অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আলোর পাশাপাশিই যেখানে অন্ধকার। ক্রমশ যত দিন এগোচ্ছে, ধর্ম সম্পর্কে গদগদ ভাবটিও ক্রমেই কমে আসতে পারছে। এখানে অবশ্য ধর্ম বলতে আমি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে বোঝাই। যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানুষে মানুষে আরও বিভাজন নিশ্চিত করা। কালী বলতে শাক্ত, শিব বলতে শৈব, বিষ্ণু বলতে বৈষ্ণব – এভাবে দেখলে পরেও উপলব্ধি হয় এক ধর্মেরই ভিতর, কেমন করেই বা আরও-ধর্মের সূত্রপাত। বিভাজন থেকেই হয় আরও বিভাজনের সূত্রপাত। ধর্ম-সংস্কারের চেষ্টা অনেক হয়েছে। তর্কে-বিতর্কে, আলোচনায়, প্রত্যালোচনায়, অনেকবার করে, অনেক রকমে একেকটি ধর্মকে কল্যাণকর করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু শেষ অবধি যে অন্তিম মানবিক প্রবৃত্তির উপর যে কোনও ধর্মের ভিত্তি অবস্থান করে, তার নাম ‘আনুগত্য’। মার্জিত বচনে যাকে আমরা ‘বিশ্বাস’ বলে থাকি। ‘আনুগত্য’ কোনও বোধ, বিশ্বাস বা ধারণার ভিত্তি হয়ে থাকলে, সেই ধারণার বিষয়ে বিরুদ্ধ-সমালোচনার স্বতঃস্ফূর্ত অধিকার থাকে না। সেই না থাকা থেকেই ক্রমশ সেই বিশ্বাস জগদ্দল পাথরের মতোই নিশ্চল, অটুট, আগাছায় সমৃদ্ধ হয়ে নিশ্চুপে পড়ে থাকে। তৈরি হয় ধর্মের নামে কুসংস্কার। ধর্মের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যই কুসংস্কারের কারণ। আনুগত্যের উপরে দাঁড়িয়ে কোনও ধারণার বিবর্তন চলে না। তবুও আজ ‘কালী’র অক্ষরেই দু’কলম লেখার প্রস্তুতি। লেখকমাত্রেই বোধকরি এমন অর্বাচীন!
ধর্মের বিষয়ে জানিনা, অবিভক্ত বাংলার সময় থেকেই এদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমাজ ও লোকাচারের উপর কালী বা চণ্ডীর এক বিরাট প্রভাব আমরা অস্বীকার করতে পারি না। শক্তির উপাসনা বা শাক্ত-বিশ্বাস, বাংলা তথা বাঙালীকে বরাবর প্রলুব্ধ করেছে। শক্তি নিঃসন্দেহে এক নেশার বস্তু, ঘোরের বস্তু, বিবশ-অবশ হয়ে উন্মাদপারা হয়ে ওঠার বস্তু। আর সেকারণেই বোধকরি রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন, ‘নেশার দ্বারা কোনও মহৎ কাজ হয় না’। মানুষ নেশার পিছনে ছুটলে ভয় কাটিয়ে ওঠে। মনে মনে শক্তিমান হয়ে ওঠে। মদগর্বে বলীয়ান হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু যে কোনও গঠনমূলক কাজের ক্ষেত্রেই উচ্ছাসের চেয়ে মস্তিষ্কের স্থিরতার প্রয়োজন বেশী। হাঁকডাক করে ন্যায়প্রতিষ্ঠা চলে না। যে কারণে ডাকাতিয়া কালীদের উপাসক ডাকাতেরা ‘রবিনহুড’রূপে সাহিত্যে চিহ্নিত হলেও সামাজিক পরিসরে বিরাট কোনও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাতে পারেনি। যে কারণে বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো নিজস্ব জবানিতেই বাংলার প্রথমযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের আংশিক অসারতার কথা স্বীকার করে গেছেন।
পক্ষপাতহীন বিচার করলে প্রথমযুগের সেই বিপ্লবী আন্দোলনের পূর্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ ও অন্যান্য অনেক কৃষক-উপজাতি বিদ্রোহের আগুন অনেক সংগঠিত রূপে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল। ব্রিটিশ শাসকের তরফেও সেই সব আন্দোলনকে সামলাতে গিয়ে অনেক বেশী পরিমাণে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পক্ষান্তরে গীতা অথবা চণ্ডীর বাণীকে সম্বল করে মাতৃসাধনা ও দেশসাধনার দুইটি ভিন্ন ধারার ভিতরে কোনও ভিন্নতা খুঁজে না পেয়ে কিছু দুঃসাহসিক কাজকর্ম, বিপ্লবী আন্দোলনের বিশেষ কয়েকটি ধারার মাধ্যমে এই বাংলায় সাধিত হয়েছিল বটে, কিন্তু দেশব্যাপী কোনও বিরাট সামাজিক পরিবর্তন আসেনি। দেশমুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে আধ্যাত্মিক মুক্তি আন্দোলনকে গুলিয়ে ফেললে পরে তাতে দেশের কোনও কোনও বিরাট সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে যাওয়া হয়। অন্তত স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ করে যার প্রভাব দেখেছি। হিন্দু অর্থবান জমিদারদের তরফে চাপিয়ে দেওয়া ‘স্বদেশী’ আন্দোলন গরীব মুসলমান প্রজাদের উপর কিভাবে বোঝা হয়ে চেপে বসতে চেয়েছিল, ‘ঘরে বাইরে’র কালজয়ী আখ্যানে আমরা তার বিবরণ পেয়েছি। পরবর্তীতে ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের বিশ্লেষণেও আমরা এই সত্যকে উঠে আসতে দেখেছি। কাজেই ‘নেশার দ্বারা কোনও মহৎ কাজ হয় না’, রবীন্দ্রনাথের এই উচ্চারণ চিরকালীন।
তাহলে শক্তি উপাসনার বিষয়ে আমার সেই গুরুদেবের মনোভাব কেমন ছিল? কালী’র প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে মনে হল, বিশেষ এই বিষয়কে নিয়েই নাহয় খানিক তলিয়ে দেখলে পরে কেমন হয়? তল্লাশিতে উঠে এল বিশেষ তিনটি নাম। বিশেষ তিন রচনার উল্লেখ। জীবনদেবতার উপাসক রবীন্দ্রনাথ শক্তি-আরাধনার প্রতি সরাসরি যে কখনই আকৃষ্ট হননি সে কথা বলাই যায়। কিন্তু তাঁর সাহিত্য-কালের একেবারে সূচনালগ্ন থেকে, সচেতন ভাবে শক্তির বিপরীতে অহিংসা, মানবতা, ক্ষমা ও সহমর্মিতার দর্শনই তাঁকে বেশী আকৃষ্ট করেছে। তাঁর রচনা, ভাবনাতেই উঠে এসেছে তার প্রমাণ। ১৮৮১, ১৮৮৭ ও ১৮৯৯ সাল।
বাল্মীকি প্রতিভা (১৮৮১)
রাজর্ষি (১৮৮৭) ও
দেবী (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ১৮৯৯)
‘দেবী’ গল্পের রচয়িতা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। কিন্তু লেখকের জবানিতেই এই স্বীকৃতি উঠে এসেছে, কোনও এক ব্যক্তিগত আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কথাকোবিদ প্রভাতকুমারকে ‘দেবী’ গল্পের ভাবনা যুগিয়েছিলেন। যদিও ‘দেবী’, আজকের তিন আলোচ্য রচনার মধ্যে তৃতীয় বা অন্তিম আখ্যান। ‘দেবী’ প্রকাশেরও আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘রাজর্ষি’, লিখেছেন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র মতো এক কালজয়ী রচনা। আলাদা করে এই লেখাগুলির বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন বলে মনে করছি। তিনটি আখ্যানই যথেষ্ট জনপ্রিয় ও পরিচিত রচনা।
তিন রচনাতেই তিনরকম ভাবে উঠে আসতে পেরেছে, শক্তি-আরাধনার মধ্য দিয়ে কোনও গঠনমূলক লক্ষ্যে পৌঁছনো চলে না। তাতে উচ্ছ্বাস আছে, উদ্দীপনা আছে, রোমাঞ্চ আছে, কিন্তু ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যে আনন্দ – তা কখনই চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে না। জীবনদেবতা অথবা মানবদেবতারই অন্বেষণ শান্তির স্পর্শ দেয়। দস্যু রত্নাকর যখন লুঠ করে আনা সমস্ত সম্পত্তিকে তৃষ্ণার্ত শ্যামার চরণে নিঃশেষে ছড়িয়ে দেয়, শান্তি তবুও তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রেমরত দুই পক্ষীর আলাপেই তাঁর হৃদয়ের জোটে শীতলতা। উন্মেষ ঘটে বাল্মীকির। কবিতায় বিনাশিত হয় অন্ধকার। কে ভুলতে পারে ‘রাজর্ষি’র সেই নিষ্পাপ আর্তনাদ? যুগ যুগ ধরে বুঝি বা আমরা এখনও কেবল সেই প্রশ্নই করে চলেছি। “এত রক্ত কেন!” কেনই বা এই রক্তের আড়ম্বর? আমরা ভুলে গিয়েছি, “Violence begets violence”এর আপ্তবাক্যকে। স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং যখন ক্ষীরভবানীর মন্দির দর্শনে গিয়ে ইংরেজিতে Kali – The Mother কবিতাটি লেখেন, ডাল লেকের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে বিচ্ছুরিত হয় তাঁর বিস্ময় – কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সেই কবিতাটিরও অনুবাদ করতে গিয়ে, তার নামকরণ করেন ‘মৃত্যুরূপা মাতা’, অন্ধকার, মৃত্যু ও লয়প্রাপ্তির এক চিরন্তন বজ্রনির্ঘোষ। কিন্তু কিছুতেই এই অন্ধকার ও ধ্বংসের উৎসবের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারি না। হয়তো বা কেউ বলতেই পারেন, কালীকে আমি সম্পূর্ণ চিনে উঠতে পারিনি। *কালীকে আমি সম্পূর্ণ চিনে উঠতে পারি না।* কিন্তু গড়পড়তা মানুষ যখন এই হিংসা, রক্ত, প্রলয়, উন্মাদনার উচ্ছাসে মাতবেন – ভবিষ্যতের পাথেয় হিসেবে তাঁদের হাতে তাহলে ঠিক কোন বস্তুটি পড়ে থাকবে? ভবিষ্যৎ বলতে আমি পরকালের কথাও বলি না। যে দেবীর আরাধনার আয়োজনের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে অন্ধকার, শত্রুনিধন ও শক্তির উন্মত্তরূপ – চিরহিংসার প্রবৃত্তিতে নিয়োজিত মানবসভ্যতার কি এমনই একজন দেবতার প্রয়োজন এখন?
‘দেবী’র আখ্যানেও আমরা প্রত্যক্ষ করি শক্তি’র প্রতি অন্ধ আকর্ষণ একেকজন মানুষকে কোন অন্ধকার মরীচিকার দিকেই বা ঠেলে দিতে পারে। সেই মরীচিকার আকর্ষণ কতখানিও বা বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যার পরবর্তীতে পড়ে থাকে কেবলই দীর্ঘশ্বাস। অন্তঃশূন্য এক বেদনার্ত হৃদয়। হিংসা মানুষকে সাময়িক উত্তেজনা দিতে পারে। কোনও বিষয়ে তাঁর সাময়িক ভীতির মনোভাবকে কাটিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করতে গিয়ে ধ্বংসকেই সত্য বলে হৃদয়ঙ্গম করা, আরও বড় বিপদেরই বার্তা বহন করে আনে। *কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এ লেখা বিতর্কিত। এ লেখা প্রচারধর্মী। এ লেখা কালী’কে বুঝতে না পেরে লেখা। আমি কেবলই আবারও সেই প্রশ্নটিকেই সাজিয়ে দিতে চাইব। যে দেবীর আরাধনার আয়োজনের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে অন্ধকার, শত্রুনিধন ও শক্তির উন্মত্তরূপ – চিরহিংসার প্রবৃত্তিতে নিয়োজিত মানবসভ্যতার কি এমনই একজন দেবতার প্রয়োজন এখন?*
‘রাজর্ষি’র আখ্যানে আমরা দেখেছিলাম, কেমন ভাবে হিংসার অতুলনীয় আগ্রাসন রঘুপতির সাম্রাজ্যকেও ধ্বংস করেছিল। আমার চোখে মা কখনও রক্তপিপাসু হতে পারে না, শ্মশানচারী হতে পারে না, মা হয়ে উঠতে গেলে বিশ্বধাত্রী হয়ে ওঠা প্রয়োজন। চণ্ডী’র চণ্ডপ্রকাশের মাধ্যমে মানুষের মাতৃভাবনাকেই অনেক স্ববিরোধী প্রশ্নের মুখে গিয়ে পড়তে হয় বলে মনে করি।
“কালীর প্রতিমা রঘুপতি আসন হইতে টানিয়া তুলিয়া লইলেন। মন্দিরের দ্বারে দাঁড়াইয়া সবলে দূরে নিক্ষেপ করিলেন। অন্ধকারে পাষাণসোপানের উপর দিয়া পাষাণপ্রতিমা শব্দ করিয়া গড়াইতে গড়াইতে গোমতীর জলের মধ্যে পড়িয়া গেল। অজ্ঞানরাক্ষসী পাষাণ-আকৃতি ধারণ করিয়া এতদিন রক্তপান করিতেছিল, সে আজ গোমতীগর্ভের সহস্র পাষাণের মধ্যে অদৃশ্য হইল, কিন্তু মানবের কঠিন হৃদয়াসন কিছুতেই পরিত্যাগ করিল না।”
“নেশার দ্বারা কোনও মহৎ কাজ হয় না।” অমাবস্যার অন্ধকার-ভারাক্রান্ত সময়ে আজ চণ্ডিকার বিপরীতে কেন জানি না সেই জীবনদেবতাকেই স্মরণ করতে ইচ্ছে হয়। যে ঈশ্বরের প্রকাশ অনেক গতানুগতিক, অনেক নীচুতে – অনেকটা কাছাকাছি আমার,
সেখানেও যে রবীন্দ্রনাথেরই উচ্চারণ,
"তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
করছে চাষা চাষ –
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
খাটছে বারো মাস"
আমার মনে আমার দেবতা থাকুক সেই বারোমাসের আশ্রয় হয়েই। অহেতুক কোনও অমাবস্যার তাণ্ডবেই আগ্রহ নেই আমার।
- প্রথম পাতা
- বিষয়
- _গল্প
- _কবিতা
- _প্রবন্ধ
- _ভ্রমণ
- _ফটোফিচার
- _বাংলাদেশের কলম
- _ধারাবাহিক
- _ফিল্ম রিভিউ
- _পাঠ পরিক্রমা
- Editions and Archive
- _২৫শে বৈশাখ
- _বৈশাখী সংখ্যা
- _স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা
- _প্রাক শারদ সংখ্যা
- _ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সংখ্যা
- _শারদ সংখ্যা
- _মাহশা ইরান সংখ্যা
- _দীপাবলি সংখ্যা
- _ঋত্বিক ঘটক সংখ্যা
- _শক্তি চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা
- _শীতকালীন সংখ্যা
- _প্রথম বর্ষপূর্তি সংখ্যা
- _বইমেলা সংখ্যা
- _ভাষা দিবস সংখ্যা
- _দোলযাত্রা সংখ্যা
- _পয়লা বৈশাখ সংখ্যা
- _কার্টুন সংখ্যা
- _শারদ সংখ্যা ১৪৩০
- _বিশেষ সংখ্যা
- _রক্ত করবী সংখ্যা
- Contact Us
- Editorial Team
- About Us