মালবিকা মিত্র
-ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই।
খালের ওপার থেকে উজ্জৎ আলি, হাফেজ আলিরা সদলে লাঠি সড়কি ল্যাজা আর কাঁসর ঘন্টার ঠঙ্ ঠঙ্ ঠঙঙঙঙঙ ধ্বনি তুলে ছুটে এলো। মাইজ্যা কত্তা মানে শৈলেশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। চার ভাই আর এক বোনের মধ্যে একা শৈলেশ রঞ্জন মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে দুই মেয়ে আর বৌ নিয়ে। সাত পুরুষের রক্ত ঘাম আবেগ অশ্রু ভেজা মাটি। দেশভাগের সেই কতো আগেই তো বাকি তিনজন কলকাতা, বরানগর, চন্দননগর শহরে পাড়ি জমালো। একমাত্র বোন বিয়ে করে বাটাজোড়ে, দেশেই। জামাইয়ের আসামে বিরাট কাঠের ব্যবসা। তিন ভাইয়ের নিজেদের পড়াশোনা, চাকরি, বিয়ে, সন্তানের জন্ম তাদের কোয়ালিটি এডুকেশন সুরক্ষিত হলো। ভাইয়েরা মেজ ভাইকেও দেশ ছেড়ে চলে আসতে বলেছিল। কিন্তু খাইছরাৎ এর দোষ, বরিশাইল্যা গোঁ, সাত পুরুষের ভিটা ছাড়ুম না। না যাম না যাম।
সেই রাতে ডাকাতি আর হয়নি। খালের ওপার থেকে "ভয় নাই" অভয় বাণী শোনা মাত্র আন্ধারে জড়ো হওয়া সারি সারি আলোক বিন্দু মিলিয়ে গেলো। সারা রাত উজ্জৎ আর হাফেজরা বাইর বাড়ির কাছাড়ি তে আড্ডা, গল্প, ঘনঘন চা, পান আর তামাকে মশগুল থাকলো। সারা রাত মাইজ্যা কত্তার একের পর এক নির্দেশ তামিল করতে করতে মাইজ্যা বৌঠান যেমন দিশেহারা, তেমনই নিরাপদ নিশ্চিন্ত।
(১)
এই ঘটনা একবার নয়, আরও কয়েকবার হয়েছে। উড়ো চিঠি এসেছে ডাকাতির হুমকি দিয়ে। পোস্ট অফিস মাইজ্যা কত্তার বাইর বাড়ির লগেই একটা ঘরে। পোষ্ট মাষ্টার মনীন্দ্র বাবু সেই খোলা হুমকি চিঠি পাঁচ কান না করার জন্য পিওন আমিনুলকে না দিয়ে, নিজেই এসে শৈলেশ রঞ্জনের হাতে তুলে দিয়েছেন। দুজনেই একমত হয়, নিছক ভয় দেখানোর জন্যই এই চিঠি। কাছারির সান্ধ্য আড্ডায় ঠিক হলো, সামান্য কিছু বিপদের আশঙ্কা দেখলেই মাইজ্যা কত্তা হাঁক মারবেন আর টর্চের আলো ফেলবে খালের ওপারে মুসলমান নমঃশূদ্র পাড়ায়। সেই মতো শৈলেশ রঞ্জন রাতের অন্ধকারে একঝাঁক আলোর বিন্দুকে এগিয়ে আসতে দেখেই দোতলার বারান্দা থেকে হাঁক মারেন "উজ্জৎ মিঞা হাফেজ মিঞা হুনবার পারছো রেএএএএ"। ডাক শুনে মাইজ্যা বৌঠান দুই মেয়েকে কোলে বুকে চেপে ধরে ওপরে দোতলার ঘরে উঠে আসে। দেখে, শৈলেশ রঞ্জন চার ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে অদূরে খালের ওপারে আলো দেখাচ্ছে হাত নেড়ে নেড়ে। আর তখনই গগনবিদারী অভয় বাণী, "ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই। এএই আইয়া পড়সি"।
আসতে দু মিনিট দেরি করে নি ওরা। খালের ওপরে শাল কাঠের খুঁটির শক্ত পোক্ত সাঁকো। শৈলেশ রঞ্জনের উদ্যোগ ও খরচে বানানো। এই গৌরনদী খাল বেশ চওড়া, তবে এই স্থানে একটু অপ্রশস্ত, সংকীর্ণ। শৈলেশ রঞ্জন ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হবার ঢের আগেই এসব তৈরি। মাইজ্যা বৌঠান দু একবার মৃদু ও শান্ত স্বরে বোঝাতে চেয়েছে, "দ্যাশ ভাগের পর এই গ্রামের হক্কল হিন্দু ঘর ভিটা ছাড়সে। চলো, আমরাও যাইগ্যা। ওই দ্যাশতো আমাগোই, আমরা জলে পড়ুমনা। আমাগো তো ব্যাবাক জ্ঞাতি গুষ্টি ওই দ্যাশেই। বিপদে আপদে এই ভিনদ্যাশে মাইয়া নিয়া কই যামু।"
প্রথম দিকে "ভিনদেশ" শুনে শৈলেশ রঞ্জনের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। "কথাডা কি কইলা, ভিন দ্যাশ! ভিনদ্যাশ না, এইডা আমাগো নিজের দ্যাশ, বুঝছো?" সব হিন্দু ভিটা ছাড়লেও শৈলেশ রঞ্জনের দৃঢ় বিশ্বাস, "বাঙ্গালগো অন্য কোনো দ্যাশ নাই। হাচা (সাচ্চা) বাঙ্গাল পরাণ ভয়ে দ্যাশ ছাড়ে না। আর বরিশাল তো নিজেই একটা দেশ।"
সান্ধ্য আড্ডায় গুটি ছয়েক "হাচা বাঙ্গাল" আড্ডায় আসে। ডাক্তার বাবু ললিত শর্মা, পোষ্ট মাষ্টার মনীন্দ্র বাবু, স্কুলের দুই মাষ্টার সুকুমার বাবু ও বিক্রম বাবু, আর আসেন বরিশালের বালাম চালের প্রধান ব্যাপারী আড়তদার কানাই বাবু। একে একে যে হারে হাচা বাঙ্গাল কমতে থাকে সেই হারে না হলেও খালের ওই পাড়ের লোক দু/চার জন করে আড্ডায় বাড়তে থাকে। ওই আড্ডা থেকেই উজ্জৎ হাফেজরা ডাকাতির হুমকি চিঠির কথা জানতে পারে। তখনই আলোচনা প্রতিরোধ পরিকল্পনা করা হয়।
"ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই।" এতো কথার কথা না। সত্যিই তো ভয় পায়নি শৈলেশ রঞ্জন। পাবেই বা কেন? হাফেজের কোলে পিঠে চেপে শৈলেশের দুই মেয়ে কতবার গ্রামে মেলায় ঘুরতে গেছে। এক গাঁ পেরিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে গান গাইতে গেছে। সব সময় এরাই তো ভরসা। বাটাজোড়ে বোন নারায়ণী থাকে। জামাই ব্যবসায়ী, আসামের কাঠ আমদানি করে। নদীনালার দেশে নৌকার কাঠের খুব চাহিদা। কাঠের তৈরি বাড়িও বিত্তবান দের মধ্যে প্রচলিত। তার বাড়িতে মহা সমারোহে ঘটা করে অন্নপূর্ণা পুজো হয়। শৈলেশ রঞ্জন তার দুই মেয়ে আর বৌকে পরম নিশ্চিন্তে পাঠিয়ে দিতো নৌকায় রহমৎ মিঞার সঙ্গে। কখনো কখনো মিঞার ছোটো ছেলে আলমও তাদের সঙ্গী হয়েছে।
রহমৎ খাল পেরিয়ে শিকারপুর নদীতে নৌকো তুলেছে। বিরাট চওড়া নদী। বৌঠান বা তার দুই মেয়ে এতটুকু ভীত সন্ত্রস্ত হয়নি। বরং "ঠাউর বাড়ির" তিন পুরুষ দেখা রহমৎ মিঞা পরম উৎসাহে পলা আর নীলাকে গল্প শোনায়, "মাইজ্যা ঠাউর"এর বিয়ে করতে যাবার পথে আসমান আন্ধার করে কেমন ঝড় উঠেছিল। তারপর নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে গুণ টেনে ঠেলে এগোনোর গল্প। সেদিনও রহমৎ বলেছিল" ভয় নাই মাইজ্যা কত্তাআআ..."। কতবার বলা ও শোনা গল্প, তবু প্রতিবারই যেন এই প্রথম শুনছে মনে হয়। রহমৎ মিঞাও যেনো আজকেই প্রথম বলছে এমন আবেগ উত্তেজনা মিশিয়ে বলতে থাকে। স্নেহ আবেগে মরচে ধরে না।
রহমত বয়সের কারণে ফি বছর বাইচ প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেও নিজে দাঁড় টানতে অশক্ত, অক্ষম। ছেলে ছোকড়ার দল গড়ে নাম দিতো। নিজে কাঁসর ঘন্টা নিয়ে হাত নেড়ে ছড়া কেটে সারিগান গেয়ে উৎসাহ যোগাতো। সাধারণত হাফেজ কাকা পলা আর নীলাকে ওই বাইচের প্রতিযোগিতা দেখাতে নিয়ে যেতো। দুই বোনের কি প্রচন্ড উত্তেজনা, একসাথে শয়ে শয়ে দাঁড় উঠছে আর পড়ছে। দাঁড়ের ওঠানামার গতি দ্রুত করছে কাঁসর ঘন্টার তাল আর সারি গানের ছন্দ। ঠঙ্গাৎ ঠঙ্গাৎ ঠঙ্গাৎ ঠঙ্গাৎ তালে।
আল্লায় বলিয়া নাও খোল রে
হেই ভাই হক্কলে।
আল্লাহ বলিয়া খোল।।
ওরে আল্লা বল নাও খোল
হয়তান যাবে দূরে।।
হেই ভাই হক্কলে।
ওরে যে কলমা পইড়া দেছে
মোহাম্মদ রসূলরে।।
হেই ভাই হক্কলে।
তাল দ্রুত হচ্ছে, রহমতের হাত আকশের দিকে তালে তালে উঠছে নামছে। আবদুলের বাইচ পিছনে ফেলে রহমত চাচা এগোচ্ছে। এক রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা। দুই বোনের বিস্ফারিত চোখ। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলে। শুধু বাড়ি জুড়ে কদিন একটা শব্দ বিরাজ করে দুই বোনের গলায় "ঠঙ্গাৎ ঠঙ্গাৎ"।
শৈলেশের এক পাগলি পিসি ছিল। বাল্য বিধবা। সে ছিল শরীরে শক্ত পোক্ত। স্নান খাওয়া আর ঘুমের সময় ছিল নির্দিষ্ট। বাকি সময় কোথায় যে উড়ছে কে জানে। তার নাম ছিল বাতাসী। আট বছর বয়সে বাল্য বিধবা। তার খুব চোপার জোর, কথা বলে কার সাধ্য। একদিন শৈলেশের মা শুধু বলেছে, "ঠাউরঝির আর কি কাম, খাওন আর শয়ন।" ব্যাস, আর যায় কোথায়। পাগল হলেও সে তো ননদিনী, ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক। "খাওন কি কম ছেরম, খাইতে বহন, ভাত মাখন, পেরতেক গরাসে হাঁ করন, চিবাইয়া গেলোন।" এই রকম মানুষ কে বৌঠান সাবধানে এড়িয়ে চলতো। বৌঠান তার হাতে মেয়েদের ছাড়তে চাইতো না। বুক কাঁপতো ভয়ে আশঙ্কায়। তো বাতাসী তা শুনবে কেন! তার জ্ঞানের নাড়ি টনটনে।
-ক্যান দিবা না? মাইয়া কি তুমি বাপের বাড়ি থিকা আনসো? আমাগো মাইয়া।
একবার দুই নাতনী কে নিয়ে বেরিয়ে বাতাসী তাদের নির্জন পথে রেখে কোথায় উড়ে গেছে। বেলা পড়ন্ত, একদিকে বৌঠানের হাপুস কান্না, "পিসিমা, পলা নীলা কোথায়?"
-যার বাচ্চা হ্যায় বুঝবো। আমার বোঝোনে কি কাম।
ওদিকে সন্ধ্যা নামার মুখে বেলা গড়িয়ে আলো কমে আসছে। পলা আর নীলার কান্নার সুর চড়ছে। ভাগ্যিস ছিল হাট বার। ফেরত আসা হাটুরের দল তাদের ঘিরে ধরে। ভীড়ের কেউ বললো "ঠাওড় হয়, ঠাউর বাড়ির মাইয়া"। আরও কেউ বললো, "হ হ, মাইজ্যা কর্তার মাইয়া"। সে যাত্রা রক্ষে। একবার তো বাতাসী ছোট্টো নীলা কে একটা খড়ের গাদার ওপর শুইয়ে দিলো রোদ্দুর পোহাতে। নীলা তখন এক বছর বা আরও কম। তারপর বাতাসী কখন সেটা ভুলেও গেলো। ধান ঝাড়া শুকানোর কাজ করছিলো কামিনের দল। তাদের চোখে পড়েছিল তাই রক্ষে। সে বারেও বৌঠান উদভ্রান্ত, "পিসিমা, নীলা কোথায়?"
-"মাইয়া রোদ্দুর পোহায়।" একটি বাক্যে সংক্ষিপ্ত এক কথায় উত্তর।
সে যাত্রাও "ঠাউর বাড়ির মাইয়া" গ্রামের প্রতিবেশী দের সাহচর্যে ঘরে ফিরে আসে। তাই বলছিলাম, "ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই" এটা কথার কথা না। এই কথার মর্ম ঠাকুর বাড়ি তিল তিল করে উপলব্ধি করতে পারে।
(২)
শুধু তো মেয়ে বৌ নয়, আছে শৈলেশ এর পিসি, আছে বৃদ্ধা মা, আছে শ্বেত শ্মশ্রুধর কাকা। এদের ভূত ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে এই ভিটের সাথে। এরাও কেউ "দ্যাশ" ছাড়তে চায়না। এদের খিদমতেও বৌঠান এর কম সময় যায়না। হুমকি চিঠি যতই বাড়তে থাকে, শৈলেশ রঞ্জন ততই বেশি আশঙ্কা আর আত্ম বিশ্বাসের অভাবে ভুগতে থাকে। দুটো মেয়ে, বৌ, এতোগুলো বুড়োবুড়ি এদের নিয়ে কি করবে ভেবে অকূল দরিয়ার মাঝে হাতড়ায়। আর উল্টো দিকে বৌঠান দু তিনটে হুমকি কাটিয়ে, সকলের মাঝে সত্যিই আশ্বাস পেয়ে আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে। ভয়টা কেটে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে একদিন সত্যিই ডাকাত পড়লো বাড়িতে। এবার আর চিঠি দিয়ে নয়। সরাসরি রাত্রে ডাকাত দলের তান্ডব।
প্রথম ক'বার চিঠি, ভয় দেখানো। কাজ হলো না। এবার তাই মাত্রা আরও একটু চড়া হলো। সশরীরে হাজির। উঠোনে ধানের মাড়াই নষ্ট করা, বাইর বাড়ি, কাছারি, এমনকি ঘরের লাগোয়া হেঁশেল, ঢেঁকিশাল, দুধ-গুড় জ্বাল দেওয়ার উনুন সব কিছু তছনছ, লন্ডভন্ড, ভাঙচুর। সবাই বুঝতে পারে এটাও একটু বৃহত্তর ভয় দেখানো। যাতে মাইজ্যা কত্তা নিজেই, স্বেচ্ছায় দেশত্যাগী হয়। শৈলেশ রঞ্জন আচমকা হামলায় একটু বেসামাল হয়ে যায়। ঘরে ঢোকার সদর দরজায় যথা সম্ভব বাধার পাঁচিল তুলে, মেয়ে বৌ বুড়ো বুড়িদের অতি কষ্টে দোতলায় ওঠায়। নিজে বল্লম নিয়ে মরীয়ার মতো নিচের ঘরে দাঁড়ায়।
না, ডাকাতরা ঘরে ঢোকেনি। খড়ের গাদায় আগুন লাগায়, গোয়ালে গরু বাছুরের উপর আস্ফালন দেখিয়ে কিছু ভাঙচুর করে। কিন্তু ওই খড়ের গাদায় আগুন থেকেই খালের ওপারে খবর পৌঁছে যায়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, কাল বিলম্ব না করে অভয় বাণী ভেসে আসে "ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই..."। মুহূর্তে ডাকাত দলের আস্ফালন, ভাঙচুরের শব্দ মিলিয়ে যায়। উজ্জৎ আলী হাফেজ আলীর দলবল এসে ঘর বাইর কাছাড়ি বাগান সব তল্লাশি চালিয়ে দেখে পালাতে না পেরে কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। এরই মধ্যে একদল পড়শী আগুন নিভিয়ে ফেলে তৎপরতার সঙ্গে। মুহূর্তে শান্তি স্থিতি ফিরে আসে।
শান্তি স্থিতি যা একবার বিঘ্নিত হয়, তা ফিরে এলেও কখনও পূর্বাবস্থায় ফেরে না। একটা ভয় আর আশঙ্কা স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। চিড় ধরে ভরসায়, তারপর সেটা জাল বিস্তার করতে থাকে। ১৯৪৭-৪৮ এ যে, বলা ভালো যারা, মাটির টান ছাড়তে পারলো না
এবার একে একে তার কাকা, পিসি, মা, এমনকি বাটাজোড়ের বোন ভগ্নিপতি সবাই "দ্যাশ" ছাড়লো। খালের ওপার বলেছিলো "ভয় নাই"। ভয় তবু একে একে পেয়েছে সবাই।
আড্ডায় মস্করা করে শৈলেশ বলতো, "হাচা বাঙ্গাল দ্যাশের লইগ্যা পরাণ ত্যাগ করে, পরাণের লইগ্যা দ্যাশ ত্যাগ করে না।" আসলে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যেমন সমস্যা একটু বাড়ছিল, সেই সমস্যা দশগুণ বাড়িয়ে পরিবেশন করা হয়েছে এদেশে। ফলে ভাই বোন আত্মীয় পরিজন সকলেই এদেশে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। বৌঠান বোঝায় নিজের জীবন নিজের পরিবার নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যায়। কিন্তু ওই বুড়ো মানুষ গুলোর জীবন নিয়ে একার সিদ্ধান্ত চলে না। শৈলেশের কাছে কথাগুলো যুক্তিপূর্ণ লাগে। তাছাড়া দুশ্চিন্তার কালো মেঘ মন জুড়ে ছিল। তাই কথাটা মনে ধরে। সেই কথার পরেই শৈলেশ একে একে বুড়ো বুড়ি বোন ভগ্নিপতি সবাইকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। তা না হলে শৈলেশ কখনো বৌঠানের যুক্তি পরামর্শ শোনার মানুষ নয়। এরপরেও শৈলেশ রঞ্জন সবাই কে ভারতে পাঠিয়ে নিজে ও দুই মেয়ে বৌ নিয়ে দেশে থেকে গেলো।
(৩)
সত্যিই তো ওরা ভয় পায়নি। তা না হলে দেশভাগের পরেও ১৭ বছর ওদেশে শৈলেশ রঞ্জন কাকা মা পিসিমা বৌ মেয়ে নিয়ে থেকে গেলো কেনো। বিশেষ একটা আত্মপর বিভেদ তো শিশুর চোখেও ধরা পড়ে নি। ভিতর বাড়িতে রান্নাঘর সংলগ্ন ঢেঁকিশাল, ঘানিঘর। মালতীর মাসি, তুসু (তেসলিম) এর মা, রাই কমিনী তারাই তো ঢেঁকিশালে সব কাজ করতো। ঘানিঘরে ঘাইন বুড়ো আর তার ছেলে শামিম, ওদের কর্তৃত্ব। ভেদরেখা তো ছিল না। তবে হ্যাঁ, শৈলেশের নিজের মায়ের ছোঁয়া ছূঁয়ি বাতিক ছিল। পুকুর থেকে স্নান করে ঘরে ফিরতো। দুই নাতনি ঠাকুমার সঙ্গে থাকতো। সত্য হোক বা না হোক, বুড়ি বলতো, "তোরা ছূঁইয়া দিছোস"... ঠাকুমা আবার চললো ডুব দিতে। এই ঘটনায় নাতনিরা মজা পেত। ঠাকুমা সারাক্ষণ বলতো "শ্রী বিষ্ণু শ্রী বিষ্ণু"। আর নাতনিরা শুনতো "ছূঁইস না ছূঁইস না"।
"ছূঁইস না ছূঁইস না" ঠাকুমার এই বাতিকের পূর্ণ সুযোগ নিতো নাতনিরা। রাইকামিনী র ছেলে লইটক্যা বা মালতীর মেয়ে ল্যাদা যখন উঠোনে কুমিরডাঙা খেলতো, একটু বেকায়দায় পড়লেই দুই বোন দাওয়ায় উঠে ঠাকুমার কাছে আশ্রয় নিতো। জানতো লইটক্যা বা ল্যাদা ঠাকুমার সামনে বারান্দায় উঠবে না। কারণ ওরা ওপাড়ায় থাকে। একবার তো লইটক্যা নীলাকে ধাওয়া করে সবেগে ছুটে আসে। নীলা ফস্কে যায়। লইটক্যা বারান্দার খুঁটিতে এসে পড়ে। কপাল ফুলে আলু। তারপর থেকেই "কুমির তর জলে নামছি" খেলা সাঙ্গ। আর ল্যাদা ছিল একটু বড়ো, সে "তরার দাওয়ায় উইঠ্যা পরন আমরার ভাইল্লাগে না" বলে খেলতে চাইতো না। বড়ো বোন পলা প্যাকেটের খেজুর, শহর থেকে আনানো বিস্কুট, লজেন্স ঘুষ দিয়ে ল্যাদাকে খেলতে রাজি করাতো।
রাইকামিনী বিধবা। তার একমাত্র সন্তান লইটক্যা।
লইটক্যার ছিল দুঃসাহস। বনে বাদাড়ে ঝোপে ঝাড়ে অবাধ প্রবেশ। ফলতঃ আজ এটার কামড় কাল ওটার কামড়। মুখ ফুলে চোখ বন্ধ বা কপাল ফুলে লাল রক্তবর্ণ। তবে অন্যায় করলে মায়ের লাঠিপেটা ছিল বাঁধা। তাই মারের ভয়ে লইটক্যা কোথায় যে আত্মগোপন করতো কেউ জানে না। আগেই বলেছি, বনে বাদাড়ে ঝোপে ঝাড়ে অবাধ প্রবেশ। তবে সমস্ত মহাকাব্যের নায়কের চরিত্রে একটা দুর্বল স্থান থাকে। লইটক্যা কুকুর কে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পায়। রাইকামিনী যেই ডাক ছাড়ে "লইটক্যারে এ এ এ, আতুত আতু তু তু উ উ উ"। যার অর্থ ছিল "এই আমি কুকুর ডাকছি, আতু উ উ"। যেখানেই থাকুক বাধ্য ছেলের মতো বেড়িয়ে এসে মায়ের প্রহার স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতো। এখন বুঝি, রাই কামিনী একমাত্র সন্তান কে চোখে হারাতো। লইটক্যাও তাই। মাকে চোখে হারায়। না হলে পিটানি খাওয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসে। ওটাতো আসলে কুকুরের ভয় না, মায়ের কাছে ফিরে আসার অজুহাত।
বছর শেষে চৈত্র সংক্রান্তির চড়কের মেলা। শৈলেশ রঞ্জন বাচ্চা ছেলে মেয়ে বৌ ঝি কে মুঠো ভরে পয়সা দিতো, কোনো হিসেব গোনাগুনি চলতো না। অকাতরে বিলোতো। আর ছিল পরদিন নতুন বছরে শহর থেকে আনা বড়ো বড়ো টিন ভর্তি রসগোল্লা। সবাইকে বিলোতেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, বরিশালে ভালো মিষ্টির প্রচলন ছিল না। ছানার মিষ্টি বিষয়টাই কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের ধারণা। সামর্থ্যবানরা শহর থেকে সন্দেশ রসগোল্লা আমদানি করতো। ছেলে বুড়ো সকলেই রসগোল্লা আনন্দের সাথে খেতো।
খাওয়ার প্রসঙ্গে মনে এলো পোৎনার কথা। স্বাস্থ্যবান সুঠাম চেহারার বছর ষোলো আঠারোর কিশোর। ঘরের এটা সেটা, ফাই ফরমাশ, বাগানের পরিচর্যা সবকিছু করতো। যেমন খাটতে পারতো, তেমনি খেতে পারতো। বয়সটাও তো খাওয়ার বয়স। একদিন বৌঠান নানা উপকরনে পঞ্চ ব্যাঞ্জন সাজিয়ে পোৎনাকে খেতে দিয়েছেন। পোৎনার সলজ্জ অনুনয় "মা ঠান, এমন হরু চাউলের ভাত, এমন হাজাইয়া দিয়া খাওন, আমাগো প্যাট ভরে না"। পোৎনাকে নিয়ে বুড়ো বুড়ির দল রসিকতাও করতো। শৈলেশ রঞ্জনের বিধবা পিসি একদিন রসিকতা করে বললো, "অই পোৎনা, আমাগো পলারে তর ভালো লাগে?" পোৎনার তাৎক্ষণিক জবাব "হঅঅ ঠানদি"। ঠানদি আবার প্রশ্ন করে "পলারে তুই বিয়া করবি?" এর উত্তর সটান নয়, ডিপ্লোমাটিক উত্তর, "হইলেই হইতে পারে, কইবো কেডায়!" কোথাও ভয়ের প্রকাশ নেইতো।
বেশ মনে আছে অঘ্রান মাসে নতুন ধানের সুঘ্রাণে নবান্নের আয়োজন। নব অন্ন। বৌঠান কতোদিন আগে থেকেই আয়োজন সারতেন। ঢেঁকিতে পার দিয়ে চাল গুঁড়ো করা। ঝুনো নারকেল আর সদ্য শাঁস হওয়া ডাব নারকেল পেড়ে আলাদা করা। নতুন খেজুরের গুড় আনা, গোটা উঠোন লেপে খটখটে শুকনো করে আশপাশের সব মেয়ে বৌ দের নিয়ে আলপনা আঁকা। কাজ অনেক, করবে ঘাইন বুড়া, পোৎনা, রাই কামিনী, ওরা সবাই। কিন্তু সব ঠিক ঠাক হচ্ছে কিনা তার তদারকির দায়িত্ব বৌঠান এর। এটা মস্ত কাজ। পলা আর নীলা সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে ছড়া কেটে উচ্চ স্বরে কাক পক্ষীদের নেমন্তন্ন করে আসতো-
"কাউয়া কো কো কো
আমাগো বাড়ি যাইয়ো
শুভ নবান্ন খাইয়ো।"
নীলা কেবলই বলতো "শুভান্ন নবান্ন খাইয়ো", আর দিদির কাছে বকুনি খেতো। কতো মানুষের আনাগোনা। কদিন ধরেই তোরজোড় আয়োজন। আর নবান্নের চাল মাখা, সেতো আক্ষরিক অর্থেই অমৃত। বরিশালের চাল নিয়ে তো কোনো কথাই চলবে না। সেই চাল গুঁড়ো মাখা হবে নতুন গুড়, নারকেল বাটা, ডাব ও নারকেলের জল , দুধ, সামান্য কর্পূর, আর মনে হয় শবরী কলা। খেয়ে খেয়ে পেট ভরে যেতো, তবু আশ মিটতো না। উজ্জত আলী মনে হয় নবান্নের চাল মাখা কে বলতো "মলিদা"।
আর বড়ো আনন্দের উৎসব ছিল সরস্বতী পূজা। পাড়ার সকলের হাতেখড়ি হয়েছে শৈলেশ রঞ্জনের বাড়িতে নির্বিশেষে। শৈলেশ রঞ্জনের হাতে বা তার কাকার হাতে সবার হাতে খড়ি। রঙিন কাগজে, ফলে ফুলে, উপোসে অঞ্জলিতে সারাদিন হই হুল্লোড় করে ভালো কাটতো। দুপুরে থাকতো গণ খিচুড়ি, কপির তরকারি, বেগুন ভাজা, টমেটোর চাটনি। প্রায় একই রকম আয়োজন ছিল লক্ষীপুজোয়। তবে লক্ষ্মী পূজার ভোগে বরিশালের ব্রাহ্মণ পরিবারে কই মাছ, ভেটকি মাছ, চিংড়ি মাছ আর ইলিশ মাছ ছিল আবশ্যিক। নদী নালার বরিশাল। দেবতার পূজায় মাছ তো থাকবেই। স্থানীয় সহজলভ্য উপকরনেই তো দেবতার পূজা। তবেই তো দেব মাহাত্ম্য প্রচার ও প্রসার, তাইনা?
বরিশালে দেশের বাড়িতে দুর্গা পূজা তেমন স্মরণে আসে না। শহর থেকে শৈলেশ রঞ্জন কয়েকটি শাড়ি কিছু ছিট কাপড় কিনে আনতো। বৌঠান রাতের পর রাত সেলাই করে সবার জন্য জামা বানাতো। ভালো কথা এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, এতো ব্যস্ত তার মধ্যে বৌঠান সেলাই শেখানো গান শেখানো জারি রাখেন। খালের এপারে র শ্রীমতী ছিল, গীতালি ছিল, আবার ওই পাড়ের মুমতাজও ছিল। বিশেষ কোনো আড়ম্বর এখানে দুর্গাপূজা নিয়ে ছিল না। পলা ও নীলার মণীন্দ্র কাকার বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো। পুজোর একদিন সেখানে সপরিবারে যেতো শৈলেশ। যতদূর জানি অষ্টমী পুজোয় অঞ্জলি দিতো শৈলেশ ও বৌঠান। মেয়েরাও সারাদিন থাকতো, দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে বিকেলে ফিরে আসতো। খুব সম্ভবত বাড়িতে এতগুলো বুড়ো বুড়ি রেখে বৌঠানের পক্ষে দুদিন যাওয়া সম্ভব হতো না। ফলে মেয়ে দুটোও পুজো গন্ডার দিনে ঘর বন্দী। মণীন্দ্র লাহিড়ীর বাড়ি একই গ্রামে। তিনি প্রতি দিনই যাবার নিমন্ত্রণ করতেন বৌঠান কে। মনীন্দ্র বাবু তো প্রতি দিনই সান্ধ্য আসরে এবাড়ি আসতেন। বৌঠান আসলে মেয়েদের আর কারো হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্ত হবেন না। অতএব পুজোর দিনেও ঘর বন্দী।
একেবারে কি আর ছাড়েনি বৌঠান? ঈদের অনুষ্ঠানে, মহরমের সান্ধ্য শোকের আসরে হাফেজ, আর উজ্জৎ আলি কতোবার তো পলা নীলা কে নিয়ে গেছে। আসলে বৌঠান জানেন হাফেজ উজ্জৎ বৌঠানের চেয়েও বেশি নজর রাখবে। ঈদের উৎসবে পলা নীলার উৎসাহ আনন্দ হতো বেশী। মহরমে ওই তাজিয়া বহন, হায় হাসান হায় হোসেন, সারি গানে একটু জলের জন্য কান্না, আর নিজেদের শরীরকে ক্ষত বিক্ষত করা। এগুলো শিশুর দৃষ্টিতে কিছুটা নিরানন্দের। শুধু বিস্ময় হিসেবে গেঁথে থাকে স্মৃতিতে উজ্জৎ আলির আত্ম পীড়ন। আর হায় হাসান হায় হোসেন। পরে যখন উজ্জৎ আলি বাড়িতে আসতো, পলা আর নীলা দূর থেকে আর আড়াল থেকে বিস্ময় নিয়ে নিরীক্ষণ করতো।
আর ছিল শাহজাহান চৌধুরী তহমিনা চৌধুরী। তারা বিদেশে থাকতেন। তবে যখনই আসতেন বৌঠান শৈলেশ রঞ্জন সপরিবারে নিমন্ত্রিত হতেন। গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। তাদের বাড়ি ঘর আসবাব বাগান লন এসবই যেনো গল্পের দেশ। গাড়িতে করেই বাড়ি পৌঁছে দিতেন। আনন্দে ঠিক নয়, দিনটা পলা নীলার স্বপ্ন আর বিস্ময়ের মধ্যে কাটতো। এখানেও সমীহ ছিল কিন্তু ভয় ছিল না।
সেটা ছিল "সবে বরাত" পরব। হাফেজ আলি বলেছিল, হিজরী শা'বান মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মাঝের রাতে পালিত মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ রাত। হিন্দুস্তানে এই রাতকে শবে বরাত বলা হয়। মুসলমানরা বিশ্বাস করে , এই রাতে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমা করেন। অনেক অঞ্চলে, এই রাতে তাঁদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। তবে অন্য আচরনে সারা রাত ধরে মৌলবী সাহেব উপস্থিত সকলের নসীবের লিখন পড়েন। এই পরব সবার কাছেই আগ্রহোদ্দীপক। ঘটনা হলো, রাত জাগা চোখে পরদিন সকালে কাজে এলো ঘাইনবুড়া। ঘাইন বুড়ার প্রকৃত নাম সম্ভবত মনিরুল।
ঠাকুমা কয়, "অঅঅই বুড়া, রাত্তির জাইগ্যা চক্ষু দুই খান তো জবা ফুলের লাহন হইছে। তা আল্লাহ তর নসিবে কি লিখলো শুনি?" প্রথমে বুড়া চুপচাপ ছিল। কিন্তু মা ঠাইন যখন বারবার জানতে চায়, বলতে বাধ্য হয়। বৌঠান এই খুঁচিয়ে কষ্ট দেওয়া পছন্দ করে না। "থাকনা মা। বলার হলে তো বলতোই।"
"মা ঠাইন, আমাগো কথা ছাড়েন" ঘাইন বুড়া বলে, "বড়ো বড়ো ঈমানদারগো নসিবে কতো কথা ল্যাহা। হেইয়া পইড়াই রাত্তির কাবার। মৌলবি সাহেব কি আর করেন। আমাগো হগলের দিকে হাত দেখাইয়া কইলেন...তোমাগো লইগ্যা সাবেক হুকুম বহাল।"
ভগবান তুমি সত্যিই আছো কি? তুমি তো মধ্য দিনের রক্ত নয়ন অন্ধ করে ধরনীকে ছত্রছায়ায় ঢেকে দিতে পারো। অথচ ঘাইন বুড়া, লইটক্যা, পোৎনা; রাত্রি যাদের স্বভাবতই দীর্ঘায়ত, তাদের মুখ চেয়ে একবার বলতেই পারতে :
একটু দাঁড়াও সূর্য্য, আজ যারা আহিস্তা চলনা।
(৪)
হয়তো এভাবেই বাকিটুকু চলতো। কিন্তু ১৯৬৫ র ভারত পাকিস্তান সীমান্ত সংঘর্ষ, দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল চওড়া করলো, শুধু তাই না। দেশের মধ্যে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কে অবিশ্বাস সন্দেহ বাড়তে থাকলো। শওকত আলীর লোভে চকচক চোখ। এই ঘোলা জল একবার থিতু হলে আর কপাল ফিরবে না। অতএব এবার না হলে নেভার। একের পর এক উৎপাত আসতে থাকে, খুচরো। সব বিষয়ে কতো আর সাহায্য করতে পারে উজ্জৎ হাফেজরা। প্রাত্যহিক চলাফেরা ওঠাবসায় বাদ সাধতে শুরু করলো। অবিশ্বাসের আবহে দু চার জন ধুয়াধার জুটে গেলো "হিঁদুগো তো নিজের ভেন্ন দ্যাশ হইসে, চইল্যা গ্যালেই পারে"। এমন সাদামাটা কুযুক্তি সহজেই মনে ধরে। সমর্থকও জুটে যায় সহজে। প্রতিবেশি ভারতে কেউ কেউ যেমনটা বলে থাকে "মুসলমানদের তো আলাদা দেশ আছে পাকিস্তান। ওরা ওখানে গেলেই পারে"।
পরবর্তী ধাপে ঠাকুর বাড়ির পুকুরে মরা মুরগির পালক, দেহাবশেষ ফেলা, কাছাড়ির বারান্দা নোংরা অপবিত্র করা। ঠাকুর বাড়ির লক্ষ্মী পুজোয় লোক সমাগম একটু একটু কমতে থাকে। বৌঠানের কাছে দুপুরে খালের ওপারে মুসলমান নমশূদ্র পাড়ার মেয়েদের সেলাই শেখা গান শেখা চালু থাকলেও খালের এপারের কিছু সম্পন্ন স্বল্প ও মধ্যবিত্ত সংশ্রব এড়িয়ে থাকতে লাগলো। একটা পরোক্ষ সামাজিক চাপ।
ইউনিয়ন বোর্ড, স্কুলের কমিটি, কতো জমি জমা, পণ্যবাহী যাত্রীবাহী নৌকা, পোস্ট আপিস, আসামের শাল কাঠের ব্যবসা, এইসবের ওপর একচ্ছত্র অধিকারের স্বপ্ন শওকৎ আলীর চোখে নেশা ধরায়। বারংবার ডাকাতির হুমকি, ডাকাত ফেলা, প্রতিবেশীদের সাহায্য সহযোগিতা এইসব মাইজ্যা কত্তা ও তার পরিবারের মধ্যে আরও আশ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছে। শওকৎ তাই গ্রাম জুড়ে থাকা বটবৃক্ষকে ডালপালা শেকড় বাকড় ছেঁটে পঙ্গু করার পরিকল্পনা করে। এই কাজটায় সে কিঞ্চিৎ সফলও হয়। ধীরে ধীরে এই ভয়ের আবহে একসময়ে শৈলেশ রঞ্জন, বৌঠান দুজনেই সহমত হলো, "হ এইবার তাইলে ছাড়তেই হইবো জন্ম ভিটা। পরাণের ভয়ে দ্যাশ ত্যাগ সত্য হইলো শ্যাষম্যাস।"
১৯৬৬ সালে অবশেষে মোড়াকাঠি গ্রাম, উজিরপুর থানা, জেলা বরিশালকে স্থায়ী ভাবে বিদায় জানালো শৈলেশ রঞ্জন, বৌঠান, পলা আর নীলা। চলে যাবার দুদিন আগে থেকেই শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকে এলো। আবার অনেকে বিনা পয়সায় নিলামের প্রত্যাশায়। কেউ কাছাড়ি বাড়ির শৈলেশের আরাম কেদারাগুলো, কেউবা বৌঠানের তিন ভাঁজের বেলজিয়াম গ্লাসের ড্রেসিং টেবিল, কারো নজর এইচ এম ভি কোম্পানির গ্রামাফোন আর পাহাড় প্রমাণ সুদৃশ্য রেকর্ডের সম্ভারে। দলে দলে মানুষ এসেছে। এদের মধ্যে আবার কেউ এসেছে সত্যিই শোকার্ত আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করতে। শৈলেশের কোনো হুঁশ ছিলো না। সে যেন ভূত গ্রস্থ। তার এই বাড়ি পরিবেশ, পুকুর, খাল, সাঁকো, ফল সবজির বাগান, সুপারি শ্রেণী, মায় ডাকবাক্স, বলা ভালো সমগ্র গ্রাম তার আপনার। নিজের উদ্যোগে সকলের সাহায্যে গড়ে তোলা। সে সব ছেড়ে যেতে হবে। তাই কোনো কানা কড়ি আগলানোর চেষ্টা নেই। ফ্যাল ফ্যাল করে শূণ্য দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বৌঠান অকাতরে সব দান করলেও, দুটো হাতা খুন্তি, দু চারটে থালা গ্লাস, দুটো বিছানার চাদর গামছা, কলম পেন্সিল সাদা কাগজ যত্ন করে গুছিয়ে নেয়। শেষ অবধি, সংসার পাতা থেকে শুরু করে গুছিয়ে রাখা; আবার ভাঙা সংসারের মধ্যেই নতুন সংসারের স্বপ্ন এতো মা কাকিমার কাজ।
ওদিকে সকাল থেকে পলা আর নীলা বেচারা ছাড়া গরু। শাসন নিষেধ বারণের শেকল নেই। মায়ের আজ কোনো তাড়া ব্যস্ততা নেই। হাফেজ দের পাড়া থেকেই সকালের টিফিন দিয়ে গেলো। শৈলেশ মুখেও তুললো না। বৌঠান মেয়ে দুটোকে খাইয়ে দিয়ে নিজে একদলা পেটে দিলো। বৌঠান অনেক বেশি বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন। মেয়ে দুটো কি ঘটতে চলেছে না বুঝলেও কিছু ঘটতে চলেছে, সেটা বুঝতে পারে। মায়ের অনুসারে নিজেদের অতি প্রিয় কোরিয়ান ডল পুতুল বিলিয়ে দেয় তেলের ঘানি, ঢেঁকিশাল, গোয়ালের তদারক ঘাইন বুড়ার নাতনি, পোৎনার ছেলে, খেলার সঙ্গী লইটগ্যা এদের মধ্যে। বুঝতে পারে এগুলোর আর প্রয়োজন হবে না তার। সাঁকোর ওপর ঝুঁকে পরে দুই বোন মুড়ি আর বাবার মাছ ধরার সামগ্রী চার ছড়িয়ে দিচ্ছে খালের জলে। মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘাই মারছে, আর খাবার গিলছে। কিন্তুু অন্য দিনের মতো দু বোনের উল্লাস নেই।
অবশেষে যাত্রা হলো শুরু। রহমৎ এর নৌকো খাল ধরে এগিয়ে চলেছে। আর দুপাশে পাড় বাঁধের ওপর রাস্তা ধরে পুরুষ নারী শিশুদের দল এগিয়ে চলেছে। শৈলেশ রঞ্জন হাফেজকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। সারা দিনের বাঁধ এবার ভেঙে গেলো। নৌকার ওপর উপুড় হয়ে আর্তনাদ করে মাথা ঠুকতে থাকে। বৌঠানের দুচোখে বিরামহীন অশ্রু ধারা। আর পলা ও নীলা সমগ্র ঘটনার মাঝে হতচকিত হয়ে জল টলমল চোখে সব নিরীক্ষণ করতে থাকে। তারপর পাড় বাঁধের ওপর ভুলু কুকুরের কান্না শুনে এতক্ষণ পরে নীলা ভ্যাঁআআ করে কেঁদে ফেলে।
"ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই।" সেই বরাভয় কন্ঠ, সেই হাফেজ আলী উজ্জৎ আলী সপরিবারে সবাই এসেছে, খালের পাড় ধরে সবাই হাঁটছে। কিন্তু মাইজ্যা কর্তার হুঁশ নেই। খালের জলে স্রোতের টান ছিল না। তাই রহমত মিঞা ও তার ছেলে ধীরে ধীরে দাঁড় টানছিলো। গ্রামবাসীদের দলটাও সাথে সাথে চলছিল। যতই খালটা নদীর কাছাকাছি এগুতে থাকলো, স্রোতের টানে নৌকা এগুলো আর ভীড়টা পিছিয়ে পিছিয়ে মিলিয়ে যেতে লাগলো।
(৫)
সন ১৯৬৬ তে এসে শৈলেশের উঠবন্দী দশা। প্রথমে পানিহাটি সোদপুর, কিছুদিন চন্দননগর, হাওড়া, শিবপুর। শুধুই বাসাবদল। আসলে, যারা আগে এসেছে তারা এখন থিতু হয়ে প্রতিষ্ঠিত। শৈলেশের সপরিবার আগমন "কাবাব মে হাড্ডি"। সেটা বুঝতে পেরেই অবিরাম আশ্রয় বদল। বিলম্বে আগমনের ফলে দেশভাগের উদ্বাস্তু তকমাটা লাগে নি। বরং বাঙাল নয়, পাকিস্তানি বলেই লোকে ক্ষেপাতো। কোনো পুনর্বাসনের প্যাকেজ জোটে নি। বরিশালের একই গ্রামের, একই মতাদর্শের নিরঞ্জন সেনগুপ্ত ১৯৬৭ সালে ত্রান পুনর্বাসন মন্ত্রী হলেন। শৈলেশ রঞ্জন দেখা করেছিল। কোনো লাভ হয়নি। সরকারটাই তো মাত্র ছয় মাস টিকলো। ১৯৬৯ এ আবার সরকার, সেটার আয়ূও মাত্র নয় মাস। সরকারের আগে নিরঞ্জনদার নিজের আয়ূ ফুরালো। তিনি নিজেই প্রয়াত হন। সবই কপাল।
প্রবল আত্মসম্মানবোধ বৌঠানের। অপরের সংসারে সাময়িক আশ্রয় নেওয়ায় আপত্তি করেনি ঠিকই, কিন্তু সুদীর্ঘ সময় কারো গলগ্রহ হতে চায়নি। প্রধানতঃ তার চাপেই শৈলেশ মধ্যপ্রদে শের বয়লাডিলায় রেললাইন নির্মাণের ঠিকা কর্মী হিসেবে যাত্রা করে বৌ মেয়েদের নিয়ে। সেখানে বাঙালি ঠিকাদার ও তেলেগু ঠিকাদারের স্বার্থ সংঘাতে দাঙ্গা বাঁধলো। বাঙালি ঠিকাদার দত্ত বাবু আত্মহত্যা করলো। তারই ঠিকা কেরানি শৈলেশের কাঁচা ঘরে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উঠে এসে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে আগুন লাগালো। "ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই" বলার মতো কোনো উজ্জৎ আলী বা হাফেজ আলীর বরভয় এখানে কোথায়?
এরপর শৈলেশ রঞ্জন বেনারসের প্রাইভেট বাস সার্ভিসে কন্ডাকটরের কাজ করেছে। ঠিক সময়ে মাটির টান না ছাড়ার দাম চুকাতে হচ্ছে। যারা কানা কড়ি হারিয়েছে, লক্ষ টাকা হারানোর গল্প করে ইনিয়ে বিনিয়ে। শৈলেশের মুখেরা নেই। চোখ যেনো মজা পুকুর, শূণ্য দৃষ্টি। শুরুতে উজ্জৎ হাফেজ রা চিঠি পাঠাতো। শৈলেশ চিঠির দিকে তাকালেই চোখে জল ভরে আসতো। চিঠি ঝাপসা হয়ে যেতো। মেয়েরা পড়ে দিতো বাকি চিঠি। আর চিঠির উত্তর, সে আর এক পর্ব। শৈলেশ কলম নিয়ে বসেই কাঁদতে থাকতো। নীলা অবস্থা টের পেয়ে এগিয়ে এসে বাবার হাত থেকে কলমটা নিয়ে নিতো, "নাও তুমি বলো, আমি লিখছি"।
-"হ সোনা মা, লিখ অ। তোমাগোও কাআউরে ভুলি নাই।" একটু দম নেয় শৈলেশ, "গ্রাম আমার চোহেএ অহনওও ছবির মতোন ভাসে"।
এরপরই কান্নায় গলা জড়িয়ে যায়। আর পারে না। নীলা নিজের আবেগে সিক্ত করে বাকি চিঠি শেষ করে। শৈলেশের ভিটা হারানোর যন্ত্রনা বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। চুয়ান্ন ছাপ্পান্ন বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো। বাবার মৃত্যুর সংবাদ নীলা চিঠি লিখে হাফেজ কাকা, মমতাজ দিদিকে জানিয়ে ছিল। হাফেজ উত্তরে লিখেছিল, আমরা রাজনীতির চক্রান্তে বিভক্ত হলেও আমাদের আত্মা অখন্ড। আর তোমার বাবা মাইজ্যা কত্তাতো দেশত্যাগী নয়। তারে স্বার্থের লালসায় শওকৎ মিঞা দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। ভূগোল রাজনীতি আমাদের পৃথক করলেও, একবার ডাক পাঠালেই আমাদের পাশে পাবে। আবার সেই অভয় বাণী ও আশ্বাস।
বৌঠান ঘোর বাস্তববাদী। বিলম্বিত দেশত্যাগের মাশুল তাকেও কম দিতে হয়নি। কিন্তু প্রকাশ্য হা হুতাশ ছিল না। মনে হয় বৌঠানের মনে একটা চাপা অভিমান ছিলো। আর সবাই যখন নিজের নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করে দেশ ছাড়লো, এই মানুষটা দ্যাশ মাটি ভিটা নিয়ে আবেগের বশে বৌ মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলো না। যখন ছাড়লো, তখন উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের সব আশা শেষ। ফলতঃ সারা জীবন শৈলেশ নিজে, সঙ্গে তার পরিবারের চরম লাঞ্ছনা। কোনো স্থায়ী ঠিকানা গড়ে উঠলো না।
ভাবা যায়, ছোট মেয়ে নীলা উচ্ছেদ ও উদ্বাস্তু জীবনের কারনে স্কুলে ভর্তি হতে পারে নি। মায়ের কাছে অক্ষর পরিচয়। তারপর নিজে নিজেই পড়ে স্বশিক্ষিত। ক্লাশ সিক্সে প্রথম স্কুলিং। তবে দেরিতে শুরু হলেও গাড়িটা আর কখনো থামেনি। পলা নীলা দুজনেই এখন হাই স্কুলের শিক্ষিকা। বৌঠানের দুঃখ লাঞ্ছনার অবসান ঘটেছে। কিন্তু একটা ভয় আশঙ্কা পলা আর নীলাকে নতুন করে তাড়া করছে। কাগজ দেখাও। কবে এসেছো? ধর্মীয় অত্যাচারের শিকার তার কোনো প্রমাণ আছে? ধর্মীয় কারণে অত্যাচার তো হয়নি। শওকৎ মিয়া তো ইসলামের একমাত্র প্রতিনিধি নয়। পলা আর নীলার দুচোখে আশঙ্কা, আবার কি ঠাঁই নাড়া, বাস্তুচ্যুতি? তারপর? নীলা ভাবতে থাকে, বাবা বলতো, "সোনা মা, এই দ্যাশ আমাগো না। এহানে কেউ আপনজন নাই, এহানে ব্যাবাকটাই ভেন্ন।" আজ কাগজ দেখতে চায় খোদ সরকার। ওদেশের শওকৎ এর ভূমিকায় এদেশের সরকার। এখানে হাফেজ উজ্জৎ ঘাইন বুড়া রহমৎ মিঞার মতো সোচ্চারে বলার কেউ নেই-
"ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই।"
(৬)
ভয় আর আশঙ্কার মধ্যেই খবর আসে, পশ্চিম দিনাজপুরের ইসলামপুর থেকে। কালি মন্দিরের পুজো সেরে ঘরে ফিরে সকাল সকাল পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরোহিত সুকুমার চক্রবর্তী শোলা নিয়ে বসেছেন, ফুটিয়ে তুলেছেন নানাবিধ নকশা। মহররমের আগে শেষ করতে হবে তাজিয়া সাজানো। এলাকাযর আর এক বৃদ্ধ শিল্পী দুলাল শীলের কাছে সেই ছোটো বেলায় সুকুমার চক্রবর্তীর তাজিয়া সাজানোর হাতে খড়ি। কালি মন্দিরের পৌরহিত্য আর মহররমের তাজিয়া, ২৯ বছর ধরে চলছে এই সহাবস্থান। মহররম কমিটির মজহর আলিম, মসজিদের ইমাম গোলাম সাবির, স্থানীয় কাউন্সিলর সঙ্গীতা সাহা দাস সকলেই এই উদ্যোগে সামিল। এই খবর কি পলা আর নীলা কে একটু আশ্বস্ত করলো?
আঁধার যতই গাঢ় হোক না কেন, একটু সবুর করলেই আশপাশ একটু করে স্পষ্ট হতে থাকে। রামপুরহাট বাসিন্দা অভিজিৎ মজুমদারের পুত্র অর্ণবের উপনয়নে ভিক্ষা মা বাবা হলেন আবদুর রেকিব ও ওয়াহিদা রহমান। আরও উল্লেখযোগ্য বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে অর্ণবের নিজের মা ছিল গরহাজির। মানবিকতার এই খবর তো ভাইরাল হয় নি। সেটা করবে কে?
বারাসত ইছাপুর নব পল্লীর পার্থ সারথি বসুর কথাই বা কম কি, শুনুন। রাজস্থান থেকে পাথরের কারিগররা এসেছেন। তারা দেখছেন মসজিদের মিনার, প্রবেশ পথ, পীর বাবা আমানত আলী শাহের হুজুর ঘর ঘিরে কাঁচের দেওয়াল গড়ে ভক্তদের বসার বন্দোবস্ত, এই পরিকল্পনা সব রকম তদারকি করছেন ইমাম সদৃশ দাড়িওয়ালা যে মানুষটি, তার নাম পার্থসারথি বসু, তাদের ভাবনার অতীত। হ্যাঁ, বসু পরিবারের নববধূ মসজিদে প্রনাম করে শ্বশুরালয়ে প্রবেশ করে, এটাই রীতি। নবজাতক কে পায়েস খাওয়ান মসজিদের ইমাম, মৃত্যু হলে শবযাত্রায় হরিধ্বনি হয়, তবে যাত্রা শুরুর আগে আজান দেন ইমাম শাহ। পার্থবাবু কেন করেন এসব? ১৯৬৪-৬৫ সালে বারাসতের ওয়াজুদ মোল্লার সাথে ভূসম্পত্তি বদল করে খুলনার ফুলতলীর অলকা গ্রামের বসু পরিবার। ওদেশে রাজাকারদের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে এদেশে চলে আসেন, ওয়াজুদ মোল্লার সাথে ভূ সম্পত্তি বদল করে। লক্ষনীয়, এর ফলে তাদের মনে ইসলাম সম্পর্কে এতটুকুও ঘৃণা বিদ্বেষ জন্মায় নি। এমনকি, প্রাপ্ত ভূ সম্পত্তির মধ্যে জঙ্গলে চাপা পড়া একটি পুরানো মসজিদের অস্তিত্ব পান তারা। এরপর বসু পরিবার সেটি পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। বর্তমানে সেই মসজিদের আধুনিক সাজসজ্জা চলছে। অপরের বিশ্বাসের প্রতি এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন মানবতার অনন্য পাঠ। একে ভাইরাল করলে, তবেই তো নতুন আখ্যান জন্ম নেবে। ভয়ের বোধটা কাটবে। আস্থার ক্ষেত্র ও পরিসর প্রস্তুত হবে।
এবার মনে হচ্ছে উজ্জৎ আলী হাফেজ ভাই রহমত চাচার কন্ঠস্বর কাঁটা তারের বাধা ডিঙিয়ে এই বাঙলায় প্রতিধ্বনি তুলছে-
-ভয় নাই মাইজ্যা কত্তা, আমরা আইতাসি ই ই।
বাস্তবিকই ভয়টা কেটে যাচ্ছে, অন্ধকার ফিঁকে হচ্ছে।