অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
[৭]
দার্জিলিং। সকালের রোদ্দুর গায়ে মেখে ওরা দুজনে বসে ছিল। শালুক আর সন্দীপন। এখানে এসেও ওদের অবাক হতে হয়েছে। ওদের হোটেল থেকে তিস্তার হোটেলটাও কিনা হেঁটে মাত্র পাঁচ মিনিট। ওদের হোটেলটা বলতে গেলে প্রায় বড় রাস্তার উপর। ওদের হোটেলের পাশ দিয়েই গলি উঠে গিয়েছে। গলি জুড়ে হলুদ সবুজ কাগজের নিশান। কোনও উৎসব ছিল বোধহয়। সন্দীপন চায়ে চুমুক দেয়।
-“এ্যাঃ লিকারটা বড্ড কড়া করে দিয়েছে রে অরিন্দম! এই চায়ের দেশে এসেও কিনা চায়ের এই হাল!”
অরিন্দম ওরফে শালুক জবাব দেয় না। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। “অরিন্দম!” আবারও ডাকে সন্দীপন। চটকা ভেঙে শালুক তাকায়।
-“আমাকে বলছিস?”
-“আজ্ঞে জাঁহাপনা, আপনাকে ছাড়া তো আর কাউকেই এই বারান্দায় চোখে পড়ছে না, কাজেই আপনাকেই,” সন্দীপন চোখ টিপে যোগ করে, “অবশ্য আপনি যাঁর কথা ভাবছেন তিনি বোধকরি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই গলি বেয়ে নামতে শুরু করবেন। সাড়ে নটায় তাঁর জন্য আমাদের বড় রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষা করার কথা।”
অরিন্দম লজ্জা পেলেও বুঝতে দেয় না। “তুই বোধহয় চা নিয়ে কিছু বলছিলিস?”
-“ওরে হতভাগা, আবার রাগ দেখানোর মতলব! এখন কটা বাজে খেয়াল আছে স্যর?” সন্দীপন হাতঘড়িটাকে অরিন্দমের চোখের সামনেটায় তুলে এনে দেখায়।
-“নটা পাঁচ! সর্বনাশ করেছে। বেয়ারাকে ব্রেকফাস্ট বলেছিস?” জিজ্ঞেস করে শালুক।
-“মহারাজ কি খাবেন সেটাই তো জেনে উঠতে পারিনি, জাঁহাপন!” সন্দীপন ফাজলামির মুডে রয়েছে আজ। অরিন্দম তেড়ে ওঠে এবার, “ইডিয়ট কোথাকার, ডিম-পাঁউরুটি যা হোক একটা কিছু বলে দে না গিয়ে, বল দশ মিনিটের মধ্যে চাই – আমি স্নান সেরে আসছি!” অরিন্দম বাথরুমের দিকে দৌড় দেয়। সন্দীপন মিটি মিটি হেসে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। ওর স্নানের পালা শেষ। “কি ভাগ্যিস গার্লফ্রেণ্ড নেই আমার,” স্বগতোক্তি করে সে রুম সার্ভিসকে টেলিফোনের জন্য হাত বাড়ায়।
ঘরময় রোদ। মেঝেতে পর্দার ছায়ারা জাফরি কেটে বেড়ায়।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা ম্যালের কাছাকাছি চলে এসেছে। এমন রোদ ঝলমলে সকাল প্রথম দিনেই ওরা পেয়ে যাবে আশা করেনি। ম্যালের কাছেই প্রাচীন অক্সফোর্ড বুক ষ্টোর। সবুজ কাঠের দরজা। ওপারে তাক ভরে সাজানো বইয়ের সম্ভার। শালুককে আটকানো গেল না। পনেরো মিনিট পর তিস্তা আর সন্দীপন বাইরে বেরিয়ে আসে।
-“আপনার বন্ধুকে বোধহয় বইয়ের দোকান দেখলেই আর আটকিয়ে রাখা যায় না, বলুন?” তিস্তা জিজ্ঞেস করে।
-“আর বলবেন না মশাই, আপনিও লক্ষ্য করেছেন। ওকে নিয়ে এই এক বিপদ! যেখানেই যাই না কেন বইয়ের দোকান একটা ঠিক খুঁজে বের করবেই। যে করেই হোক – আর ব্যস, ওখানেই এক ঘণ্টার গল্প।”
-“আমাকে নিয়ে কি কথা হচ্ছে শুনি?” ওরা কেউই খেয়াল করেনি অরিন্দম কখন বেরিয়ে এসে ওদের পিছনে দাঁড়িয়েছে। তিস্তা লজ্জা পেয়ে সরে যায় খানিক। সন্দীপন মুখ ভেটকিয়ে মজার মুখভঙ্গি করে বলে, “কই না তো! আমরা তো ইয়ে মানে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছিলাম!”
-“তাই বুঝি?”
-“আহ! লাগে না আমার?”
সন্দীপনের মাথায় এক গাঁট্টা লাগিয়েছে শালুক। “এই নে,” হাতের প্যাকেটটা থেকে কয়েকটা বই বের করে আনে অরিন্দম।
-“এটা তোর জন্য,” সন্দীপনের হাতে চলে এসেছে জন কীয়ের লেখা ‘দ্য গ্রেট আর্ক’, “কিভাবে এই বিশাল হিমালয় পর্বতমালাকে জরিপ করা হয়েছিল, তারই বাস্তব ইতিহাস,” শালুক বলতে থাকে, “আর এটা আপনার জন্য,” তিস্তা অবাক হয়ে যায়, “মাইকেল পলিনের হিমালয় অভিযানের কাহিনী!” আর আমার জন্য রইল – শালুক উজ্জ্বল চোখে সকলের দিকে তাকায়, “নিকলস রোয়েরিখের পেইন্টিংস।“ তিস্তা আপত্তি জানাতে যায়। কিন্তু জানাতে পারে না। ওর বইয়ের ভিতর থেকে একটা ছোট্ট কাগজ রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। উপরে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা, “আপনি থেকে তুমিতে নামলেও তো হয়!”
সন্দীপনের ঠিক এই সময়েতেই কাশির দমক এসে যাওয়ায় ও আরও একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তিস্তাও চোখ ফিরিয়ে নেয়, দূরের দিকে তাকায়। বরফ ঢাকা পাহাড়গুলোকে দেখতে পায়। শালুক বইগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে আবারও প্যাকেটের ভিতরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। হাওয়াটা শনশন করে বয়ে আসছে। একটু চা খেলেও নেহাত মন্দ লাগবে না এখন।
[৮]
মানুষ চেয়েও কত কিছু পায় না। অরুণজ্যোতি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন। কতজনেরই বা জীবন কেটে যায় গতানুগতিকতার চাকায় পিষতে পিষতে। কতজনেরই বা স্বপ্নপূরণ হয়না। তবুও মানুষ আশার পিছনে ছোটে। বুক বেঁধে এগিয়ে যায়। যায় বলেই সে মানুষ। শাল্মলী তাঁকে অনেকবার করে ভেবে দেখতে বলেছেন। এ কাজ করতে বারণ করেছেন। কিন্তু অরুণজ্যোতি সে কথা মানতে চান না কোনোভাবেই। জীবনে তিনি অনেক হারিয়েছেন। শেষ খেলাটুকু এইবারে চলুক তাঁর মতো করেই। তাঁর ইচ্ছেতেই। একে কি কেউ নৃশংসতা বলবে? নাকি বলবে অহংকার? অরুণজ্যোতির ভাবতে ইচ্ছে করে না। তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
নিস্তব্ধ কলকাতা শহর। রাত্রির মধ্যেও প্রশান্তি আছে। প্রেম আছে। বিছানাতে না গিয়েও তা অনুভব করা চলে। যৌবনে অরুণজ্যোতি কবিতা লিখতেন। এখন আর সেসবের কথা মনে পড়ে না। হিসেবের খাতা লিখতে লিখতেই জীবন পার করে দিলেন। শেষ বয়সে এলো কম্পিউটার। শিখতে হলো ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট। হাসি পায় তাঁর। শাল্মলীও কতগুলো বছর পুনাতে কাটিয়ে দিলেন। পুনার বৃষ্টির কথা শুনেছেন অরুণ। দেখা হয়নি কোনোদিন। কতবার শাল্মলী চিঠি লিখেছেন, পুনাতে ঘুরে যেতে বলেছেন। অজন্তা, ইলোরা, মহাবালেশ্বরের লোভ দেখিয়েছেন। অরুণজ্যোতি সময় করে উঠতে পারেননি। নাকি সময় করে উঠতে চানওনি বোধহয়? শাল্মলীর সাথে তাঁর শেষ দেখা আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে। হয়তো বা আঠাশ।
তখনও কলকাতায় নতুন সহস্রাব্দ আসেনি। তখনও কলকাতায় হলুদ-কালো ট্যাক্সি চলত। তিনরঙা পোস্টার পড়ত শাহরুখের ছবির। ট্রামের ঘন্টিতে ঝংকার শোনা যেত, বাসগুলো বেয়াড়া রকমের ঝুঁকে পড়ে বাঁক নিত। এখনও নেয়।
বারান্দা থেকে অরুণজ্যোতি দেখেন চুপ করে গলিটুকু নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। ফুটপাথের গায়ে একটা অংশে রোজকার মতোই কিছু আবর্জনা পড়ে রয়েছে। ফ্যাসফেসে হ্যালোজেনের আলোয় কেমন যেন হলুদ ঘিনঘিনে একটা অনুভূতি। অনেক দূর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। শাল্মলীর ফোন। অরুণজ্যোতি স্মার্টফোনটাকে পাশের বোতাম টিপে বন্ধ করে দেন। শাল্মলীর কাছ থেকে তাঁর শেষ বিদায় নেওয়া হয়ে গিয়েছে। কাল থেকেই হয়তো নতুন এক অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। অরুণজ্যোতি বুক ভরে শ্বাস নিলেন। শেষ কার্তিকের শীতলতা। মাঝে মাঝে এই কলকাতাতেও শ্বাস নিতে ভালো লাগে হঠাৎ।
শালুক আর তিস্তা, দু'জনেই এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে চিৎপাত হয়ে শুয়ে, নিজের নিজের বিছানাতেই কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সন্দীপন ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ।