[৯]
দেবেন রায় মৃত। কখন ও কিভাবে তিনি মারা গেলেন কেউ জানতে পারেনি। নিজের বাগানে ছোট কেদারাটার উপর তিনি ঠেস দিয়ে শুয়েছিলেন। চোখেমুখে যন্ত্রণাও ছিল না। কেবল একটু বোধহয় মুখটা কুঁচকিয়ে এসেছিল। ডাক্তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডেথ সার্টিফিকেটে লিখেছেন, 'আকস্মিক হৃদরোগ'। এতখানিও আকস্মিকতা প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু দেবেন রায় আর এই ধরাধামে নেই। তথ্য হিসেবে কেবল এইটুকুই। তার মৃত্যুতে কলকাতার কোনও বড় খবরের কাগজে, অথবা টেলিভিশনের কোনও রগরগে চ্যানেলের রঙচঙে পর্দাতেও কোনও অন্তর্তদন্তমূলক অনুষ্ঠান কখনও আয়োজিত হবে না। গুরুত্বহীন একেকজনের চলে যাওয়া ঠিক ততখানিই গুরুত্বহীন বলে মনে হয়। কুয়াশার ভিতর শালুক আর তিস্তা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল।
কুয়াশা ঘিরে আসছে। সন্দীপন যথারীতি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর বন্ধুর সঙ্গে তিস্তা বলে মেয়েটির এই নতুন ঘনিষ্ঠতার বিষয়টা ওকেও বেশ ছুঁয়ে গিয়েছে। ওর ভালো লাগছে। সন্দীপন বন্ধুমহলে কিঞ্চিৎ কাঠখোট্টা বলে পরিচিত। যদিও ওরও রুকস্যাক ঘাঁটলে পরে যে দু'এক কপি জয়, শক্তি বা সুনীল বেরিয়ে পড়তে পারে, এই খবর সকলের কাছে নেই। শালুক জানে সে কথা। সন্দীপন খুশি হয়েছে সে বুঝতে পারে। শালুক আর তিস্তা কথা বলছিল।
-"আমরা কিন্তু আপনার বন্ধুকে নেগলেক্ট করছি", তিস্তা বলে ওঠে।
-"মোটেও না, দেখুন গিয়ে সেও এখন মনে মনে কবিতার লাইন আউড়িয়ে চলেছে। কিন্তু আবার কখন থেকে মশাই আমরা আপনি-আপনি'তে ফিরে গেলাম?"
তিস্তা চোখ পাকায়, "বড্ড সাহস আপনার!"
-আর কথাই বলব না!"
-"হবে না বলতে!"
ওপাশে গভীর খাদ নেমে গিয়েছে। তিনজনেরই প্রথম দার্জিলিং। কুয়াশা বেড়ে উঠছে খুব। এমন সময় শালুকের ফোন বেজে ওঠে।
-"হ্যালো বাবা! বলো, কি খবর?" শালুক ফোনটা নেয়। ওপাশ থেকে শালুকের বাবা কি বলছেন ঠিক শোনা যায় না। সন্দীপন এদিকটায় চলে আসে। ফোন রেখে দেয় শালুক।
-"বাবাও আসছেন, আগামীকাল।" শালুক অবাক গলায় বলে ওঠে, "আর কত সারপ্রাইজ ভাই এই ট্রিপে?" ফিক করে সে হেসে ফেলে।
সন্দীপন হাসে। "ব্যস তাহলে তো তিস্তাদেবীর সঙ্গে আলাপটা এই গ্লেনারিজেই," শালুক ঘুষি পাকায় এবার।
_"খুব কথা ফুটেছে না তোর?"
-"চল চল, অনেক তো আলাপ-কবিতা হলো। এবারে একটু পা চালিয়ে চল, সামনেই একটা ছোট কাফে কাম বেকারি মতো রয়েছে। এক ভদ্রমহিলা চালান। সোফিয়া'স কর্নার না কি যেন নাম। সেখানে বসে একটু কফি আর কেক দিয়ে গা গরম করি চল।" সন্দীপন বলে ওঠে।
-"তুই এত সব জানলি কোত্থেকে আবার!" শালুক বলে ওঠে।
-"ইনস্টাগ্রাম, মাই ডিয়ার ওয়াটসন, ইন্সটাগ্রাম ইজ গ্লোবাল ইনফো-গ্রাম নাওয়েডেজ! আসার আগে দেখলাম এক বন্ধু এই কাফের পেজটা শেয়ার করেছে। সেই থেকেই মাথায় নোট করে রেখেছিলাম।" তিন বন্ধুতে পা চালায়। পাহাড়ের উপর অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে।
[১০]
অদ্ভুৎ সুন্দর জায়গাটা। খাস দার্জিলিংয়ের ভিড়েও যে এখনও এমন একেকটা ছোট ছোট লুকনো জায়গার হদিস পাওয়া যায় কারোর ধারণা হবে না। ছোট্ট একচিলতে ঘর। ভিতরে হাতেগোণা দু’তিনটি টেবল। সঙ্গে তিনটে বা চারটে করে চেয়ার। বাইরে কাঠের বেড়ার ধারে, খোলা আকাশের তলায় ছাতা-সমেত দুখানি গোল টেবল। সেগুলিকে ঘিরে চারখানি করে চেয়ার। কুয়াশা নামলে এই চেয়ার-টেবলগুলির উপর দিয়েই বয়ে গিয়ে নীচের খাদে নেমে যায়। মোটামুটি বর্ণনায় এই হচ্ছে ‘সোফিয়াজ কিচেন’। নামটা বলতে ভুল করেছিল সন্দীপন। ওরা বাইরের একটা টেবলেই বসল সকলে। গরম গরম মোমো আর চায়ের অর্ডার দেওয়া হলো। হালকা চাদরের মতো কুয়াশা নেমে আসছিল।
আগের রাত্তিরেও অনলাইন হননি অরুণ। শাল্মলী বুঝতে পারছিলেন। আজও দুপুর গড়িয়ে যায়। অরুণজ্যোতির নামের পাশে সবুজ আলোটিকে জ্বলতে দেখা যায় না। অভ্যুদয় অফিস থেকে বেরুচ্ছিলেন তখন। শাল্মলী ফোন করেন। দুজনে কথা বলেন। সেই অনেক দিন আগেকার দুজনের মতো। সেদিনও বিকেল ছিল এমন। সেদিন সন্ধ্যে নামতে শুরু করেছিল। অদ্ভুৎ একটা রাত। শাল্মলী কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকান। পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে। পুনা শহরের এই পাহাড়ি চরিত্রটাই তাঁর সবচেয়ে ভালো লাগে। কলকাতা ছেড়ে আসতে এতটুকুও অসুবিধে হয়নি তাঁর। অভ্যুদয় তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তারপর নিজেও বুঝতে পারেন, এভাবে হওয়ার নয়। তিন দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এতদিন পরেও! হু হু করে হাওয়া দিয়ে ওঠে।
সোফিয়ার রান্নাঘরে তখন তিস্তার গলায় সুর। রবীন্দ্রনাথের গান। আকাশ বাতাস জুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর। শব্দগুলো কানে লেগে থাকছে। শালুক শুনছে, “সেই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়, বাজায় বাঁশি, ভালোবাসি!” সন্দীপন ভালো করে গলায় মাফলারটা জড়িয়ে নেয়। দূর দূরান্ত অবধি চলে গিয়েছে রঙ পালটানো পাহাড়। অদ্ভুৎ একেকটা স্কাইলাইন। কাল দুপুরেই অনেক রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। অনেকগুলো প্রাণ এসে মিলবে অনেককালের চেনা কোনও বৃত্ততেই। এরা কেউ সেই খবর জানে না। কেবল পরদিন যখন, শালুক আর তিস্তা, গাড়ি থেকে তিনজন মানুষকে নেমে আসতে দেখবে, তখনও অবধি তারা বুঝে উঠতে পারবে না সভ্যতার ইতিহাস কেমন অবাক করে দেয়। কেমন বিচিত্র সব বাঁক আর গিরিপথেই তার চলন। সবকিছুকে মিলিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।