অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
অম্বা সেদিন সুমনকে খুঁজেছিল। সুমনও সেদিন খুঁজেছিল অম্বাকেই। দুজনের কেউই সেদিন কাউকে খুঁজে বের করতে পারেনি। উইংসের ওপার থেকে গান বেজে উঠেছিল। কোন সকালের অন্ধকারে, ডাক দিয়ে যাওয়ার গান। কেউই তার খবর পায়নি। ‘মুক্তধারা’ সেদিন বাঁধা পড়তে চলেছিল। রবিঠাকুর আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যন্ত্রসভ্যতার সর্বনাশ। আমরা আজও বুঝিনি। এখনও আমরা বিজ্ঞানের ঔদ্ধত্য শানিয়ে প্রকৃতিকে এঁটে বাঁধবার চেষ্টা করে চলেছি। এখনও আমরা ভীষণ হয়ে উঠতে চাই। নদীকে আমরা জিজ্ঞেস করি না, “নদী তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?” বরং ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তারই ধারা-প্রকৃতিকে নির্ধারণ করতে চাই।
৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ দিবসের কথা উঠলেই আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ন, পরিবেশ পরিবর্তন, কার্বন নিঃসরণ, বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা, জলাভূমি বাঁচাও আন্দোলন, ইত্যাদি একগুচ্ছ বিষয়কে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করে ফেলি। তলিয়ে ভাবতে চেষ্টা করি না, এগুলির যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদেরই ভবিষ্যতের উপর ক্রমশ এসে পড়তে চলেছে, কতখানি মারাত্মক তার ফলাফল হতে পারে। আমরা পরিবেশ দিবসের সাধারণীকরণ ঘটিয়েছি। দিনটিকে আমরা কতগুলি বিশেষ শব্দগুচ্ছের সমষ্টি বানিয়ে তুলেছি। আমরা ভেবে দেখতে চেষ্টা করিনি, আদতে মাতৃদিবস বা পিতৃদিবসের উদযাপন যেমন কোনও একটি বিশেষ দিনে মাত্র হতে পারে না, তেমনই পরিবেশ দিবসেরও কোনও একটি বিশেষ দিন মাত্র উদযাপনের জন্য থাকতে পারে না। আমরা প্রকৃতির যে সর্বনাশ ঘটিয়েছি, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমাদের সার্বিক সচেতনতারই প্রয়োজন এখন। পরিবেশের উদযাপনকে এখন একদিকে যেমন আমাদেরই নিজেদের প্রতিদিনকার অভ্যাসে নিয়ে আসতে হবে, অন্যদিকে আমাদেরই সচেতন হতে হবে প্রশাসনিক বা নীতি-নির্ধারক স্তরে পরিবেশ-বিরোধী সিদ্ধান্তগুলির বিষয়ে। নচেৎ জোশীমঠ বা উত্তরাখণ্ডেরই মতো বিপর্যয় নেমে আসবে আমাদেরই মহল্লায় হঠাৎ।
এতটুকুও বাড়িয়ে বলছি না। উত্তরাখণ্ডের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি আজ, সম্পূর্ণ রাজ্যটিই যে এখন কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার বিপদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রহর গুণে চলেছে, কিছু কথায় আজ পরিবেশ দিবসের সমকালে দাঁড়িয়ে তারই ব্যাখ্যা করি বরং? পরিবেশকে বাদ দিয়ে সাহিত্য বা সংস্কৃতি হয় না। উত্তরাখণ্ডের যে বিপুল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব, বছরের পর বছর সেই গুরুত্বকেই ভাঙিয়ে চলতে গিয়ে, আমরা পরিবেশের খেয়াল রাখিনি। পর্যটনের নামে আদতে নামিয়ে এনেছি বিপর্যয়। ভৌগোলিক দিক থেকে দেখলে আমাদের মনে রাখা উচিত, বয়সের দিকে থেকে হিমালয় আদতে নবীন। রীতিমতোই সে নবীন। এখনও তার গঠনপ্রক্রিয়া অব্যাহত। তারই ফলস্বরূপ পাহাড়ের নীচে, ভূঅভ্যন্তরে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে অজস্র চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন। যেগুলির থেকেই যে কোনও মুহূর্তে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে যেতে পারে। এমতাবস্থায় আমাদের কিই বা করণীয় ছিল? করণীয় ছিল এটাই, যে আমাদের নিশ্চিত করা উচিত ছিল–কোনও ভাবেই যেন সেই সমস্ত চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইনের উপর চাপ এসে না পড়ে। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের ভূঅভ্যন্তর ও ভূমিরূপকে আমাদের সচেতনতার সঙ্গে, নমনীয়তার সঙ্গে, ধৈর্যের সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত ছিল। বাস্তবে আমরা ঠিক তার উল্টোটাই ঘটিয়েছি।
হিমালয়কে যদি আমরা একটি সজীব অস্তিত্ব হিসেবে ভাবতে চাই, (আমাদের ‘প্রাচীন শাস্ত্র’ অনুযায়ীও এমনটা ভেবে নেওয়া কষ্টকর নয় বোধহয়), তাহলে আমরা দেখব বিগত কয়েক দশক ধরে নিয়মিত ভাবে আমরা সেই সজীব অস্তিত্বকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলারই নীতি নিয়ে চলেছি। এই উত্তরাখণ্ডেই সুন্দরলাল বহুগুণার নেতৃত্বে এককালে গড়ে উঠেছিল চিপকো আন্দোলন। পাহাড়ের বনভূমি রক্ষার্থে সেই আন্দোলন সারা পৃথিবীর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আদতে পাহাড়ের সেই বনভূমি সংরক্ষণের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল কেবলই অক্সিজেন উৎপাদক সবুজ বাঁচানো নয়। বরং পাহাড়ের গভীরে প্রোথিত যে মহীরুহের শিকড়, সেগুলির মাধ্যমে তারা যে মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়–সেই মাটিকে বাঁচানো। ভূমিক্ষয় রোধ করা। যাতে কিনা ভূঅভ্যন্তরে কোনও অস্বাভাবিক শূন্যতার সৃষ্টি না হয়, যা ক্রমশ পাহাড়ের ভারসাম্যকে দুর্বল করে দিতে পারে, এবং সেই শূন্যতার পথ বেয়েই গড়িয়ে আসতে পারে বরফগলা জলের প্রবাহ, ভূপৃষ্ঠকে ফাটিয়ে চুরমার করে সৃষ্টি করতে পারে বিপর্যয়।
আমরা শিক্ষা নিইনি। আমরা তাই চারধাম প্রকল্পকে রূপায়ণ করেছি। তারই সঙ্গে আমরা উদ্বোধন করেছি একগুচ্ছ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের। নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে নিয়ে আমরা আক্ষরিক ভাবেই ছিনিমিনি খেলতে চেয়েছি। যে নদী প্রত্যক্ষ ভাবেই পাহাড়ের উপরকার হিমবাহ থেকে জন্মের মুহূর্তে ‘আপনবেগে পাগলপারা’ হয়ে ছুটে চলতে চায়, আমরা তাকে আমাদেরই ইচ্ছে মতো বাঁধতে চেয়েছি; চালাতে চেয়েছি নিজেদেরই পছন্দের অভিমুখে।
হিমালয়ের এই অঞ্চলে যাঁরাই বা গিয়েছেন, তাঁরাই নিশ্চিত করে নিজের চোখে দেখে এসেছেন সেই অঞ্চলের নদীগুলির কেমনতরো রূপ। তদুপরি যেমনটা বলে এলাম, প্রতিটি পাহাড়েরই বয়স অল্প, পাথর বা মাটি এখনও নবীন, অভ্যন্তরে এখনও চ্যুতিরেখার নড়াচড়া চলেছে। এমন একটি অঞ্চলে, উত্তরাখণ্ডের আয়তনও মোটামুটি সবাইকারই জানা, সেই ছোট্ট রাজ্যের এমন সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চলেই, একটি, দুটি বা তিনটি নয়–সরকারি তরফে গড়ে তোলা হয়েছে ৭০টিরও বেশি নদীবাঁধ প্রকল্প। বিশ্ব উষ্ণায়নে বরফ গলছে। নদী ও সমুদ্রে জলস্তর বাড়ছে। বাড়ছে আবহাওয়ার খামখেয়ালি প্রবৃত্তি। ২০১৩ সালের মেঘফাটা বৃষ্টিতে যখন দেবভূমি কেদারনাথ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, আমরা দেখেছিলাম পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে, পাহাড় ফাটিয়ে, নদীর একেবারে জল অবধি নেমে এসে, হোটেল ও রাস্তা তৈরির ফলাফল কি মারাত্মক হতে পারে। এরও পরবর্তীতে আমরা ৭০টিরও বেশি নদীবাঁধ প্রকল্পকে অনুমোদন করেছি। অনুমোদন করেছি চারধাম প্রকল্পের মতো আত্মধ্বংসী পরিকল্পনাকেও।
৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১। চামোলি হিমবাহ গলিয়ে সেদিন অভিশাপের জলস্রোত নেমে এসেছিল। কেদারনাথ পেরিয়ে, তপোবন এলাকার কাছে ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ ফাটিয়ে সেদিন বিপর্যয় ঘটেছিল। সরকারি হিসেবেই সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন ২০০রও বেশি মানুষ। আর কি কি ঘটেছিল সেদিন? ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, ৯০% ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। পাঁচটি সেতু সম্পূর্ণ ভেসে গিয়েছিল। ধৌলিগঙ্গার বাঁধে চওড়া ফাটল ধরেছিল। ভেসে গিয়েছিল গ্রামকে গ্রাম, প্রকৃতির রুদ্ররোষের সামনে এতটুকুও দাঁড়াতে না পেরে। সরকারি প্রকল্পগুলির থেকে ভেসে গিয়েছিল অন্ততপক্ষে ৩০,০০০ কোটি টাকার বিবিধ যন্ত্রাংশ ও পরিকাঠামো-বিষয়ক উপাদান। ‘বিকাশ’কে তবুও রুখে দেওয়া যায়নি। গড়গড়িয়ে এরপরেও গড়িয়েছে ‘চারধাম প্রকল্প’এর জয়রথ। থামিয়ে রাখা যায়নি তার মদমত্ততাকে। তাকে নিয়েই বা কিসেরই এত বিতর্ক, একটু দেখে নেওয়া যাক বরং।
চারধাম প্রকল্পের নামে হিমালয়ের উপর অতখানি উচ্চতায় তৈরি হতে চলেছে ৭১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১০ মিটার অবধি প্রশস্ত, এ্যাসফল্টে মোড়া একেকটি অভাবনীয় রাজপথ। তৈরি হবে হেলিপ্যাড, অসংখ্য বাইপাস, সেতু ও সুড়ঙ্গব্যবস্থা। যে গাছগুলির শিকড় মাটি আঁকড়িয়ে থাকত, সেই গাছগুলিকে একেকটি মাত্র কলমের আঁচড়ে নির্বিচারে কেটে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হবে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে দীর্ঘতর কোনও সড়ক প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে গেলে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব সম্পর্কে একটি বিস্তারিত আলোচনা করা জরুরি। আইনি পরিভাষাতে একে বলা হয় এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট এ্যাসেসমেন্ট বা সংক্ষেপে ইআইএ সমীক্ষণ। চারধাম প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই সমীক্ষাপর্বকে যাতে এড়িয়ে যাওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে চারধাম প্রকল্পটিকে কমবেশি ৩৫টি ভাগে বিভক্ত করে সম্পূর্ণ প্রকল্পটির রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। যাতে কিনা সড়কপথের কোনও অংশেরই দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটার না ছাড়ায় এবং এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশগত সমীক্ষার বিষয়টিকেও স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাওয়া চলে। গাছ, মাটি পাহাড়ের কথা বলছিলাম – তথ্য বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল অবধি এই দুর্গম পার্বত্যভূমিতে সড়কনির্মাণ ও অন্যান্য ‘উন্নয়নমূলক’ কাজের প্রয়োজনে ৫৮৬৮৪ হেক্টর পরিমাণ জমির অরণ্যসম্পদকে সমূলে বিনষ্ট করা হয়েছে। এবারে প্রকৃতির আত্মরক্ষার সময়।
পরিবেশ দিবসে আমরা কেউই হয়তো ধ্রুবজ্যোতি ঘোষকে স্মরণ করব না। স্মরণ করব না গুরুদাস অগ্রবালকে। গত শতকের সত্তরের দশকে ডঃ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চল বা ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যাণ্ডস অঞ্চলের বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব নির্ধারণে কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁরই গবেষণার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, কিভাবে এই জলাভূমি অঞ্চল নিজের বিপুল বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্যকে কাজে লাগিয়ে কলকাতা শহরে উৎপাদিত প্রতিদিনকার দূষিত জলের একটা বিরাট অংশকে নীরবে শোধন করে চলেছে। সেই দূষিত জলের পরিমাণ কত আন্দাজ করতে পারেন? অঙ্ক কষে ডঃ ঘোষ দেখিয়েছিলেন, সেই পরিমাণ কমবেশি ৭৫ কোটি লিটার। মূলত তাঁরই গবেষণা ও আন্দোলনের ফলস্বরূপ আদালতের তরফে এই জলাভূমির স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনে বেশ কিছু নির্দেশ জারি করা হয়। পরবর্তীতে তিনি ও তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের একান্ত পরিশ্রমে আন্তর্জাতিক জলাভূমি-পর্যবেক্ষক সংস্থা পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চলকে রামসর সাইট বা ওয়েটল্যাণ্ড অব গ্লোবাল ইম্পর্ট্যান্সের স্বীকৃতি প্রদান করে।
সিভিল এঞ্জিনিয়র গুরুদাস অগ্রবালের কপালে অতখানি সৌভাগ্য জোটেনি। আইআইটি রুরকি থেকে সিভিল এঞ্জিনিয়রিংয়ে স্নাতক, বার্কলে ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর, পরবর্তীতে কানপুর আইআইটির অধ্যাপক, চাইলে পরে কেরিয়রের দিক থেকে চমৎকার এক নিশ্চিন্ত জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন তিনি। কিন্তু ১৯৭৪ সালে তিনি নব-প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রধান সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। সদ্য বিদায় নেওয়া ইউপিএ সরকারের আমলেও ‘ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন অথরিটি’রও তিনি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। কিন্তু গঙ্গা তথা হিমালয়ের প্রতি পরিবেশগত দিক থেকে সরকারি ও আমলাতান্ত্রিক উদাসীনতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। জীবনের চল্লিশটা বছর গঙ্গা ও তার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের জন্য প্রাণপাত করে গিয়েছেন এই গুরুদাস অগ্রবাল। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর জীবন ছিল সেই গঙ্গারই জন্য বলিপ্রদত্ত বোধহয়।
২০১১ সালে তিনি সংসার-আশ্রম ছেড়ে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন। তাঁর নতুন নাম হয় স্বামী স্বরূপানন্দ। নিজের অধীত বিদ্যা ও অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতিতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে রুদ্ধ করে, সংশোধন করে, তাকে বাঁধ দিয়ে যেমন খুশি আটকানোর প্রচেষ্টা কতখানি ভয়ানক হতে পারে। ২০০৮ সালে প্রথমবারের জন্য তিনি গঙ্গার এক প্রধান উপনদী ভাগীরথীর উপর জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতায় অনশনে বসেন এবং অন্যান্য নদীসমূহের উপর সমস্ত নির্মীয়মান প্রকল্প প্রত্যাহারের দাবি জানান। কিন্তু অনশন সত্যাগ্রহে অধ্যাপক অগ্রবালের প্রথম সাফল্য আসে ৬০০ মেগাওয়াটের লোহরি-নাগপালা প্রকল্পের বিরোধিতায়। তাঁর ৩৮ দিনব্যাপী অনশন ইউপিএ সরকারকে অবধি শেষমেশ নমনীয় হতে বাধ্য করে। সরকার তাঁর দাবিগুলি মেনে নেয় ও গোমুখ থেকে উত্তরকাশী পর্যন্ত গঙ্গার প্রায় ১০০ কিলোমিটার যাত্রাপথকে ‘বাস্তু-সংবেদনশীল অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করে। আন্দোলন তাতেই থেমে থাকেনি তাঁর। জীবনের শেষ দশবছরে অন্তত পাঁচবার তিনি দীর্ঘমেয়াদী অনশন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি অঞ্চলে যে একের পর এক পরিবেশ ধ্বংসকারী নদীবাঁধ প্রকল্প, তারই প্রতিবাদে ২০১৮ সালের ২২শে জুন তিনি হরিদ্বার শহরে অনশন আন্দোলন শুরু করেন। আজ সেই বাঁধগুলির বিষয়ে তাঁর প্রতিটি ভবিষ্যদবাণীকে আমরা সত্য হিসেবে মিলে যেতে দেখেছি। দেখেছি উত্তরাখণ্ডের বিপদ ঠিক কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ২০১৮তে, আমরা কেউই তাঁর আন্দোলনকে গুরুত্ব পেতে দেখিনি। ১১০ দিনের অনশনের পর ১১ই অক্টোবর, ২০১৮, দেবীপক্ষের সূচনার দুই দিনের মাথায়, অনাহারে প্রাণত্যাগ করেন স্বামী স্বরূপানন্দ ওরফে গুরুদাস। সামাজিক মাধ্যমে কখনই তাঁকে নিয়ে বড় একটা হইচই পড়তে দেখিনি।
৫ই জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আমরা এই দিনটিতেও, কেবল যদি সেই নিবন্ধের শুরুতেই বলে আসা শব্দ বা শব্দবন্ধগুলিকে স্মরণ না করে, গুরুদাস অগ্রবাল, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ, অথবা উত্তরাখণ্ডের এমন সমস্ত ঘটনাকেই নিজেদের স্মৃতিতে বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই, তাহলেই বোধহয় আমাদের তরফে তা হবে পরিবেশ দিবসের সর্বশ্রেষ্ঠ উদযাপন। আগে আমরা নিজেদেরকেই বরং সচেতন করে তুলতে চেষ্টা করি। সমাধান খোঁজার সদিচ্ছা থেকেই একদিন হয়তো মিলবে সমাধানেরও হদিস। কাজেই সেই সদিচ্ছারই খোঁজটুকুতে আজ বিশ্বাস রাখতে চেয়েছি। সভ্যতার সংকটেও বিশ্বাস রাখতে চেয়েছি, মানবতায়।
সূত্রঃ
[১]https://www.4numberplatform.com/?p=28001
[২]https://www.4numberplatform.com/?p=24525
[৩]https://www.4numberplatform.com/?p=8741