দোঁহা

শতদল মিত্রের উপন্যাস


 আধেকজান

 

 (পর্ব #১৬)

বাদলা-বাতের এতক্ষণের জনহীনতা, তার অন্ধকারকে চিরে শিবতলা ক্রমে জেগে ওঠে দু-জোড়া পায়ের ছন্দে, কেননা সেখানে মুখর জাগে গাঁয়ের পঞ্চজনা, সে মুখরতায় বিজলিবাতির উজলহাসির আলো, যে আলোয় উদ্দালকের চোখে ভেসে ওঠে কয়েকজনা গাজনসন্ন্যাসীই যেন, ফলে প্রশ্ন দোলে,

     --এখানে চড়ক হয়?

     --হয় তো। নীলপুজো। শিবের। সোমবার নীলষষ্টি। ভাল সময়েই এসেছিস তুই। নইলে গাঁয়ে সময় কাটানো মুশকিল হতো তোর।   

     এ কথায় আটচালার থামের আড়াল থেকে এক বৃদ্ধদেহ আলোয় ভেসে ওঠে।

     --কে সানু নাকি? তা ধম্মরাজের পুজোর কথাটো তো বললে না! তোমরা লেখাপড়া জানা লোক হয়ে...

     কথাটা আর শরীর পায় না, যেহেতু তার বৃদ্ধনজরে তখন উদ্দালকের ছায়া, যে ছায়াকে গাঢ় করে তুলতে প্রাচীন চক্ষুদুটির ওপর হাতের তালুর জীর্ণ ঠেকা।

     --লতুন মানুষ্যি দেকচি! কুটুম মনে লয়!

     --জ্যাঠার ছেলে গো নেতাইদা।

     --অ, তুমি সমরার বেটা? সমরা আমার স্যাঙাত ছিল গো ছুটুবেলায়। তা মুখের ঠুলিটো খোল কেনে। মুখটো দেকি।

     এমত কথায় স্নেহ আলো পায়, ফলে সে, উদ্দালক, মুখের মাস্ক খোলে মুখে মৃদু হাসি এঁকে, সেখানে টুকুন বিস্ময়ও খেলে, যেহেতু তার বাবা সমীরণ যে কখনো সমরা হতে পারে এ তার কল্পনাতীত। এ বিস্ময়ে তার নজর চকিতে সায়নের দিকে ঘোরে, যেখানে সায়ন হাতের মুদ্রায় পাগলামির ইশারা দাগে। ততক্ষণে সে বৃদ্ধশরীরে হামাগুড়ির ভঙ্গি জাগে, সে ভঙ্গিমায় স্থানিক ব্যবধান ঘুচলে উদ্দালকের শরীরে প্রাচীনহাতের মায়া বয়, যা মাটিমগ্ন।



     --সমরাটো ছুটুছেলের পারা ছিল। তার সাদা মনে কাদা ছিল নাই কুনো। আমি তো তোমাদের বাড়ির মান্দের ছিলাম পেটভাতার। আমাকে বলে কিনা-- তু ধান চাষ করিস, লাঙল দিস, তখন ধান কেটে আপন ঘরে তুলবি... একভাগ ধান দিবি আমাদের। আমি তো পেটভাটার মান্দের, ওদের কিষেন ছিল ক্ষ্যাপা ডোম, ছিদাম বাগদি। উরা শুনবে কেনে আমার কথা? তাছাড়া বাবুদের সনে মোদের জীবন বাঁধা সেই বাপ-পিতিমোর কাল থেকে। ছুটু বয়েস, তাই সাদা মন। জানে না উ যি বাবুদের চাষ নিজেদের হাল-বলদে। আমরা তো বর্গা লই—কিষেন-মান্দের, হালের কথায় কিষিমজুর। তা উ বলে কিনা—ধান দিবি না! হাঃ হাঃ হাঃ! দুলে দুলে হাসে সে প্রাচীন মান্দের, কৃষিশ্রমিক মেঘলা সাঁঝের আঁধার ছলকে আপন মনের ছন্দেই যেন।

     সে ছন্দেই বোধহয় এক পশলা হাওয়া বয়, যাতে ভিজে শীতলতা। আটচালার অপর প্রান্তের থাকবাঁধা ছায়াশরীর থেকে কথা ভেসে আসে সে হাওয়ায়—ও সানুদা ইদিক পানে এসো কেনে! উ ক্ষ্যাপাতো তোমাদেরকেই গাল পাড়বে।

     --ও দাদু মাইলোর গানটো শোনাতে ভুলো না যেন।

     বুড়োমানুষটা ভেসে আসা কথা কথায় কান দেয় না, যেহেতু তার প্রাচীন হাত ধুলো ঝাড়ে আটচালার শানের, যেন বা ধুলোর সঙ্গে উড়িয়ে দেয় উড়ো কথাগুলোকেও। সায়ন উদ্দালককে ইশারা করে ওদিকে যায়, সে গমনও কোনো হেলদোল দাগে না বুড়োর আপনভোলা ছন্দে, যে ছন্দে আপাতত পরিচ্ছন্ন ঠাইটিতে চাপড় মারে সে।

     --বসো বাবা, বসো। তা তোমার নামটো কী বাবা।

     --উদ্দালক।

     -- ই কঠিন নাম জিবে আনতে লারব বাবা। তোমাকে ছেলে বলেই ডাকব। সমরার বেটা তো আমারও বেটা। লয় কিনা?  

     বৃদ্ধমানুষটির আন্তরিকতা, নাকি তার বাবার স্মৃতি, হয়তো দুটোরই টান—উদ্দালক আটন গাড়ে সে স্থানে এবং সামাজিক ব্যবধান রেখেই, এ অবসরে খেই ধরে প্রাচীন কথার আবার।

     --তা, সমরার মন যেমন সাদাপারা, রক্তও ছিল খাঁটি লাল। কুনো জং ছিল না। আমার পারা। জানো ছেলে, ই গাঁয়ে লাল পতাকা আমিই গাড়ি পেথ্থম। আমি নেতাই ডোম... নিতাই বীরবংশী, বীরের জাত... আগে ডুম বাগে ডুম ঘোড়াডুম সাজে... সি ডোম আমরা। আমার বড়বাবার বাবা লেঠেল ছিল জমিদারের। রণপায়ে উড়ে যিত সি। আমি নেতাই ডোম—ই গাঁয়ের, দু-দু ক্ষেপের পঞ্চাত্‍ মিম্বার, তা আমাকে সরিয়ে দিলে চাল করে! পেথ্থম বার বুঝতে লারি। ই সিটটো মেয়েছেলের হল সি ক্ষেপে। উ তো কানুন—আমি-তুমি লাচার। মনকে বুঝও দিলাম। পরের ক্ষেপে বলে কিনা—টিপ ছাপ মিম্বার চলবে না। লিখাপড়া মিম্বার পেয়োজন। ই সিট থেকে পঞ্চাত্‍ পোধান হবে। আমাদের ছুটু গাঁয়ের ইটো একখানই সিট—শিড়ুল। বললে কে? না, তোমার ছোটোবাবা অজে বামুন। যি কিনা সারাটা জেবন গাই-বাছুরের পোঙায় পোঙায় ঘুরে, যমের দুয়োরে হত্যে দিয়ে ইস্কুল মাষ্টর হল, সি হল কিনা কামরেড-- রেতেরেতেই লাল পার্টির নেতা। যমের দুয়োরের কেপায় মাইলো চুরি করে দেদার ট্যাকার গরমে নেতা। নেতা না ন্যাতা! হুঁ! অজে বামুনের বেটা, তোমার খুড়ো, ওই বিজুবাবু গো, সি সময়, যেখুন লাল রঙ মুছে যেছে, সব্বাই সবুজ, সি সময় উ ঝাড়া একটো বচ্ছর মাচায় বসে জল মাপচিল। তাপ্পর সবুজপানে জল ভারী বুঝে উ দিকে ঝাঁপ খায়। আর সঙ্গি সঙ্গি নব জাতির বড় ন্যাতা সি। উর সনে ঝাঁপ খায় আমাকে ছাড়িয়ে যাকে পঞ্চাত্‍ করলে সি অসকা বাগদিও। উর বেটা উত্তম আজ পঞ্চাত্‍!          

