(পর্ব # ১৩)
পরের ঢেউ : হয়তো তারও পরের...
॥ ১ ॥
আকাশ জোড়া কৃষ্ণকালো গাভিন মেঘ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে যেন আচরাচর চকচকি ডাঙার বাউলরাঙা শরীর জুড়ে, যেন বা একটু গান উঠলেই ঝরে পড়বে সে সজল জীবনের সহজিয়া ঢঙে। আর অতিলৌকিক সে গান বেজেও ওঠে, যেহেতু বাতাস বয় পথের দু-ধারের, দূরের তালসারি-খেজুরবৃক্ষের রুখু, সেহেতু উদাস পাতায়-পাতায়, ফলত সুর জাগে সে প্রাকৃতিকতায়—সড়-সড়, সড়-সড়। আর বৃষ্টি ঝরে এক ফোঁটা, দু ফোঁটা... অজস্র ধারায়, আচরাচর সে লাল ডাঙাকে আভাং ভিজিয়ে জীবনের ধ্যানে, যে ধ্যানে মাটির দেহজ সোঁদাগন্ধ জাগে। ঘোর লাগে উদ্দালকের নাগরিক মনে, সে ঘোরে চোখ ভরিয়ে, বুক ভরিয়ে জীবনতৃষ্ণা বসত নেয় তার প্রাণে। ততক্ষণে তার বাহন গতিহীন, এসি বন্ধ করে জানলা খুলে দিয়েছে সে। বৃষ্টির ছন্দে মিশে সোঁ-সোঁ শব্দ ওঠে যেন মাটিতে, উদ্দালকের চৈতন্যে। আমনশরীর জল টানে তৃষ্ণার্ত মাটি, তার জিওল ঘাসের শেকড়—জল পায় উদ্দালকের ছিন্ন শেকড়ও। সে শিকড়-সংকেত অঞ্জলি মুদ্রা আঁকে তার তার দু-হাতে। দু-হাত বাড়িয়ে দেয় সে বাইরে। গণ্ডুষে ধরে প্রাকৃত, ফলত পবিত্র সে জলধারা। অর্পণ করে পুণ্য সে সলিল মাটিতে।
--ঠাকুরদা, বাবা… আমার জনম-মৃত্তিকা, তোমরা গ্রহণ কর এ জল। আমার শ্রদ্ধা নাও। প্রণাম নাও তোমরা।
মনে মনে তর্পন সারে উদ্দালক। তার চোখ সজল হল কি! সে ভিজে-শীতল হাত চোখে রাখে। চোখ সইতেই বিদ্যুত্ ঝলসায়। বৃষ্টির মায়াচ্ছন্ন অন্য আলোর বিস্তীর্ণ এ চরাচরকে অতিনীল রশ্মিতে ফালাফালা করে। মেঘ ডেকে ওঠে গম্ভীর গর্জনে, যেন বা শিবের ডম্বরুধ্বনি। গুম-গুম সে ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে যায় চরাচর ছড়িয়ে দূরে, আরও দূর শূন্যে।
--হে রুদ্রসুন্দর, প্রণাম তোমাকে। উদ্দালকের অবচেতন মন প্রণত হয়। যেহেতু ভক্তি ভয়জাত, তাই তার শহুরে সচেতন মন একটু হলেও ভীত-দিশাহারা এ অতীব প্রাকৃত উন্মুক্ততায়। নিরুপায় সে জানলা বন্ধ করে। গাড়িকে গড়াতে দেয়।
বৃষ্টির অঝোর মায়ায় দিগন্ত ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নেয় যেন, সে অ-বৃহতে দৃষ্টিসীমা ঝাপসাপারা হলে পিচকালো রাস্তার দু-ধারে জলের স্রোত চোখ টানে তার গেরুয়া রঙের আধিদৈবিকতায়, যা বিস্ময় আঁকে উদ্দালকের দর্শনে—আহা! প্রকৃতি! সে উদাস বয়ে যাওয়া নিঝুম বাতাসপুর পার করে কখন যেন বা বামনী নদী, যার ছিলছিলে জলধারায় বৃষ্টির অনাবিল শৃঙ্গার সৃজন করে অগণন ঈশ্বরীয় মাছের ভাস-ডুব লীলা, তার রূপালি ঘাই। সে সুন্দরে হাওয়ারা পাগলপারা এলোমেলো ছুটে যায়, অকারণ ঢেউ তুলে নদীপাড়ের একলা অর্জুনগাছটির জলে ধোয়া চিকন পাতায়-পাতায়। চেনা চেনা গাছটি মাথা দুলিয়ে বলে উঠল যেন—আয়! আয়! ফলে নদীর ওপরের সেতুতে থমকায় মোহিত উদ্দালক। জানলার কাঁচ নামিয়ে বুক ভরে টেনে নেয় নদীর জলজ ঘ্রাণ। দূরে ঝাপসা সবুজরেখা, যেন জলে ধোওয়া ছবি। ও রেখাই তার গ্রাম, কুসুমডাঙা।
#
বর্ধমান ছাড়াতেই মেঘ সঙ্গী ছিল উদ্দালকের। ছাড়া-ছাড়া সে মেঘ যতই উত্তর দিকে এগিয়েছে ততই নিবিড় হয়ে সঙ্গ দিয়েছিল তাকে। এ মেঘলায় তার যাত্রাপথ হয়ে উঠেছিল মায়াময় যেন। আবার এ মেঘছবিতে তার নাগরিক মনে আশঙ্কার ছায়াও যে ছিল না তাও নয়, যে ছায়ার ধূসরতায় ঝড়ের উঁকি ছিল—যদি রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়ে, কিংবা তার সৌখিন, তাই পলকা এ বাহনে! পথের দু-ধারে বিছিয়ে থাকা বোরো ধান তার সোনালি-সবুজ গড়ণে কম্পন তুলে সে কালোছায়াকে বুকে ধরেছিল যেন, ফলে বিষণ্ণ-সুন্দর বিরাজিত হয়েছিল আদিগন্তিক হলুদের আলোহীন ছায়াতপে, যে হলুদ কখনোই ভ্যানগগীয় নয়, যা জীবনানন্দীয়, বাংলার নিজের। যদিও বিষণ্ণ, তবুও এ হলুদের ছায়াতপের অগণন রকমফের চোখ টানে, অন্তত যে দেখতে জানে। চক্ষুষ্মান উদ্দালক লোভ সামলাতে পারে না। গাড়ি থামায়। ফোনের ক্যামেরায় সে-হলুদকে ধরে মেঘময় আকাশের দিকচক্রে। আম্রপালিকে হোয়াটসঅ্যাপ করে—আমার বাংলা। গুগুলে ওয়েদার রিপোর্ট আভাস দেয় ৮০% বৃষ্টির। এ আভাস প্রবাদ ভাসায় উদ্দালকের মনে—আশায় মরে চাষা! সে তো জানে গ্রীষ্মের এ ধান চাষীর কাছে কতটা? ছিন্ন হলেও শিকড়ের স্মৃতি যে থেকেই যায়। এ স্মৃতিকথায় দীর্ঘশ্বাসের বিষণ্ণতার ছায়া লেখা থাকে যেন। পথের টানে গাড়ি এগিয়ে যায়, যে পথ মেঘমগ্ন, ফলত অলৌকিক যেন বা। পার হয় ঈশ্বরপুর, কুসুমডাঙার ব্লক ও থানা শহর। আরও খানিকটা গড়ালে মূল রাজ্য সড়ক ছেড়ে বাঁ-হাতি রাস্তাটাই উদ্দালকের গ্রামের, আর তখনই বৃষ্টি নামে মেঘ ভেঙে।
॥ ২ ॥
সেই কোন ছেলেবেলা এসেছিল উদ্দালক, তবুও পিতৃপুরুষের ভিটে-বাস্তুমায়া থেকে যায় রক্তের অন্তর্লীন স্রোতে, আর তাই হারায় না কিছুই। ওই তো বড় পেলেন্ডী, হরিসায়র—যার গা ঘেঁষে গাঁয়ে ঢোকার প্রথম রাস্তা বোলতলার পাস দিয়ে। সে পথ ছাড়ালে ওই তো শিবতলা, যতই পুরনো টিন-মাটির ঘর ভেঙে ভগবানের আটন এখন ঝাঁ চকচকে ইঁট-সিমেন্ট-মার্বেলের হোক না কেন শিবতলা সেই শিবতলার মাহাত্ম্যে বিরজমান আজও। ভাবে উদ্দালক। শিবতলার বাঁদিকে কংক্রিট বাঁধানো পথ ঢুকে গেছে গ্রামে। গাড়ি ঘোরায় সে, ওদিকেই তাদের বাড়ি। তাদের বাড়ি! না, এ ভুল যেন না হয় আর কখনো তার! নিজেই নিজেকে সচেতন করে উদ্দালক। বৃষ্টির তেজও আর নেই এতক্ষণে। হর্ণের ইশারায় সে গাড়ি দাঁড় করায় স্বর্গীয় মাধবচন্দ্র মুখার্জীর, তার প্রপিতামহ যে, তার বাড়ির দোরগোড়ায়। সে বাড়ির সামনের টগর ফুলের গাছতলাটা এখনো গন্ডিহীন খোলা দেখে এক অবাক ভালোলাগা জড়িয়ে ধরে তাকে। সেখানেই গাড়ি পার্ক করে সে।
গাড়ির আওয়াজে ছাতা মাথায় সায়ন বেরিয়ে আসে মাধব মুখার্জীর ভদ্রাসনের দরজা খুলে। উদ্দালকের সায়ন-দা, বছর খানেকের বড় যে, মুখে স্বাভাবিক উচ্ছলতা ফুটিয়ে তোলে-- যা আন্তরিক, মাটিময়, অন্তত উদ্দালকের তেমনই মনে হয়।
--আয়, আয়। দে, ব্যাগটা দে।
--আরে তুমি ছাতা-ব্যাগ, দুই-ই ধরবে নাকি? এমন কিছু ভারী নয়। গাড়িটা এখানেই...
রাস্তা নতুন সিমেন্ট বাঁধানো। আর বীরভূম লাল কাঁকরমাটিরও, তবুও কৃষিভিত্তিক মানুষের স্বাভাবিক চারণভূমি ছিল নদীমাত্রিক পলিময়, ফলে টগরতলা জল পেয়ে কাদা-পিছল। তাই অনভ্যস্ত উদ্দালকের পা এ ক্ষণে সাবধানী হয়। কথারা টাল খায়।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখানেই থাকুক। কিছু হবে না।
ততক্ষণে মাটির চাতাল পেরিয়ে তারা দু-জন ইঁটবেছানো ঘরোয়া পথে কথার পিছন পিছন সদর পার করে ঘরের বাঁধানো উঠোনে। যেখানে মাটির পুরনো টিন-ছাওয়া দোতলা কোটার পাশে উদ্দালকের চোখে নতুন পাকা বাড়ির সামনের বারান্দায় আবারো কথারা আবাহনে বেজে ওঠে যুগলবন্দিতে।
--এসো বাবা, এসো।
--সেই কখন ঈশ্বরপুরে ফোন করেছিলে। ভাবছিলাম বৃষ্টিতে পথ ভুল করলে নাকি!
--না, না, রাস্তা ভুল হয় নি। বৃষ্টিটা এত জোরে এলো... তাই একটু সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল।
কাকা-কাকিমাকে প্রণাম করতে করতে বলে উদ্দালক। মুখ তুলতেই ঘরের দরজার আড়ালে একটা ছায়াশরীর লুকিয়ে যায় যেন, এ দৃশ্য তার চোখে মজার আলো ছড়ায়, যে আলোয় এখনো গ্রামীণ সহজিয়া লজ্জার স্বীকৃতি।
--বৌমা কোথায় গেলে? তোমার দেওর হয়। লজ্জা কী?
শাশুড়ির এ আহ্বানে সে ছায়াশরীর প্রকাশ্যে এলে অন্য এক আলো জাগে—বিয়ের নতুন জলের, যে জল সদ্য গত মাঘের, যদিও উদ্দালক আসে নি করোনার দোহাই দিয়ে, যা সম্পর্কের দূরত্বকে উসকেই দেয় এ ক্ষণে এ প্রশ্ন জাগিয়ে—করোনা না থাকলে? উত্তর জানে না সে।
চমক ভাঙে তার সে নবীনার হঠাত্ আনত ভঙ্গি কাকিমার বেজে ওঠা কথায় স্থাণু হলে—আ-হা-হা! কর কী বৌমা! সম্পর্কে ও যে ছোটো হয়।
--তাহলে তো আমাকে প্রণাম করতে হয়। দেওরের এ বাক্যে তার বউদিটি ছুটে পালায় ঘরের আড়ালে আবার, যে ঘটনা দেওর-ভাজের মধুর সম্পর্ক আঁকলে আলো ফোটে মাধবধামে এবং বাইরেও, কেননা তখন বৃষ্টি মুছে আকাশ টুকুন ফরসা।
-- বৌমা শরবত-জল দাও উদ্দালককে। কতদূর থেকে আসা!
কাকিমার কথায় উদ্দালকের বোধেও খিদে প্রাণ পায় যেন, যেহেতু সেই কোন সকালে দুটো টোস্ট আর চা খেয়ে বেরিয়েছে সে।
--দাঁড়াও আগে হাত পা ধুয়ে আসি। যদিও নিজের গাড়ি। আর রাস্তায়ও দাঁড়াই নি করোনার কারণে।
সে যে কিছু খায় নি, এমন কি চা’ও না—সে কথা ঊহ্য রেখেই ফোন বের করে সে। মা-কে পৌঁছনোর খবরটা দিতে হবে, আর আম্রপালিকেও। কিন্তু দেখে যে ফোনের টাওয়ার নেই, এ দৃশ্যে বিস্ময় বাক নেয়।
--টাওয়ার নেই!
--তোর কী কোম্পানি? এখানে ‘গুরু’ ছাড়া অন্য কানেকশন পাবি না। সায়ন বিশদ হয়।
--আমার তো সরকারি আর ‘এয়ারজি’।
--সরকারি তো পাবিই না। ‘এয়ারজি’ পাবি, ওই বাইরে টগরতলায়।
অগত্যা উদ্দালক তার কাকার ফোনটা চেয়ে নিয়ে মা-কে খবরটা দেয়, যেহেতু এ নম্বর পরিচিত তার মায়ের। আম্রপালিকে না হয় পরে হোয়াটসঅ্যাপ করে বুঝিয়ে বলবে। এ ভাবনায় অসহায়তা থাকে, যাতে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ লব্জটি করুণ হাসি নিয়ে ঝুলে থাকে।