লয়ে পালিয়ে বেড়ায় তিস্তার থেকে। সিঁড়িতেই বসে থাকে তিস্তা, নিঃশব্দে আর ভীষণ যত্ন নিয়ে কাঁদতে থাকে।
কয়েক মিনিট কিংবা কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। তিস্তা উঠে দাঁড়ায়। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বিল্ডিংয়ের পিছনের সেই সিঁড়িটার দিকে। নামতে থাকে, নামতে নামতে এসে দাঁড়ায় সেই ঘরটার সামনে। সেখানে আজকে কোনো তালা ঝুলছে না!
যতটা অবাক হওয়ার কথা তার কিছুই প্রকাশ পায়না তিস্তার চেহারায়। যেন সে জানত যে আজ খোলা থাকবেই। একটা ঠেলা দেয় সে, একটুও শব্দ না করে খুলে যায় দরজাটা।
ভিতরের ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে অজস্র ইলেকট্রনিক আলোর লাল সবুজ বিচ্ছুরণ, যেন কয়েক হাজার জোনাকি ঐক্যতানে ডানা মেলেছে অবশ্যম্ভাবী কিছু আশঙ্কায়। তার ভিতরে কোথাও কোথাও অন্ধকার যেন একটু বেশিই নিরেট।
তিস্তার কান্না থেমে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। শুধু মাথার ভিতর আলোড়নটা চলছে এখনও। আর মাত্র কয়েক পা, এইটুকু ব্যবধান পেরোলেই ঘরের ভিতর ঢুকে পড়বে সে। ওই অন্ধকারে কি আজকেও আছে সে? হয়তো তারই অপেক্ষায় দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে গত তিনদিন ধরে। ও কে? কি করে পারল এমন? বিভৎস ঘৃণাকে অতিক্রম করে বিরল তৃপ্তি পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছল সে? হেরে গিয়েও এত আনন্দ পাওয়া কিভাবে সম্ভব, তার ব্যাখ্যা নেই তিস্তার কাছে।
অশরীরী আত্মা কিভাবে অমন ঝড় তুলতে পারে শরীরের আনাচে কানাচে। ধুস। আচ্ছা, অফিসের কেউ কি হতে পারে? অথচ এমন রুক্ষ, অমার্জিত, অসভ্য চেহারা তো কারোর নেই তার দামী অফিসে।
চারিদিক ফাঁকা হতেই প্রশ্নগুলো আবার ঘিরে ধরেছে তিস্তাকে, পাথর ছুঁড়ছে তার দিকে, রক্তাক্ত করে চলেছে তার চেতনা।
গত মাসের এক উইকেন্ডে অফিস যখন বিকেলের দিকে প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছিল, কেবিনে ডেকে একরকম তার 'অনুমতি' নিয়েই শরীরে হাত দিয়েছিলেন, তাকে দিয়েই পোশাক খুলিয়ে তার উদ্ভিন্ন যৌবনের স্বাদ নিয়েছিলেন তার উপরতলার এক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। সেটা তো তাহলে ধর্ষণ ছিল না তাই না? কিন্তু তবে কেন সাড়া দেয়নি শরীর? মুখের হাসি দিয়ে ভিতরের যন্ত্রণা মুছে দিতে পারল কি?
কিংবা যখন প্রতিরাতে তার বিদ্ধস্ত ক্লান্ত শরীরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় পার্টনার সিদ্ধার্থর লোভী হাতটা, আর সেই সিদ্ধার্থর উত্থিত বুভুক্ষু পুরুষাঙ্গকে চুম্বনে, লেহনে শ্রান্ত, নিঃশেষিত করে ঘুম পাড়াতে হয় বাধ্য, আদর্শ স্ত্রীয়ের মতো- সেখানে তো ধর্ষন কেন, অনুমতিরও প্রশ্ন আসে না তাই না? কারণ অনুমতি দেওয়ার দায়িত্বে আদৌ সে নেই, আসলে কোনোদিনই কেউ ছিল না, অন্তত তিস্তার মতো কেউ থাকে না। গ্র্যাজুয়েশনের সমাজতত্ত্ব পড়তে গিয়ে একটা শব্দ জেনেছিল তিস্তা। "More", যার মানে, সমাজের কিংবা মানুষের ঠিক করে দেওয়া ঠিক ভুলের নিয়ম। মানুষ মানে কারা? বইয়ে অবশ্য লেখক সেটা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলেন।
অসহ্য লাগে তিস্তার। যত সময় যায় বাড়তে থাকে মনের ভার। প্রশ্ন করতে জানার ক্ষমতাই সম্ভবত মানুষের একমাত্র সুপার পাওয়ার, এবং নিশ্চিত ভাবেই সবচেয়ে বিপজ্জনক পাওয়ার। একটি অনুচিত প্রশ্ন ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার চেয়েও দ্রুত, পারমাণবিক বোমার চেয়েও অনেকগুণ বেশি বিধ্বংসী। রক্তাক্ত মনটা নিয়ে কোনরকমে আরো কয়েক পা এগিয়ে যায় সে।
ঢুকে পড়ে ঘরটার মধ্যে। তার সামনে এখন একটা দেওয়াল, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে।
অন্ধকার জমাট বাঁধা বিশাল দেওয়ালটা…সব উত্তর অথবা আরো হাজারটা নতুন প্রশ্ন অপেক্ষা করছে ওই দেওয়ালের ওপারে। কিংবা হয়তো কিছুই নেই, স্রেফ ফাঁকা একটা যান্ত্রিক শূন্যতার সম্মুখীন হবে সে। ঠিক হাইজেনবার্গের পরীক্ষার মতই, সবই তার কাছে স্রেফ সুষম সম্ভাবনা। এই দেওয়ালের এপার থেকে দেখলে ওপারে একইসাথে বাস করে কয়েক হাজার সমান্তরাল বাস্তবতা।
তারপর অন্ধকারের মধ্যে স্রেফ মিলিয়ে যায় সে। দরজাটা শব্দ করে বন্ধ হয়।