     ক্ষোভ উড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে বৃদ্ধহৃদয়, বুকে নতুন-তাজা বাতাস ভরে তুলতে চেয়ে, এ অবসরে যমের দুয়ার—কথাটি শিকড় চারায় উদ্দালকের মনে। গাই-বাছুর না হয় অধুনা প্রাচীন, তাই আদি, যদিও তখন নতুন, সত্তর দশকের নব্য জাতীয়তাবাদী দলের প্রতীক। মাইলোও জানে সে। এখন যেমন মিড-ডে মিল, সে সময়ে আমেরিকা থেকে আসা মাইলো, ভুট্টার ভাঙা দানা যা, দেওয়া হতো স্কুলের বাচ্চাদের। কিন্তু যমের দুয়ার? এ প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়, কেননা প্রাচীন মাটির কমরেডটি ততক্ষণে কথা বোনে আবার।

     --কামিয়ে নেওয়ার জন্যিই কমুনিস সব। আসলি অল্যাজ্য কারবারে আমি থাকি নাই কুনোকালে। বারবার ল্যায় লেগেছে আমার সনে। শেষকালেতে পারটির থিকে আমিই বেবাক বাদ। আর উ, নিজের হাল-বলদের জোতদার হল কিনা পারটির নেতা। পারটিও চোখ মুদে রইলে কলকেতার ঠান্ডা ঘরে। লাও, বগল বাজাও কেনে ইখন! লম্প লিয়ে খোঁজলিও ইখন একটোও লাল নাই বেবাক গাঁ-গঞ্জে।

     প্রাচীন মানুষটির জীর্ণ হাতের বৃদ্ধ আঙুল-দুটি নড়ে ওঠে, নড়তেই থাকে, আঁধার দুলিয়ে। উদ্দালক শব্দকে অন্ধকারে ঢেকে জিজ্ঞাসা করে,

     --তখন ওই সময়ে এদিকে নকশাল আন্দোলন হয় নি কোনো?

     --না, ছেলে। শুনেছিলাম, উসব ছিল নাকি সিউড়ির ওদিকে। তবে সমরার পারা দু-জন শহুরে বাবুছেলে এসেছিল বটে সি সময়। সমরার পারাই বলেছিল—ধানের ভাগ দিও নি। বলেছিল বেপ্লব হবে। সি জৈবন কালে কাকে বলে বেপ্লব, কাকে বলে কমুনিস—কিছুই জানতাম না আমরা। বলেছিল যুদ্ধ হবে। ওদের কাছে নাকি বোমার মশলা ছিল। বন্দুক ছিল। বলেছিল কাস্তেতে শান দিতে। সড়কি, তির, টাঙি, ধারালো রাখতে। তা, আমাদের বাপ-দাদারা বললে—মুনিবরাই ভগমান। বড়দাদা-পরদাদার কাল থিকে মুনিব-কিষেন সোম্মন্ধ—বাপ-বেটার সোম্মন্ধ। ই অল্যাজ্য। আমার স্যাঙাত দিলে বাগদিটো উদের চেলা হইছিল দু-দিন। তখুন তো নদীর পুল ছিল না, তা বাদে ধরমগড়ের বিলও জলভরা, সোমত্ত। পুলিশগাড়ি আসতে গিলে পর লাঘাটা পুল পেরিয়ে সাতকোশ পথ ঠিঙিয়ে মহোদরী গাঁ দিয়ে ঢুকে মাঠ ভেঙে, তারপর আসা। দেখো ছেলে, আমাদের ঘরে আমাদের পারা মানুষ এলে মিশ খায়। ইকাল হলে তাও বুঝি সোম্ভব। কিন্তুক সি কালে? বাবুদের ঘরের ছেলের রোশনাই কি  আমাদের মধ্যি ঢেকে রাখা যায়? আগুনকে যতই ছাইগাদা চাপা দাও না কেনে, ধুয়ো উগলোবেই। চৌকিদারকে উরা মানিয়েছিল। তা, এক রেতে দেখি গোটা গাঁখান ঘিরে পুলিশ আর পুলিশ। খপর দিয়েছিল কেউ তবেই না! লিশ্চয় অজেবাবু-দত্তবাবুদের শলা। উরাও গতিক বুঝে রেতের আঁধারে মিশে, লদীর শরবনের ছায়ায় দেহ নুকিয়ে পগারপার। হাঃ হাঃ! দিলের তো পথঘাট, আঁদার-বাঁদার সব জানা। উ বাইরের পুলিশ আমড়া করবে!

     স্যাঙাত দুলের চালাকিতে আবারও দুলে দুলে হেসে উঠেছিল সে প্রাচীন শরীরখানি নৈঃশব্দকে কায়েম করে, যে নৈঃশব্দে চাপা দীর্ঘশ্বাস জেগেছিল, যেহেতু তাতে বিস্মৃত স্মৃতির খননধ্বনি ছিল।

     --বুঝলে বাবা, তারপরেতে দিলে আর ঘরে ফেরে নাই। মাঝখান থিকে দিলের বাপ আর উ চৌকিদারকে লিয়ে পুলিশের খামোখা টানাটানি।

    ফোত্‍ করে সে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিতাই বীরবংশী, ফলত আঁধার চলকে উঠলে, কথা ভাসে।

     জাদুবুড়ির মাইলো

     নেতাইবুড়ো খাইলো...

     এ রসিকতায় বৃদ্ধের শিথিল শরীর তত্ক্ষণাত্‍ ছিলাটান, যে বিভঙ্গে ঘাড় ঘুরে যায় পলকে শানানো বাক্যে।

     --মা’মেগোর দল, খালভরার দল। মাইলো তোর বাপ খায়। শালো!

     --আহা, চটো কেনে খুড়ো। লাতির দল খানিকপারা মস্করা কচ্ছে।

     --মস্করা উদের বাপের ঠেঙে করতে বল। হুঁ! মস্করা! বয়সির মান নাই!

     এ মস্করায় সে প্রাচীন মন আনমনা হলে উদ্দালক উঠে সায়নের কাছে যায়, বস্তুত কথাও সে ক্ষণে বাঁক নেয়।

     --আরে, আব্বাস! বাতাসপুরের মসজিদ ছেড়ে ই ঠাকুরথানে?

     --কেনে? আমি তো পেত্যেক দিন আসি। না কি! দু-দিন শুধু আসা হয় নাই।

     --আরে, তার লেগেই তো বলা। ভাবলাম, আব্বাস আবার তাদের ভাইজানের মোচলমান দলে ভিড়লে কিনা! সি দলের সনে আবার কমুনিস, তা বাদে আদি জাতি দলের জোট। মেলা টাকা পেছে বুঝি আব্বাস!

     --ধুর-ধুর! টাকা কোথা? মুখে ফুটানি শুধু! ঘরের টাকা দিয়ে কেউ ভোটে খাটে?

     --তা, হিন্দু পাটি তো তোদের টাকা দেবে না। নব জাতি টাকা কিছু দিলে? আমাদের গাজনে নব জাতি পাঁচ হাজার দিলে তো, হিন্দু দলও পাঁচ হাজার। ভোটের পর তো চিনতে লারবে, এ সুযোগে টাকা খিঁচে লাও।

     --মিছে কথা বললে গুনা হবে। নব জাতি পাঁচ হাজার মসজিদে দেছে। তা, হাওয়া কী বুঝছিস?

     --বলব কেনে? ই বাদলা বাতের পারা হাওয়াও থম মেরে আছে। ভোটের আর পনেরো দিন। ই সমুয়ই তো ভোটারদের দিন। যেমুন পারো আদায় করে লাও। তবে একটো ভোট কমুনিস পাবে, নেতাই কামরেডের। হাঃ হাঃ!

     এ মস্করা ঝিমন্ত মানুষটাকে যেন জাগিয়ে দেয় তার নষ্টস্বপ্নে,-- কলা দুবো রে শালো, কলা।

     ঊগড়ানো বাক্যের ছন্দে লুঙির ওপর থেকে বৃদ্ধহাতে দুলে ওঠে মানুষটার শিথিল পুরুষাঙ্গখানি, যা হাসির লহরা ওঠায়—হাঃ হাঃ হাঃ! প্রতিধ্বনি তোলে ব্যাপ্ত চরাচরে। ছায়া আচ্ছন্ন আকাশ-দিগন্তে বিদ্যুত্‍ ঝিলিক হানে। মেঘ গর্জায় চাপা আওয়াজে। দূরে নদীর ধারে শেয়াল রাত মজায়। ফলে বাস্তব যেন ক্ষণেক লুপ্ত হয়। ছায়া ঘন হয়।

     এ ছায়ার আড়ালে সভ্য-শিক্ষিত উদ্দালকরা স্বেচ্ছায় খসে যায় শিবতলার জমাট আঁধার থেকে, কেননা সে আঁধার ভীষণই জীবন্ত, যেহেতু তা তার মতো করে অন্যায়ের মেঠো প্রতিবাদের, ফলত কায়েমী স্বার্থের চোখে জ্বলন্ত পাপের। সাবধানী ঘরমুখো পথ ভাঙে  উদ্দালকরা, যে পথের পাশে দেড় বছর ধরে অনাদর ঘুমে পড়ে আছে কুসুমডাঙা-বাতাসপুরের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়খানি ভাইরাস গেলে আবার জেগে ওঠার স্বপ্নে, এ স্বপ্নে উদ্দালক একটু থমকায়, একটুখানিই। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে যেন, ফলে ওরা দু-জন পা চালায়, যদিও হাতে ছাতা, তবুও যে অকালের জল—গায়ে লাগলে জ্বর-জ্বালা হতে কতক্ষণ, বিশেষত এ করোনা কালে, যা যম কালই যেন!       

      পরের দিন উদ্দালক ঘরবন্দিই থাকে প্রায়, যেহেতু সে অকালের জল নাছোড় ঝরেই যায় সারাটা দিনমান জুড়ে—আবহাওয়ার ভাষায় হালকা থেকে মাঝারি ছন্দে, যে ছন্দে আলিস্যি ছায় দেহ-মনে, সে আলিস্যিতে উদ্দালক সারাদিনটা গড়িয়েই দেয় প্রায়, সে গড়ানোতে মিশে থাকে মাটির দেহজ সোঁদাগন্ধ, জানলার পাশের আমগাছের পাতায়, একটু দূরের জরুলের পাড়ের বাঁশগাছের পাতায় জলের ঝরে পড়ার রূপ-ছন্দ, যা নাগরিক তার অভিজ্ঞতায় অপূর্বই! টিভির খবর জানায় যে ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে নিম্নচাপ রেখার কারণে এ জল নাকি চলবে আগামী আরও দু-দিন। চলুক! ভাবে উদ্দালক—ভাবনাহীন!         

 

॥ ৪ ॥

সোমবার—আজ শিবের নীলপুজো, নীলষষ্টিও, যে দিন উদিত হয় সকল মানুষজনকে পুণ্যাতুর অবাক করে, যেহেতু এ সকাল নির্মেঘ-আলোমাখা, ফলে দেব মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা পায়, সে মাহত্ম্যে সোমবার-শিববার—এ কথাটিও আটন পায়। যদিও নীলপুজো যে নিম্নবর্গের ক্ষমতায়নও, তাও উচ্চ নিনাদিত ছিল কাল সাঁঝ থেকেই ডিজের প্রবল স্পর্ধায় বেজে ওঠায়, সে মহিম স্পর্ধায় সাজো-সাজো রব জেগেছিল বৃষ্টিভেজা সাঁঝ-আঁধারকে টলিয়ে ডোমপাড়ায়, বাগদিপাড়ায়, কেননা অন্তত জনা চল্লিশ ডোম-বাগদি মেয়ে-মরদ বাঁক কাঁধে যাত্রা করেছিল দূরের উদ্ধারণপুরের গঙ্গার ঘাটের পানে, জল ভরতে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে, বৃষ্টির ধারা অঙ্গে জড়িয়ে জয়ধ্বনি জেগেছিল-- শিবো হে! জয় বাবা কাল ভৈরবের জয়। বোলে ব্যোম, তারক ব্যোম!

     একটু বেলা বাড়লে ষষ্টির ফোঁটা কপালে নিয়ে উদ্দালক-সায়ন হাঁটা দেয় শিবতলার উদ্দেশ্যে, উত্সবের আঁচ আমনশরীরে মাখতে, যদিও গাজন জেগে উঠবে বেলা গড়ালে বিকেলে, তবুও উত্সবের আয়োজন থাকে, থাকে তার আলো, যা লেপ্টে থাকে উত্সব-প্রাঙ্গণে।

     উদ্দালক চোখ ভরে দেখে সে উত্সবের আপাতত উদাসীন সৌন্দর্যের ফুটে ওঠা-- বৃষ্টি ধোয়া শিবতলার রঙিন কাগজের শিকলে-আম্রপল্লবে সেজে ওঠায়, মন্দিরের গর্ভগৃহে কয়েকঘর বামুন-কায়েত রমণীর শিবপুজোয় আর আটচালায় সন্ন্যাসীদের অলস যাপনে, ডিজের অকাল স্তব্ধতায়। এ উদাসীনতা আরও গাঢ হয়ে ওঠে যেন নিতাই ডোমের ছেদহীন-একটানা খেদোক্তিতে, যে খেদ শিবমন্দিরের দখিনবাগে মেঠোপথের ওধারে প্রাচীন পাকুড়গাছের তলায় পরিত্যক্ত ধরমরাজের আটন নিঃসঙ্গ জাগায়।

    --হুস! হুস! শালো গিরগিটি! ন্যাতার মারি তোর! রঙ বদলানো আবার! এখুনি সবুজ তো তেখুনি লাল, তাবাদে চক্কু পলকে মাটি রঙ! ওহ, ঘাড় ঘুরিয়ে রোখ দিখায় আবার!

    বৃদ্ধ মানুষটি ঢিল ছুড়লে সরীসৃপটি ছুটে মাঠের আলের আড়াল নেয়, এ অবসরে নিতাই ডোম কোদালের হাতলে শরীরের ভর রেখে একটু জিরেন নেয় যেন, সে ঢঙে  বুড়ো ফুসফুস তার বাতাস পায়, ফলে তার চনমনে দেহ আবারও হাতে কোদাল ধরে বজ্রমুষ্টিতে, সে মুষ্টিতে কোথায় যেন প্রাণের আরাম লেখা থাকে, মনের শান্তি। ধরমতলার মাটি চাঁচে পরম মানুষটি মায়ায়, সে মায়ায় সূর্যের আলো খুনসুটি করে পাকুড়ের জল-ধোওয়া চিকন পাতার সনে— আলোছায়ার আলপনা ঝিরঝির ভিজিয়ে দেয় বৃদ্ধ শরীরটি, কেননা তখুনি হাওয়া বয়। কোদালের ঢিমে ছন্দে মুখ চালায় নিতাই ডোম, বীরবংশী যে।

     --শিবপুজো কচ্ছে! তা কর কেনে শিবপূজো। আমরাও করেচি আজেবন। তা বলে বাপ-পিতিমোর ধম্মরাজকে ভুলে যাবি? আরে খালভরা, নামুনে, বাঁশবুকোরা—ডোম-বাগদির আসল দ্যাবতা ই ধম্মরাজ ঠাকুর। না, জাতের দ্যাবতাকে অছেদ্যা করে জাতে ওটার পচিষ্টা! বামুন-কায়েত হবে সব! উদ্দারেনপুর থিকে পবিত্ত গঙ্গাজল আনবে শিবের লেগে! সিনিমা-টিবির হুজুগ! ওরে বোকারা বুঝিস না কেনে—নারানতলায়, দুর্গাতলায় তোদের উটতে দেয়? শুধু বিসজ্জনে ঠাকুর কাঁধাবার লেগে তোদের পেয়োজন। তা, তখুন তো ঘট বিসজ্জন সারা। পতিমের পরানটোই তো বিসজ্জন হয়ে গেইছে।

    আপনমনে বকে আর কোদাল চালায় নরম হাতে নেতাই কামরেড, দু-দুক্ষেপের পঞ্চাত্‍ যে,-- অধম্ম। অধম্ম সব। অধম্মে গেছে পিথিমিটো। এতো অধম্ম সইবে না, তা বলে দিছি। তখুন এ বুড়োর কথাখান মান পাবে।

     একটু থামে সে, শ্বাস নিতেই যেন, আবারও নতুন উত্সাহে কোদাল চালাতে, সে ধরতাইয়ে কথা বুনতে।

     --তুরা বুঝিস বুঝি ই বুড়ো কিছুটি জানে না। পঞ্চগাঁ জানে আর আমি জানতে লারবো! উ চকচকির ডাঙাটোকে খাবলে, কামড়ে শেষ করে দিলি। কী না, মোরাম চালান দিয়ে দুটো ট্যাকা।! মা-মেগোরা মাটি-মা’টোর ইজ্জত লিলি দুটো পয়সার লালচে। মায়ের পারা লদীটোকেও সম্বচ্চর বালি তুলে, বালি তুলে বারোভাতারি করে ছাড়লি! ... পঞ্চাতের চোকের ছামুতে, পাটির আশকারায়। ভাবলি, শিবের মন্দিরটো বিলিতি মাটি আর পাথর দিয়ি গড়ে দিলিই সকল পাপ মকুব। জেনে রাখীস মনেতে পাপ বাপকে ছাড়ে না। অধম্ম সইবে...

      বাক্যি হরে যায় সহসা নিতাইয়ের, যেহেতু তার কোদালে উঠে আসে পোড়া মাটির এক খোঁড়া অশ্বমূর্তি, যা স্তব্ধতা আনে তার আমনদেহে পুরাণ ঘোর জাগিয়ে, যে ঘোরে সে তার মাথায় জড়ানো গামছাখানি খুলে মাটি মোছে সে পুরাণ মূর্তির, সে ভঙ্গিতে আদর লেপা থাকে যেন। ক্ষণ পরে ঘোর–আচ্ছন্ন নিতাই তড়িঘড়ি কুলুপুকুরের ঘাটের পানে ধায়, সে পথ ভাঙায় তার দু হাতের অঞ্জলিতে শুয়ে থাকে মাটির প্রতীকটি পরম মায়ায়, সে মায়ার টানেই নিতাই গোড়ালিডোবা জলে কোনোগতিকে চান করায় তার পড়ে পাওয়া স্মৃতিচিহ্নটিকে, মনে এ বাসনা হেনে যে বিকেলে ধরমগড়ের বিলে জাদুরঘটায় বাণেশ্বরকে চান করার কালে সেও চান করবে এই ধম্মবাহককে।

     ধর্মপূজারী নিতাই পরম যত্নে আপাতত সে মূর্তিটিকে গাছের ফোকরে রেখে, সে নিশ্চিন্ততায় বাকি ঠাইটুকু চেঁচে-ছুলে, জলমাড়ুলি দিয়ে গোটা ধরমথানটিতে পবিত্রতা লিখলেপর কোমরের পেছনে হাত দিয়ে স্বস্তি আঁকে দেহে, মনেও—কেননা সে মনে আশুভবিষ্য আলো পায়। বিকেলে আকন্দ ও ধুতরো ফুল দিয়ে সাজাবে সে এ আটনখানি। ধূপ-দীপ জ্বালাবে। তারপর তেল-সিঁদুর মাখিয়ে ধম্মরাজকে আবার জাগাবে সে এ ধরমথানে। এ স্বস্তি তৃপ্তি দাগে যেন, ফলে মানুষটি প্রাচীন চক্ষু মেলে লহমার তরে রোদ-উজলা আকাশের পানে, সে ভঙ্গিমায় প্রণাম থাকে। লহমা যদিও, তবু তার প্রাজ্ঞ দৃষ্টিতে ছায়া ফেলে দূরতর শূন্যতায় ভাসন্ত নিঃসঙ্গ এক চিল, বিন্দুবত্‍ সে খেচরের গোলাকার ক্রমশ নেমে আসা।  ধরমথানে উদাস দৃষ্টি মেলে স্বগতোক্তি করে সে—গতিক সুবিদের লয় দেকচি। বাদলা বাত আবার এলো বলে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন