দোঁহা

তিস্তা-শালুক



অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 
(প্রথম কিস্তি)

 “ডানদিক থেকে লিখতে শুরু করব ভেবেছিলাম। যেমন ভাবে উর্দু লেখা হয়ে থাকে। উর্দু হলো প্রেমের ভাষা, শায়েরির ভাষা। সাত সাগরের, সাত হাজার বছরের প্রেম। মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, তাকেই আমরা প্রেমের প্রথম ধাপ বলে চিহ্নিত করতে পারি। বাকিটা লেখা থাকে মহাকালের অক্ষরে। লোকে শুধু জানুক, আমি ডানদিক থেকে লিখতে শুরু করব ভেবেছিলাম।”

 

[১]

এই গল্প যতখানি তিস্তার, ঠিক ততখানিই শালুকের। শালুক কোনও ভাবে যেন বুঝতে পারছিল, তিস্তার সঙ্গে ওর আবার দেখা হবে। মেট্রোয় চেপে ফিরতে ফিরতে ও কেবলই তিস্তার কথা ভাবছিল। প্রথম আলাপেই এভাবে ভালো লেগে যাওয়াটা, কেমন যেন বোধ হয়। আসলে, ওদের বয়সে এমনটাই হওয়া উচিত। আলাপের জায়গাটাও এমন অদ্ভুৎ। শালুক প্রেসিডেন্সির ছাত্র। ইকনমিক্স। এসেছিল বন্ধুদের সাথে কৃষক আন্দোলনের মিছিলে। সেখানেই মেয়েটার চোখে চোখ পড়ে গেল হঠাৎ।

আসলে চোখ পড়েনি ঠিক। মেয়েটাই হোঁচট খেয়ে ওর গায়ে এসে পড়েছিল। ওই ভিড়ের ভিতরে, মিছিল যতক্ষণে এস এন ব্যানার্জি রোডের মুখটায় এসে পড়েছে, পুলিশ আটকে দিল। মিছিলের যাওয়ার কথা ছিল এস এন ব্যানার্জি পেরিয়ে মেট্রো চ্যানেলের উপরটায়। সভা হওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু কর্পোরেশনের লাল বাড়িটার আগেই মিছিলটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হলো নিজাম, নিউ মার্কেটের গলিতে। পিছনের ভিড় উপচিয়ে এসে পড়ল সামনেটায়। কোনও মতে ম্যাটাডরের উপরে উঠে দাঁড়ালেন দিল্লী থেকে আসা কৃষক নেতারা একেকজন। সামনে-পিছনে ঠেলাঠেলি তখন। ঠিক এইসময়েই মেয়েটা শালুকের গায়ের উপর এসে পড়ল। নিজেকে সামলে নিতে নিতেই মেয়েটারও হাত ধরে ফেলল শালুক। নয়তো দুজনেই পড়ে যেত রাস্তার উপর। বিপদ ঘটতে পারত। আশপাশ থেকে ওর বন্ধুরাও হইহই করে উঠল। মেয়েটা নিজেকে সামলে নিয়েছিল। হাতে একটা ক্যামেরার ব্যাগ ছিল, বেশ বড়গোছের। “এর জন্যই বেশি বেসামাল হয়ে গিয়েছিলাম,” মেয়েটা নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে অস্ফূটে বলে উঠেছিল। শালুকের বন্ধুরা সেসব শুনতে চায়নি। ঘিরে ধরে সকলে মিলে তাকে আর শালুককে নিয়ে একপাশে সরে এসেছিল। সকলে মিলে পাশের দোকানে বসে একসাথে চা খাওয়া হয়েছিল। শালুকের কেবল এই দৃশ্যগুলোকেই তখন কেন জানি না খুব করে মনে পড়ছিল। ট্রেন ছুটে চলেছে। বাইরে অন্ধকার।

 
“অগলা স্টেশন যতীন দাস পার্ক, প্ল্যাটফর্ম ডাঁয়ে তরফ”।  শালুকের সম্বিৎ ফিরে আসে। এখন সন্ধ্যে কলকাতায়।

 
বাড়ি ফিরতে শালুক দেখল এরই মধ্যে ওর বাবা ফিরে এসেছেন। রিটায়ারমেন্ট যতই এগিয়ে আসছে, ততই যেন ওর বাবা আজকাল বেশ তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে আসতে শুরু করেছেন। অন্ততপক্ষে তেমনটাই চেষ্টা থাকছে তাঁর। বেশ বুঝতে পারছে শালুক। বাবার অবসর, কথাটা এখনও তার ভিতর অবধি কোনো বিশেষ অনুভূতি ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই শালুকের বেড়ে ওঠা। ওর সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্কটাও দেখতে গেলে সহজ, সরল, স্বাভাবিক, গড়পড়তা আর পাঁচজন মানুষের সন্তানের মতোই। যদিও তেমনটা না হওয়ারই সম্ভাবনা ছিল বেশি। ওর বাবা সেটাকে বুঝতে দেননি। অতিরিক্ত আদর অথবা শাসন, কোনোটাই শালুক পায়নি। ওদের বাইরের ঘরে ঢুকতেই যে কারোরই চোখে পড়বে খাবার টেবলের বাঁ দিকে দেয়ালের উপর বিশাল একটা ল্যাণ্ডস্কেপ। জলরঙে আঁকা ছবি। খোয়াই, শান্তিনিকেতন। দূর দূর অবধি রুখাশুখা মাটি ঢেউ খেলিয়ে চলে গিয়েছে। তারই সঙ্গে শালবন, নিষিদ্ধ সবুজ। একপাশে ভালো করে লক্ষ্য করলে চোখে পড়বে একটি সাঁওতাল মেয়ে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটু দূরে একটা কুকুর। ছবিটা শালুকের ভালো লাগে কিনা সে জানে না। কিন্তু সে জানে ছবিটা ভীষণ, ভীষণ প্রিয় তার বাবার। কখনও কখনও অনেক রাত্তিরে সে বাবাকে এই ছবিটার সামনে চুপ করে বসে থাকতে দেখেছে। ছবির তলায়, ডানদিকে একটা অদ্ভুৎ সুন্দর নাম, পদবী-বিহীন, সই করা আছে। নামটাকে শালুকের ভালো লাগে। তার মধ্যে যেন এক অবাক করা মিষ্টতা লুকিয়ে রয়েছে।

 শালুকের বাবা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "টিকিটটা কেটে ফিরতে নিশ্চয়ই আজকেও ভুলে গিয়েছ? "গলায় যত না হতাশা, তার চেয়ে অনেক বেশি যেন কৌতুক। শালুক অবশ্য টের পায়নি। বরং প্রশ্নটা শুনতেই আবারও তার হাতটা আপনা থেকেই তার মাথার উপরে চলে গেল, "একদম ভুলে গেছি! কাল ঠিক পেয়ে যাব। তুমি টেনশন কোরো না বাপি!" ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে স্বাভাবিক হতে চায়। উলটো দিকের মানুষটি মুখ টিপে হাসেন। "আর চিন্তা করতে হবে না। আমি নিজেই কেটে এনেছি অফিস ফেরত। কাল সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় ছাড়বে বাস। স্লিপার নিইনি, তবে এয়ারকণ্ডিশনড নিলাম। আরামে যেতে পারবে। "শালুক মাথা নামিয়ে নেয়। ওর ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠেছে।

 মুখ তুলতে শালুক দেখল ওর বাবা ভিতরে চলে গিয়েছেন। টেবিলের উপর খাবার আর দুটো বাসের টিকিট সমেত কিছু টাকা রাখা রয়েছে।  বাবা এখন চা করবেন‌। অন্যের হাতের চা তাঁর মুখে রোচে না। শালুক আবার সেই ছবিটাকে লক্ষ্য করে। আদিগন্ত বিস্তৃত রুখা মাটির দেশ। খোয়াই। বোলপুর, শান্তিনিকেতন। ওর ভালো লাগছে।

 
[২]

 -“প্রতিদিন কেন ফোন করো মা? আমি তো ভালো আছি। ঠিকই আছি। নিজেকে দিব্যি গুছিয়ে গুছিয়ে রাখছি। সবকিছু বুঝে বুঝে নিচ্ছি, আর এই তো মাত্র কদিনের এ্যাসাইনমেন্ট ছিল। তাও তো দেখো শেষ হয়ে এসেছে। এবারে শুধু ভ্যাকেশনিং আর ব্যাক টু তোমার কাছে!” ব্যাগে জামাকাপড় ভরতে ভরতে মার সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলছিল তিস্তা। খাটের উপরে ছড়ানো জামাকাপড়। বড় অগোছালো সবকিছুই। ওপাশ থেকে তিস্তার মা কথা বলেন। মেয়ে এবারে পা ছড়িয়ে বিছানার উপর বসে পড়ে। ধপ করে শব্দ হয়।

 
-“উফফ মা, তোমার মেয়ে এখন অনেক বড় হয়েছে। গ্র্যাজুয়েশন সেকেণ্ড ইয়ার, ইউ ডু গেট দ্যাট মা? ছাড়ো এসব। ছবিগুলোকে তুমি যদি দেখতে না মা একবার, একেকটা যা শট পেয়েছি। আমি তোমাকে হোয়াটস্যাপ করছি দাঁড়াও। ভাগ্যিস জার্নালিজম নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। একটা শটের জন্য জানো মা, ল্যাম্পপোস্টের নীচে যে কংক্রিটের গোল মতো একটা ধাপ থাকে, তারই উপর উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। উফফ, না মা, একটুও অসুবিধে হয়নি,” গোটা ঘর জুড়ে তিস্তার কলস্বর উড়ে বেড়াতে থাকে। ওপাশ থেকে কোনও কথা শোনা যায় না। হোয়াটস্যাপে ছবি ঢুকছে।

 
পুনার পাহাড়তলিতে বসে কোনও এক মায়ের মোবাইলে ছবিগুলো পৌঁছে যায়। তিনি একেকটা করে নামিয়ে নামিয়ে দেখেন। মানুষের মিছিল, মানুষের উচ্ছ্বাস  । কলরোল। কতদিন আগে তিনি ফেলে এসেছেন সেসব। একটা সময় তিনিও তো কলকাতায় ছিলেন। সেসব দিন আর মনে পড়ে না তাঁর। কিন্তু এই মিছিল, আন্দোলন, অথবা কলকাতার উচ্ছল যৌবনের চেহারাগুলোকে কোনও ভাবে কোথাও দেখলেই হঠাৎ, কেন জানিনা তাঁর বুকের ভিতরটুকুতে একেকটা শব্দ, একেকটা স্পর্শ, একেকটা সন্ধ্যেরাত, ভিড় করে আসে। তিনি ফিসফিস করে কবিতা বলে ওঠেন। আবারও নিস্তব্ধ হয়ে যান। সম্বিৎ সামলিয়ে তিনি বলে ওঠেন, “ব্যাগে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো রে? ওখানে কিন্তু ঠাণ্ডা পড়বে খুব। কেন যে তোর এই শেষ নভেম্বরেই দার্জিলিং যাওয়ার শখ হলো,” বলে একটু বিরতি নেন। তেষ্টা পেয়ে গিয়েছে। তিস্তা এপার থেকে আবারও কলকলিয়ে ওঠে, “সবকিছুকেই ঠিক মতো গুছিয়ে নিয়েছি মা। ক্যামেরার লেন্স, ট্রাইপড, ক্যামেরার ব্যাগ,” বলেই সে জিভ কেটে ফেলে, “আর হ্যাঁ জামাকাপড়, ওষুধ, এইসবও নিয়েছি!” মনে মনে সে ভাবতে চেষ্টা করে, সত্যিই এই শহরের সন্ধ্যেগুলো কি ভীষণ মনোরম। জানালা দিয়ে ছাতিম ফুলের গন্ধ আসছে। মধ্য কলকাতার হোটেলের ঘরে বসেও এমনটা অনুভব করা যায়! বিশ্বাস হয় না তার। ওর মা বলেন, একমাত্র যারা কলকাতা ছেড়ে গিয়েছে, তারাই কখনও-সখনও বুঝে নিতে পারে এর মাহাত্ম্য কোথায়। ওর মায়ের কাছ থেকে এতদিন তিস্তা কলকাতা বলতে শুধু এমন সন্ধ্যেগুলোরই সব গল্প শুনেছে। সেসব চোখে দেখা, গায়ে মেখে নেওয়া, তিস্তার জীবনে এই প্রথম। তিস্তা বোধহয় নিজেই নিজের ভিতরে হারিয়ে যাচ্ছিল। ফিরে আসছিল আবার। ফিসফিস করে সে উচ্চারণ করে, এই জীবন তো আসলে অনন্ত এক হারিয়ে যাওয়ারই উপাখ্যান, ফিরে পাওয়ারই উপাখ্যান। তিস্তা তার ডায়েরিতে কথাগুলো লিখে রাখবে। ওর মা ফোনটাকে নামিয়ে রেখেছেন। তিস্তা আবারও ব্যাগ গোছাতে শুরু করে।

 
কাল বিকেলেই রওনা দার্জিলিং! ওর মনটাও কেমন উল্লাসে, উচ্ছ্বাসে হু হু করে ওঠে হঠাৎ।

[ক্রমশ]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন