অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
তৃতীয় কিস্তি
[৫]
দেবেন রায় মাসছয়েক হলো অবসর নিয়েছেন। সুগার-প্রেশারের সামান্য অত্যাচার ধরা পড়েছে। তবুও দেবেন রায় তৃপ্ত মানুষ। অর্থে, প্রতিপত্তিতে, সামাজিক প্রতিষ্ঠায় মোটামুটি একটা জায়গা করে নিয়েছেন। পাড়ায় দু'পাঁচজন মানুষ তাঁকে চেনেন জানেন। বেসরকারি কোম্পানির উচ্চপদস্থ চাকুরে বলে সম্মান করেন। তা উচ্চপদস্থ তো তিনি বটেই। গুডউইল এ্যাণ্ড হ্যানসেন কোম্পানিতে এ্যাকাউন্ট্যান্ট ক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। অবসর নিলেন শর্মা এ্যাণ্ড এ্যাসোসিয়েটসের এ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের সর্বময় কর্তা হিসেবে। কর্তৃত্ব তো একটা আছেই। তাই বলে কি ছোটোখাটো পদস্থলনও হয়নি তাঁর? হয়তো হয়েছে, হয়তো বা হয়নি। এসব এখুনি বিচারের সময় নয়। জোকার ওদিকে ছোট্ট একটা বাড়ি বানিয়েছেন দেবেন। স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ কিছু বছর। দেবেন রায় নিঃসন্তান। সারাদিনের একটি কাজের লোক আছে। এমন বিকেলের আশেপাশেই সে বাড়ি চলে যায়। তিনি তখন বাগানে এসে বসেন। প্রকৃতির শোভা উপভোগ করেন। এখন হেমন্তকাল। কলকাতা শহরে হেমন্ত উপভোগ করা প্রায় অসম্ভব। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ভিন্ন অন্য কোনও ঋতুকে এই শহর আর মনে পড়ায় না। দেবেন সামনের টেবলে রাখা চায়ের পেয়ালাতে চুমুক দেন। চা খাওয়া হয়ে গেলে পিরিচ-পেয়ালা দুটোকে তিনি নিজেই তুলে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে রাখবেন। প্লাস্টিকের টেবল-চেয়ার দুটো বাইরেই পড়ে থাকে। এ পাড়াতে ছিঁচকে চোরের উপদ্রব নেই। সপ্তাহে দু'দিন করে সুগারের জন্য ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিতে হয় তাঁকে। আজ সেই লোকটি আসতে দেরী করছে। দেবেন অলস ভঙ্গিতে গেটের দিকে তাকান। মালি আসে সপ্তাহে তিনদিন। বাগানটা মোটামুটি গোছানো। কিছু মরসুমি ফুলের গাছ। বেশি চাকচিক্য নেই। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ বোধহয় এইভাবেই চাকচিক্যহীন, অগোছালো জীবন কাটিয়ে দেয়। দেবেন রায় কোনওদিন পাহাড় দেখেননি। বেড়ানো বলতে পুরী, দীঘা আর বেনারস। স্ত্রী যখনই বেড়ানোর কথা বলতেন দেবেন রায় ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দিতেন। সুদ কত কমে যাচ্ছে, আবার কবে সুদ বাড়বে। আবার কোন মাসে টাকা ফিক্স করলে বাড়তি সুদ ঘরে আসবে। এই সব বলতে বলতে ক্রমশ আলোচনাটাকে অফিসের আর্থিক অবস্থার বিষয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলতেন। বলতেন, "এখন বেড়াতে গেলে কত চাপ জানো। কোম্পানির হাল ডুবুডুবু। কাগজপত্র থেকে শুরু করে আদায়পত্র, সবটুকুই যে আমাকে দেখতে হয়!"
গিন্নি একেকবারে বলেছেন, "থাক না বাপু, কার জন্যই বা এত কাঁড়ি কাঁড়ি যক্ষের ধন জমাচ্ছো! ছেলেপুলে তো . ." বলেই নিজের ভুল বুঝে চুপ করে যেতেন। দেবেন রায়ও আর ফিরে কিছু বলতেন না। কেউ কখনও দেবেনকে রাগতে দেখেনি। ঠাণ্ডা মাথার, মরা চোখের একজন মানুষ। কেবল টাকা জমানোতেই তাঁর আনন্দ। তাই বলে তিনি যে কিপটেমি করতেন, তাও নয়। কেবল সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতেই তাঁর সুখ। লোকে বলে তাঁর নাকি বেনামেও কিছু সম্পত্তি ছিল এক সময়। এখন সব বেচেবুচে দিয়েছেন। আসলে লোকে জানে, দেবেন রায়ের মতো ছুটকো-ছাটকা চুরি করা মানুষ পৃথিবীতে অনেক রয়েছে। তারা ঠিকই তাদের মতো করে জীবন কাটিয়ে দেয়। ঈশ্বরের অত সময় থাকে না এতজন পাপীতাপীর ভিতরে একেকজনকে খুঁজে পেতে এনে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার। জগৎটাই দাঁড়িয়ে থাকে দুর্নীতির উপর। দেবেন ব্যতিক্রম নন। সুগারের ইঞ্জেকশন দেওয়ার লোকটি এসেছে। দেবেন তাকে গেট পেরিয়ে আসতে বলেন। জামার আস্তিনটা গুটিয়ে নেন। কেবল দেবেন লক্ষ্য করেন না বড় রাস্তার উপর মুখে মাফলার জড়ানো একটা লোক হঠাৎই যেন দাঁড়িয়ে পড়ে স্থির দৃষ্টিতে তাঁর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। হেমন্তের কলকাতায় অল্প অল্প শীত জানান দিচ্ছে। বাতাস ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে। দেবেন রায় ইঞ্জেকশন নেবেন বলে হাত বাড়িয়ে দেন।
[৬]
চরিত্র বেড়ে উঠেছে। চরিত্রের বৈচিত্র্য বেড়েছে। নাকি সেও আসলে জীবনেরই ধর্ম? আমাদের চারপাশেই যে এমন কত মানুষের সমাহার। কত মানুষ একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত অথবা বিযুক্ত হয়ে একলাটিই অথবা গোষ্ঠীবদ্ধ জীব হিসেবে এগিয়ে চলেছে পরিণতির অভিমুখে। এনবিএসটিসির বাসটা যখন শিলিগুড়িতে এসে পৌঁছালো তিস্তাকে তখন আর একা একা মাল নামাতে হলো না। শালুক আর ওর বন্ধু দুজনেই হাত লাগাল। তিনজনেই ওরা তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে দার্জিলিংয়ের বাস ধরবে বলে ভেবে রেখেছিল। দরকার পড়ল না। তিনজনেই নিজেরা ঠিক করে নিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। আনন্দ কখনও একলাটি আসে না, আনন্দ সকলকে নিয়ে আসে। সকলকে নিয়েই আনন্দে মাততে হয়। গাড়ি ছুটেছে দার্জিলিং। ওদের সকলেরই এই প্রথম দার্জিলিং আসা। তিস্তা-নদী পেরুতেই ঘন সবুজ আর পাহাড়িয়া রাস্তা। চোখ জুড়িয়ে যায়। পথের বর্ণনা দেওয়ার তেমন একটা প্রয়োজন দেখছি না। শালুক ভাবছিল তিস্তার কথা। তিস্তা ভাবছিল শালুকের সঙ্গে পরিচয়। এমন হুড়মুড়িয়ে ভালো লেগে যাওয়াটা কি মানসিক সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ? অত ভাবতে নেই। অনেকদূরে পুনা শহরে তিস্তার মাও তখন তিস্তার কথা ভাবছিলেন। শালুকের বাবা ভাবছিলেন শালুককে নিয়েই। একা সন্দীপন এসমস্ত ভাবনার বৃত্তের বাইরে। সে সামনেটায় বসেছে। বুক ভরে হাওয়া নিচ্ছে পাহাড়ের। ঠাণ্ডা এখানে বেশ। সন্দীপনের অসুবিধে হয় না। সে শীতে অভ্যস্ত। শালুক একটা মাফলার জড়িয়ে নেয়। সবুজ, বড় সবুজ। এমন ভাবে চলতে চলতেই যদি অনেকদূরে হারিয়ে যাওয়া যেত? মানুষ হারাতে চায়। হারাতে পারে না। কোনও না কোনও সময় তাকে ফিরেই আসতে হয়। যেমন ভাবে অরুণজ্যোতি ফিরে আসেন। ফিরে আসেন শাল্মলী অথবা অভ্যুদয়।
শাল্মলীর মনে পড়ে কলকাতা ময়দান। চিনেবাদাম। সময়টা নব্বই দশক। তখনও হলুদ কালো ট্যাক্সি ছুটে চলে কলকাতায়। ময়দানে তাঁবু পড়ে সার্কাসের। সিনেমা হল বলতে তখনও মাল্টিপ্লেক্স বোঝেনি কেউ। শাল্মলী আর অভ্যুদয় ময়দানে ঘুরে বেড়ান। গভীর, গভীর এক বেদনাতে সেই সময় ডুবে থাকেন অভ্যুদয়। তাঁদের হাতের উপরে হাত পড়ে। শাল্মলীর হাতটাকে দু’হাতে আলতো করে চেপে ধরতে চান তিনি। তাঁর পুরুষকার তাঁকে সে কাজ করতে দেয় না। শাল্মলীকেই কাজটা করতে হয়। তিস্তা অথবা শালুক সে কথা জানে না। তারা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের উপর। খাদের পাশের কোনও দোকানে কোথাও চা খাচ্ছে বোধহয়। তাদের কাপ থেকে ওঠা ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছে পাহাড়ের ঘ্রাণ। অভ্যুদয় শাল্মলীর দিকে তাকান। হু হু করে একটা ধুলোর ঝড় ওঠে। ময়দানের ডানপাশে তখনও হাইরাইজ বলতে চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল অথবা টাটা স্টিল। বেলুনওয়ালা এগিয়ে এসেছে। টুং টুং ঘণ্টা বাজছে তার।
-“একটা গান ধর না অরিন্দম,” সন্দীপন বলে ওঠে। শালুক লজ্জা পেয়ে যায়। তিস্তা চায়ের কাপ থেকে মুখ তুলে তাকায়, “আপনি বুঝি গান গাইতে পারেন?” শালুক আরও লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ে, “না না, একটুও না। একেবারেই না। ও মজা করছে আপনার সঙ্গে।” সন্দীপন এইবারে চোখ পাকিয়ে তাকায়, "মজা করছি আমি? গাইবি না সেটা বল। অত পাত্তা নেওয়ার কি দরকার?” সে চুপ করে যায়। তিস্তা হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে রয়েছে। শালুক কাঁধ ঝাঁকায়। “পরে থামতে বলবেন না কিন্তু!” গান ধরে দেয়। গান গাইতে শালুকের ভালো লাগে। কত দূরদূরান্তের মানুষকেও একজোট করে তোলে এই গান। সুর জিনিসটা বড় পবিত্র। তিস্তাও কখন যেন গলা মেলায়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গান ছড়িয়ে যায়। অঞ্জনের সুর। চলো লেটস গো!...
ওরাও চলেছে দার্জিলিং! সুর বাড়ছে। গাড়ি স্টার্ট দেয় আবার।
কলকাতায় ইজিচেয়ারে বসে অরুণজ্যোতি আবারও তাঁর হাতের তাস উলটিয়ে রাখেন। পেশেন্স খেলে আর সময় কাটছে না।