দোঁহা

কৌশিক সেনের কবিতা

 

 ভাগের মা: স্বদেশ পর্যায়

আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে

যতবার গড়তে গেছি, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে ইমারত। সম্ভবামি মিলনের প্রলয়লগ্নে ঈশ্বরকে জাতক হিসেবে পাবো বলে বিষাদের গাত্রদাহে লাল হয়ে গেছে ঘরবসত, জমিজিরেত। কান্না জমেছে গভীর প্লুতস্বরে। ঘটিবাটি বন্ধক দিয়ে উঠে এসেছি ব্রীড়াবনত শ্যামলিমায়। যতবার সাবলীল ভক্তিতে চরণস্পর্শ করেছি মেঘলা কাঠপুতুলির, স্বপ্নের ভিতর আড়াআড়ি ছিঁড়ে পড়েছে করালবদনা মা আমার! অশ্রুতে অশ্রুতে পিচ্ছিল হয়েছে নিকানো আঙিনা। স্বরগ্রামে ভেসে উঠেছে ঋতুরক্তের খরবিচালি। ঈশ্বর নন, প্রসবযন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠেছেন উলঙ্গিনী নৃমুণ্ডমালিনী মাতৃকা! যতবার মায়ের আঁতুড়ঘর বেঁধেছি, ভেসে গেছে বানের জলে। চুলের মুঠি ধরে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে আলোর ধাত্রীদেবতাকে! যতবার কান্না জমেছে কণ্ঠনালীতে, আছিলা বাঁশ ভরে দিয়ে গেছে মুখগহ্বরে। মাৎসর্যের লক্ষণরেখা টেনে আবারও ছুটে গিয়েছি অলৌকিক মারীচবধে।


ওরে ওই উঠেছে শঙ্খ বেজে

বুঝি রাতের তারার ভিতর পরমসুন্দরের অবস্থান। নিভৃত গর্ভগৃহে জেগে ওঠেন অর্ধনারীশ্বর। আমাদের কোটিকল্পের দেবভূমি। আমাদের তিমিরবিদার লালিত সংস্কার। ঈশ্বরের আরতিধ্বনি শুনি। এই মৃত্তিকা, আজন্মের স্বর্গবাস, ডালে ডালে পুষ্পচয়নে কেটে গেছে আমাদের মাঙ্গলিক মুহূর্তগুলি। পূজার আয়োজনে ত্রুটি হয়নি কোনোদিন। তবে কেন এই বাটোয়ারা! ভিন্ন হয়ে যায় শাকম্ভরির সংসার, শরিক হয়ে যায় সহোদর! গণ্ডি কেটে মেপে রাখো ওয়ি ভুবনমনমোহিনীকে! এই নীলাকাশ, পুণ্যবাহিনী নদী, পাখীদের পরিক্রমণপথ–কই পারলে নাতো, জোর করে বেঁধে রাখতে! আমাদের হাসিকান্না, দিবারাত্রির কাব্যভাষাকে তো ভিন্ন করতে পারলেনা তোমরা! মিশ্র দাদরার লয়ে চিরকল্যাণময়ী মা’কে ডাকি এখনও।  রক্তক্ষরণের পর সন্তানের নাভিশক্তি আলাদা করবার সাধ্য তোমাদের নেই।  শাসনে যতই ঘেরো, আছে বল দুর্বলেরও। 


ধর্ম যবে শঙ্খ রবে করিবে আহ্বান
 
ইথারের তরঙ্গ যেন! দর্শনে ও ঘর্ষণে ফুলকি ছোটে। অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত হয় লাভাস্রোত। এসো জীবনের উদ্বোধনে! চণ্ডীপাঠে আবাহন করি তোমায়। ভাঙনবিধ্বস্ত স্বদেশ থেকে মন্দ্রিত হোক শঙ্খধ্বনি। স্পর্শে নির্মিত হোক অমৃতযোগ। হর্ষ উল্লাসে স্বাগত জানাও এক সনাতন দেবীকে।  আলোকবর্ণা মাতৃমূর্তি এক! সোনার মন্দিরে দুয়ার খুলে গেছে বুঝি! স্মিত বদনে, বরদায়িনী মুদ্রায়, পদ্মপলাশ হস্তে, ত্রিনয়নে হাজার হাজার ফাটল ধরেছে বহুদিন। ভাঙা হাট, মঙ্গলাচরণের বেদী, দুধপুষ্করিণীর ঘাটের পাঁজরে ফণা তুলেছে হিংস্র কালাচ। রক্তের আবণ্টনে গোধূলির ছায়া থেকে মুখ তুলেছে লোলুপ শৃগালেরা। তবে ডেকেছি কেন!  অধর্মের লীলাক্ষেত্রে তুমিই তো আমাদের প্রাণের প্রব্রাজিকা, মাগো! 


কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ
 
মাতৃসঙ্গীত থেমে গেছে বুঝি! আবণ্টনে বোধ হয় বন্যাত্রাণের তহবিল। তছরুপে তছরুপে শূন্য হয়ে গেছে শস্যভাণ্ডার। বিবর্ণ তমসারেখায় শুধু জল আর জল। ডাঙার উদ্দেশ্যে সাঁতরে চলেছি শতাব্দীকাল থেকে। যেদিকে চোখ যায়, দেখি মায়ের নাঙ্গা লাশ ভেসে বেড়ায়। এত অশ্রু ছিল ওই তৃতীয় নয়নে! এই দুঃসময়ে নিরঞ্জনের প্রয়োজন নেই আর। অপরাজিতা পূজার কিবা মাহাত্ম্য! বরং ঘর্ষণে ঘর্ষণে উত্তপ্ত করি আকাশ। বাষ্পীভূত হোক এই নোনাজলের সংক্রমণ। এস অক্ষয়পুণ্যসৌরভ দেবশিশুরা, বোধনের মঙ্গলঘট স্থাপন করি এই মাহেন্দ্রক্ষণে। সূর্যস্তবে শিউলি ঝরুক এই শীতল বসুন্ধরায়।


শূন্য পাণে চেয়ে প্রহর গণি গণি
 
জননচিহ্ন খুঁজে পাইনা আজকাল। ব্যাথা, বড় ব্যাথা এই অন্ধকারে। এইতো নাভি সংক্রমণের সময়! শরিকের দেশ থেকে কারা এনে দেবে, আমার দুষ্প্রাপ্য উপাচার! রৌদ্রের কিনারে কিনারে সেঁকে দেবে চিরকালীন ক্ষতদাগ! তবে এই কি ভবিতব্য, এই কি শাশ্বত! সূর্যকিরণে ঝলসে যাওয়া পাণ্ডুলিপি বের করে পরখ করি বারবার। পাতায় পাতায় বিজাতীয় ঘ্রাণ কে ছড়িয়ে দিল অমন করে! মেঘের অজুততরঙ্গে সাজানো নহবতে তবে কি আর সানাই বাজবেনা কোনোদিন! বড় ইচ্ছে করে বৃষ্টি নামাই, এই খণ্ডিত অববাহিকায়। আজ নাহয়, শ্রাবণধারায় সিক্ত হোক এই পোড়া দেশ! বজ্রপাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাক বুকের ভিতর বিছিয়ে দেওয়া অমোঘ কাঁটাতার। নূতন যুগের ভোরে শৃঙ্খলমুক্তি হোক দেশমাতৃকার!



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন