অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
দ্বিতীয় কিস্তি
অনেক রাত। অরুণজ্যোতি বিছানার উপরে উঠে বসেন। শাল্মলী ফোন করবে। জুম কলে আসবে বলেছে। অনেকদিন ধরে এমন রাত্তিরে কথা বলে বলেই ওঁদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। বাথরুমে গিয়ে অরুণজ্যোতি মুখেচোখে জল দিয়ে আসেন। ল্যাপটপটা খুলে রাখেন টেবলের উপর। জুম মিটিং শুরু হয়নি এখনও। শাল্মলীই হোস্ট করবে। এর অর্থ সে এখনও অনলাইন হয়নি। অরুণজ্যোতি মনে মনে কথাগুলোকে সাজিয়ে নেন। তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু কাজ সম্পূর্ণ শেষ করা প্রয়োজন। শাল্মলী যতই তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন, তিনি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়বেন না। তাছাড়া, শাল্মলী নিজেও যাতে কোনও ভাবে এই বিষয়ে জড়িয়ে না যান সেটা দেখাও তাঁর দায়িত্ব। রাতবিরেতের এই ফোনকলগুলোকে বন্ধ করতেই হবে এবার। তিনি নিজেকে গুছিয়ে নেন। স্ক্রিনে দেখতে পান মিটিং শুরু হয়েছে।
-“অরুণ, কেন করতে চাইছ এমন? অনেক তো হলো। সবকিছুই তো পেয়েছ তুমি। তাও কেন এমন!” অরুণ শাল্মলীকে থামিয়ে দেন।
-“সুমি, বাধা দিও না আমায়। এই বাকি কাজটুকু আমায় করতেই হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তুমি আমাকে ঠেকাতে পারবে না।”
শাল্মলী চুপ করে থাকেন।
-“শুনতে পাচ্ছো?” কিছু পরে অরুণ জিজ্ঞাসা করেন।
-“পাচ্ছি।” জবাব আসে।
-“আমাকে ভুল বুঝো না। আমাদের কথা বলাটাও এবারে শেষ হওয়া প্রয়োজন বোধহয়।”
ওপাশ থেকে কোনও আওয়াজ আসে না।
-“অনেক তো হলো,” অরুণ বলে চলেন, “এবারে বাকি পথটুকুতে নাহয় আমাকে একলাটিই হাঁটতে দাও।” কোনও জবাব নেই।
ক্কড়কড়িয়ে বাজ পড়ে কোথাও।
-“সুমি, সুমি,” অরুণ অস্ফূটে জিজ্ঞাসা করেন।
-“বলো।” জবাব আসে এবার।
-“শুনতে পাচ্ছো?”
-“পাচ্ছি।“
-“আমাকে ভুল বুঝো না। এই শেষ কাজটুকু না করলে আমার মুক্তি নেই। ভবিতব্য তাই বলছে আমায়।”
-“আর আমার বলাতে বুঝি কিছু এসে যায় না?”
-“সুমি, লক্ষ্মীটি। এমন কোরো না। সবটুকুকে সুষ্ঠু ভাবে শেষ করতে দাও। আমি নিজের কাছে সৎ হয়ে থাকব। যে’কটা দিন ...”
-“চুপ,” শাল্মলী অরুণকে থামিয়ে দেয়, “বুঝেছি।” এক অবাক নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। টিপটিপ করে জল পড়ছে। অন্ধকারে গাছের উপর, পাতার উপর, টিপটিপ করে জল পড়ছে। পোকামাকড়েরা সব গর্তে গিয়ে সেঁধিয়েছে। মাটির ভ্যাপসা ভাব কেটে গিয়ে, মিষ্টি সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে হঠাৎ। অরুণজ্যোতি বুক ভরে সেই গন্ধ নিতে থাকেন। ল্যাপটপের আলো নিভে গিয়েছে। ঘর ভরে আছে অন্ধকার। মোবাইলের ছোট্ট আলোটা হঠাৎ জ্বলে উঠেই নিভে গেল। যোগাযোগ ছিঁড়ে যাচ্ছে। আবারও হয়তো শক্ত হচ্ছে। শেষ অবধি অরুণজ্যোতি জানালাটা বন্ধ করে দেন। ঘুম আসছে তাঁর।
[৪]
আধো অন্ধকার এসপ্ল্যানেড চত্বর। ওপাশে কেসি দাশের মিষ্টির দোকান। শালুক আর ওর বন্ধু সন্দীপন যখন ধর্মতলার মোড়ে এসে দাঁড়াল ঘড়ির কাঁটায় তখন সাতটা পেরিয়েছে। সরকারি বাসগুমটিতে অবশ্য অন্ধকার নেই। এনবিএসটিসির দুখানি বাস সার দিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সন্দীপন শালুককে বললো, "তুই বরং এখানেই থাক, আমি বাসের নম্বরটা জিজ্ঞেস করে আসি। ব্যাগগুলোর খেয়াল রাখিস।" সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে শালুক। এসপ্ল্যানেড চত্বর বলতেই শালুকের ফার্স্ট ইয়ার মনে পড়ে। সদ্য সদ্য কলেজে পা দিয়েছে। বিকেল হলেই কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে ট্রামে চড়ে এখানে চলে আসত। একটুদূরে গ্র্যাণ্ড হোটেল, উল্টোদিকের ফুটপাথ। উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষদের কাপড়ের দোকান। শালুকরা এপারের লোক। '৪৭ অথবা '৭২এর ভয়াবহতাকে কেবল বই পড়েই জেনেছে। পিছনে, আরো অন্ধকার এক দৈত্যের মতোই মাথা উঁচিয়ে নিজের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে শহীদ মিনারের অবয়ব। শালুক কবিতা লেখে বোধহয়। একলাটি কিছু সময় পেলেই সে তখন নিজের মতো করে নিজের কাছটুকুতেই হারিয়ে যায়। অপার নিস্তব্ধতায়। হঠাৎ সম্বিৎ ফেরাল একটা গলার স্বর। শালুক ফিরে তাকায়।
-"আপনি এখানে?"
শালুকের বুকের ভিতরে হঠাৎ করেই যেন বা লাবডুব করে জল কেটে গেল। মেয়েটির সঙ্গে যে ওর আবার দেখা হবে তা সে জানত, কিন্তু সে তো কেবল মনের কল্পনায়। সত্যি সত্যি করেই যে এত তাড়াতাড়ি আবারও তিস্তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি শালুক। চকিতে ও একবার তিস্তার সঙ্গে থাকা মালপত্রগুলোর উপরে চোখ বুলিয়ে নেয়। এও কি সম্ভব হতে পারে? পরক্ষণেই নিজের মনকে বোঝাতে চেষ্টা করে শালুক। জীবন কখনও এতটাও কাকতালীয় হতে পারে না। সে মৃদু হাসে।
-"ওরেব্বাস, এ তো দেখছি পৃথিবীটা সত্যি সত্যিই গোল। এত তাড়াতাড়িই আবার দেখা হয়ে গেল!" জবাব দেয় শালুক।
-"তাই তো দেখছি। কিন্তু যাওয়া হয় কোথায়?" সুরেলা কন্ঠস্বর।
-"দার্জিলিং!" প্রবল উচ্ছাসে শব্দটা শালুকের মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, "মানে এখন এখান থেকে শিলিগুড়ি। সাড়ে সাতটার বাস। এনবিএসটিসি'র।" এক লহমাতেই সে অনেক কিছু বলে ফেলে হঠাৎ। তারপর একটু বোকা হেসে তাকায়।
ঘন আয়ত চোখে কিছুক্ষণ শালুকের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে তিস্তা। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে বলে ওঠে, "আমরা তাহলে একই বাসের যাত্রী?"
