সুমনা ঘোষ দস্তিদার
দিনবাজারে ঢোকার মুখে যে রাস্তা বাঁয়ে বেঁকেছে, সেই ঘিঞ্জি গলির ঠিক যেখানে এক ফালি রোদ্দুর এসে পড়ে, সেখানে বসে বছর তিরিশের কাজল চোখের শ্যামলা মেয়ে দিঘি। কাজ সেরে ফিরতি পথে বাজারে দোলনের কাছ থেকে ফুল আর মালা কিনতে দেখা মাত্রই দৌড়ে এসে হাত চেপে ধরে, "আবার আসবে কবে, আমার কাছে?" বলার সময় অকারণ শরীরে ঢেউ তোলে ও। চোখে একটা গভীর আবেদন ঘন হয়ে আসে।
"আসব রে, সময় পেলেই ঠিক চলে আসব। সেদিন রবি ঠাকুরের গান শোনাবি তো?" আবার বুকের আঁচল টেনে কিছুটা নামিয়ে নিল, কোমরের শাড়ির ভাঁজটা চেপে টানটান করে নিতে নিতে, লম্বা চুল হাতে পেঁচিয়ে খোঁপা বেঁধে নিল। সদ্য কেনা জুঁইয়ের মালাটা খোঁপায় জড়িয়ে দিতে গেলেই হাসির দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল ওর।
"মাইরি, তুমি কি রূপদাদা হলে নাকি গো?" "সে আবার কে? তোর প্রেমিক?"
"হাসালে মাক্কালি। পাড়ার মেয়ের আবার প্রেমিক! তবে তাকে মনে ধরেছে গো দিদি, ওই ছোঁড়াগুলোর মত হারামি নয় সে। সেবার ঘরে এলে বসিয়ে রাখল বিছানায়। আঁচল নামাতে গেলেই হাত চেপে ধরল। তবে সে চায়টা কী? আরও সাংঘাতিক কিছু? ভয়ে ঘামতে রইলাম। কপাল গড়িয়ে ঘাম বুক ছুঁলো। আমার বুকে পাথর ভাঙার আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট। সে আওয়াজ ধীরে ধীরে উঠে গলাকেও যেন আটকে দিল। আমার কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে দুহাতে মুছিয়ে বলেছিল, 'অনিচ্ছায় প্রতিদিন বহুবার কষ্ট পেতে হয় তোমায়, আজ নইলে আমিই নিলাম সে কষ্টটুকু।' এত্ত সংযম জানে সে শরীর? জুঁই ফুলের মালাটা চুলে গেঁথে, সারাদিনের পারিশ্রমিক রেখে ফিরেছিল সেই গভীর রাতে। যখন চাঁদের আলোয় শরীর ডুবিয়ে পিউ কাঁহা অবিরাম ডেকে চলেছে। কত জন আসে যায়, কিন্তু আর এল না সে। আশায় আশায় পথ চেয়ে থাকি রোজ। ওই পথেই হারিয়ে গেছে সে আমাদের মতো মেয়েরা, হারিয়েছে আমাদের প্রেম,আশারা। শুধু রোজ একটা প্রদীপ তার নামে জ্বালি গো দিদি। তার নামে জ্বালি।" ডাগর চোখে অযূত কালো মেঘ ভীড় করে এল।
হঠাৎ শক্ত পুরুষ হাতের টানে পড়ল। দাম দরাদরি চললো খানিকক্ষণ। তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল দিঘি, দরজার আগল উঠল। দিঘির জ্বালানো প্রদীপের শিখাটি হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল বারবার। নিভে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি আর। বুক নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল অজান্তেই, মনে মনে বলেছিলাম, দিঘির ভালো হোক।
