সুমি দত্তগুপ্ত
পুজোর রেশ তখনও কাটেনি, ঠিক কালীপুজোর আগে, হঠাৎ ইচ্ছে হল, প্রতিবার শান্তিনিকেতনে পিসির বাড়ি যাই, কিন্তু যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়ে ওঠে না, মনের গভীরে থাকা কয়েকটি জায়গা, রাজনগর, মলুটি। মনে সংকল্প নিয়েই যাত্রা শুরু করলাম। চলেছি বোলপুর হয়ে দুমকার পথে। লীলা মজুমদারের হলদে পাখির পালকের মালিকানা হাতে এসেছিল, তখন আমার তৃতীয় শ্রেণী। সেই তো দূমকার সাথে পরিচয়। ঝগড়ু চিনিয়েছিল দুমকা কে। জেনেছিলাম, 'দুমকায়, ওদের গাঁয়ে হয় না, এমন আশ্চর্য জিনিস নাকি নেই।'
তারও অনেক পরে, কালকূটের কোথায় পাবো তারে উপন্যাসে দুমকার মলুটিতে সেই আশ্চর্য, অজানা ভুবনের আবিষ্কার।' সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয়' ঝগড়ুর এই বিশ্বাস আমার হৃদয়ে নোঙ্গর করে নিল। শুরু হলো, মলুটির সাথে আমার ঘর বসত।
অনেকদিনের চেষ্টা সফল হল, সেই কোন ভোরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে তে হাইওয়ে মির্চিতে, তড়িঘড়ি কিছু খেয়ে চলেছি মলুটির পথে। বোলপুর হয়ে সাঁইথিয়ার রাস্তায়। বোলপুর বাজার, সাঁইথিয়া বাজারে, কালী পুজোর বিকিকিনি চলছে। ঘনবসতি পূর্ণ, গঞ্জের বড় বাজার অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলেছে। ময়ূরাক্ষীর ওপরে পুরনো ব্রিজের মেরামতি চলছে, তাই নতুন ব্রিজের ওপর দিয়ে চলেছি। পথে শনিবারের বিরাট গরুর হাট, ট্রাকের ভিড়, বেচাকেনা চলছে। যানজট পেরিয়ে আমেদপুরের রাস্তায়, সড়কের পাশে পাশে চলেছে রেল লাইন। সবুজে, সবুজে মেশা নীল নীলিমায হারাতে হারাতে বাতাসপুর, গদাধরপুর, পুরন্দর পুর, মল্লারপুর, হস্তীকাদা হয়ে চলেছি মলুতির পথে।
সাঁওতাল পরগণার শিকারিপাড়া থানার অন্তর্গত মলুটি বাঙালি অধ্যুষিত হলেও, কয়েক ঘর ওঁরাও আছেন। তাদের বাড়ী, ঘরদোর নানা ছাঁদের, নানা আকারের | একচালা, দোচালা, খড়ে ছাওয়া মাটির দোতলা। চুমড়ে আর চন্দননালা নদী চলেছে গ্রামের দুপাশে, লাল, রুক্ষমাটির দেশ, দূরে টিলা। মন্দিরের গ্রাম মলুটিতে বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে 72 টি মন্দির, 108 টি মন্দিরের মধ্যে। যদিও হয়তো বা আবহবিকার, বায়ুক্ষয়ের কারণে মন্দিরের গায়ের টেরাকোটার কাজ অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত। বর্তমানে পুরাতত্ত্ব বিভাগ মন্দির সংরক্ষণের কাজে হাত দিয়েছেন।
মলুটি কে ঘিরে অনেক উপকথা, রূপকথাও। বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের এই ভূমের নাম ছিল মল্লহাটি, সেখান থেকেই মলুটি নামের উৎপত্তি, অনেকে মনে করেন, এই মল্লভূম ছোটোনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল, বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর নিয়েই গঠিত ছিল।
কারও বিশ্বাস, মহুল বন থেকেই মহুলটি এবং তারপরে লোকমুখে মলুটি।
শক্তি সাধনার তীর্থভূমি মলুটি। কালী এখানে বিভিন্ন রূপে পূজিত হন। মন্দিরের দেশ মলুটির আরেকনাম গুপ্তকাশী। তন্ত্রসাধনক্ষেত্র মলুটি তে বজ্রযান বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তন্ত্র সাধনা করতেন।
একথাও শোনা যায়, আদি শঙ্করাচার্য কাশী যাওয়ার পথে কিছুদিন এখানে অবস্থান করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের সর্বজনীন, ক্রমবর্দ্ধমান আবেদনকে হ্রাস করার জন্য এখান থেকেই হিন্দু পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু করেন।
সরকারী খাতায় মলুটি ছিল 15 শতকের আয়কর রাজ্য। গরীব ব্রাহ্মণ বসন্ত রায় গৌড়ের সুলতানের বেগমের হারিয়ে যাওয়া পোষা বাজপাখি খুঁজে দিয়ে এই গ্রাম উপহার পান। বসন্ত রায়ের নতুন নাম হয়, বাজ বসন্ত। কাশীর সুমেরু মঠের দন্ডি সন্ন্যাসী তাকে রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। এই বংশের রাজারা প্রাসাদ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন না, যতটা ছিলেন মন্দির তৈরী তে। তাই ক্রমেই মলুটি হয়ে উঠলো মন্দিরের দেশ। প্রতিটি মন্দিরের গায়ে, প্রাকারে টেরাকোটার অসাধারণ চিত্রশৈলী, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের গল্প গাথা অনবদ্যভাবে খোদিত।
মলুটির আকাশে বাতাসে রামপ্রসাদি সুর, ওই যেন বেজে ওঠে খ্যাপা গোবিনের গলায়, 'অই হে, আমি এই ভয়ে মুদি না আঁখি / নয়ন মুদিলে পাছে, তারা হারা হয়ে থাকি'।
নাচ, গান, সাপ খেলানো, কালীর জয়ধ্বনি আর দেবী মৌলীক্ষা এই নিয়েই মলুটি। কার্তিকের চতুর্দশী অমাবস্যায়, আর শীতে মৌলীক্ষা মন্দির প্রাঙ্গণে হয় দেবী পূজার আয়োজন, বসে মেলা, দুই রাজ্যের মানুষ এক হয়। কর্মসূত্রে ভিন দেশে থাকা মানুষ ফিরে আসে নিজভূমে, দূর দূরান্তের সাঁওতাল পল্লীর মানুষ চলে আসেন দেবীর থানে ও টানে।
কী এক রহস্যময়তা মৌলীখ্যার প্রান্তে, চলে অরূপের খেলা। কার্তিকের চতুর্দশী অমাবস্যায়, রায়বাড়ির অতিথি হয়ে কালকূট পেয়েছিলেন সেই অরূপ রতনের সন্ধান। জীবন সন্ধানী লেখক দেখেছিলেন, মন্দিরের গাত্রের নর-নারীর মত, সাঁওতাল নর-নারী,কালীপুজোর রাতে মৌলীখ্যার প্রান্তরে, গহীন আঁধারে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠে, সে এক পরম বিস্ময় ছিল লেখকের কাছে, তিনি দেখেছিলেন, এ যেন সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা ধরিত্রীর জন্য পুজ। সেই পুজোয় মন্দিরের গায়ে পুরানের নর-নারী, এবং সাধারণ রক্ত মাংসের নর-নারীদের প্রার্থনায় কোনও বিভেদ নেই। আজ কালের নিয়মে সবই ইতিহাস।
মলুটি আজ হেরিটেজ ভিলেজ। ডেভিড ম্যাককাচিয়ান বীরভূমের মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। কিন্তু এই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা, পরে শিক্ষক গোপালদাস মুখোপাধ্যায় মলুটির ইতিহাস সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। চন্দন নালার ধারে প্যালিওলিথিক যুগের অস্ত্র ও পাথর পাওয়া গিয়েছে, পাওয়া গিয়েছে অনেক পুরনো পুঁথি। একার চেষ্টায় সেগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন গোপালদাস মুখোপাধ্যায়।
গ্রামে মন্দিরের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছি বামদেবের মন্দিরের সামনে, সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে, শুনশান গ্রাম, প্রতিটি মন্দিরে শ্যামাপূজার প্রস্তুতি চলছে, পাড়ায় ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে, মেলা বসবে। বামদেবের মন্দিরের প্রতিমার কাঠামো তৈরী হয়েছে, মাটি লেপা হয়নি। চারিদিকে মন্দির, মন্দির-0ই বাড়ি, সবাই কালীর সেবক, মূর্তির কারিগর ও। মন্দির গুলো একেবারেই ভিন্ন ধাঁচের। মন্দির, মসজিদ, গির্জার গঠনশৈলী থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ নতুন অসাম্প্রদায়িক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। সব মন্দিরে শ্যামা মায়ের আরাধনা হয়, মহাদেব ও আরাধ্য দেবতা|
চায়ের দোকানে ছোট জটলা। এগিয়ে যাই গলা ভেজানোর জন্য। দোকানদারের সাথে খুশী, স্থানীয় মানুষজন। এগিয়ে আসেন, সাহায্য করেন মন্দিরের পথ নির্দেশে। রাজার কথা বলতে পারেন না, তবে বলেন, রাজপাট তো আছে, রাজা এখন সরকার। 9অনুযোগ করেন, কালীপুজোর দিন এলেন না কেন? উৎসব তো এখনও শুরু হয় নি, মূর্তি গড়া চলছে, চক্ষুদান না হলে বুঝবেন কি করে মায়ের মহিমা?
সেই আবার কোথায় পাবো তারে উপন্যাসের ক্ষ্যাপা গোবিনের কথা মনে আসে, গুনগুনিয়ে ওঠে মন, "ওহে কালী কুণ্ডলিনী, শম্ভূভাবিনী/ জাগ মা অন্তরে শ্যামা, জাগ হে অন্তরে।"
মলুটি বড়ই আটপৌরে, ছাপোষা জীবন। গ্রামের যে কজন চাকুরে, তারা শহরে থাকে, কিন্তু কালীপুজোয় বাড়িতে আসা একেবারে নিশ্চিত। শহরের আলোর রোশনাই নেই, আছে মানুষের আন্তরিকতা।
সবাই প্রহর গুণছে, মায়ের আগমনের। 'নেচে, নেচে আয় মা শ্যামা'। সারা বছরের প্রতীক্ষা, গরীব, নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রামবাসীর আটপৌরে জীবনে এই সময়টুকুই শুধু আঁধারে আলোর ক্ষণ। পূজোর পরে, আবার নেমে আসবে আঁধার, মলুটি ও হয়তো চলে যাবে বিস্মৃতির অন্তরালে।… কিন্তু ইতিহাস থেকে যাবে, মলুটি কথা বলবে, কৌতূহল জাগাবে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ভ্রামণিকদের কাছে।
তথ্য ঋণ:
কোথায় পাবো তারে - কালকূট
অনির্বাণ ভট্টাচার্যের মলুটি সংক্রান্ত লেখা
গোপাল দাস মুখোপাধ্যায়ের মলুটির ইতিহাস।