(পর্ব # ১৫)
॥ ৩ ॥
বিকেলে উদ্দালক সায়নের সঙ্গে ঘুরতে বেরোয় গাঁ দর্শনে, হয়তো বা তার ছেলেবেলার স্মৃতির সন্ধানে, যদিও স্মৃতি প্রতারকই এবং এ ক্ষেত্রে তা আরও সত্য, যেহেতু গাঁ-খানা খাঁ-খাঁ মলিন। এ মলিনতা আরও গাঢ যেন বা, কেননা এ বিকেল মেঘলা এখন, তাই মনখারাপি, ফলত নৈঃশাব্দিক, যাতে কুড়ি কুড়ি বছর আগের নিঝুম স্মৃতিঘুমের খননধ্বনি। আবার এমত খনন একাকী হওয়ায় সায়ন বেজে ওঠে নিজস্ব লয়ে।
--বলছিলাম না! বাবুপাড়া সব ফাঁকা। বামুন পাড়ায় আমাদের নিয়ে তিন ঘর আছি। আর দত্তদের ওপাড়ায় দত্ত, ঘোষ, সরকার, মিত্তির মিলিয়ে মোট পাঁচ ঘর। সেই বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকেই চাকরির জন্যে প্রবাসী। পরিযায়ীও বলতে পারিস।
নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে সায়ন। সে হাসিতে মেঘলা বিকেলের ঝিমঝিম আলোকে চলকে জাগিয়ে তোলে তাদের, মুখার্জীদের ছোটোতরফের সরস্বতীতলা তার আলোহীন জীর্ণতায়, সে আলো-আঁধারে মায়া রচে ইঁটের দেওয়ালের ওপর টিনের চালঅলা মন্দিরখানি, তার ভাঙা আটচালার স্মৃতিকে বুকে জড়িয়ে, যে স্মৃতি চারিয়ে যায় উদ্দালকের কুড়ি-কুড়ি বছরের বিস্মৃতিকে উসকে দিয়ে। ছোট্ট উদ্দালক তো সরস্বতীপুজোতেই আসতো, যেহেতু তা তাদের বাড়ির পুজো, মা সরস্বতী যে তাদের কূলদেবতা—আড়াইশো বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের, যে ঐতিহ্যে জমজম করে ওঠে আটচালা সমেত মন্দিরখানি, লোক-লস্করে, ঢাক-ঢোল-সানাই-এর মূর্ছানায়, সরস্বতী-লক্ষ্মী-জয়া-বিজয়ার জাগ্রত ঔজ্জ্বল্যে। এ ঔজ্জ্বল্যে আলো পায় সুজিত মুখার্জীর মুখ।
--জানো দাদাভাই, আমরা আদিতে মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপির—পঞ্চস্তুপ বৌদ্ধবিহারের, তাই থেকে পাঁচথুপি। তা সেখান থেকে আমাদের এক পূর্বপুরুষ অন্নের সন্ধানে চলে আসে রামপুরহাটের কাছে বেলুন গাঁয়ে। সেখান থেকে আবার তিনশো বছর আগে কেশবরাম পণ্ডিতি করতে আসে এখানে, কুসুমডাঙ্গায়। সেই পেট, পেটের ধান্দায়। এই যেমন আমি গাঁ ছেড়ে নগর কলকেতায়। হাঃ-হাঃ। হেসেছিল দাদু, যে হাসি অনুরণন তোলে যেন এ ক্ষণে মেঘলা বিকেলের ম্লান আলোয়, যেহেতু হাওয়া বয় রসকেগড়ের বাঁশবনে ঝির-ঝির আওয়াজ তুলে।
--তখন তো এখানে দত্তদের জমিদারী। পরে ওদের বড় তরফ সময়কে পড়তে শেখে, ঈশ্বরপুরে চলে যায়, ঝরিয়ায় কয়লাখনি কেনে—লক্ষ্মী বাঁধা পড়ে। এখানে পড়ে থাকে তাদের দুই আনি-তিন আনি একটা অংশ। সে তো অন্য কাহিনী। এদিকে কেশবরামের দু-পুরুষ পরের শ্রীনাথ আর ক্ষেত্রনাথ—এই দুই ভাই সংস্কৃতের সঙ্গে, সেই-ই সময়কে পড়তে শিখে আরবি-ফারসি শেখে। বর্ধমানে রাজার সেরেস্তায় কাজ নেয়। পয়সা-কড়ি করে। জমির মালিক হয়—মেলা জমি, ছোটোখাটো জমিদারই। তা, বেলুনে মুখার্জীদের দুর্গাপুজো, ওরা দু-ভাই ভাবলে এখানেও দুর্গাপুজো করবে। তো, বেলুনের ওরা দুর্গার কাঠামোর অংশ কিছুতেই দিলে না। পুরনো কাঠামোর অংশ ছাড়া পূর্বপুরুষের পুজোর নতুন প্রতিষ্ঠা হয় না। করলে পুরোপুরি নতুন ভাবে করতে হয়, যাতে পুরনোর ঐতিহ্য, প্রাণ থাকে। ওদের মন নতুনে সায় দিলে না, তাছাড়া ও-পাড়ায় দত্তদের দুর্গা আছেই। তাই পণ্ডিত বংশের কারণে সরস্বতী, সঙ্গে লক্ষ্মী আর জয়া-বিজয়া—এই চার প্রতিমা এক কাঠামোয়। দুর্গাপুজোর মতোই হোম-যজ্ঞ-আচার-অনুষ্ঠান। তিন দিন ধরে।
ঠাকুরদার বহুবার বলা এ স্মৃতির উড়ালের, যা বংশগৌরবের, আর তা উদ্দালকের নিজের গর্বেরও, যেহেতু পুরনো মাটির মন্দির জীর্ণ হলে সে সময়ের রেওয়াজে সিমেণ্টের শানবাঁধানো আটচালা ও টিনের চাল সমেত মন্দিরখানি তার ঠাকুরদারই তৈরি, ফলে সে ধরতাইয়েই যেন হাহাকার ঘনায়, হয়তো অপরাধবোধও উদ্দালকের মনে এ বাদল বিকেলে এমত স্বননে—আর আজ! সে হাহাকারে পথ গড়ালে জেগে ওঠে এক জীবন্ত মানুষ এতক্ষণে— এ কে বটে রে সানু?
--জ্যাঠার ছেলে গো কাকা।
--ও, সমীরণদার বেটা। কখন আসা হল বাবা?
--এই দুপুরে কাকা।
--তা, গাঁ ঘুরতে বেরিয়েছ! সে গাঁ আর নাই বাবা।
এ আক্ষেপ গড়ালে ভেসে ওঠে পাশেই মুখার্জীদের বড় তরফের সরস্বতীতলা একই ম্লান জীর্ণতায়। এ ম্লান ছায়া আরও ঘন যেন বা এপাড়া আর ওপাড়ার মাঝের বাঁকের বাড়িপুকুরের পাড়ের বাঁশঝাড়ের নির্জনটায়। তবুও পথ, তার চলমানতা, ওদের পৌঁছে দেয় ওপাড়ার দুর্গামন্দির আর নারানতলার যত্নরঙিন ঔজ্জ্বল্যে, যেহেতু পাশাপাশি দুটি ঠাকুরথানই ঢালাই ছাদের, সিমেণ্টের-মার্বেল পাথরের। ফলে বিস্ময় স্বাভাবিক জাগে,-- এ পাড়ার মন্দির দুটো তো বেশ নতুন, ঝকঝকে! আগে তো টিনের চালের ছিল।
--দুর্গাতলাটা দত্ত, ঘোষ, সরকার, মিত্তির—সবাই মিলে চাঁদা তুলে নতুন করে তৈরি করেছে। আর মিত্তিরদের এক ঘর সিউড়িতে থাকে। ওরা ব্যবসা করে মেলা টাকা করেছে। ওরাই নারান তলাটা একাই করে দিয়েছে। দলের অহরাত্রির মচ্ছবের পুরো খরচাও ওরাই দেয়। ওরা প্রতি রবিবার পুরো ফ্যামিলি সিউড়ি থেকে সন্ধেবেলা গাড়ি নিয়ে আসে। সন্ধ্যারতি দেখে আবার ফিরে যায়। কাল তো রবিবার। দেখতে পাবি।
কথার আওয়াজ পাশের ঘর থেকে একজন বৃদ্ধমানুষকে বাইরে টেনে আনে।
--অ! সানু নাকি? সঙ্গে কে?
--জ্যাঠার ছেলে গো দাদু।
--সমীররণের ছেলে? বাঃ, অনেক বড় হয়ে গেছে দেখছি।
উদ্দালক বোঝে তাকে অনেকবারই পরিচিত হতে হবে এ ভাবে। এ পরিচয়ের বৃত্তান্তে তার নজর টানে বৃদ্ধের বাড়ির টিনের চালের বারান্দার থামে ঝোলানো ফালি সাইনবোর্ড—ইন্ডিয়া পোস্ট। এ চিহ্নে তার স্মৃতি টাল কহয় যেন।
--পোস্ট অফিস আগে আমাদের পাড়ায় ছিল না?
--হ্যাঁ, মদনকাকার বাড়ি। ও পোস্টমাস্টার ছিল তখন। রিটায়ার করেছে। এই ফুলুদাদুর ছেলে রানার কিনা, তাই এ বাড়িতে পোস্ট অফিস এখন। গ্রামীণ পোস্ট অফিসের রেওয়াজ এটাই।
বোঝা-না বোঝার দোলায় উদ্দালক জনশূন্য পথ ভাঙে একমাত্র সঙ্গীজন বলতে সায়ন ওরফে সানু’দা তার, যে সঙ্গী হঠাত্ই হ্যাঁচকা টানে তাকে সরু পথের এক পাশে দাঁড় করায়, নিজের স্থাণুমূর্তির নিস্পন্দ ছায়ায় অন্য হাতে ইশারা এঁকে, যে ইশারায় পথের অপর পাশে এক বন্ধ ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে সাদা হিলহিলে এক সরীসৃপও স্থাণুবত্, সে দৃশ্যে হিলহিলে চোরা স্রোত বয় শহুরে উদ্দালকের শিরদাঁড়া বেয়ে। ক্ষণিকমাত্র, সে প্রাণী একটি গর্তে ঢুকে গেলে সায়নের কথায় নিশ্চিন্তির প্রলেপ যেন।
--চিতি সাপ। ঘরেই থাকে ওরা।
ভয় তাড়ানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে উদ্দালকের বুক খালি করে, সে ঘাতে পথ সাবধানে গড়ায়, যা তাদের পৌঁছে দেয় গ্রামের এ প্রান্তের শেষসীমা বোলতলায়, যেখানে বৃদ্ধ বকুল গাছটি আজও ফুল ঝরায় বিরাটব্যাপ্ত হরি সায়রের জলজ মায়ায়। সে মায়ায় উদ্দালক সায়রের জল ছুঁতে চাইলে শয়ন বাধা দেয়।
--ওদিকে যাস না এখন... ডোম-বাগদিদের মেয়েমানুষরা মাঠ করতে আসে এ সময়। মানে তোদের ভাসায় পাটি করতে।
--মানে! নির্মল ভারত-স্বচ্ছ ভারত নেই এখানে?
--থাকবে না কেন? সব ঘরেই আছে। তবে জল কোথায়? গ্রীষ্মে তাবত্ এলাকার সব কুয়ো, টিউবওয়েল শুকনো। পুকুরের জল তলানিতে, পচা। শুধু এই হরি সায়রে, আর আমাদের ওদিকে বেনেদিঘিতে যে টুকু জল। আর ভরসা শিবতলার সে ব্রিটিশ আমলের ইঁদারা—ওর জল অফুরান সম্বচ্ছর। এক মাইল দূর থেকে জল টেনে নির্মল-স্বচ্ছ ভারত পোষায়। আমাদের বাড়ির শ্যালোতে ওই ভোরে যে টুকু জল ওঠে। থামে সায়ন, বাস্তবতাকে জোরের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েই—এ হি হ্যায় আসলি ভারত ভাই!
এ বাস্তবতায় দীর্ঘশ্বাসের হাহাকার থাকে, ফলে সময় বিষণ্ণ হয়। আলোহীন মেঘলা বিকেল ঢলে পড়ে সাঁঝের অন্যতর আলোহীনতায়। দিগন্তের মাঠে রাত্রের ঝুপসি আঁধার গুঁড়ি মেরে বসে থাকে চরাচরে ঝাঁপিয়ে পড়্ববে বলে।
আবছা আঁধার ভেঙে ওরা দু-জন পথ হাঁটে, যে পথ কিছু দূরে ওঠে পাকা রাস্তায়, ওদের নিয়ে যায় শিবতলার পানে। পাশ কাটিয়ে ছুটে যায় ঘরমুখো দুটো-একটা মোটরবাইক, ভ্যানো—কুসুমডাঙার কিংবা তা ছাড়িয়ে আরও দূরের কোনো গ্রামে। রাস্তার পাশে তেঁতুলগাছটায় কাঁচ-কাঁচ আঁধার দুলিয়ে পাখিরা ঘরে ফিরে আসে।