দোঁহা

এবং আগমনী কথা



প্রদীপ কুমার দে

আর মাত্র একমাস বাকী। প্রস্তুতির কোন খামতি নেই। সবদিক দিয়ে সেজে উঠছে এই শারদীয়  উৎসব…

ব্যানারে ব্যানারে ত্রিনয়নীর মুখ, কোনোটাতে একা আবার কোনোটায় পুত্র পুত্রীদের নিয়ে, তার প্রকাশ ঘঠেছে, কিন্তু দুপাশে অবশ্যই নেতা নেত্রীদের আশীর্বাদি হাত জোড় করা হাস্যোজ্জ্বল অবয়বে ভরা ছবিসহ হাজারো উপদেষ্টাবৃন্দের নাম সম্বলিত ফেস্টুনটিতে মায়ের আগমন বার্তা। এগুলি লটকে দেওয়া হয়েছে এই গোটা শহরের রাজপথ থেকে অলিগলিতে।

রাস্তায় রাস্তায় তার প্রস্তুতি,
নানান কথায় আর আওয়াজে সরগরম এই পুজো আসার খবর,
-আরে ন্যালা একটু তুলে ধর, তুলে ধর। বিলু ওদিকটা টেনে নে...
-হেভী হয়েছে পোস্টারটা দাদা…
এক তেল মারা বয়স্ক ভাই সম্পাদককে তেল মারার ধান্দায় ব্যস্ত।
আর এক মাতব্বর জুড়ে দেয় কীর্তন,
-রাস্তা জ্যাম হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি কর, কেন রাতের বেলায় করতে পারিসনি, তখন কি দু পেগ টেনে, হারকাটা লেনে গেছিলিস?

তার আরো অনেক আগে মিটিং সহ ইটিং হয়ে গেছে, সঙ্গে  নিদেনপক্ষে চা সিঙ্গারা তো ছিলই। বাজেট কষে, প্ল্যানে, প্ল্যানে ঘাম ঝরিয়ে, ঝরিয়ে একটা খসড়া খাড়া করে তা প্রচারের মাধমে সকলকে জানানোর মতো একটা বড় কাজ প্রায় সারা। তাও কিন্তু কম ঝামেলার নয়...
রবীনের রাগ,
-তোরা যদি প্ল্যান করেই রেখেছিলি তাহলে আমায় ডাকলি কেন?
আরো কয়েকজন কয়েক রকম কথায় কথায় ভরিয়ে দিল,
-আমার অতো সময় নেই, এই কাজটা অপুকে দে...

অপু রেগে লাল,
-হ্যাঁ রে অপু তো বেকার...
অন্যজনে,
-সব কটা ঢ্যামনা!
ইত্যাদি...প্রভৃতি...

চাঁদা দাও। ক্লাবের অর্ডার, ভালো ভাবে দিলে ভালো, না হলে আঙুল বেঁকিয়ে দাও দেখবে ঘি মানে মালকড়ি হুড়োহুড়ি করে ক্লাবের পকেটে ঢুকে পড়বে। পাড়ায় পাড়ায় এখন রিয়েল এস্টেট, এত বেশী যে গুনতে মেশিন লাগে। আর পুরো কাজের জন্য বিরাট তালিকাবদ্ধ কত পদ আর কত যে নাম তাদের…
-দাদা, একটু কমান,
-পারবো না, পারবো না,আমরা ছেড়ে দিচ্ছি আপনি পূজোটা করে দেখিয়ে দিন?

আর একজন,
-দুদিন পরে আসুন।
-হ্যাঁ, আর কি? আমাদের তো  আর কাজ নেই! এই নিয়েই থাকি! আপনাদের লজ্জা করে না?

-আমি চাঁদা দেব না, যা পারেন করে নিন।
-সামলাতে পারবেন তো?

রোজ রাতে হিসেব নিকেশ চলে, চায়ের ফেলে দেওয়া বাতিল কাপ থেকে রঙিন বোতল সব গলাধঃকরণ হতে হতে মধ্যরাত হয়ে যায়। বাড়িতে মা বউয়ের খিস্তি না খেলে তা হজম হয় না যে...
-লাথখোড় ঘরে এলেন! সকলের উদ্বারকর্তা আমার!

মোড়ের মাথায় হকার সারি সারি সুসজ্জিত হয়ে লাঠ খাচ্ছে, সন্ধ্যায় ভিড় উপচালে, পুজো, পুজো গন্ধে টাকার আনাগোনা এক পকেট থেকে অন্য পকেটে ঢুকে যায়, শেয়ার বাজারের সেনসেক্স এর মত নামা ওঠা করে।

খরিদ্দার নিয়ে টানাটানি,
-এটা ভালো করলি নি হারুন?
-চল চল, বেশি বকিস না, তুই একাই সব খাবি না?

হাবলা, কেলো, উজ্জ্বলদের মুখে আলো পড়ে আরো উজ্জ্বল হয়। ঠ্যালা রিকশা, অটো, টটোওলাদের দিনরাত এক হয়ে যায়। সওয়ারী নিয়ে ওরাও  মারামারি করে,
পল্টু তেড়ে আসে,
-তুই কি ভাবিস? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখবো? আর তুই খেলবি?
-আরে শুয়োরের বাচ্ছা আমি যে তোর আগেই অটো ঢুকিয়েছি?
-মেরে পিছু ভেঙ্গে দেবো উল্টা পাল্টা বললে তোর বাপ শালা শুয়ার।

-আরে দাদা রাস্তা ছাড়ুন! বাড়িতে গিয়ে মারামারি করুন গে...

ডেকোরেটারদের যত ছোটাছুটি বাড়ে, তা গিয়ে থামে কর্মকর্তাদের পায়ে। গতবারের বাকী আদায়ে পিছন হলুদ হয়ে যায়।
-এবারে কিছু ছাড়েন, একবছর তো হলো
-এইটা দেবে, আগে কাজ শুরু কর।
-আরে কাজতো করছিই
-হ্যাঁ  আগে তাই কর
-ওখান থেকে ভিখারিগুলো আগে ওঠান। চা বিড়ি আর তেলেভাজার দোকানগুলোকে সরতে বলুন...
-কিরে সেন্টু? এ ডেকারেটর কি বলছে শুনেছিস, ওখানে নাকি সবাই এখনো বসে আছে?
-দেখছি দাদা। উঠে যেতে বলেছিলাম, শালারা এখনো ওঠে নি?
-চল তো দেখি…

-এই যে তোরা কবে ছাড়বি জায়গা? মা কি আসবে না?
-বাবু আমাদের একটা জায়গা করে দ্যান সরে যাই।
-এতোদিন কে জায়গা করে দিয়েছিল রে? পুজোর দুদিন দোকান বন্ধ রাখ। এটা কি তোদের বাপেদের রেজেষ্টী করা দোকান নাকি রে?
-পুজোয় তাহলে বেকার হয়ে যাব?
-যাবি! তাতে কি হবে? এতদিন তো কামালি, এক পয়সাও তো দিসনি? বেশি কথা বলবি না এবারে দুই জনায় চাঁদাও দিবি বুঝলি? বেশি চালাকিগিরি, না?

চা, বিড়ি বেচা রতন আর তেলেভাজার কার্ত্তিক ভেবে পায় না মা কেন ফি বছর আসেন?
তাদের বউয়েরাতো প্রতিবছর অষ্টমীতে উপোস করে পুস্পাঞ্জলি দেয়। কিন্তু কি পায়?
কিন্তু প্রতিবছর দুকান তুলতে বসাতে যে অনেক খরচই হয়!

কুমোরদের হিসাব করে এগোতে হয় সারাবছরের খরচ। দূর্গা সাজে তাদের মেয়ে বউয়েরা সাজার জিনিস কিনবে বলেই। তাদের ছেলে মেয়েদের ভালো করে মানুষ করে তোলার আশায় প্রতি পূজোর আগে মন ভরে ওঠে মা লক্ষ্মীর আশায়!

ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী মহঃ কাদের সকলের খিস্তি খায়। নিজের হাত ভাঙা আর শরীর লিকলিকে তাই কয়েকটি শাগরেদ মানে হেল্পারের উপর নির্ভরশীল। বেশী বললে তারাই তেড়ে আসে। একটা বিচকে হেল্পার মিন্টু গালাগাল দেয়,
-তোর গুষ্টির পিছনে এই আলো জ্বালিয়ে  ছাড়বো, আমার পিছনে লাগলে। এয়্যিই বলে রাখলেম। পয়সা চাইলে পোঁদ ফেটে যায় না?
-আরে দাঁড়া না। ক্যাশিয়ার টাকা দিলেই তোদের কিছু কিছু দিয়ে দেব।
-এইটা দেবে? শালারা সব ভিখিরি মালখোর!
বলে বাজে ইঙ্গিত করলো মিন্টু।

সব চাইতে বাজে অবস্থা পুরোহিতের। থাকে মেদিনীপুর। গতবারের চুক্তির চার হাজারের মধ্যে দেড় হাজার পেয়েছে।
সব বাকী। বলছে এবারে দিয়ে দেবে। ফোন করে ডেকেছে। তাই এসেছে,
-দ্যান দিখিনি বাকী আড়াই হাজার।
-সে কি রে? এত বাকী আছে নাকি?
-উমাঃ ভুলে মারলেম দেখি।
-বাজে বকিস না, আমরা অতো টাকা কারোর বাকী রাখিই না। কেষ্টর হিসেবটা একবার মিলিয়ে দেখিস তো।

কে কেষ্ট? কোথায় কেষ্ট? হরে কেষ্ট? হাওয়া কেষ্ট!

আশ্বিন মাসে মা আসবেন। ভাদ্র মাসে গনশা এসেছিল ঠিকই কিন্তু কোন ব্যবসাই আসেনি এই রঙ্গ বঙ্গে! এখন আমরা এব্যাপারে শ্বেতপত্র দাবী করবো। অনশন, ট্রেন অবরোধ করে না হলে বনধ্
ডাকতেই হবে।

ভাদ্রমাসের টাক ফাটা রোদ্দুরে পুরোহিত ভোম্বল চাটুজ্জের চাঁদি ফেটে চৌচির। পাওনা টাকার আশা ছেড়ে গলদঘর্ম হয়ে ছুট লাগায় হাওড়া স্টেশন পানে। বাড়ি ফিরতে হবে যে...

মেদিনীপুর লোকাল ছুটে চলেছে। ভোম্বল পুরোহিত খালি পেটে জানালার ধারে বসে ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। তবে টনটনে জ্ঞানে, চোখ মেলে, এক এক বার দেখে নিচ্ছে বাইরেটা।

উলুবেড়িয়া পার হচ্ছে…
বাইরে কি সুন্দর প্রকৃতির প্রকাশ, কাশফুলের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে পদ্মের চাষ।
পদ্মচাষীরাও যে মায়ের আগমনের অপেক্ষায় কি কায়িক পরিশ্রমই না করে চলেছে...
মায়ের জন্যে…
অবশ্যই পেটের টানে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন