সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ মহা অষ্টমী।
সক্বাল সক্বাল স্নান সেরে পূজোর গন্ধ মাখা নতুন জামাটা পড়ে দে ছুট্ দুর্গা-দালানে! ধূপ-ধুনোর গন্ধে ম ম করছে চারিদিক। পুরুতমশাই এর মন্ত্র-পাঠ, হঠাৎ করে ঘন্টা নাড়ানো আর সাথে সাথে শঙ্খ-উলু আর ঢাক-কাঁসর এর যুগলবন্দী!
কি মজা! কি আনন্দ!
মনটা না জানি কেমনধারা পাগল পারা।
'কি সুন্দর ঠাকুর!'
অবাক চোখে দেখে ছেলেটা।
একচালের বাঁশ-খড়ের খিলোনটা শিল্পীর ছোঁয়ায় আজ ডাকের সাজের মৃন্ময়ী প্রতিমা। পিছনে আধো-চাঁদ চালচিত্রটাও পটুয়ার রঙ তুলিতে বড়ো বর্ণময়!
এত বার দেখেও আশ মেটে না। এ যেন মেলা থেকে কেনা যাদু-নল টার ভিতরে দেখা রঙীন নকশা। রকমারি, রঙবাহারি নতুন নতুন কারুকাজ। প্রতিফলনের টানা-পোড়েনে প্রতিবিম্বের বিচ্ছুরণ।
শুধু দাঁত-মুখ খেঁচানো অসুরটাকে বড়ো বেমানান লাগে তার। দুগ্গা মা'র ত্রিশূলের খোঁচা খেয়ে বুকের রক্ত ঝরিয়ে ঐ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কি দরকার বাপু! বুঝে পায় না সে।
হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেমন যেন চিনচিন্ করে ওঠে। মনে পড়ে যায় আর তো মাত্র দু'দিন। দুগ্গা মা এর সাথে মা ও যে চলে যাবে তার।
হ্যাঁ, জীবনটা একটু আলাদা ওর। মাকে পায়না মোটে। গাঁয়ে থাকে সে ঠাকুমার সাথে, আর মা থাকে বাবার কর্মস্থলে।
সারা বছর ধরে চিঠি লিখে নদীর বালিতে পূঁতে দেয় সে।'মা আমি তোমার কাছে যাব!' কিন্তু উত্তর আর আসে কই!
প্রত্যেক বার মা ফিরে যাবার সময় বলে,'যাবি রে?'
ভিতরটা ডুকরে ওঠে, 'হ্যাঁ মা যাব, যাব তোমার সাথে।' কিন্তু ঠাকুমা যে খুব কড়া! ভয়ে কাঁটা হয়ে দু'দিকে মাথা নাড়ে সে।
মা ই বা কি করে এত গুলো ছেলে-পিলে নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। আর ছেলেটাও যে বড়ো পেট-রোগা!
পুষ্পাঞ্জলি শেষে বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। সামনে দেখে মোটাসোটা পিসেমশাই চলেছেন হেলে-দুলে, দুলকি চালে। অদ্ভুত ভাবে হাঁটেন উনি, দেখলেই হাসি পায়। ওনা কে নকল করে পিছন পিছন চলতে শুরু করে সে।
–'ও পিসেমশাই দ্যাখেন দ্যাখেন!আপনাকে বক দ্যাখাচ্ছে!'
দেশে ঘরে কি আর শত্রুর অভাব আছে!
ব্যাস! আর যায় কোথায়!
চ্যাংদোলা করে বাড়িতে এনে হাজির করা হয় তাকে।
বনেদি বাড়ির ছেলে হয়ে বড়দের অসম্মান করা! জামাই এর চলা নকল করা!
দু'একটা চড়-থাপ্পড় কানমোলা আগেই পড়ে যায়।
–'কি রকম ঢ্যাঁটা ছেলে দ্যাখো! মুখে রা টি নেই। ক্ষমা চা! বল্ আর করবো না কোনো দিন!'
দু'চোখ ভরা জল নিয়ে মাথা নিচু করে পা এর বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁটতে থাকে সে।
বিচার চলতে থাকে, শেষ আর হয় না।
হঠাৎ বজ্রপাত হয় যেন!
–'পূজোর দিনে ছেলেটা কে কি না কাঁদালেই নয়! অনেকক্ষন ধরে দেখছি আমি!'
চকিতে মাথা তুলে ঝাপসা চোখে ছেলেটা দেখে মা দুগ্গা সামনে দাঁড়িয়ে!
–'সকাল থেকে কিছু পেটে নেই ছেলেটার, একটু মায়া-দয়া কি নেই তোমাদের?'
না না মা দুগ্গা নয়, অবিন্যস্ত ঘোমটা সামলে রনংদেহি মূর্তি তে দাঁড়িয়ে তারই গর্ভধারিণী!
আজ এ কোন রুপ মা'র! অবগুন্ঠনের অসহায় রুপই যে দেখে এসেছে সে।
সবকিছু একাকার হয়ে যায় যেন। মনে হয় একচালার ডাকের সাজের মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী রুপে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
আর অসুর গুলো–
হঠাৎ করে কেমন যেন থম্ মেরে যায়।
–'যা যা আর করিস নে' বলে যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
–'অনেক হয়েছে,আয় খেয়ে নে এবার', মা ডাকে।
ছেলেটা বুঝতে পারে মা দূর্গার আসে পাশে এই ভাবেই সব অসুর গুলো ঘুরে বেড়ায় আর তাদের কে ক্রমাগত বধ করে যেতে হয়।
দুর্গা প্রতিমার সাথে অসুর এর মূর্তিটা কে আর বেমানান লাগে না
তার।
