দোঁহা

শতদল মিত্রের উপন্যাস


 আধেকজান

 

(পর্ব #১৭)

     ওদিকে ততক্ষণে উদ্দালকের নজর টানে শিবতলার সাজার ইঁদারাতলার পাশে টুলে বসা একটি যুবককে ঘিরে নারী-পুরুষ বহু মানুষের থোকা হয়ে ফুটে থাকা, তার গুঞ্জনধ্বনি।  

     --সায়নদা, ওখানে ভিড় কিসের?  

     --রেশনকার্ডের সঙ্গে আধার লিঙ্ক হচ্ছে। সারা গাঁয়ের মধ্যে ওখানেই একমাত্র নেটের ফুল টাওয়ার পাওয়া যায় কিনা!

     ফলত বিস্মিত উদ্দালকের মনে ‘ডিজিটাল ভারত’—এ ছবিখানি তার সরকারি সংজ্ঞায় আটনপ্রাপ্ত হয়।

     --এই দুটো লাস্ট। আর আজ নয়। গাজনবাদ পয়লা বোশেখ আবার।

     --তা বললি তো হবে না কন্টোল দোকানি। আমরা ‘দিদি’কে বলে দুবো কিন্তুক।

     এ কথায় হাসির হুল্লোড় ওঠে, যা নিরীহ রস মজায়, যে রসে কথারা ডোবে-ভাসে।   

     --তা বল গে কেনে? এখন ভোটের সময়। দিদিও নাই, ‘দুয়োরে সরকার’ও নাই।

     --ভোটবাদ আবার ‘দাদা’কে বলতে হবে কিনা দেখ আগে! তখুন আবার যমের দুয়োর দেখাবি না তো দোকানি? হাঃ, হাঃ!

     সে ভিড় দুলে দুলে হেসে ওঠে আপন রসে, যা চারায় উদ্দালকের মনেও, আর সেখানে যমের দুয়োর কথাটি ভেসে ওঠায় পরশুর সাঁঝমাখা গুহ্য লব্জটি ঘাই মারে ওর সুপ্ত মগজে।

     --আচ্ছা সায়নদা, সেদিন নিতাইকাকা যমের দুয়ারে হত্যে দেওয়ার কথাটা বলছিল... তার মানে কী? ভদ্রতাবশত ও ওর ছোটোদাদুর প্রসঙ্গটা ঊহ্যই রাখে।

     --হাঃ হাঃ! যমের দুয়োর বলতে এখানে লোকে মজা করে জে-ডি, যাদব দত্তকে বলে। ঈশ্বরপুরের, আমাদের গাঁয়েরও জমিদার ছিল যাদবকৃষ্ণ দত্ত। জমিদার, আবার শিল্পপতিও। কয়লাখনি, আরও অনেক ব্যবসা ছিল তার। ব্রিটিশ আমলে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান, স্বাধীনতার পর কংগ্রেস এমএলএ। এখন ওর ছেলেরা—বিশাল ব্যবসা, বিশাল টাকা। ডাইরেক্ট পার্টি করে না, কিন্তু সব পার্টিই ওদের টাকার বশ। জে॰ ডি॰ অ্যান্ড কোং নামে ওদের বাংলা মদের ফ্যাক্টরি আছে। তাই এলাকার লোকেরা মজা করে জেডি-র বাংলা মদকে যমের দুয়োর করে নিয়েছে।

     --সত্যি, গ্রামের লোকেরা পারেও! অল্পতেই বাঁচার আনন্দ খুঁজে নেয়।

     --ওইটুকু আছে বলেই গাঁ-গঞ্জ বেঁচে আছে আজও।

     ওরা দু-ভাই বাড়ির পথ ধরে।

 

ঢাকের দগর বোলে, ডিজে-র উদোম তালে দুপুর আজ বিকেলের পানে ঢলে যায় আচমকাই যেন, সে যাত্রায় আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের নিঃসাড় ভেসে ওঠাও থেকে যায়, এ প্রাকৃতকতায় ধূসর প্রেক্ষাপটে দুধসাদা এক বক ক্রেংকার তুলে উদ্দালকের দৃষ্টিসীমায় বন্দি হলে নাগরিক তার মনে এক অতিলৌকিক ছায়া জাল ছড়ায়, যে ছায়ায় শিকড়ের মাটি-মগ্নতা। ফলে সে, উদ্দালক সায়নকে ভাতঘুম দুপুরে না ডেকে একাই বার হয় পথে।

     শিবতলা লোকে লোকারণ্য যেন, যে অরণ্য ভূমিজ, কেননা ডোমপাড়া-বাগদিপাড়ার গোটাটাই সে স্থানে ভেঙে পড়েছে যেন, যেহেতু সে ক্ষণে উদ্ধারণপুর ঘাট থেকে ভক্তের দল ঘট ভরে ফিরে এসেছে। পথের ওপারে মন্দির লাগোয়া জোড়া খেজুরগাছের তলায় বাঁশের তৈরি মাচায় ভক্তদের ঘটভর্তি বাঁকগুলো থরেথরে জিরেন নেয় যেন, যে জিরেন ভঙ্গি আটচালায় এলায়িত ভক্তদের দেহজুড়েও, যদিও তাদের চোখে ক্লান্তিকে ছাপিয়ে কৃচ্ছসাধনার প্রশান্তি জাগে। এ সমাগম, পবিত্র যা, ব্যস্ততা আনে সন্ন্যাসীদের মধ্যে, জাগ ওঠে ঢাকের বোলে।

     ঢাকের বোলে, ধুনোর ধোঁয়ায় বাণেশ্বরের স্নানযাত্রা এগিয়ে চলে ধরমগড়ের বিলের জাদুরঘাটার পানে, যে যাত্রায় পথ আঁকে সেই গঙ্গাপবিত্র ভক্তের দল, আরও কিছু মাটিমগ্ন-লোকজ মানুষ, সেই সঙ্গে আপামর কৈশোর। না, বাবুপাড়ার কাউকে নজরে পড়ে না।

     ছোটোবেলার বিলকে খুঁজে পায় না উদ্দালক-- দিগন্তজোড়া, নদীপারা, চোখের দৃষ্টিসীমায় অধরা সে বিল মজাডোবা যেন আজ। মানুষের লালসা লুট করে নিয়েছে তার জলের অহংকার, স্বপ্নের স্রোতচিহ্ন, যেহেতু কথিত যে বহু জন্ম আগে বামনিনদী নাকি বয়ে যেত এই খাত বরাবর। তবু এ গ্রীষ্মেও সবুজ দামের মাঝে টলটলে জল জাগে তার প্রাচীন অভিজাত্যে, এ কারণে যে পুরাণ প্রবাদ আজও বয়ে যায়— বাণেশ্বর দেবের এ জাদুরঘাট নেমে গেছে নাকি পাতাল বরাবর। এই তো সি দিনও শোকার বড়বাবা কিংবা তার বড়বাবা তেসাঁঝের বেলা চান করতে নেমে আর উঠে আসে নাই। ফলত কাল গোলায়, তবু প্রবাদ প্রবাহমান। যদিও সে প্রবাহ মানুষের মাটির লোভ, তার দখলদারিত্বে দাগ কাটে না বোধহয় আজ আর!

     দাম চিরে একটি জলরেখা গিয়ে মিশেছে সে প্রাচীন টলটলে জলে, যা কাকচক্ষু, যেখানে আকাশ মুখ ভাসায়, সে আকাশমুখি জল ভেঙে সন্ন্যাসীরা ডুব দেয়, চান করায় যত্নে, যে ঢঙে পবিত্রতা শব্দটি জাঁক পায়। ঢাক বাজে কাঁসির সঙ্গতে, যেন বা ব্রহ্ম জাগে ছায়ামাখা বিকেলময় এ উন্মুক্ত চরাচরে। এ দৈবে স্থাণুবত্‍ সে মানুষগুলো সে ক্ষণে, যারা জাগতিক বাস্তবতায় এতক্ষণ বিলের দখলদারি মাটিতে রোয়া খরার আদুরেহলুদ পোয়াতিধান কেটে রাখছিল উঁচু আলে, যদি কিছু ধান বাঁচে, কেননা দুদিনের বৃষ্টির জল জমিতে তিরতির দেয়ালা করে আগামী বৃষ্টির সুখে। এ অঞ্চলের জলহীন রুখু মাটিতে যে সামান্য বোরো চাষ, তা এই বিলের গাবায়, আর বামনিনদীর দু-পাড়টুকুতেই।

     বাণেশ্বরের সে শোভাযাত্রা ফিরে আসে শিবতলায়, সেখানে তখন সারা গাঁয়ের মানুষ ফুটে থাকে যেন আনন্দে-রীতে, ফলে ধ্বনি জাগে—শিবো হে! বোলে ব্যোম! হর হর মহাদেব! এ নাড়ায় ঢেকে যায় ধরমতলায় আকন্দ-ধুতরো আর বেলপাতায় আটন জাগানো নিতাই ডোমের একক নির্জন কণ্ঠ-- জয় ধম্মরাজের জয়।

     উদ্দালকের চোখ খুঁজে নেয় কুয়োতলায় দাঁড়ানো তার সায়ন’দাকে, সে দৃষ্টিতে একই সঙ্গে শিবমন্দিরের চাতালে তদারকরত বিজনকাকার ব্যস্ত ভঙ্গি ভেসে উঠলে, উদ্দালকের ঠোঁট অদৃশ্য হাসি আঁকে, যেহেতু পার্টি-- তার দায়বদ্ধতা-জনসংযোগ নেতা বিজনের আন্তরিকতায় প্রশ্ন জাগায়, হয়তো অহেতুক তবুও। সে সায়নের পাশে গিয়ে পিঠে হাত রাখে, সে পরশে সায়ন চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে হাসি আনে মুখে, যা মৃদু, সৌজন্যেরও, সেহেতু বাঙ্ময়।

     --আমাকে ডাকতে পারতিস তো?

     --ভাবলাম তোমার তো দেখা। দুপুরে বিরক্ত করব আবার? আমি কখনো দেখিনি, তাই একাই...

     --এখন তো আগের মতো জাঁক আর নাই। তা কেমন দেখছিস?

     --আমাদের শহরে যে কোনো উত্সবে, পুজোয় প্রাণ নেই। আমাদের ভূমিকা শুধু হুজুগে দর্শকের, প্রাণহীন দেখানেপনায়। আত্মার যোগ নেই। এখানে প্রাচীন ভারতের মাটির আত্মা যেন এখনো...  

     উদ্দালকের এ তন্ময় ধ্যানকে গুঁড়িয়ে ডিজে বেজে ওঠে সহসা ফিলমি ঝংকারে।

     --ভোলে বাবা পার করেগা রে...

     সে ঝংকারে চাপা পড়ে যায় ঢাকের আদিম ছন্দ। মুছে যায় মাটির মন্ত্র—শিবো হে!

     তবুও ভিনভাষী এ ঝংকারে কোথাও একটা আদিমতা নাচে, যা হা-ক্লান্ত উপবাসী ভক্তের দলকে জাগিয়ে তোলে যেন সে ক্ষণে, যে জাগরণে থাকবন্দি ভক্তের দল একে একে পূর্ণঘট নিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে। পবিত্র গঙ্গোদক অর্পন করে শিবলিঙ্গে। ধরিত্রী উর্বরা হয় সে পুণ্যাচারে।

     কোথাও কি শহুরে হওয়ার, জাতে ওঠার প্রচেষ্টা, যেমনটা আক্ষেপ হয়ে ঝরেছিল সকালে নিতাই ডোমের, বীরবংশী যে, তার সজ্ঞান প্রলাপে? ভাবে উদ্দালক, যে ভাবনায় ঠাই নেয় এ সংশয়ও যে, আদিবাসী বা দলিত-নিম্নবর্গীয় মানুষ, ভারতের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ যারা, তারা কি হিন্দু আদৌ, আর্য হিন্দুত্বের সংজ্ঞায়? সত্যিই এরা তো আজও অছ্যুত বনেদি আর্য দেবতার মন্দিরে! দু-একটা শহুরে আলো-উজালা শো-পিস তো আর গোটা ভারত নয়? তবে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় রক্তের এ মানুষগুলোর নিজেদেরকে বিকিয়ে উঁচু জাতে ওঠার এ চেষ্টা কেন? শিক্ষার অভাব? রাজার জাতে উঠলে জান-মানের নিশ্চয়তার আশ্বাস? উদ্দালকের এমত ভাবনা মীমাংসা পায় না, তবুও সে ভাবনার অতলে এ সারাংশ ঘাই মারে যে—আছে, আছে। এখনও আছে কিছু রক্তের কন্দরে, অবচেতনের অভ্যাসে। কিছু মুছে যায় কালের নিয়মে হয়তো, তবু অনেকটাই রয়ে যায় জাতকজন্মের ধর্মে, স্মৃতির সংকেতে। কেননা এ ইতিবৃত্তে উদ্দালকের শিক্ষিত মন বাণেশ্বরের, যা ধম্ম-ধর্মরাজ, তার দারুকাঠামোয় বুদ্ধ-ইশারা পায়, সে ইশারা কালিক গতিতে কখন আবার অরণ্যচারি কৌম মাতৃকারূপ-উর্বরাশক্তির কৃষিস্বপ্নের প্রতীকে মিলে-মিশে অনার্যের একান্ত—শিবো হে! পরের গল্প তো রাজধর্মের, যে ধর্মে ঈশ্বরবিরোধী বুদ্ধ আর্যহিন্দুধর্মের দশম অবতারের এক অবতার হয়ে ওঠে, ঋক-বেদের প্রজাপতি-ইন্দ্র মুছে গিয়ে পৌরাণিক বিষ্ণু-শিব জেগে ওঠে—প্রলয়পয়োধি জলে ভেসে যায় ব্রহ্মাও। আর এ ভাবেই অনন্ত বাঁচে মানুষের সে আদিম কৃষ্টিধ্যান জন্ম-জন্মান্তরে, রূপে-রূপান্তরে।

 

ছায়া-আচ্ছন্ন শেষ বিকেলে দূরে কোথায় বিদ্যুত্‍ হানলে, থমমারা বাতাস মৃদু বয় যেন, ফলে বিকেল ঢলে সাঁঝ-মায়ায়, সে মায়া সহসা আঁধারকালো আজ, কেননা মেঘ মুছে দেয় সাঁঝবিয়ানি আলোখানি। যদিও এ ক্ষণের সাঁঝ-মায়া জেগে ওঠে অন্য আলোয়, যেহেতু মাটির কুণ্ডে গনগনে শিখাহীন আগুন জ্বলে, সে আগুনে একে একে ঝাঁপ খায় শিব-সন্ন্যাসীর দল। আঁধার চিরে জোকার ওঠে—শিবো হে! জয় বাবা কাল ভৈরবের জয়! বোলে ব্যোম তারক ব্যোম! শিব মাহাত্ম্য আটন পায়। না, উদ্দালকের মন এ মুহূর্তে বিজ্ঞানকে সরিয়েই রাখতে চায়।

     কিছুক্ষণ পরেই পঞ্চগাঁয়ের গাজনদল একে একে আসতে শুরু করে। পরনে সাদা ধুতি-গেঞ্জি, কারও বা রঙিন পাঞ্জাবি কালের ছোঁয়ায়, সে পরশে হয়তো বা পেশাদারিত্বও, কেননা কারও কোমরে আবার দেখনধারি রঙিন উত্তরীয়ও শোভা পায়। কারও গলায় ঢোল, কারও হাতে কাঁসি, কারও বা খঞ্জনি, খালি পায়ে ঘুঙুর জড়ানো। কারও বা মাথায় পাগুড়ি, মুখেতে লাল-কালোর উল্কি-বেলকি। আবার দেখো কেনে—বলিহারি যায়, কারও গলায় হারমোনিও। শিবতলাতে বিজলি বাতি দিনের কুহক রচে।  

     প্রথম গান কুসুমডাঙার দলই ধরে, কেননা ওদের আবার ভিন গাঁয়ে যাওয়ার তাড়া যি। আসর শুরু হয় গুরুবন্দনায়।

       শুনো শুনো পঞ্চজন

       প্রথমে করি গুরুর বন্দন।

       গুরুর নাম গৌর দাস, বামনিপারে বাড়ি

       তাঁর চরণ স্মরণ করে দেশবিদেশে ঘুরি

       জেলার নাম বীরভূম, ঈশ্বরপুর থানা

       গ্রাম কুসুমডাঙা, এই তাঁর ঠিকানা।

    এ ধরতাইয়ে তারা তাদের নতুন গানে যায় আর যেহেতু বোলান গান, তাই তাতে সময় ভাসে।

       শুনো সবে শুনো পঞ্চজনা

       ই বারে করি করোনা বন্দনা

       আকাশ হাতে আইল সি ভাইরাস

       মানবজমিন সব হইল যি খাস

       আজব মাহাত্ম্য দেবী করোনার

       ধনী-গরিবে তার সমান ব্যাভার

       গরিবের যদি বা বাঁচে পরান

       বড়লোকের জানটি জেনো লবেজান

       দয়া কর হে দেবী করোনা

       মানত করি ষোল আনা

       হাতেও না, ভাতেও না  

       মানুষেরে আর মেরো না

       হায় গো দেবী করোনা...(ধুয়া)

    আসর জমে ওঠে, সে মাতনে ততক্ষণে তাল ঠুকতে লেগেছে বাতাসপুরের ঢোল-কাঁসি-ঘুঙুর।

       শুনুন শুনুন বঙ্গবশী, শুনুন দিয়া মন

       ওগো এই আসরে দিদির কথা করিব বর্ণন

       এগারো সালের পরিবর্তনে দিদি যখন এলেন

       গদিতে বসেই অনেক কিছু দেবার কথা বলেন

       আমরা সবাই বোলান শিল্পী, বাতাসপুরে বাড়ি

       ওগো লাল আমলে পরিচয় পেতে কত না ঘোরাঘুরি

       দিদির কালে পেলাম আমরা শিল্পী পরিচয়

       ওগো সেই সঙ্গে হাজার টাকা, শুনুন মহাশয়

       আহা শুনুন মহাশয়... (ধুয়া)

    এ গান সমসময়কে ভাসালেও তা শাসকদলের দিকে মেরুদন্ড নুইয়ে দাঁড়ায়, ফলে শিল্প বিকিয়ে যায় যেন, কেননা বোলানগান রঙ্গ-ব্যঙ্গের এমনই হিলহিলে সামাজিক চাবুক যে রক্তক্ষরণের পর বোঝা যায় কোথায় কোপ পড়ল! অবশ্য এটাও সত্যি যে আগের সমাজবাদী লাল আমল থেকেই শিল্প-শিল্পী নিজেকে বিকিয়ে সরকারি ভিক্ষায় বেঁচে আছে, যে ঘা নব্য জাতীয়তাবাদী কালে আরও দগদগে, প্রকট।

    আর এই শাসকদলের দিকে ঝুঁকে থাকা বোলানের বোল কিছু প্রশ্ন তোলে এ আসরে, বিশেষ করে সময় যখন ভোটের এবং যে কালে নবজাতি-সবুজ, আর হিন্দু-গেরুয়া মিলেমিশে একাকার, পৃথক করা দায়। ফলে প্রশ্ন উড়ে আসে, কথা গড়ায়।

     --ইটো কি নব জাতির ভোটের মিটিন, নাকি সরকারি মিটিন? পাটির ঠেঙে কত টাকা ঘুঁষ খেঁয়েচিস?

     --মুখ সামুলে কতা কবি, বলে দিচি। ঘুঁষ খেঁয়েচি আমরা? আর তোরা যি দু-পাটির ঠেঙে টাকা লিলি ই গাজনে, তার বেলা?

     --উ তো সব গাঁ লিয়েচে। দু-পাটি ঠেঙেই লিয়েচি। এক দিকে তো জল গড়ায় নাই?

     --ই কথাটো অল্যাজ্য লয়। পরব সব্বার। ইখানে কুনো পাটি চলবে না।

     কথাগুলো বেবাক রাজনীতির, আবার ভোটের মরসুমও বটে, ফলে বেরঙ গিরগিটিরা যে যার লুকনো রঙ ধরে মুহূর্তে, সে রঙ ক্ষমতার হওয়ায় যুদ্ধসম্ভাবীও যেন বা। অতএব উদ্দালকের কাকা, গাঁয়ের বিজুবাবু যে, পঞ্চায়েত মেম্বার অশোক বাগদিকে সঙ্গে নিয়ে তত্ক্ষণাত্‍ আসরে নামে, কেননা পরব-উত্সব গ্রাম্যপ্রাণে পার্টির ঊর্ধে আজও, এ কারণে গাঁ-গঞ্জে পরবের সুষ্ঠ উদযাপনের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে পারলে তা আখেরে, ভোটের কালে, ফলবতী হয়। নেতা বিজুবাবু হাঁকার দেয় তাই।

     --চুপ করো সবাই। পরবে কোনো অশান্তি আমি হতে দেব না। সরকারও তা চায় না। গাঁয়ের উত্সব সকল মানুষের উত্সব—কোনো দলের না। এখানে সরকারের বা কোনো দলের নাম নিয়ে গান চলবে না।

     এ ঘোষণায় ওজন থাকায় গাজনতলায় শান্তি নামে, যে শান্তির মোড়কে জনতার রাশ এ ক্ষণে বিজুবাবুর হাতে, যেহেতু ন্যায়—এ কথাটা মানুষের মনে চারায়, এ উপলব্ধিতে নেতা বিজন মনে মনে হেসেও ছিল বোধহয়, যদিও হাতের রাশ আলগা হাতে না দিয়ে সে আবার কথা গাড়ে সে মঞ্চে।

     --ওই টো মহোদরির দল এসে গেছে। নাও হে তোমরা শুরু করে দাও তোমাদের গান।

     এ ঘোষণায় সভা উজলা হয় আবার, কেননা ঢোল-কাঁসি-ঘুঙুর বেজে ওঠে তালে সে ক্ষণে।

       ঘোলা জলে মাছ ধরোনি মেছুনি

       জাল ছিঁড়ে মাছ পলাইন যাবে এখুনি।

       দিদি ভালো, দাদা ভালো

       চোরও ভালো, পুলিশও ভালো

       পেরজা মোরা বানে ভাসা

       বিনি পয়সায় খাচ্ছি খাসা

       কনটোল চাল কাঁকরমনি

       ঘরের টুইয়ে বসছে হায় শকুনি

       তাই তো বলি ঘোলা জলে

       মাছ ধরোনি মেছুনি।

       হায় রে মেছুনি...

    ঝাঁকবন্দি শ্রোতার মধ্যে থেকে ছেলে-ছোকরার দল লাফিয়ে ধুয়া ধরে—হায় রে মেছুনি...। ফলে আসর জমে যায়। বিরামহীন না হলেও আরও দু-চারখান দল আসে, সে অবসরে কেউ কেউ অদূরে ঝোপের আঁধারের আবডালে যমের দুয়োরে তৃপ্তির চুমুক দেয়, কেউ বা ভোলে বাবার প্রসাদে সুখটান দেয় কল্কে উড়িয়ে। উত্সবের এ মাতনের আনখেয়ালে কখন যেন আকাশে ঘোর কালো মেঘ জমে। এক-দু ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টির যে ঝরে পড়া দেখতে না দেখতে অঝোর, সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। আসর ভেঙে যায়। যে যার ঘরের পথ ধরে। উদ্দালকরাও। সন্ন্যাসীরা শুধু তারই মাঝে রাত জেগে শিব জাগায়।

     যত রাত বাড়ে, ঝড়-জলের তাণ্ডব বাড়ে যেন, যেন বা তাণ্ডবলীলা, সে লীলায় ঘরের বদ্ধ জানলা-দরোজার ফাঁক-ফোকর দিয়ে আধিভৌতিক শব্দ জাগে, এ ঘোরে উদ্দালক কখন যেন ঘুম-আচ্ছন্ন হয়, যে আচ্ছন্নতায় রাত্রির কালো চিরে দূরে কোথায় এক চাপা হাহাকার ধ্বনি ভেসে উঠে ডুবে যায়।

 

॥ ৫ ॥

পরের দিন ভোর হল কী হল না বেলা জাগে, কেননা মেঘকপালে দিনে বেলা বোঝা দায়, যদিও কুসুমডাঙার, তা বাদে বাতাসপুর, ঈশ্বরপুর, আবার ওদিকে মহোদরি—পঞ্চগাঁয়ের মানুষ রাত থাকতে জাগা ভোরের প্রত্যাশা না করেই। তবুও প্রাকৃত ইশারায় আলো ফোটে, যে আলো আঁধারপারাই, যেহেতু মেঘম্লান বিষণ্ণতায় গত রাতের তাণ্ডবলীলার ক্ষত দগদগে জাগে। ঘুম ভেঙে উদ্দালক পাখা বন্ধ দেখে জানলা খোলে, ফলত বাহির ভেতরে আসে লহমায়, সে বাহিরদৃশ্যে জরুলপাড়ের বাঁশগাছগুলো কেমন যেন ওলট-পালট, খুদি কদমগাছের পাতাগুলোও যেন বা ওলটানো—ছেঁড়া-ছেঁড়া, মলিন। ফলত এ ভাবনা জাগে তার মনে--এত ঘুমিয়েছে সে কাল রাতে যে কিছুই জানতে পারে নি, লোডশেডিং সত্ত্বেও!   

     নিচে নেমে সে শোনে কাকা আর সায়ন বেরিয়ে গেছে ভোরের আলো না ফুটতেই।

     --কী ঝড় বাবা! কালাভৈরবের প্রলয়নাচন যেন! স্বয়ং শিবমন্দির ভেঙে পড়েছে। নিশ্চয়ই কাল পুজোয় কিছু খুঁত ছিল। গোটা ডোমপাড়াটা ছারখারে গেছে বাবা। ছোটোলোকের বড্ড বাড় বেড়েছে... ক্ষেপা ভোলানাথ, রুদ্রশিব—তাকে নিয়ে ছেলেখেলা!

     কাকিমার কথাগুলো চা’য়ে ভিজিয়ে আনমনে চা খায় উদ্দালক, সে ভঙ্গিতে দ্রুততার ইশারা, যেহেতু তার মন এখন বাইরে ধায়, তাই চাটুকু কোনোগতিকে শেষ করেই তার আনমন মনে জাগে।

     --কাকিমা, একটু ঘুরে আসি।

     যেহেতু এ সৌজন্য, তাই সম্মতির অপেক্ষা না করেই বাইরে পা বাড়াই সে এবং সে-বাহির পলকে কাল রাত্রির প্রলয়ের চিহ্ন দাগে তার চোখে, যে চিহ্নে দগদগে যেন পথ জুড়ে ইতিউতি ছড়ানো ঝরে পড়া পাতা, খড়কুটো, ছেঁড়া প্লাস্টিকে। চকিতে তার নজর যায় নিজের গাড়িখানির দিকে, যা নির্বিকার স্থির মাটিতে ফুল-কুঁড়ি ছড়িয়ে, এলোমেলো পাতা নিয়ে তবুও খাড়া টগর গাছটির নিচে, যার কাঁচকপালে লেপটে আছে একটি ছিন্ন মলিন টগরপাতা। ভাগ্যিস কোনো ডাল ভেঙে পড়ে নি, গাড়ির ওপর। ভাবে উদ্দালক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন