(পর্ব # ১৪)
তার সায়ন’দা তাকে দোতলায় তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে দেয়। পাশেই বাথরুম, মার্বেল-টাইলসে-বেসিনে যা যথেষ্ট শহুরে, আধুনিক। হাত-পা ধোয় সে, পোশাক পাল্টায়। তারপর ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বার করে। নিচে নামে। তার কাকা সরু চোখে সে প্যাকেটে নজর দিয়েও দেয় না যেন। চওড়া গ্রিলঘেরা বারান্দার টেবিলে একটা প্লেটে চারটে নারকেল নাড়ু আর দুটো ছানার ছাঁচের মিষ্টি উদ্দালককে তার ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়িয়ে দেয়, যে স্মৃতিতে ঘরোয়া ছাঁচের মিষ্টির সঙ্গে পুজোর সময়ের খইয়ের নাড়ু, সিড়ির নাড়ু চকিতে ঝলসায়।
--সেই ছাঁচের মিষ্টি! কতদিন খাই নি। কিন্তু এত?
--ভাত খাবার বেলা হয়েছে... তাই তো অল্পকটাই দিলাম।
কাকিমা হাত দিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে বলে, যে কথার পিঠে কাকা যেন বা শহুরে চেকনাই আনতে চায়,
--ঈশ্বরপুরের ভরেশ ময়রার রসগোল্লা-দই করোনার ভয়ে তো একবছর ধরে ঘরেই ঢোকাই না।
টেবিলে রাখা কাঁচের গেলাসের গায়ে বিন্দু-বিন্দু জলের গড়িয়ে পড়ার শীতল সংকেত তার তৃষ্ণার্ত প্রাণকে হাতছানি দিয়ে ডাকলে সে হাত বাড়াতে গিয়েও মুহূর্ত থমকায়, যেহেতু করোনা-কথা সংশয় গড়ে—ওর আসা কি ওরা পছন্দ করছে না! তবুও হাতের তির বেরিয়ে গেলে তাকে ফেরানো যায় না আর, তাই নিরুপায় উদ্দালক সংশয় চাপতেই সে ঠান্ডা পানীয়তে আলতো চুমুক দেয়।
--এখানে করোনা কেমন?
--ধুর! ধুর! করোনা আছে আবার নাইও। টেস্ট করায় নাকি এখানকার লোকে? কিছু হলে লটকোনের দোকানে গিয়ে বলে— শরীলটো ম্যাজ-ম্যাজ করছে, মাথাটো টিপ-টিপ করছে। একটা ওষুদ দাও তো দোকানি। ওই একটা প্যারাসিটামল। তাতেই ফিট। করোনা আছে কলকাতায়, ঈশ্বরপুরে—বাবু পাড়ায়। তোমাদের বস্তির লোকেদের কাউকে করোনায় মরতে দেখেছ? করোনা থাকলে ভোটের মিছিল-মিটিং হয়? রোজ?
চুপচাপ সায়ন অনেক কথা একসঙ্গে বলে একটু থামে দম নিতে যেন, সে ধরতাইয়ে আবারও বলে,-- এখানে কোনও ভয় নাই। আর ভোটের ডিউটি যখন করেছিস, তখন ভ্যাকসিন তো নেওয়া আছেই। আমার, বাবারও ভ্যাকসিন হয়ে গেছে। ভোটের ডিউটির জন্যেই।
তার সায়ন’দার কথা শীতলতা আনে উদ্দালকের মনে, যেহেতু ভয়ের বিভ্রম বাঁক নেয় কলকাতার বাবু তার পানে, ফলে শীতলতর তৃপ্তিদায়ক হয়ে ওঠে সে ঠাণ্ডা পানীয়। চুমুক আরাম আনে দেহে, সে আরাম কথা ভাসায়।
--দেড় বছর ধরে ঘরবন্দি। সময় পেলাম তাই চলে এলাম। একদিন ঠাকুরর্দাকে স্বপ্নে দেখলাম... আবার কবে লকডাউন হয়, না হয়।
--তোমার পিতৃপুরুষের ভিটে, তাছাড়া জমি-জমা...
যদিও আজ দশ বছরের ওপর জমির কোনো টাকা পাঠায় না তার কাকা, তবুও হিসেব মতোই কাকাকে বিষয়কথা শেষ করতে দেয় না উদ্দালক, যেহেতু দু-দিন অতিথি নারায়ণ হিসাবেই স্বাচ্ছন্দ্য পেতে চায় সে এ গৃহে।
--তুমি থাকতে, সায়নদা থাকতে, ওসব জমি-জমা নিয়ে মাথা ঘামতে চাই না আমি।
আড় নয়নে দুই অভিজ্ঞ মুখে স্বস্তির চকিত আভা দেখে যেন সে, যা আরও উজ্জ্বল হয় তার হাতের প্যাকেটটা খুললে।
--বৌদি, বিয়েতে তো আসতে পারি নি। এই নাও।
ঘরের দরজার ছায়ায় হেলান দেওয়া স্বভাবলাজুক সে নারীমূর্তি উদিত হয় রাঙাআলো মেখে, যা খুশির, যেহেতু তার হাতে তখন তার দেওরের উপহার—কলকাতার নামী দোকানের দামী শাড়ি।
--কাকিমা, এইটা তোমার।
--এ সব আবার কেন বাবা! এ বয়সে দামী শাড়ি নিয়ে কী করব? গাঁয়ে কোথাও তো যাবার জায়গা নাই। বলতে হয় বলেই যেন এ কথা ভাসায় উদ্দালকের কাকিমা, কেননা এ কথা নরম-মায়ালু। সে মায়া ছড়ায় সেখানের পঞ্চজনা মানুষের মনে, সে টানে আবারও কথা ভাসে।
--পাওয়া ভাগ্য শুধু মেয়েদেরই, যেন ছেলেদের কিছু পেতে নাই। ঘাই তোলে সায়ন, যা ঘূর্ণি তোলে কহনস্রোতে।
--এ জন্মে তো আর হল না। দেখো, পরের জন্মে নারীজনম পাও কিনা! উদ্দালকের এ কথায় খিল-খিল চোরা স্রোত বয়, সে স্রোতে মুখে আঁচলচাপা নবীনা দেহখানি টলমল।
--নাও, আর দুঃখ করতে হবে না। এটা তোমার, আর এটা কাকার।
উদ্দালক, অতিথিদেব যে, দুটো ব্রান্ডেড ঘড়ি দু-জনের দিকে বাড়িয়ে ধরে।
--আবার আমাদের জন্য কেন! বাড়ির অভিভাবকের সৌজন্যের এ কথার কথায় আলো থাকে যথেষ্ট, যে আলো চারায় আকাশে, যেহেতু মেঘ চিরে দিনমনি চকিত আভাসে জাগে সে ক্ষণে। আলো চারায় যেন উদ্দালকের সে ভুয়োদর্শনে—সকল সম্পর্কই অর্থনৈতিক। ঠোঁটে আলো ঝুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস চাপে সে।
খাওয়া-দাওয়া এ বাড়িতে এখনো সাবেকি, মাটিতে আসন পেতে এবং তা পুরনো মাটির ঘরেই—এ প্রথার সঙ্গে ঝকঝকে কাঁসার থালা-বাটি-গেলাস অন্য এক ভালোলাগা তৈরি করে উদ্দালকের মনে।
--বাহ! পাটের শাকটা তো মিষ্টি খুব! কতদিন পর খেলাম।
--পাটের শাক নয় বাবা, এ হল লালতেশাক। এ এখানেই পাওয়া যায় শুধু। কলকাতায় পাবে না। বটঠাকুর এলে চেয়ে চেয়ে খেতেন। আর ওই তরকারিটাও এখানে ছাড়া পাবে না কোথাও। উদ্দালক কাকিমার উদ্দিষ্ট লাউ-এর মতো তরকারিটা দু-আঙুলে তুলে মুখে দেয়, দাঁতে-জিবে স্বাদ নেয়—লাউ-এর মতোই অনেকটা। কী এটা?
--একে খেরো বলে। গরমকালেই পাওয়া যায়।
কাকিমার এই বসে থেকে খাওয়ানোটা ভালো লাগে উদ্দালকের। শহরে, অন্তত তাদের বাড়িতে এ রেওয়াজ নেই। অবশ্য চাকরিজীবী তার মায়ের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। আগে ঠাকুরদা থাকতে রাতের খাওয়াটা আর ছুটির দিনে দুপুরে একসঙ্গেই হতো। তারপর পড়ার চাপ, কাজের ব্যস্ততা...। তবে তার মালতীমাসি তাকে বসে না হোক, দাঁড়িয়ে থেকে আজও খাওয়ায়। এ ভাবনায় তার খাওয়ার গতি শ্লথ হলে কাকিমা হাঁ-হাঁ করে ওঠে যেন।
--কী হল বাবা? হাত গুটিয়ে নিলে যে এখুনি? রান্না ভালো হয় নাই?
এ কথায় চমক ভাঙে উদ্দালকের, আবার চমক গড়েও ওঠে কাকিমার এখনো গ্রাম্য সারল্যে, ফলে মানে প্রলেপ দিতে কথা ঘোরায় সে,-- না, না, খুব ভালো লাগছে। ভাবছি খেরো আর লালতে শাক কলকাতায় নিয়ে যাব।
এ কথা তৃপ্তি আঁকে পৌঢা মানুষটির মুখে আর উদ্দালকও পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে যায় ডাল, ঝিঙে-আলুপোস্ত, মাছের ঝোল, আমের চাটনি, দই—সব-সব, টুকটাক কথার ভেসে ওঠার মজলিসে।
--মাছের ঝোলটা বৌমা রেধেছে কিন্তু।
--বাহ! দারুন। উদ্দালক মুখ তুলে চোখে তারিফের ইশারা আনলে সে নববধূ লজ্জায় মুখ নামায়, ফলে তৃপ্তি কথাটা আবারও আদল পায়।
--গাঁয়ের সব পুকুরেই আমাদের ভাগ। তবুও ভালো মাছ শহর থেকে কিনে খেতে হয় জানো? প্লাস্টিকে-প্লাস্টিকে পুকুরের তলা সব বুজে গেছে—শুধু লাইলেনটিকা, না হয় আমেরিকান রুই। ও মাছ ভদ্রলোকে খায়! তারপর চুরি তো আছেই। এখন আর গাঁ আগের মতো নেই।
তার বিজন কাকার এ হেন আফসোসে তেমন অবাক হয় না উদ্দালক, যেহেতু তার এ কাকা রাজনীতির নেতা, দায় এড়ানো ভন্ডামি থেকে মুক্ত নয় যে।
--দইটা ঘরে পাতা। চিনি লাগলে বলো।
টক দই খেতে পারে না উদ্দালক। তাই চিনি চেয়ে নেয়। খাঁটি জিনিসের স্বাদ পায় তার জিব, সে স্বাদে আপনিই প্রগলভ হয় সে ইন্দ্রিয়—বাহ! এ শব্দ আহ্লাদি হওয়ায় আদর পায় সেখানের পঞ্চজনেই।
--অনেকটা পথ ঠেঙিয়ে আসা। যাও একটু বিশ্রাম করো ও ঘরে গিয়ে। আমরা বুড়ো-বুড়ি কিন্তু পুরনো ঘর ছাড়ি নাই। মাটির ঘরে আরাম কত? গরমে ঠান্ডা, শীতে গরম।
এ কথা ভদ্রতা দাবী করে, তাই উদ্দালকও ভান করে,-- আমার ছোটোবেলার দেশের স্মৃতি বলতে তো এই মাটির ঘরই। তবুও সময়ের সঙ্গে আধুনিকতাকেও তো মেনে নিতে হয়।
--মাটির ঘর যে দু-একটা আছে তা কিন্তু আমাদের ভদ্র পাড়াতেই। ছোটোলোক পাড়াতে সব ইঁটের খুপরি—ইন্দিরা আবাস, প্রধানমন্ত্রী আবাস। রমরমা তো ওদেরই এখন! আমাদের বাবুপাড়া সবটাই ফাঁকা। আমার কয়েক ঘর কেবল।
আধুনিক, শিক্ষিত সায়নের কথায় উদ্দালক বিস্মিতই হয়, যে বিস্ময়ে বাকহীনতাই বাঞ্ছনীয় আর সে বাকহীনতা বাঙ্ময় হয় আবার তার কাকার কথায়।
--তাছাড়া চাল ছাওয়ানোর বারুইও পাওয়া যায় না। বারুই কী, জমির লেবারও অমিল এখন। পায়ে ধরে সাধতে হয়। একটু জিরোয় রাজনীতির মানুষটি, এ প্রসঙ্গটাকে শেষ করতেই যেন।
-- আর কথা নয়, যাও বিশ্রাম নাও একটু। আমিও একটু গা-গড়িয়ে নিয়ে বেরবো আবার। ঈশ্বরপুরে পার্টির ব্লক-মিটিং আছে।
উদ্দালকও সচেতন হয় হঠাত্ এ কথা মনে হওয়ায় যে ও না গেলে মহিলা দুজন খেতে বসতে লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়।
--আরে, তোমরা খাবে কখন?
--এই এঁটোটা ঘুচিয়ে, খাব এবার। এঁটো বাসন তুলে মাটিতে জল-হাত বুলোতে বুলোতে বলে কাকিমা।