‘ধারা’র বহমানতাই স্রোতের অনুকূল, কিন্তু সেই ‘ধারা’কে উলটে দেখুন কী পাওয়া যায়? সহজ উত্তর ‘রাধা’। সত্যিই সহজ! খুব সহজ! কিন্তু আসলে কি সহজ? একেবারেই নয়, পদাবলির রাধাকে ‘ধারা’র বিপরীতে গিয়ে কৃষ্ণপ্রেমের হ্লাদিনী শক্তি হতে হয়েছিল। স্রোতের বিপরীতে হেঁটেই আজও রাধার কৃষ্ণপ্রেম জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেছে। তাঁর প্রেমের সর্বোচ্চ সীমা স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণও বুঝে উঠতে পারেনি। তাইতো রাধার প্রেমকাহিনি ধারার বিপরীতে গিয়েও শ্রেষ্ঠ প্রেমের তকমা পেয়েছে।
আজকের সমাজেও এমন অনেক প্রেমের সম্পর্ক আছে, যেখানে সমাজ স্বীকৃতি না দিলেও প্রেমের শুদ্ধতায় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সে সম্পর্ক পরিণতি পেয়েছে। সেই ধরনের সম্পর্কের কথা আমরা খুব কমই জানি বা জেনেছি। কিংবা হয়তো খ্যাতির বিচারে সেই সম্পর্কের পরিণতিদানে প্রেমিকাসত্তা উপেক্ষিত হয়েছে বারে বারে।
আমরা সকলেই ‘পথের পাঁচালী’র স্রষ্টা বিভূতিভূষণকে এক নামে চিনি, জানি। তাঁর অমোঘ সাহিত্যকীর্তি তাঁকে কেবল বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্বসাহিত্যেও অমর করে রেখেছে। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় পত্নী রমাদেবীর কথা আমাদের নামমাত্র শোনা। তাঁর প্রেমের শুদ্ধতায় স্রোতের বিপরীতে গিয়েও তাঁদের ঊনত্রিশ বছর বয়সের ব্যবধানের সম্পর্ক পরিণতি পেয়েছে। কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টির সুবাদে বিভূতিভূষণ খ্যাতির শিখড়ে পৌঁছোলেও চির উপেক্ষিতায় হয়ে রইলেন রমাদেবী। আজ আমরা সেই উপেক্ষিতা রমাদেবীর স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার কাহিনি শুনব।
আজ থেকে তিরাশি-চুরাশি বছর আগেকার কথা৷ রমা’র তখন সতেরো-আঠারো বছর বয়স ৷ রম’র বাবা ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আবগারি দপ্তরের আধিকারিক। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি বদলি হয়ে আসলেন বনঁগা শহরে৷ রমা’র হৃদয় তখন সাহিত্যপ্রেমে ভরপুর৷ সেখানে এসেই রমাদেবী এক প্রতিবেশীর কাছে খবর পেলেন ‘পথের পাঁচালী’র স্রষ্টা বিভূতিভূষণেরও বাস এই শহরেই। অনুভূতিতে জেগে উঠল প্রিয় লেখকের সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছা, সুতরাং আর বিলম্ব না করে সোজা চলে এলেন লেখকের বাড়ি৷
বাড়ির ভিতরে খবর যেতেই লেখকের ভাগনি উমা মাদুর এনে বারান্দায় পেতে বসার অনুরোধ করলেন ৷ কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে এলেন বিভূতিভূষণ, রমার হাতে তখন অটোগ্রাফের খাতা, চোখেমুখে খুশির দীপ্তি৷ আর লেখকের মুখে তখন বেদনার ছাপ স্পষ্ট। কথোপকথন চলাকালীনই রমা বাড়িয়ে দিলেন অটোগ্রাফের খাতা, সেই খাতায় বিভূতিভূষণ লিখে দিলেন— “গতিই জীবন, গতির দৈন্যই মৃত্যু”৷ সেদিন কেই-বা জানত, রমাদেবীর জীবনে সেই গতির বাহক তিনিই হবেন!
তবে এবার বাড়ি ফেরার পালা, শেষমেশ রমাদেবী লেখককে তাঁদের বাড়ি আসার জন্য অনুরোধ করলেন আন্তরিকভাবে ৷ উত্তর এল নিশ্চয়ই তিনি একদিন তাঁদের বাড়ি যাবেন কিন্তু সঠিক দিন তিনি বলতে পারছেন না, কারণ তাঁর বোন জাহ্নবিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! সঠিকভাবে অভ্যর্থনা না করতে পারার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করলেন লেখক৷
অটোগ্রাফ নিতে এসে আলাপচারিতা। তারপর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব। ২৯ বছর ব্যবধানের দুই নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব, চিঠি চালাচালি আর একবছরের মাথায় বিবাহ। রমাদেবী বুঝেছিলেন যোগাযোগ ছাড়া কোনো সম্পর্ক হয় না, সম্মান ছাড়া কোনো ভালোবাসা হয় না আর বিশ্বাস ছাড়া কোনো সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই বাড়িয়ে দিলেন বিয়ের হাত, অবশ্য বিয়ের প্রস্তাবও তিনিই দিলেন। কিন্তু অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটি সময় চাইলেন। তিনি রমাকে নানাভাবে বোঝালেন। বয়সের বিস্তর ফারাককে সামনে এনে গল্পপ্রেমের মোড় ঘোরাতে চাইলেন। কিন্তু বয়সের অসম্ভব তফাতকে একেবারে গুরুত্বই দিলেন না রমা৷ তাঁর কাছে সম্পর্ক হয়ে উঠল বয়সের নয়, মনের মিলন। শুরু হল স্রোতের বিপরীতে হাঁটা। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই রমাদেবীর মণিকোঠায় জায়গা করে নিল তাঁর সেই অনুভূতি—“এই দুনিয়ায় চেনা মানুষের সংখ্যা অনেক হলেও তাদের মধ্যে খুব অল্প কেউ হয় ‘আপনার মানুষ’…‘কাছের মানুষ’।’’ আর পেয়েও গেলেন সেই কাছের মানুষকে।
‘পথের পাঁচালী’র স্রষ্টা বিভূতিভূষণ প্রায় ২০ বছর ছন্নছাড়া জীবন কাটিয়েছেন। ১৯১৯ সালে প্রথম বিয়ের এক বছরের মাথাতেই মারা যান স্ত্রী গৌরীদেবী। দীর্ঘ একাকিত্বের পর, ১৯৪০-এর ৪ ডিসেম্বর রমাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁদের সুদীর্ঘ বয়সের ব্যবধান কেবল বিয়েতে নয়, দুজনের স্বামী-স্ত্র’র দাম্পত্যজীবনেও কোনোদিন প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারেনি৷
রমাদেবী প্রায়শই তাঁর ছেলে এবং বউমাকে বলতেন মরতে তিনি ভয় পান না কারণ ওপারের ঘাটে অপেক্ষায় আছেন তাঁর স্বামী বিভূতি৷ বিভূতিভূষণের প্রথম পত্নী গৌরীদেবীর মৃত্যুর পর লেখক আর নতুন করে বিয়ের কথা কোনোদিনই ভাবেননি, কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় অন্য কিছু৷ শেষপর্যন্ত কন্যাবয়সি রমাকে বিবাহ করেছিলেন এবং সেই সম্পর্কে ভালোবাসার বাঁধন ছিল দৃঢ়৷ সারাজীবনে রমাদেবী স্বামীকে মাত্র দশ বছর পেয়েছেন ৷ ১৯৫০-এর নভেম্বরে ঘাটশিলা শহরে বিভূতিভূষণ পাড়ি দিলেন নাম না-জানা দেশের উদ্দেশে। তারপর তিন বছরের শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এলেন রমাদেবী। এরপর তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন স্বামীর প্রচার আর স্মৃতিবর্ণনে৷
বিভূতিভূষণের ডাইরির পাতা থেকেই পাওয়া যায়, তাঁদের প্রেমের গভীরতার অমোঘ স্মৃতি— “সেই দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে অন্ধকারে দূরের একটি নিরীহা প্রেমময়ীর কণ্ঠস্বর কেবলই কানে আসে, কান্না পায় যেন। কল্যাণী (রমাদেবীর ডাকনাম)! আর কি তোকে দেখতে পাবো? কেন এমন মন হল? মেসে এসেই আগে ঘর খুলে দেখেছি দোরের পাশে ওর চিঠি এসে পড়ে আছে কিনা। আছে, আছে! ভগবান তোমায় অজস্র ধন্যবাদ। সত্যিই এমন অদ্ভুত মনের অবস্থা আমার কেন হল আজ? চিঠিখানা ওর আজ বড় সুন্দর। কতবার পড়লুম যে! তোকে ক্রমে ক্রমে চিনচি, কল্যাণী! কত ভাগ্যে তোর মতো স্ত্রী পাওয়া যায়। হৃদয় আছে তোর। ভগবানকে আবার ধন্যবাদ দিই যে ওকে পেয়েচি।’’ তারপরই লিখলেন—“কল্যাণীকে পত্র লিখলুম সকলের আগে, কারণ সারারাত স্বপ্নের মধ্যেও ওর কথাই মনে এসেচে।’’ আরেকবার, বনগাঁয় বিভূতিভূষণকে কাছে পেয়ে সারারাত গান শোনালেন কল্যাণী। শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়লেও, হাত ধরে রইলেন বিভূতিভূষণের, ‘পাছে পালিয়ে যাই ভোরের ট্রেনে’। এই প্রেমকাহিনি আমাদের স্মৃতিপটে রাধাপ্রেমেরই উদ্রেক ঘটায়।
এভাবেই প্রেমে ও বিরহে বিভূতিভূষণের ডাইরির শুকনো-মর্মর পাতা ভরে আছে। তরুণী স্ত্রী’র প্রতি তাঁর এই সমর্পণ ও উতলা ভাব সত্যিই আমাদের অবাক করে দেয়। দীর্ঘ একাকিত্বের পর কল্যাণী তাঁকে দিল পরমপ্রেমের শীতল আশ্রয়। আরণ্যকের লেখক সংসারের স্বাদ পেলেন কল্যাণীর কাছে এসে। স্রোতের বিপরীতে এসে কল্যাণী প্রমাণ করে দিল তাঁদের এই দাম্পত্য যে-কোনো প্রেমকাহিনিকে টেক্কা দিতে পারে। ‘সত্যি ও আমাকে বড় ভালোবাসে’—এই বিশ্বাস আঁকড়ে শান্তি পেলেন বিভূতিভূষণ, শুধু কি তাই! পেয়েছিলেন জীবন ও সাহিত্যসৃষ্টির রসদ। সেদিনের বয়সের ফারাক-কে তোয়াক্কা না করে ফুঁ-দিয়ে উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন বলেই, তাঁদের দাম্পত্যকাহিনি কত নরনারীর দাম্পত্যজীবনকে আদর্শের পথে নিয়ে যেতে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে তুলেছে।
কেবল ভারতবর্ষ নয় সারা পৃথিবী রমাদেবীর কাছে কৃতজ্ঞ। শত প্রলোভনে আর্থিক সমস্যার শিকার হয়েও 'পথের পাঁচালী'র চলচ্চিত্র রূপায়িত করার প্রস্তাব তিনি একমাত্র প্রবাদপ্রতিম সত্যজিৎ রায়ের হাতেই তুলে দিলেন ৷ তারপরের ইতিহাস কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা৷ মৃত্যুর আগে রমা বন্দ্যোপাধ্যায় আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রিয়জনদের কাউকেই চিনতে পারেননি। তবুও তিনি তাঁর রচিত বিভূতিজীবনীর প্রচ্ছদ দেখে ছেলেকে বলেন—“তোর বাবার ছবিটা খুব ভালো এঁকেছে রে...৷” সত্যি নিখাদ প্রেমের গভীরতায়—এই দাম্পত্যকাহিনির কাছে শতশত বাধাও হার মেনে যায়।
স্রোতের অনুকূলে গিয়েও, আমরা হাজারো চেষ্টা করে পারি না একজন মানুষকে সর্বকালের জীবনসঙ্গী করে রাখতে। পারি না কথা দিয়ে কথা রাখতে। আর অপর দিকের মানুষটা হাত ধরেও পারে না, সেই হাতের স্পর্শে থাকতে। তারা স্বপ্ন দেখায় ভবিষ্যতের তবে বর্তমান সাজাতে পারে না। আসলে তারা পারে না থেকে যেতে, আর আমরাও পারি না তাদের ধরে রাখতে। অথচ দেখুন স্রোতের বিপরীতে হেঁটে রমাদেবী কত সহজেই জিতে নিলেন বিভূতিভূষণের হৃদয়। কারণ একটাই, অটুট ভালোবাসার বাঁধন। দীর্ঘ বয়সের ফারাক আজও সেখানে ধুলোতেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাই, ভালোবাসো তাঁকে, ‘ভালোবাসায় ভালোবেসে বেঁধে যে রাখে!’
