দোঁহা

শতদল মিত্রের উপন্যাস


 

আধেকজান

 (পর্ব #১৮)

     যত শিবতলা পানে এগোয় ততই প্রলয়ক্ষত প্রকট হয় তার নজরে, সে দৃশ্যে দৃষ্টিবিভ্রম যেন বা, কেননা জরুলের পাড়ের বাঁশগাছগুলোকে কে যেন প্রবল আক্রোশে দুমরে শুয়ে দিয়েছে, ফলত দৃষ্টিসীমা বাধাহীন পরিসর পেলে ও পাড়ের আমগাছটির ছিন্ন ডাল দুলে ওঠে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে উদ্দালক আনমনেই, সে টানে নজর এ পানে আবার ঘুরলে তাদেরই বংশের প্রবাসী একজনের বাড়ির চালের একখানি ঝুলন্ত টিন দোল খায় বিপন্নতা জাগিয়ে, সে বিপন্নতায় সামনের স্কুলবাড়িটি ভেসে ওঠে মেঘলামলিন আলো মেখে।

     স্কুলের বাঁক পেরোলেই শিবতলা জেগে ওঠে হাহাকারের গুঞ্জনে, যে গুঞ্জন ছাপিয়ে আদল পায় নিতাই ডোমের ক্ষোভায়িত প্রলাপ, ক্রদনই যা।

     --ডাঙা লুটে, নদীটোকে মেরে মন্দির গড়বি! পাপের টাকায় বিলিতি পাথরে ভগমানের আটন গাড়বি! মনে লিলি পাপের টাকার ভাগ ভগমানে উত্‍সুগ্গু করলে পর পাপ ধুয়ে যাবে! লে ইবার বগল বাজা কেনে! ক্ষেপা ঠাকুর বটে শিব। উ কেমুন তোদের পাপের টাকায় লাথ মেরে নিজের ঘর নিজেই ভেঙে দিলে!

     এ প্রলাপধ্বনি সহসা শিবমন্দিরটিকে উদ্দালকের চোখের মায়ায় জাগিয়ে তোলে, সে মায়া আবারও বিপন্নতা আঁকে তার মনে, যেহেতু মন্দির লাগোয়া জোড়া খেজুর বৃক্ষদুটির মাথা এক প্রবল শক্তি মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে যেন। এক অনস্তিত্ত্বের শীতল বোধ উদ্দালকের শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে, যে বোধে ছোবল দেয় জোড়া খেজুর সংলগ্ন মন্দিরটির কোণার হা-হা ফাটল।

     --অধম্ম, অধম্ম সব। ধম্মরাজকে ভুলে গেলি! বাপ-দাদার জাতের ঠাকুরটোকে ভুলে বাবু হইলচে সব। জেতে ওটার বাসনা! ই অধম্ম সইবে কেনে!  

    আবারও প্রলাপ ভেসে উঠলে ধর্মরাজের পাকুড়বৃক্ষটি স্বভাবতই নজর টানে উদ্দালকের, যে প্রাচীনপ্রাণ তার এলোমেলো নবীন কচি সবুজ পাতায় ঝড়চিহ্ন আঁকলেও সটান খাড়া, যার তলায় সে বৃদ্ধ মানুষটি ঝরে পড়া পাতা-খড়কুটো পরিস্কারে রত আপনমনে কথা বুনতে বুনতে, সে বয়নে বিষণ্ণতার সুর ছায় শিবতলা জুড়ে, হয়তো বা পাপবোধও চারায় ঠাকুরথানে ছাড়া ছাড়া ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মনে, যা আতুরও সে ক্ষণে, যেহেতু কথা ভাসে, ডোবে, ঘূর্ণি তোলে ঘুরে ঘুরে।

     --বুড়াটো সেই থিকে জ্বালিয়ে খেলে দেকচি! এক কতা—ঘ্যানোর ঘ্যানোর।

     --তা নেতাইখুড়ো ল্যাজ্য কথাই বলচে বটে। নইলে গোটা গাঁয়েতে আর কিছু হল না, শুদু ডোম আর বাগদি পাড়াটোতেই ঘর উজাড় হল ঝড়ে! এমুন ঝড় বাপের কালে দেখি নাই। হাতির শুঁড়ের পারা যেন শুষে লিচে যা পেচে ছামুতে স-ব!

     হাতিশুঁড় ঝড়! টর্নেডো নাকি? ভাবে উদ্দালক, যে ভাবনা শেকড় পায় পরের কথায়।

     --হাতিশুঁড় ঝড়! তাতে কী? ইটো কি পেথ্থম নাকি? এই তো ক-দিন আগুতে কলকেতার কাচে বাণ্ডিল না কোথায় যেন গঙ্গার ওপর দিয়ে পাক খেতে খেতে চলে গেল। টিভিতে দেখালে। হাতির শুঁড়ের পারা। দুপাড়ে ছামুতে যা পেচে সব গুঁড়িয়ে দিচে। সব পোকিতির লীলে। পাপ না ছাই!

     --হাঁ, ই কতাটো কিন্তুক খাঁটি কতা। টিভিতে আমিও দেকেচি সি ঝড়। তাও তো কপাল ভালো যি ঘরের ওপর দিয়ে যায় নাই, মাঠপানে ছুটে গেলচে। তার ল্যাজের ঝাপটেই যিটুকু ক্ষেতি। গোটা ঘর তো কারও ভেঙে পড়ে নাই... কারুর চালের কোনা উড়েচে, কারুর বড় জোড় খানিকআধেক পাকা দেওয়ালে চিড় ধরেচে। যেমুন ই শিবমন্দিরটোতে... পাপ লয় কুনো। নইলে পথের পুবধারে সব ঘর বেঁচে গেল কেনে? উ ধারের সব ডোম-বাগদি পূন্যিমান? তা, নেতাইদাদা তো বড় ল্যায়বান, মুকেতে সব্বদা ধম্ম-ধম্ম, তা উর ঘরের চালের টিন উড়লে কেনে?

     --তোরা সব আজকালকার ছেলে-ছোকরা। তা, তোরা মানিস আর নাই মানিস... নেতাইদা ল্যাজ্য কতাই বলচে... কিছু একটো খুঁত তো হয়েইচে। নইলে দ্যাবাদিদেব মহাদেব, উর মন্দির...

     কথাটা শেষ হয় না যেহেতু একটা বালক ছুটতে ছুটতে এসে ছুঁড়ে দেয় অপর কথা, যাতে আশ্চর্য-সংকেত, যা এ পরিস্থিতিতে সুসারবাহী হয়তো বা!

     --ধরমগড়ের বিলে পদ্মপাতা জেগেছে! দেখবে এসো সকলে।

     সে কোন কালে ধরমগড়ের বিলে পদ্মবন ছিল, মানুষের লোভ যে সুন্দরকে মুছে দিয়েছে কবে, তবুও এ ঘোষণায় আশ্চর্য থাকায় নিতাইবুড়ো আগে দৌড় লাগায় বিল পানে, সে টানে পিছু পিছু বাকি অনেকে।

     না, পদ্মগাছ জাগে নাই, শুধু একটি নিটোল পদ্মপাতা নৃত্যভঙ্গিতে ভেসে বেড়ায় বিলের টলটলে জলে, যেহেতু এলোমেলো হাওয়া নাচে ছলাত্‍ছল ঢেউ জাগিয়ে সে জলে। হয়তো ঝড়ের টানে অন্য কোনও গাঁয়ের পুকুর থেকে উড়ে এসেছে পদ্মের এ পাতা। ভাবে নাগরিক উদ্দালক। আর তার ভাবনাকে ছিঁড়ে যূথকথা ভেসে ওঠে—কী আশ্চজ্যি! পাতাটো ই ঘাট পানেই আসচে যি গো!

     সত্যিই হাওয়ার টানে জলের ঢেউয়ে ভেসে ধীরে ধীরে পাতাটি এ তটপানেই ধায়, সে ভাসায় ভাষা জেগে থাকে, কেননা পাতার দু-কোণ ওঠে-নামে হাওয়া মেখে, সে বিভঙ্গে হাতছানি—আয়! আয়!

     এ আহ্বানে সাড়া দিয়েই যেন সহসা জলে ঝাঁপ দেয় নিতাই বীরবংশী ওষ্ঠে জয়ধ্বনি এঁকে—জয় ধম্মরাজের জয়!

     পাতাটিকে পরম যত্নে বুকে ধরে জল ভেঙে উঠে আসে যেন বা অন্য নিতাই, যার চোখে সে ক্ষণে অপর আলোর মায়া, যা সুদুরের, হয়তো বা রক্তের অতিগূঢ স্বপ্নেরই, যেহেতু তার অঞ্জলির সে আশ্চর্য সবুজে ঈশ্বর ইশারা, যা ধর্মরাজের ঘোড়ার, ফলে এ প্রতীকের প্রাকৃতকতায় আচরাচর ধম্ম আটন পায় এক্ষণে, কুসুমডাঙায়—জয় বাবা ধম্মরাজের জয়। জয় ধম্মের জয়।

     এ দৈবে শীতল হাওয়া ঝাপট মারে এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝরিয়ে। এক পশলাই।   

 

গাঁয়ের সর্বজনা যেন মন-প্রাণ ঢেলে দেয় ধরমতলার পবিত্রতায়-- ধর্মপ্রতিষ্ঠায়, সে পুণ্যে ধরমথান জুড়ে কোদাল-ফাওড়া ঘাস মাটি চাঁছে আবারও নতুন করে নিখুঁত নৈপুণ্যে, গোবরজলের মারুলির প্রলেপ পড়ে, পিটুলির আলপনা মায়া রচে ভিজে মৃত্তিকায় যতটুকু সম্ভব তার চেয়েও বেশি যেন বা। পাকুড়গাছটির প্রাচীন গুঁড়ি তেল-সিঁদুরের উজল-মহিমায়, ধূপধুনোর ধোঁয়ায় জেগে ওঠে, এ জাগরণ প্রাণ পায় যখন অপরাহ্ন বেলায় নিতাই ডোম, বীরবংশী যে, সে আটনে পরম যতনে স্বপ্নাদ্য ধর্মচিহ্নিত পদ্মপত্রটি মেলে দেয়, তার ওপরে কলকে ও ধুতরোফুল বিছিয়ে  কালকের ভাগ্যে পাওয়া পোড়ামাটির পবিত্র প্রতীকটিকে স্থাপন করে সর্বাঙ্গে ভক্তি মেখে। ভক্তির সে পরম্পরায় শিবের সন্ন্যাসী ভক্তের দল শিবথান থেকে বাণেশ্বর এনে শুইয়ে দেয় ধর্মের আটনে। নিতাই কমরেড, নতুন ধুতি-গামছায় ধর্মদেবের দেয়াশীই যেন, জোকার দেয়— জয় বাবা ধম্মরাজের জয়। শিবো হে।

     এ বোধনে এ স্থান এক্ষণে যেন দৈব-মহিমায় জাগ্রত হয়, সে মহিমায় ঢাক দগর তোলে কাঁসির দোহারকিতে, এ আহ্বানে ডোম-বাগদিজন সময় বিহনে কাঁচা মাটিরই ঘোড়া গড়ে নিবেদন করে ধরমতলায় তেল-হলুদের ফোঁটা কেটে, যে নিবেদনে মানত থাকে, কেননা তারা লাল-কারে ঢিল বেঁধে সে দৈব পাকুরের ডালে ঝোলায় ভক্তিতে, হয়তো বা এতদিনকার বিস্মৃতির ভয়েও, সেহেতু সে ভক্তি আনত হয় সাষ্টাঙ্গ প্রণামভঙ্গিতে, ফলে থেকে থেকে জোকার জাগে ঢাকের বলে মিশে—জয় বাবা ধম্মরাজের জয়। শিবো হে।

     বুকের পুরাণ কন্দর থেকে উঠে আসা এ ধ্বনি আ-মাটি-আকাশ প্রতিধ্বনি তোলে যেন দূর দূরান্তরে-গ্রাম গ্রামান্তরে, যেহেতু পঞ্চগাঁ থেকে লোক আসে কুসুমডাঙা রাঙিয়ে—মানতে, নৈবেদ্যে। উত্তম বাগদি গুছিয়ে রাখে মণ্ডা-বাতাসার সে নিবেদন, এ অধিকারে যে সে পঞ্চাত্‍ এ গাঁয়ের, হয়তো এ চিন্তায়ও যে এ ধর্মের আঠা আখেরে লাভ দেবে সামনের ভোটে। এমত জঙ্গম ছন্দে মেঘমাখা বিকেল কখন যেন সহসা ঢলে পড়ে সাঁঝ উজিয়ে রাতের আঁধার মায়ায়, সে মায়ায় যেন বা প্রাণ পায় দেয়াশীর ছায়া-শরীর, যে শরীরে ব্রহ্ম জাগে আবহমানের লোকচেতনায়-- জয় বাবা ধম্মরাজ। ধম্ম রেখো বাবা। অধম্মে আগড় দিও। ই গাঁয়ের দেবতা তুমি। গাঁ-টোকে রক্কা করো বাবা। কুনো খুঁত থাকলে পাপ লিও না হে। জয় ভগমান! শিবো হে!

     মাটিমগ্ন এ মন্ত্রে আঁধার আদিম হয় যেন, যে আদিমতা চলকায় নিতাই দেয়াশীর হাতে ধরা প্রদীপের কম্পমান আলোক শিখায়, যেহেতু এক্ষণে সে দেয়াশী ঘূর্ণনরত ঝুঁঝকো আঁধারমাখা প্রাচীন পাকুড়বৃক্ষটিকে কেন্দ্রে রেখে। রাত ক্রমে জাগে ঢাকের বিরামহীন জাগর ছন্দে, ধর্মের জয়ঘোষে, সে দৈবে পাকুড়ডালের সাঁঝঘরে ঘুমন্ত পাখিরা কেউ কেউ ঘুম ভেঙে শূন্যে বেভুল পাক মেরে আবারও ফিরে আসে কুলার জৈবিক অভ্যাসে, কেউ কেউ ঘুম চোখে ডানার আড়মুড়ি ভেঙে আবারও চোখে ঘুম আঁকে। দূরে নদীর হাতায় শরবনের আড়ে শিয়াল প্রহর জাগায়, ফলে এ রাত আদিম আঁধারঘন হয় আরও একটু বিজলিহীন কুসুমডাঙার এ ধরমথানে।

     সে আদিমতা যেন বা হিলহিলে জাঁক পায় নিতাই দেয়াশীর লম্বা ক্ষয়াটে প্রাচীন শরীরখানি ঘিরে, যেহেতু তা দুলতে লেগেছে সাপের পারা, যা নৈঃশব্দ ডাকে সহসা, এ শব্দহীনতায় দৈব আটন পায়—ভর নামে দেয়াশীর আমনশরীরে। পেঁচা এক রাত-নিশুত এ নৈঃশব্দতাকে চিরে জান্তব উল্লাসে হঠাত্‍ উড়ে গেলে ঢাক জেগে ওঠে মত্ততায়, এ নাদে লন্ঠনের চিড়ধরা কাঁচে লেপ্টে থাকা নিষ্প্রভ আলোটুকু দুলে ওঠে রাতকে তমস বিলিয়ে।

     এ জিরানে আবহমানের জাতক-আলো, লাবণিক যা, জাগর হয় এ দেবস্থানে, যেহেতু আবারও পুরাণমন্ত্র হাঁক পাড়ে—জয় ধম্মরাজের জয়। শিবো হে!   

    সে ধরতাইয়ে ধর্মরাজের আজ্ঞা হয়-- আমাকেও ভোটে চড়াতে চাস? ইটো ভালো লয় উত্তম।

    ভয়-ত্রাসিত উত্তম বাগদি, প্রবল পঞ্চাত্‍ যে, ভূমি নিতে না নিতেই আবারও ধর্মের আজ্ঞা হাঁকার দেয়—বিজুমাস্টার, তু মনে লিচিস যি আমার ই থানটো তু বিলিতি পাথরে বাঁধাই দিবি! তা এ যাবত দিস নাই কেনে? ই তালেতে আমার নাম ভাঁড়িয়ে ভোট কিনবি?

     --ভোট নয় বাবা। গাঁয়ের জাগ্রত স্থান। মনের বাসনা...

     কথা খেই হারায় যেন, তাই কোনোরকমে গড় হয়ে প্রণাম করে বিজনবাবু, সর্বদা ক্ষমতাসীন নেতা যে এ এলাকার, মুখ লুকোয় অন্ধকারে চোরের পারা, যা উদ্দালককে লজ্জা দেয়।

      দৈবের এ প্রতাপে ধর্ম জাগে তার প্রতিষ্ঠায়, ফলে ছায়ারা ঠাইনাড়া হয়, কথারা কায়া পায়।

     --হে বাবা, আমার লাতিটোর পা হল না এখুনও। দয়া করো বাবা।

     --উকে ই থানের মাটিতে কালকে ভোরসমুয়ে একবার শুইয়ে দিস ধম্মরাজের নামে। তাপ্পর বাবার দয়া।

     --বাবা ঠাকুর, আমার মেয়েটোর বিয়ে হচে না বাবা। কুনো সম্মন্ধিই টিকচে না।

     --সমুয় হলে সব হবে। ভোরকালে চান করে থানের পবিত্ত মাটি খানিক লিয়ে গিয়ে ই উচ্ছুগ্গ বেলপাতার সনে ঘরের ইশেন কোণে পুঁতে দিস।

     --হেই বাবা, আমি হাঁটতে লারচি, আমার গেঁটে বাতটো...

     --জৈবনকালে খুব মরদগিরি করেচিস, তার ফল। থানের মাটি নিত্যি হেঁটোতে লাগিয়ে রোদ দিস। ঠিক হয়ে যাবে।

     --বাবা, ঘুঁষ দিইচি, তবু আমার ছেলেটোর সিবিক পোলিশের কাজ হচে না।

     --পারলে সক্কলের ছামুতে সি ঘুঁষখেকোর নামটো বলে দে। অধম্ম করেচিস। তা ধম্মরাজ কী করবে?

     হুংকার দেয় সে হিলহিলে শরীর, যেন বাজ হানে, সে ধারতাইয়েই প্রতিধ্বনি বাজে নিচু খাদে।  

     --শুনো সব্বজনে। অধম্ম করো না কেউ। সব্বদা ধম্মপথে থাকবে। তাতে সোমসারের সুসার, জগতের সুসার।

     দোলায়িত হিলহিলে সে ধর্মরূপ দেবাংশীশরীর সে ক্ষণে সহসা স্থানুবত্‍ যেন বা, যে ভঙ্গিতে শীতল শিথিলতা, যাতে রাতের নিজস্ব আলো জাগে, সে আলোয় শিথিল শরীরখানি নুইয়ে পড়ে ভুইয়ে, ওষ্ঠে মৃদু মন্ত্র এঁকে-- জয় ধম্মরাজের জয়। শিবো হে। জয় ভগমান।   

     এ নিবেদনে রাতের আদিম আঁধার চিরে, আবার জুড়ে, আমাটিআকাশ নিনাদিত হয় জয়কারে—জয় ধম্মরাজের জয়। শিবো হে। জয় ভগমান। জয় নিতাই দেয়াশীর জয়।

     সঙ্গতে ঢাক বেজে ওঠে নিজেকে ছাপিয়ে যেন, কাঁসির দোহারকিতে, ফলে প্রাচীন সে বৃক্ষশাখায় ঘুমন্ত পাখিরা বেভুল জেগে আবারও ডুবে যায় নিশুত ঘুমে। আর এ প্রাকৃতে-অপ্রাকৃতে পুরাণ ধর্ম পুনর্জাগরিত হয় কুসুমডাঙার পুরনো ধরমতলায় তার আবহমানের রক্ত জাগিয়ে, সে জাগরণে নিয়তিতাড়িত লোকমানসে   আটন পায় নতুন এক আশ্রয়-বিগ্রহ—নিতাই দেয়াশী, ধর্মের দেবাংশী যে।

     এ প্রতিষ্ঠা আদল পায় চিরায়িত গ্রামীণ সম্পূর্ণতায়, যখন উত্তম বাগদি ধুলোটে মাতে মাথায় দই-এর হাঁড়ি নিয়ে, যার পিছু পিছু কিছু মানুষ বৃত্তাকারে ঘোরে নৃত্যের ভঙ্গিতে, যে বিভঙ্গে এক পা আগিয়ে সামনে দেহ ঝুঁকিয়ে পেছনের পা টানে তাকে এগিয়ে দিয়ে ঢাকের তালে তালে—ড্যাডাং ড্যাং, নাটাং টাং। বৃত্তশেষে দই-এর হাঁড়ি ফাটে মাটি ছুঁয়ে, এ ধুয়োয়—লুই পাদের হৈ-আ-আ! জয় ধম্মরাজের জয়। শিবো হে! জয় নিতাই দেয়াশীর জয়!

     এ ধ্বনি আনন্দময়, সেহেতু আঁধার আলো পায়, কেননা মেঘ সরিয়ে চাঁদ উঁকি মারে এক ঝলক, এ নিমিত্তে হাওয়া বয় শীতলতা জড়িয়ে।

    লুইপাদ—লব্জটি ঘাই মারে নাগরিক-শিক্ষিত উদ্দালকের মনে। বৌদ্ধ চর্যাপদের কি! নব্যগ্রাম উত্তর জানে না তার।

 

॥ ৬ ॥

রাতের আঁধার ভেঙে ভোররাঙা আলো উঁকি দিল কি দিল না, সে আলো ঠোঁটে নিয়ে বাতাস বয়ে গেল ঝিরঝিরিয়ে বৃক্ষের পাতা দুলিয়ে, ফুলের কুঁড়ি আলগোছে ছুঁয়ে, হরিসায়র-কুলুপুকুরের জলে ছলছল ঢেউ জাগিয়ে, ঘুমন্ত শিশুটির মুখে দেয়ালা এঁকে। এ শিহরণে পাখি ঘুম ভেঙে অবাক ডাকে—পিউ, নবীন পাতা কোরক খুলে উঁকি মারে, কুঁড়ির কোলে ফুটি-ফুটি ফুল হাসি ছড়ায়, মাছ ঘাই মারে জলে, শিশুটি মায়ের বুক খুঁজে নেয়। জগত জেগে ওঠে, এ জাগরণে নির্মেঘ অনন্ত নীলের পূব আকাশে তখন সাতরঙের মায়া—জবাকুসুম রঙমেখে সূর্য ভেসে ওঠে নতুন দিনে, নতুন জীবনে। কে বলবে মাত্র এক দিন-রাতের ফারাকে প্রলয় নেমেছিল এ মাটিতে, যেন বা সে তাণ্ডব ছিল নেহাতই প্রকৃতির আপন খেয়াল খুশির লীলা!    

 

আজ পয়লা বৈশাখ, বচ্ছরকার প্রথম দিন, যদিও তা বিশেষ হয়ে ওঠে না বাঙালি জীবনে, যা আর পাঁচটা দিনের মতোই নিত্যনৈমিত্তিক স্বাভাবিক, শুধু কিছু দোকানের হালখাতার পুণ্যাহ ছাড়া। ভাবে উদ্দালক গাড়ি চালাতে চালাতে—আজই কলকাতায় ফিরছে সে, যে ফেরার পিছু পিছু কিছু মায়া, পিছুটানও থেকে যায়, যা মাটির, শেকড়ের।

     তার চিবুক ছুঁয়ে কাকিমা বলেছিল—আবার এসো বাবা।

     শিবতলার ধরমথানের প্রাজ্ঞ পাকুড় তার জলে ধোয়া সবুজপাতা নাড়িয়ে বলেছিল—আবার এসো।

     হরিসায়র পাড়ের বকুলবৃক্ষ ফুল ঝরিয়ে বলেছিল—যাই বলতে নাই, বলো—আসি।

     সে সায়র,বড় পেলেন্ডি ছলছল জল জাগিয়ে বলেছিল—আবার এসো কিন্তু।

     নদীটি কলকলিয়ে বলেছিল—ভুলো না যেন।

     চকচকির ডাঙা উদাস সুরে বলেছিল—আবার আসবে তো!

     --আসব গো, আসব। মনে মনে বলে উদ্দালক। ফিরে তাকে আসতেই হবে নিজেকে, নিজের আত্মাকে চিনতে, যে আত্মা আবহমানের মাটিমগ্ন ভারতবর্ষের, যা আপাতত ভাইরাসের ঢেউয়ে দোলায়মান। তবুও একদিন না একদিন ভাইরাসের এ দ্বিতীয় ঢেউ কেটে যাবে। তৃতীয় ঢেউ আসবে কিংবা আসবে না, এলেও ধীরে ধীরে তা মিলিয়ে যাবে প্রকৃতির আপন খেয়ালে। কিছু বীজ তার হয়তো রয়ে যাবে প্রকৃতির গহন কোণে, মানুষের রক্তের গহীন কন্দরে—আবার কখনো জেগে উঠবে বলে, যদি কোনোদিন অধর্ম জাগে প্রকৃতিতে-মানবআত্মায় ধর্মের নামে, জেগে উঠবে কায়েমী সেই ধর্মস্বার্থের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উজ্জ্বল পাপে। ইতিহাস সাক্ষী কায়েমী অন্যায়ের-অধর্মের বিরুদ্ধে ন্যায়ধর্মের প্রতিবাদকে-প্রতিশোধকে স্বার্থান্বেষী অনুশাসনের দোহাই, সর্বদাই পাপ বলে দেগে দেওয়া হয়। এ পাপ তাই উজল-পবিত্র, আবার এ কারণেও যে তা প্রাকৃত, মানবিকও। এ পবিত্র-উজ্জ্বল পাপে নিমগ্ন হতে তাকে আবার ফিরে আসতেই হবে গ্রামে, কেননা আবহমানের মাটিই একমাত্র এ পাপের আলো মাখতে জানে।

     জলে ধোয়া কাঁচস্বচ্ছ আকাশ থেকে তিরের ফলার মতো ঝরে পড়ছে বৈশাখের চড়া রোদ সামনের পিচকাল রাস্তায়, পিছলে যাচ্ছে উদ্দালকের চোখ ধাঁধিয়ে, দূর দিকচক্রে মরীচিকা রচে, সে মায়ায় ভেসে ওঠে যেন কমরেড নিতাই দেবাংশী চিরন্তন পাপের ঔজ্জ্বল্যে, লোকবাসনায়। উদ্দালকের আনমনা মন বলে অস্ফুটে—আবার আসব গো স্যাঙাত।
(সমাপ্ত)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন