অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
[১১]
সম্পর্ক, ভালোবাসা, অভিমান, নিজের নিজের গতিপথ ধরে এগোয়। অথচ তারই ঘূর্ণিপাকে ঘুলিয়ে ওঠে জীবন। কিন্তু, সেই ভালোবাসাগুলোয় যদি খাদ না থাকে, প্রত্যাখ্যান না থাকে, ভান না থাকে, সুতোগুলো জড়িয়ে যেতে যেতেও একেকটা নকশারই জন্ম দিয়ে যায়। নানা রঙের আবছায়া অবশেষ। জটিল প্যাঁচপয়জারের অঙ্ক, শহর কলকাতায়।
‘১৯৯২’
আজকাল কাউকে ‘তিরিশ বছর আগেকার কথা’, এমনটা বললেই আর ১৯৭০ ভেবে নেওয়া চলে না। তিরিশ বছর আগে মানে ১৯৯০ সাল। নব্বইয়ের দশক। তখন কলকাতা ছিল অনেকটাই রঙিন, কিন্তু এতখানিও গ্ল্যামারের জৌলুসে তাকে পুড়তে দেখেনি কেউ। সে ছিল ম্যাট ফিনিশের স্নিগ্ধতা। হলুদ-কালো ট্যাক্সি, টকটকে লাল শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার আমেজ, ময়দানি ট্রাম, হাত ধরাধরি, একরঙা, দোরঙা, তিনরঙা ছবির পোস্টার, কুছ কুছ হোতা হ্যায় আর সুমনের কণ্ঠে ‘তোমাকে চাই’, ঊষা উত্থুপের কালো টিপ, আর বইমেলা মানে তখনও বেনফিস কেবল। মাটির ভাঁড় তখনও ইনস্টাগ্রামে পোস্টানোর সামগ্রী হয়ে ওঠেনি। ফেসবুক, ট্যুইটার, স্মার্টফোন – সবকিছুই যেন দূর কোনও এলিয়েন পৃথিবীর বাসিন্দা সেই সময়। ছিল তখনও ল্যাণ্ডলাইন ফোন, এসটিডি বুথের প্রেম। আনন্দমেলা আর সানন্দার জগত। অপর্ণা সেন তখনও নায়িকা-জীবনের মধ্যগগনে, সৌমিত্র তখনও রাজা লিয়রের কিংবদন্তী হয়ে ওঠেননি। মাধবী-সৌমিত্র জুটিকে তখনও কলকাতার মঞ্চে অভিনয় করতে দেখা যায়। কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয় এসব।
ঠিক সেই সময়েই মধ্য কলকাতার রাসেল স্ট্রিট চত্বরে গুডউইল এ্যাণ্ড হ্যানসেনের কোম্পানিতে এ্যাকাউন্টস বিভাগের আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে চাকরিতে ছিলেন দেবেন রায়। পদোন্নতি হতে হতে ততদিনে তিনি লোয়ার ডিভিশন থেকে এক ধাপ উঠে পার্মানেন্ট হয়ে গিয়েছেন। অফিসে অল্পবিস্তর দাপট হয়েছে তাঁর। মার্কেটিং ডিভিশনে পার্মানেন্ট হিসেবেই ছিলেন শাল্মলী স্যান্যাল। অস্থায়ী এ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে দুজনকে এ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। অরুণজ্যোতি মিত্র এবং অভ্যুদয় সেন। এই দুজনেরই চাকরি ছিল পাকাপোক্ত রকমে চুক্তিভিত্তিক। অর্থাৎ কিনা সেদিনের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনোই নিশ্চয়তা নেই। তবুও চাকরিরা চলেছিল চাকরির মতো করেই।
শাল্মলী অরুণকে ভালোবাসতেন। অরুণের রক্তে ঠিক ভালোবাসা ছিল না। একটা বুনোরকমের বহির্মুখীতায় তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন। দায়িত্ব শব্দটাই অভিধানে ছিল না তাঁর। ভালোবাসতেন তিনি। নিশ্চয়ই ভালোবাসতেন। কিন্তু বিয়ে, সংসার, ভবিষ্যৎ - এসব নিয়ে তিনি ভাবতে চাইতেন না একেবারেই। তার উপরে চাকরির নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় উড়নচণ্ডীপনাই সই। অথচ এটা ভাবলে ভুল হবে যে অভ্যুদয়ের এই নাটকে কোনও চরিত্র ছিল না। কাছেপিঠে বয়স হওয়ায় অরুণ, অভ্যুদয় আর শাল্মলী তিনজনেই তিনজনের কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। অভ্যুদয় সেদিক থেকে দেখতে গেলে চাপা স্বভাবের। গোছানো। বাবার বয়স হয়েছে। মনে মনে শাল্মলীকে সে শ্রদ্ধা করত। অবাক চোখে দেখত, কিন্তু বলতে পারত না কিছুই। নব্বই দশকে এমন বন্ধুত্ব অনেক গজিয়ে উঠত। সেগুলোতে মিষ্টতা থাকত। সিনেমা হলে তখন মুক্তি পেত অপর্ণা সেনের নতুন কোনও সিনেমা। তিনজনে মিলেই দেখতে যেত সেসব। অরুণ দরাজ গলায় গান গাইত। শাল্মলী ওকে একটা ছবি এঁকে দিয়েছিল। ল্যাণ্ডস্কেপ। শাল্মলীকে অরুণ ‘ময়ূরাক্ষী’ নাম দিয়েছিল। শাল্মলী ওকে ডাকত ‘খোয়াই’। ছবির নীচে শাল্মলী সেই 'ময়ূরাক্ষী' নামেই সই করেছিল। ময়দানে খোলা আকাশের তলায় কতদিন অবধি শাল্মলী, অরুণ, অভ্যুদয় চিনেবাদাম খেয়ে কাটিয়েছে। ধুলো উড়ত খুব। ঘোড়সওয়ার পুলিশেরা খুব কাছ দিয়ে চলে যেত। বাঁশের মাথায় ঘণ্টি-লাগানো ক্যাণ্ডিফ্লস। অভ্যুদয়কে অনেক গুঁতিয়ে-গাঁতিয়ে আবৃত্তি করানো হতো। শাল্মলী পরে সেই একেকটা দিনের ছবি এঁকে রাখত। আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসার এমন অনায়াস চলনেই তাদের বন্ধুত্ব এগিয়েছিল। যতদিন না অবধি দেবেন রায়ের মতিভ্রম ঘটে।
ক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করলেও দেবেনের মাথা ছিল পরিষ্কার। ঝকঝকে বুদ্ধিতে তিনি অনেককেই টেক্কা দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে পড়াশোনা বেশিদূর না হওয়ায় এই কেরাণীর চাকরিতে ঢোকা। অল্পস্বল্প সরিয়ে রাখতে শেখা। কিন্তু এমনি করতে করতেই অঙ্কটা বেড়ে উঠল। অরুণ, অভ্যুদয় দুজনেরই সেটা নজরে আসতে শুরু করল। কিন্তু প্রথমেই বড়সাহেবকে গিয়ে কিছু না বলে দেবেনকে সাবধান করতে যাওয়াটাই কাল হলো ওদের। দেবেনের রগচটা মেজাজ আর অফিসে চাপা দাপট, এই দুইয়ের খবর ওদের কাছে ছিল না। উলটে দেবেনই শুরু করলেন বড়সাহেবের কাছে গিয়ে দুজনের নামে লাগানো। তাতেও ততটা কাজ হচ্ছিল না দেখে মোক্ষম চাল খেললেন তিনি। সেপ্টেম্বর মাস, ১৯৯৪ – বিশাল অঙ্কের টাকা তছরুপ হল কোম্পানিতে। অক্টোবরের ত্রৈমাসিক অডিটে ধরা পড়ল সেই দুর্নীতি। কাগজে পাওয়া গেল অভ্যুদয়ের নাম। অরুণ দেরী করেনি। বড়সাহেবকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করা হল। কিন্তু দেবেনের আবার বোর্ডের এক-আধজনের সঙ্গেও দালালির সম্পর্ক ছিল। বড়সাহেব জানিয়ে দিলেন, কোপ আসবেই যে কোনও একজনের উপর। অরুণ ...
অরুণকে কেউ কোনওদিন বুঝে উঠতে পারেনি। মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয়ের কথাই সে শুনেছে বেশি। কখনও বা তাকে মনে হয় জাত উড়নচণ্ডী, কখনও বা মতিভ্রষ্ট। কাউকে ভালোবাসতেও সে যে সত্যিই চায় কি চায় না, তাও সঠিক করে ঠাহর করে ওঠা যায় না। শাল্মলী রেগে গিয়েছিল খুব। বড় ছোট মনে হয়েছিল নিজেকে তার। এখনও হয়। অভ্যুদয় শাল্মলীকে সত্যিই ভালোবাসত। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। কিন্তু অরুণও তো তার জন্য অপেক্ষা করতে পারত। একটা নিশ্চিন্ত চাকরি খুঁজে নিতেও, বছর দুয়েকের বেশি তো সময় লাগেনি তার। অথচ সময় পাশে থাকেনি শাল্মলীর। অভ্যুদয়ের চাকরি পাকা হলো। অরুণ বরখাস্ত না হলেও, চাকরিতে ইস্তফা দিতে হলো তাকে। শাল্মলীর বাবা হঠাৎ মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। অভ্যুদয়কে দেখে শাল্মলী শান্তি পেত। কিন্তু অরুণ, আগুনের শিখার মতো সেই ছেলেটি। শেষের কবিতার অমিত রায়ের মতোই হঠাৎ সেও কি বিশ্বাসঘাতকতা করল? সময়টা বড় ঘেঁটে গিয়েছিল সেই সময়। অরুণ কেমন রাগী হয়ে উঠেছিল। আবার দুরন্ত প্রতাপের সঙ্গেও সে শাল্মলীকে ঘিরে রাখত কেমন। একেকটা কোম্পানির দুর্নীতি, অদ্ভুৎ - একেকটা মানুষের জীবন, একাধিক মানুষের জীবনকেও কত ভিন্ন ধারাতেই না বইয়ে দিতে পারে!
অরুণ পরে বিয়ে করেছিল।
বিয়ে করেছিলেন শাল্মলী-অভ্যুদয়। চাকরি নিয়ে অভ্যুদয় পুনাতে চলে এসেছিলেন। ওঁর বাবার সেই শহরে কিছু পরিচিতি ছিল সেই সময়। অরুণের উপর একটা প্রবল রাগ রয়ে গিয়েছিল শাল্মলীর। ঘটনার আকস্মিকতায় এতকিছুও যে ঘটে যেতে পারে। তারপর অরুণ ... সন্তান হয় তাঁর। অরুণের স্ত্রী বেশি দিন বাঁচেননি। কি একটা যেন দুরারোগ্য অসুখ ছিল। শাল্মলী জিজ্ঞেস করতে পারেননি কোনও দিন। সম্পর্কেরা এভাবেই ভেঙে যায়, টিকে থাকে আবার। ভিতরে ভিতরে শিকড় ছড়িয়ে যায়। একে অপরকে আঁকড়িয়ে থাকে বোধহয়। অভ্যুদয়কেই প্রথম দেবেনকে খুনের পরিকল্পনার কথা জানান অরুণ। শাল্মলী বারণ করেছিলেন অনেক বার। কিন্তু অরুণের আরও একটি অনুরোধ ছিল। আশ্চর্য এক অনুরোধ ছিল তাঁর। শাল্মলী, সেদিন অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। অভ্যুদয় তাঁর হাতের উপরে রেখেছিলেন হাত।
কলকাতায় সেদিন বৃষ্টি খুব। অরুণের মোবাইলে সেই রাত্তিরে একটানা বেজে চলেছিল, ঝড়ের রাতে দুয়ার ভাঙার গান। অরুণ সেদিন বাড়িতে একলা ছিলেন। অরুণের সেদিন খুব একলা লাগছিল।
[১২]
কাল্পনিক এই জায়গাটার নাম দেওয়া যাক বরং মেরিনার্স পয়েন্ট। সোফিয়াজ কিচেন থেকে একটুখানি উপরে উঠে এলেই একটা ছোট্ট খাঁজ মতো যেন বেরিয়ে রয়েছে পাকদণ্ডী থেকে। পিছনে খাড়া পাহাড়। সামনে সটান খাদ নেমে গিয়েছে, আর তারও সামনেটায় - দূরে, অনেক দূর অবধি চলে গিয়েছে সারি সারি পাহাড়ের সিল্যুয়েট। বিভিন্ন রঙের স্তর। মধ্যভাগে অপার মহিমান্বিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই রাত ছিল পূর্ণিমার। শালুক অথবা তিস্তার কাছে তখনও অবধি সবটা পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি। খাঁজটার উপর, সন্ধেরাতের আবছায়াকে গায়ে মাখতে মাখতে দাঁড়িয়েছিলেন ওরা ছয়জন। মনের দিক থেকে, ছয়জন কাছাকাছি মানুষ। শাল্মলী, অভ্যুদয়, অরুণ; তিস্তা, শালুক আর সন্দীপন। দেবেন রায়কে কিভাবে যে তিনি ইনসুলিন ইঞ্জেকশনের বদলে বাতাস ভরা সিরিঞ্জ পুশ করে চিরঘুমে ঘুম পাড়িয়ে এসেছেন, শালুকদের কাছে আর তা বিস্তারিত করে বলেননি অরুণ। তিস্তাও কেমন অবাক হয়ে গিয়েছে। অচেনা বন্ধু থেকে হঠাৎ প্রজন্ম আগেকার সম্পর্কের কথাও এভাবে যে সামনে চলে আসবে, ভাবতে পারেনি কেউ। শালুক প্রথমটায় কেঁদে ফেলেছিল। কি দরকার ছিল এভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার? অরুণজ্যোতি উত্তর দিতে পারেননি। শাল্মলী, অভ্যুদয় চুপ করে ছিলেন। শালুক আর তিস্তা পরস্পরের দিকে তাকায়। অরুণ মুখ ফুটে বলেছিলেন, “আমরা কেবল চেয়েছিলাম, আমাদের পরবর্তী মানুষেরা যেন এভাবেই মিলে যায়। মিলে যেতে পারে।” সেই থেকেই তিস্তা, শালুকের এক বাসে আসার বন্দোবস্ত করা। যদিও আন্দোলনের মিছিলে ওভাবে যে ওদের আগে থাকতেই আলাপ হয়ে যাবে বড়রা কেউই সেটা ভেবে উঠতে পারেননি। অরুণ-শাল্মলীরা শুধু চেয়েছিলেন ওদের দুই ছেলেমেয়েতে যেন একবার অন্তত কাছাকাছি আসুক। কোনও ভাবে কিছুক্ষণ অন্তত কাছাকাছি থাকুক। জন্ম থেকেই দুজনে মিশুকে, আমুদে, খোশমেজাজি হয়ে বেড়ে উঠেছে। কাছাকাছি এলে যদি বা আলাপ হয়। যদি বা বন্ধুত্ব হয়েও যায়। অথবা নিছক পরিচিতিটুকুই। অদ্ভুৎ ভাবে ফাটকা খেলতে চেয়েছিলেন ওঁরা তিনজনেই। আর অরুণ চেয়েছিলেন প্রতিশোধ। এক অদ্ভুৎ প্রতিশোধের আগুন তাঁকে কুরে কুরে খেতে চেয়েছিল। আজ এমন নিখুঁত ভাবে সবটা মিটে গেলেও অরুণের পথ শেষ হয়নি। কেন জানি না বিশেষ রকমে অরুণের বিশ্বাস ছিল, শালুক আর তিস্তার মধ্যে মিলমিশটা হবেই। একে কি ভবিতব্য বলা উচিত, নাকি ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ইঙ্গিত, জানা নেই। কিন্তু শাল্মলী আর অভ্যুদয়কে অরুণ জোর দিয়ে বলেছিলেন, শালুক আর তিস্তার মধ্যে দেখা হলেই, দুজনের বন্ধুত্ব হতে বাধ্য। এর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা ছিল না। সবকিছুরই কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা থাকেও না সবসময়। আজ সবকিছুই মিলে গিয়েছে। কিন্তু অরুণের ভবিষ্যৎ?
আপাতত নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। শাল্মলী নীচু স্বরে গান করেন। খুবই নীচু স্বরের গান। সেই ভালোবাসার গান। দিগন্তপারে চেয়ে থাকার গান। চোখের জলে ভেসে যাওয়ার গান।
অরুণকে যেতে হবে এবার। অরুণকে পুলিশ ধরতে পারবে না। অরুণ খুব নিখুঁত আয়োজনেই সমস্ত কাজ মিটিয়ে দিয়ে এসেছেন। কিন্তু সামাজিক জীবনে অরুণের আর জায়গা হবে না। নিজেকেই সেই শাস্তি দিয়েছেন অরুণ। এখানে আসতে আসতে আরও গভীর এক অনুশোচনা বোধ অরুণকে প্রভাবিত করেছে। সামাজিক জীবনে তিনি এমনিতেও আর ফিরতেন না। তবুও, এই অনুশোচনার অনুভূতি এমন ভাবে যে তাঁকেও প্রভাবিত করবে, তা তিনি আঁচ করতে পারেননি। চিরন্তন ভালোবাসার জিতে যাওয়ার এই সময়ে, একখানি এমন প্রবল হিংসার প্রকাশ। অরুণের ভুল হয়ে গিয়েছে। অরুণ সে কথা উপলব্ধি করেন।
শাল্মলী আর অভ্যুদয়, তিস্তাকে নিয়ে পুনায় ফিরে যাবেন। হয়তো বা আগামী বছরে কলকাতায় পড়তে আসবে সে। ততদিন অবধি কলকাতায় শালুকের সঙ্গে থাকবে সন্দীপন। শালুককে এবার একলাটিই বড় হতে হবে। অরুণ চলে যাবেন ভূটান সীমান্তে কোথাও। সেখানে তাঁর এক বন্ধু গরীব পাহাড়ি আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য অস্থায়ী স্কুল খুলে বসেছে। সেখানে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। লোকালয় থেকে অনেক দূরের সেই গ্রাম। সেখানেই আস্তানা পাতবেন অরুণ। শালুক বা অন্যেরা চাইলে কখনও সখনও দেখা করতে আসবে। শাল্মলীর গান শেষ হয়ে গিয়েছে।
অরুণ সকলের দিকে তাকান।
-“এবারে যে যেতে হবে আমায়।“
কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। দিগন্তে শায়িত বুদ্ধের স্কাইলাইন। জ্যোৎস্নায় আকাশ আলোকিত হয়ে রয়েছে। শালুক যেন বা হঠাৎ করেই অনেকটা বড় হয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। তিস্তা ওর হাতের উপরে হাত রেখেছে। সন্দীপন, শাল্মলী, অভ্যুদয়, নির্বাক সবাই। অরুণ হা হা করে হেসে উঠতে চেষ্টা করেন। অতটা দরাজ হয় না। অল্প ভাঙা ভাঙা গলায় তিনি বলে ওঠেন, “বলেছিলাম না, জীবনটাকে উজাড় করে নিয়ে বাঁচব। প্রতিটা পরিচ্ছেদ হবে একেকখানা করে উপন্যাস! ফুল সাইজ, বোর্ড বাঁধাইয়ের মতো!” শালুক কাঁদছে। শাল্মলী আর অভ্যুদয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরেন। একবার, শালুক ...
পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে যাচ্ছেন অরুণ। নীচের দিকে তাকিয়ে ওরা পাঁচজন। কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ ঝলমলিয়ে উঠেছে খুব। অরুণ গান গাইতে গাইতে নেমে যাচ্ছেন। শালুকেরা শুনতে পায়, রবিঠাকুরের সেই গান। বড় প্রিয় গান ছিল যা অরুণজ্যোতির। উদার কণ্ঠে তিনি গাইছিলেন,
“যেতে যেতে একলা পথে, নিভেছে মোর বাতি, ঝড় উঠেছে ওরে এবার – ঝড়কে পেলেম,” গলা মিলিয়ে যায়।
শালুক তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ। ওদের বয়স বাড়ছে।
পাহাড় বেয়ে তখন শীত নেমে আসতে থাকে। ওরা পাঁচজন নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল