অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
২০০১ সাল, টেলুরাইড চলচ্চিত্র উৎসব, কলোরাডো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘ প্রায় বারো বছরের ফতোয়া-জীবনের পর, ধীরগতিতে ক্রমশ স্বাভাবিক জীবনের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন সলমন রুশদি। এসে পৌঁছেছেন আমেরিকায়। নিউ ইয়র্ক শহরে পাকাপাকি একটি বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করা গিয়েছে। এই সময়ই রুশদি, সলমনের কাছে আমন্ত্রণ এলো টেলুরাইড চলচ্চিত্র উৎসবের তরফে। জানানো হলো, সাহিত্যিক যদি তাঁর প্রিয় সিনেমাগুলির মধ্যে থেকে কয়েকটিকে নির্বাচন করে দেন, তাহলে বিশেষ সংগ্রহ হিসেবে সেগুলিকে সেই বছরের টেলুরাইড চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হবে। স্যাটানিক ভার্সেস’এর ‘কু’(?)খ্যাত লেখক বেছে নিলেন আন্দ্রেই তারকোভস্কির ‘সোলারিস’, ফ্রিৎজ ল্যাংয়ের নির্বাক যুগের ছবি ‘মেট্রোপলিস’, এবং – তাঁরই কথায় তাঁর অন্যতম পছন্দের ছবি,
।। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ।।
[সূত্রঃ জোসেফ আন্তন, সলমন রুশদি, ২০১৩]
সম্প্রতি মৃণাল সেনের জন্ম-শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা-অনুষ্ঠানে শ্রোতার আসনে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে অভিনেতা-গায়ক-পরিচালক অঞ্জন দত্ত, মৃণাল সেন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ইংরেজিতে ‘বিতর্ক’ শব্দটিকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কেউ কেউ বলতে পারে ‘বিতর্ক’ অর্থে ‘কন্ট্রোভার্সি’, যা শুনলেই বেশ উত্তপ্ত, উদ্দীপ্ত বাদানুবাদ থেকে ক্রমশ হাতাহাতি-মারামারির কথাও মনে পড়বে। আবার কেউ কেউ এর বিপরীতে এও বলতে পারে, ‘বিতর্ক’ শব্দের অর্থ হলো ‘ডিবেট’ বা যুক্তি ও পালটা যুক্তির মাধ্যমে কোনও সমাধানে গিয়ে পৌঁছনোর জন্য আলোচনা। সেই আলোচনা যে সবসময় কোথাও একটা গিয়ে পৌঁছবেই, এমনটাও বাধ্যতামূলক নয়। অঞ্জনের কথায়, মৃণাল সেনের কাছে সবসময় দ্বিতীয় অর্থটিই একমাত্র অর্থ হিসেবে মান্যতা পেয়ে এসেছে। সীমিত পাঠ-অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে বলতে পারি, সলমন রুশদির সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঠিক সেই একই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য। তিনি কেবল প্রশ্নের অধিকারের সপক্ষে লড়াই করে এসেছেন।
আজ ১৯শে জুন, সাহিত্যিক সলমন রুশদির জন্মদিন। ৭৫ পেরিয়ে আজ তিনি ৭৬ বছরে পা দিলেন। আজীবন মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সপক্ষে বক্তব্য রেখে আসা এই মানুষটিকে নিয়ে, তাঁর লড়াইকে নিয়ে অনেক আলোচনা, অনেক নিবন্ধ-প্রবন্ধ-পুস্তিকাকে আমরা পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু রুশদি বললেই আমাদের চোখের সামনে যে গড়পড়তা একটা ধারণা ভেসে উঠতে চায়, না জানি কি ভয়ানক, অগ্নিবর্ষী, তীক্ষ্ণ, উত্তপ্ত মারণাস্ত্রের মতোই বুঝি বা তাঁর উদ্যত লেখনী, সবসময়েই উঁচিয়ে রয়েছে নতুন কোনও বিতর্কের অপেক্ষায় – রুশদিকে যাঁরা পড়েছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা এমন বক্তব্য থেকে সরে দাঁড়াতে চাইবেন। রুশদি আমাদের এই বিরাট সমাজের কাছে ‘বিতর্ক’ (পড়ুন কন্ট্রোভার্সি)রই আরেক নাম হয়ে দাঁড়ালেও, আদতে সেই মানুষটির অভ্যন্তরে একদিকে যেমন বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান, এবং অন্যদিকে চরম রসবোধে জারিত এক মূর্ত বিদূষকেরও স্থায়ী বসবাস – আমরা আজ সেই রুশদিকে নিয়েই বরং আলোচনা সাজাতে চাইব। যে রুশদি গত বছরের সেই প্রাণঘাতী হামলা থেকে বেঁচে ফেরার পর, পেন আমেরিকার পুরষ্কার-জ্ঞাপক অনুষ্ঠানে প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতায় বলতে উঠেই, স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠেছিলেন, “ইটস গুড টু বি ব্যাক! ফিরে আসতে পেরে আমার ভালো লাগছে। যদিও না ফেরার বিষয়টিও আমার কাছে অন্যতম বিকল্প হিসেবে উপস্থিত ছিল। কিন্তু ছক্কার দান আমার ফিরে আসার দিকেই গড়িয়েছে; আর এতে যে আমিও ভিতরে ভিতরে এতটুকুও খুশি হইনি – তাও বলতে পারিনা।”
রুশদি কখনও প্রশ্ন করতে পিছপা হননি। আজীবন তিনি সওয়াল করার সপক্ষেই সওয়াল করে এসেছেন; আর তারই অন্যতম অস্ত্র হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন রস অথবা কমেডিরই বিবিধ উপাদান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “ ‘কমেডি’ আমার প্রিয়তম শব্দ, আর সবচেয়ে অপছন্দের শব্দ হলো ‘রিলিজিয়ন’ “। যদিও ধর্মের বিষয়ে তিনি অসহিষ্ণু অথবা উগ্র মনোভাবাপন্ন, এমনটা ভাবলে পরে ভুল ভাবা হবে। তিনি কেবল বারংবারে বলে এসেছেন, প্রত্যেক ধর্ম আদতে এক বিশেষ ধারণা অথবা ভাবনা মাত্র; আর কে না জানে প্রত্যেক ধারণা অথবা ভাবনা সময়ের নিরিখে অস্তিত্ব বজায় রাখে তার বিবর্তন-ক্ষমতারই উপর। সেই বিবর্তন আসে সমালোচনার মধ্য দিয়ে, উদ্ভবের মধ্যে দিয়ে। যে সমস্ত ধারণা বিরুদ্ধ সমালোচনাকে বুক পেতে নেয়, সেগুলির প্রেক্ষিতে পর্যালোচনা সাজায়, যুক্তি দিয়ে সেই সমালোচনাকে পর্যুদস্ত করে অথবা সমালোচনার বিষয়গুলিকে হৃদয়ঙ্গম করে নিজেকে বিবর্তিত করে, সেগুলিই ইতিহাসের স্রোতে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখে। বিপরীতে রক্ষণশীল, গোঁড়া, খোলসবন্দি যে সমস্ত ধারণা সমালোচনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বালিতে মুখ গুঁজে রাখে, অথবা বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে অত্যাচারের খড়্গ শানায়, কালস্রোতে তাদেরই বিলুপ্তি ঘটে। সমালোচনাই বিবর্তনের অনুঘটক।
নিজের বিরুদ্ধ সমালোচনাকেও তাই বুক পেতে নিতে এতটুকুও পিছপা হননি সলমন। মৌলবাদীদের আক্রমণকেও তিনি বরণ করে নিয়েছেন স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গ-রসিকতায়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯, মৌলবাদী ধর্মগুরু আয়াতোল্লাহ খোমেইনির তরফে যেদিন রুশদির বিরুদ্ধে ‘মৃত্যু-পরোয়ানা’ জারি হয়, সেদিনের প্রসঙ্গেও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি হাসি চাপতে পারেননি। রুশদি লিখেছেন, “যেদিন এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে প্রথম খোমেইনির ফতোয়া সম্পর্কে জানালেন, আমি প্রথমটায় বুঝতে পারিনি বিষয়টাকে কতখানি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। একি কেবলই রাজনৈতিক ভাষণ, নাকি বাস্তব ক্ষেত্রেই এটি বিপজ্জনক। আমার মনের মধ্যে চলতে থাকা এমন সব ভাবনার ভিতরেই আমার সেই সাংবাদিক বন্ধু আমাকে আশ্বস্ত করে বলে উঠেছিল, ‘চিন্তার কারণ নেই তেমন। প্রতি শুক্রবারের প্রার্থনাতেই খোমেইনি এমন ভাবে প্রত্যেক মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শুনিয়ে থাকে।’ আমি মনে মনে খানিক নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম।”
বিরুদ্ধ সমালোচনাকে তিনি যে কতখানি গুরুত্ব দিতেন সেই প্রসঙ্গেই আরও একটি ছোট্ট ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করি। ফতোয়া-জীবন চলাকালীন তিনি যখন লণ্ডনে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে কার্যত অন্তরীণ অবস্থায় রয়েছেন, ঠিক সেই সময় এক পাকিস্তানি পরিচালক ‘ইসলামের শত্রু’ রুশদির বিরুদ্ধে ‘ধর্মপ্রেমী জিহাদি’দের এক কাল্পনিক অভিযানের রুদ্ধশ্বাস গল্প সাজিয়ে আদ্যন্ত ভাবেই এক প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ছবিটি ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে মুক্তির জন্য ছাড়পত্র পাবার আশায় ব্রিটিশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের দ্বারস্থ হয়। ছবিটি গুণমানের দিক থেকে যে অকথ্যের চেয়েও অকথ্য হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। ছবিটি রুশদিকে দেখানো হয়, এবং রুশদি সেই ছবিটির প্রসঙ্গে নিজের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়লে পরে হাসি চেপে রাখা দুষ্কর। নিজের চলচ্চিত্রায়িত সংস্করণটিকে পর্দায় দেখে, এবং শেষ অবধি ‘দুরন্ত ঈশ্বরের দারুণ অভিশাপের মাধ্যমে’ তাকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে রুশদি যারপরনাই আমোদিত হয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছিল অন্য জায়গায়। ব্রিটিশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে দুটি কারণে ছাড়পত্র দিতে চায়নি। প্রথমত তাঁদের ধারণা হয়েছিল ছবিটিকে ছাড়পত্র দিলে আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাঁদের মনে হয়েছিল এই ছবিটিকে যে মুহূর্তে তাঁরা ছাড়পত্র দেবেন, তখনই রুশদি সেই পরিচালক বা প্রযোজক সংস্থার বিরুদ্ধে মানহানি ও অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হবেন; আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেন্সর বোর্ডকেও অযাচিত আইনি লড়াইতে জড়িয়ে পড়তে হবে। এই সম্পর্কে রুশদিকে জানানো হয়। রুশদি তৎক্ষণাৎ লিখিত আকারে সেন্সর বোর্ডকে জানান, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার সপক্ষে তিনি আজীবন সওয়াল করে এসেছেন। কাজেই সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে যাঁর লড়াই, সেই তিনিই কিনা সেন্সরশিপের আড়ালে লুকিয়ে বাঁচবেন, এমনটা তাঁর পক্ষে নীতিবিরুদ্ধ কাজ হবে। তিনি লিখিত আকারে প্রতিশ্রুতি দেন, ছবিটি ছাড়পত্র পেলেও পরিচালক, সংশ্লিষ্ট প্রযোজনা সংস্থা অথবা সেন্সর বোর্ডের বিরুদ্ধে তিনি কোনওরকম আইনি ব্যবস্থা নেবেন না। পক্ষান্তরে তিনি অনুরোধ করেন, ছবিটিকে যেন যত শীঘ্র সম্ভব ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এরপর রুশদিরই কথায়, “ছবিটি ছাড়পত্র পেল। কিছু কিছু সিনেমা হলে দেখানোও হলো। কিছু মানুষ দেখল, এবং তারপর সবাই ভুলে গেল।” মানুষের শুভবুদ্ধির পক্ষে বিশ্বাস হারানো পাপ। সেদিন রুশদি হাতেকলমে তাই প্রমাণ করে দেখিয়ে ছিলেন। নিজের আদর্শের প্রতি এতখানি সততার নজির, ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে, খুব কমজনই দেখাতে পারবেন বোধহয়।
বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে রুশদির প্রগাঢ় জ্ঞানের বিষয়ে আগেই বলেছি। রুশদির সাহিত্য পড়লেই সেই বিষয়ে অবগত হওয়া যাবে। কিন্তু রুশদির যে অন্তরের সংবেদনশীলতা, এমনকি সেই মৃত্যু-পরোয়ানার সম্মুখে দাঁড়িয়েও একজন বাবা হিসেবে তাঁর অনুভূতির যে অদ্ভুৎ গভীরতা ও মিষ্টতা, তাঁর লেখা থেকেই বরং সেই বিষয়ে কিঞ্চিৎ পড়ে দেখতে চেষ্টা করি।
গ্রিমাস, মিডনাইটস চিলড্রেন, শেম, দ্য স্যাটানিক ভার্সেস, পরপর নিজের প্রথম চারটি উপন্যাসই সাহিত্যিক রুশদি লিখেছিলেন এ্যাডাল্ট ফিকশন হিসেবে। মিডনাইটস চিলড্রেন প্রকাশের ঠিক আগের বছরে, ১৯৮০ সালের জুন মাসে রুশদির প্রথম সন্তান জাফরের জন্ম হয়। জাফরের অনুযোগ ছিল, রুশদি কেবলই বড়দের জন্য লেখেন। শেষমেশ রুশদি কথা দেন স্যাটানিক ভার্সেসের কাজ শেষ করেই পরবর্তী যে উপন্যাস তিনি লিখবেন, তা হবে ছোটদেরই জন্য লেখা। সেই থেকেই ‘হারুণ এ্যাণ্ড দ্য সি অব স্টোরিস’এর ভাবনার সূত্রপাত। কিন্তু স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশের পরেপরেই পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেল। ফতোয়ার পরবর্তীতে কড়া নিরাপত্তায় রুশদিকে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হলো। সেই অবস্থাতেও রুশদি প্রাথমিক মনের চাপ কাটিয়ে উঠে লিখতে শুরু করলেন হারুণের উপাখ্যান। প্রথম যেদিন লেখবার খাতায় হারুণের জন্ম হলো রুশদি সেই দিনটির প্রসঙ্গে লিখলেন,
“গল্পটা যেন বা উপহারের মতোই আমার মাথায় একদিন টুপ করে এসে পড়ল। আমি জাফরকে তার বিকেলবেলাকার স্নানের সময়ে পাশটিতে বসে একনাগাড়ে গল্প বলে যেতাম। শুতে যাবার সময়ের বদলে, স্নানের সময়ের গল্প! স্নানের বাথটবে, জলের উপরে ছোট ছোট চন্দনকাঠের তৈরি পশুপাখি আর কাশ্মীর থেকে আনা শিকারা-নৌকোর খেলনা ভেসে থাকত। সেখান থেকেই সেই গল্পের সাগর (বা সি অব স্টোরিস)এর জন্ম, অথবা পুনর্জন্ম! আদতে তো এই গল্পের সাগরের উল্লেখ মেলে এক প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে। একাদশ শতকে কাশ্মীরের এক শৈব ব্রাক্ষ্মণ সোমদেব এক বিরাট সংস্কৃত গল্প সংকলন সাজিয়ে তোলেন। তার নাম দেন কথাসরিৎসাগর, অথবা কাহিনী-নদীর সমুদ্র, অথবা ইংরেজিতে সঠিক ভাবে অনুবাদ করলে, নদীরূপ কাহিনীরা যে মহাসাগরে গিয়ে মেশে, তারই আকরগ্রন্থ। সোমদেবের রচনায় কিন্তু আক্ষরিক অর্থে কোনও সাগরের বর্ণনা ছিল না। কিন্তু কেমন হতো যদি সত্যিই এমন এক সাগরের অস্তিত্ব থাকত? এমন এক সাগর যেখানে বিভিন্ন একমুখী-বিপরীতমুখী গল্পেরা স্রোতেরই মতো সাঁতার কেটে চলত? জাফর যখন বাথটবের ভিতরে বসে জল নিয়ে খেলা করত, তার বাবা তখন ছেলের বাথটবের ভিতরকার জল থেকে এক মগ করে জল তুলে নিয়ে মিছিমিছি চুমুক দিয়ে দেখত, আর তক্ষুনি তার মাথায় কেমন করে জানি একটা না একটা গল্প চলে আসত। বাথটবের সাগর-জলে বইতে থাকা কথাসরিৎসাগরের উপাখ্যান!” এভাবেই ‘হারুণ এ্যাণ্ড দ্য সি অব স্টোরিস’এর আখ্যান আরম্ভ!
রুশদি নিশ্চিত ছিলেন প্রশ্নের অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। সমালোচনার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই সেই অধিকারের চিরকালীন সত্যতা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে, ফতোয়া-জারির ১০ বছর পর এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে হঠাৎই এক ব্যক্তি উঠে এসে বলে, তার নাম আসাদ। ১৯৮৯তে রুশদির বিরুদ্ধে ইংল্যাণ্ডে যে সমস্ত হিংসাত্মক প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটিতে সে মূল আয়োজক হিসেবে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এর পরেপরেই সাহিত্যিক রুশদিকে আশ্বস্ত করে আসাদ বলে ওঠে, “ভয় পাবেন না। আমি এখন নাস্তিক। আমার বিশ্বাস পালটে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, আপনার লেখা বইটিও আমি পড়েছি। পড়তে গিয়ে দেখলাম, কোথাও একবারের জন্যও মনে হলো না আপনি এতে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে কোনও অবমাননাসূচক কথা লিখেছেন। না পড়েই আমি আপনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলাম।” রুশদি আসাদকে জবাবে বলেছিলেন, “অপরাধবোধে ভোগার কারণ নেই। স্বয়ং যিনি আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিলেন, সেই খোমেইনি সাহেব নিজেও ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করে গিয়েছিলেন – আমার বইটিকে পড়ে দেখার মতো তাঁরও সময় বা প্রবৃত্তি হয়নি!”
প্রথম দেশ হিসেবে ভারতবর্ষ যখন স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে সরাসরি চিঠি লিখে রুশদি বলেছিলেন, “এই সময়টা আপনার আয়ত্তে হতেই পারে, কিন্তু মনে রাখবেন শতক বা সহস্রাব্দের উপর কায়েম থাকবে একমাত্র শিল্পেরই অধিকার!” নিজের নিরাপত্তা নিয়ে যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে দেখা করতে যাবেন সলমন, প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে কোনও বিদেশি রাষ্ট্রদূতের দেওয়া উপহার হিসেবে বিরাট এক টেডিবিয়ারের খেলনা দেখে সটান তিনি প্রধানমন্ত্রীকেই জিজ্ঞেস করে বসবেন, “এর কোনও নাম দেওয়া হয়নি? আমি হলে নাম দিতাম টোনি বেয়ার!” শাণিত যুক্তি ও তারই সঙ্গে মুচমুচে রসবোধের এক চূড়ান্ত উদাহরণ, এই পঁচাত্তুরে জাদুকর সলমন – যিনি কিনা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও সদর্পে ঘোষণা করতে পারেন, “ছুরি-হামলার ঘটনাটিকে নিয়ে একটা বই লিখব, বড় যন্ত্রণার কাজ। কিন্তু সেই লেখাটাকে শেষ করেই হাত দেব নতুন উপন্যাসের কাজে। তার জন্য ভালো করে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। কাফকার ‘কাসল’ আর মানের ‘ম্যাজিক মাউন্টেন’, বইদুটোকে নতুন করে পড়তে শুরু করেছি।”
“আমরা আলাদা আলাদা ফুটবল দলের সমর্থক হয়েও একই রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারি। আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেও, সন্তান প্রতিপালনের বিষয়ে একইরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারি। সন্তান প্রতিপালনের বিষয়ে আমরা ভিন্নমত হলেও আমরা একইরকম ভাবে অন্ধকারকে ভয় পেতে পারি। আলাদা আলাদা বিষয়ে আমরা ভয় পেলেও আমরা একইধরণের সঙ্গীত ভালবাসতে পারি। বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতকে ভালবাসলেও আমরা একই ঈশ্বরকে পুজো করতে পারি, আবার ধর্মের বিষয়েও আমরা একে অপরের ধারণার চরম বিরোধী হয়েও – আমরা একই ফুটবল দলের সমর্থক হয়ে থাকতে পারি!”
সলমন রুশদি আজীবন বিবিধের মাঝে মিলনের কথা বলেছেন। নিজের দ্বিতীয় সন্তানের নাম মিলন (ইংরেজি বানানে মিলান) রাখার সময়েও তিনি সংস্কৃত ভাষায় এই ‘মিলন’এর অর্থকেই স্মরণ করেছেন। রুশদির বিশালত্বকে আমরা যে কেবল বিতর্কে (পড়ুন কন্ট্রোভার্সি)তেই হারিয়ে ফেলেছি, নিজেদেরকে সেই বোধে আচ্ছন্ন করে রেখেছি, সেই অক্ষমতা আমাদেরই কেবল। আমরা নতুন করে আজ রুশদিকেই পড়তে চেষ্টা করি বরং। হয়তো বা শেষমেশ রুশদি বা তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের ভিন্নমত থাকলেও, মানুষ হিসেবে আমরা আরেকটু কাছাকাছি আসতে পারব; আর তাঁরই জন্মদিনে তাঁর প্রতি এর চেয়ে বড় উপহার আর কিই বা হতে পারে!
Tags:
প্রবন্ধ