শালুকের বুকের ভিতরে জল। আর তাতে লাবডুব কাটছে না। পিছন থেকে সন্দীপনের গলা শোনা যায়, "এই তো এই বাসটাই যাবে রে অরিন্দম। ১০৫৭। উঠে পড়া যাক?" শালুকের ভালো নাম অরিন্দম।
যারা ভাবুক প্রকৃতির হয়, তারা অল্পতেই অনেক কিছু ভেবে নিতে পারে। গাড়ি ছুটতে ছুটতে কতকিছুই না তিস্তার মনে আসছিল। হয়তো সে একলা বলে। হয়তো বা তাই জন্যও নয়। শালুক আর তার বন্ধু বসেছে খানদুই সারি পিছনে। তিস্তা মাথা ঘুরিয়ে দেখল একবার। দু'জনে বেশ গল্প জুড়ে দিয়েছে। তিস্তার বন্ধুভাগ্য এমন নয়। অবশ্য সে বোধহয় তা চায়ওনি। মেলামেশা ব্যাপারটা তার আসে না। চুপচাপ নিজের গণ্ডিতে গুছিয়ে থাকতেই তার ভালো লাগে। বড় একটা কেউ সেই গণ্ডি পেরুনোর সুযোগ পায় না। গাড়ি ছুটছে খুব। হুগলীর পুল পেরুল। মনে মনে তিস্তার হাসি পেল। পুল শব্দটা আজকাল আর কেউ ব্যবহার করে না। তার মতো প্রবাসীরা তো নয়ই। কিন্তু পুনাতে তাদের বাড়িতে বাংলার চল আছে। ওর বাবার দিককার আত্মীয়েরা বহুদিন পুনার বাসিন্দা। ও শুনেছে বিখ্যাত বাঙালী সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পুনাতে ছিলেন, ওর জ্যাঠা-কাকাদের বাড়িতে নাকি তাঁর যাতায়াত ছিল। ওর বাবা অবশ্য লেখালিখির দিকে যাননি। রাতের দিকে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। যদিও সাঁতরাগাছি দিয়ে যেতে যেতে তিস্তা দেখল ওপাশের লেনে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। লরি ঢোকার সময় এখন। এই সময়টায় জ্যাম হওয়া স্বাভাবিক। ওর মামার কাছে গল্প শুনেছে তিস্তা। তিনি কলকাতায় থাকেন, কাজের সূত্রে দুর্গাপুর যেতে হয়। তাঁর কাছ থেকেই এই ভয়াবহ সাঁতরাগাছি জ্যামের কথা শুনেছে তিস্তা। সত্যিই, গাড়ির লাইন পড়ে গিয়েছে। পেরুতে পেরুতে অনেক সময় লাগছে।
পিছন থেকে হঠাৎ কেউ ডাকল। "কেক চলবে নাকি?" তিস্তা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। শালুক বলে ছেলেটাই জিজ্ঞাসা করেছে। তার হাতে বাড়ানো ব্রিটানিয়ার প্যাকেট। বাস ছুটছে। দোনামোনা করেও হাত বাড়িয়ে একটা কেকের টুকরো তুলে নিল সে। বন্ধুত্ব? সে অত ভাবতে পারছে না। বাইরে অন্ধকার।
বাসটা ছুটছে। ছুটতে ছুটতে কতদূর পেরিয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীতে সাতশো কোটি মানুষ। তারই মধ্যে দেখতে গেলে আমাদের দেশেই গিয়ে দাঁড়াবে একশো চল্লিশ কোটির হিসেব। দু'জন অথবা তিনজন মানুষ। নাকি বৃহত্তর হিসেবে ধরলে পাঁচ? অথবা ছয়? সংখ্যার হিসেব করতে নেই। সমাজে সংখ্যার হিসেব চলে না। গণতন্ত্রে চলে। এসব জটিলতা নিয়ে তিস্তা ভাবতে চায় না। শালুক বোধহয় ঘুমোচ্ছে। আরও একটু সময় যায়। জাতীয় সড়ক ধরে বাস ছুটে চলেছে। থামবে গিয়ে একেবারে সেই জলঙ্গীর তীর। কৃষ্ণনগর। বেথুয়াডহরি। নামগুলো তিস্তা খাতায় নোট করে এনেছে। একলা কোনও মানুষের এমনই সব অদ্ভুৎ অভ্যাস হয় বোধহয়।