দোঁহা

নহি দেবী

 আরাত্রিক ভদ্র


“মেয়েরা দেবীর রূপ।“

আমাদের দৈনন্দিন আলোচনার ভরকেন্দ্রে কোথাও গিয়ে গভীরতার অভাব প্রাসঙ্গিক ভাবেই ধরা দেয়। বেশিরভাগ মূলধারার আলোচনা একটা তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টায় থাকে। যদি একটা উপযোগী সহজ উত্তর পাওয়া যায়, তবে তো আর কথাই নেই। চারিপাশে এমনিতেই মেধা এবং বুদ্ধিকে খুব “অমঙ্গল-কারক” হিসেবে দেখার প্রবণতা শুরু হয়েছে, মানুষের চিন্তাশক্তিকে ছোট করে দেখানোর একটা প্রচেষ্টা চলছে। এমন একটা সমস্যা যদি পুরুষতন্ত্র হয়- তবে তারও এমন বহু “সহজ” বিরোধ উপস্থিত। প্রথমেই পুরুষতান্ত্রিকতার সাথে “নারী- নির্যাতন” এর একটা সমীকরণ টেনে এনে, নারীকে দুর্বল প্রমাণ করা- ইংরেজিতে যাকে বলা যেতে পারে “victimize” করা। তারপর স্বাভাবিক ভাবে সেই victim কে উদ্ধার করার দায়িত্ব পুরুষকে দেওয়া, এবং সর্বশেষ কথা সেই নারীকে “অন্য” তকমা লাগিয়ে তাকে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এই পদ্ধতির মধ্যেই একটি প্রধান ভাবনা, নারীকে “দৈবত্ব” প্রদান করা।

বিশদে যাওয়ার আগে, প্রথমেই কয়েকটি ধারণা পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন। আমার কাছে, “রাজনীতির” খুব অপরিমার্জিত স্থূল একটি ভাবনা রয়েছে- সেটি একটি দ্বন্দ্বের। কার মধ্যে দ্বন্দ্ব? একটি বৃত্তের কেন্দ্র এবং প্রান্তের। কেন্দ্রের মধ্যে পরিবেষ্টিত থাকে ক্ষমতা। এই ক্ষমতা প্রান্তিকের মানুষদের ধারে ঘেঁষতে দেয় না। বিভিন্ন ভাবে ভাবলে এই বৃত্তের বিভিন্ন রূপ পাওয়া যাবে। আমি যেই বৃত্তের কথা বলছি, আমাদের সমাজের লিঙ্গ- রাজনীতি বা “gender politics”, তার ক্ষমতা লিঙ্গ- কেন্দ্রিক (এখানে লিঙ্গের অর্থ পুরুষের যৌনাঙ্গ) বা phallocentric- এবং বাকি সমস্ত লিঙ্গ - যৌনতার মানুষ প্রান্তিক। এবার এই Phallocentric রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ তিন রকম- “নারী- বিদ্বেষ” বা misogyny, “পুরুষ-প্রাধান্য” বা sexism এবং “ পিতৃতন্ত্র” বা patriarchy এবং আগে যে বলেছিলাম যে মূলধারার মধ্যে একটা চক্রান্ত এগুলিকে গুলিয়ে দেওয়ার, তা কিন্তু ওই পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাই। এই ভাবনাগুলোর সমাজে এতটাই ব্যাপ্তি, যে গভীরে গিয়ে চিন্তা না করতে পারলে, এগুলোর সমস্যা সমাধান হওয়া মুশকিল।

দারিদ্র্য দেখলেই অনেক মানুষ মনে করেন বুঝি তাদের একটু কম্বল বালিশ, টাকা পয়সা ভিক্ষা দিলেই অনেক উপকার হবে- তাদের বিপদমুক্ত করা যাবে, তাই যারা দান-ধ্যান করেন, তাদের মহর্ষি বলেই গণ্য করা হয়, অথচ দৈন্যতা কিন্তু ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিপ্লবীদের মহর্ষি মনে না করলেও, তারা কিন্তু এই আর্থিক বৈষম্যের মূলে গিয়ে বিচার করে সমস্ত শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কিন্তু ওই যে বললাম, ওই পদ্ধতিটা সঠিক হলেও অতটা সহজ নয়- বাড়ি থেকে টুক করে নেমে একটা পয়সা ভিক্ষা দেওয়ার মতো, তাই লোকে তা গ্রাহ্য করেনা। তেমনি পিতৃতন্ত্র, সমস্যাটাকে গুলিয়ে দিয়ে, তার সমাধানের জায়গায় নিজের রাজনীতি আরও দৃঢ় ভাবে স্থাপন করে।

শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার কেবল মাত্র লিঙ্গকেন্দ্রিক ব্যবস্থার মূল বিষয় নয়- যদিও কোথাও শারীরিক অত্যাচার, ধর্ষণ জাতীয় জিনিস দেখলেই আমরা মনে করি মহা সমস্যা রয়েছে- অতএব “দুর্বল” মেয়েদের মায়ের রূপে পুজো করি এসো। না একদমই তা নয়। মূলস্রোত থেকে তাকে দূরে রাখা, সামাজিক মূল্য এবং মূল্যবোধ তার শরীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া- এবং তাকে হয় দেবী বা ডাইনি রুপে ব্যক্ত করা, এছাড়াও পিতৃতন্ত্র, জৈবিক জীবনকে সামাজিক জীবন করে তোলে দ্বৈত মূল্যবোধ আরোপ করে- লিঙ্গ বৈষম্য এখান থেকেই জন্ম নেয়। পুরুষেরা সমাজে হন শক্তিশালী, বীর এবং উগ্র; নারীরা হন দুর্বল, ভীত, এবং লাজুক, এ সকলই পুরুষ নির্ভর রাজনীতির অঙ্গ।

মেয়েদের দেবী বলায় সমস্যা কোথায়?

দেবী স্বাভাবিক ভাবেই একজন নারীকে অতিক্রম করে একটি প্রকাণ্ড ভাবনা। দেবী সব গুণ ছাড়িয়ে বিরাজ করেন। তাঁর মধ্যে আনন্দ, শোক, ক্রোধ, শৃঙ্গার- কিছুই নেই, তিনি সবের সীমানা ছাড়িয়ে অবস্থান করেন। একজন নারী কে সেই দৈবত্ব প্রদান করার সাথে সাথে, প্রথমেই আমরা তার মানুষ হিসেবে বাঁচার যা গুন, তা সব কিছুই শেষ করে দিতে চাইছি। তাঁর কোন কামেচ্ছা নেই, তিনি সমস্ত দুঃখ সহ্য করতে পারেন, তিনি অনেক কষ্ট করলেও তাঁর শোক নেই, তিনিই মা দুর্গার মতো সকলের দায়িত্ব নিয়ে রয়েছেন, তিনি ত্যাগ করবেন-এটাই স্বাভাবিক, ফলেই তিনি “আমরা” নন, আমাদের থেকে “আলাদা”- কাজেই বৈষম্যের উত্থান, এবং একটি মানব দেহের মধ্যে ঈশ্বরের প্রবেশে তার মানবতার মৃত্যু।

রবীন্দ্রনাথের মস্তিষ্ক প্রসূত, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের “দেবী” গল্পে আমরা দেখতে পাই এমন একটি উদাহরণ। দয়াময়ীকে ঈশ্বরের রূপ বানিয়ে তার ভিতরের মেয়েটিকে তিলে তিলে হত্যা করা হয়- আসলে এটি একটি চক্রান্ত, দৈবের মাধ্যমে শরীরের এবং সমাজের মধ্যে দখল নেওয়ার। সকলে যে জেনে বুঝে করেন তা একেবারেই নয়- এবং যারা অজান্তেই এমনটি করেন, এই প্রবন্ধ তাদের উদ্দেশ্যেই।

এখানে বলে রাখা ভালো, এই প্রবন্ধটি সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারা আরোপিত দৈবত্বের বিরুদ্ধে এক প্রকাশ। বেদান্তের অদ্বৈতবাদ যখন বলে মানুষের মধ্যে ব্রহ্মের বাস, বা আমিই ব্রহ্ম, সেটা কিন্তু একেবারেই অন্য আলোচনা।

বিভিন্ন মূলধারার ছায়া ছবিতে এই একই রকম ভুল দেখা যায়। এর মধ্যেই মেয়েরা দেবী হিসেবে আরও বেশী বেশী করে উঠে আসেন, অনেকে হয়ত না জেনে স্বেচ্ছাতেই। অনেক সময় বিষয়টাকে অভ্যন্তরীণ-করন করা হয়। তবে এর মধ্যেই, পিতৃতন্ত্র তার সামাজিক মূল্যের দ্বারা নারীকে প্রান্তিক করে নিজেদের শক্তি আরও সুবৃহৎ করে তোলে।

এখানে যদিও একটি বিশেষ ধারণার কথা বলার প্রয়োজন আছে, এবং সেই ধারণার নামই হল শক্তি বা কালী। দৈবত্ব সম্পর্কে আমার ধারণা যে কি, তা স্পষ্ট করেই বলেছি। এবার বলি, দেব-দেবীদের মধ্যেখানের একটা লিঙ্গ বৈষম্য, যা আবার ওই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সামাজিক স্তরে আরোপ করেছে। সকল দেবীকেই “লক্ষ্মী” প্রতিমার মতো গৃহপালিত করে তোলা হয়েছে। শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে, ঘোমটা মাথায় দিইয়ে- 'ঘরের মেয়ে' বা 'ঘরের বৌ' করে তোলা হয়েছে- তা সে বৈদিক দেবীই হন, বা স্থানীয় দেবী। কালীকেও তেমন করেই শ্যামা রুপে গ্রহণ করেছেন- কিন্তু কালীর মূল প্রতীক কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে, তাঁকে কখনোই কোন সামাজিক মূল্যবোধে বাঁধা যাবে না- তার কেশের মতই তিনি শৃঙ্খলাহীন। তাঁকে “বসন” পরানোর চেষ্টা চললেও, তিনি উলঙ্গ হয়ে ঘোরেন পিতৃতন্ত্রের মাথা গলায় নিয়ে। তাঁর রক্ত পিপাসু জিভ তাঁর কামের প্রতীক, তাঁর খড়গ তাঁর কর্তৃত্ব বা agency, তিনি সদম্ভে তাঁর সঙ্গীর ওপরে দাঁড়িয়ে। লক্ষণীয়, মূলস্রোতে শিবশক্তির প্রতিরূপ যখন যোনি ও লিঙ্গ দ্বারা হয়- লিঙ্গ সর্বদা উপরে বিরাজমান, কালীর ক্ষেত্রে তা অন্য। তিনি মূলধারার বাইরের দেবী- সমাজের বাইরে ডাকাতদের সাথে জঙ্গলে থাকেন তিনি। চণ্ডাল দের সাথে শ্মশানে, তান্ত্রিকদের সাথে তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে বিরাজ করেন, মদিরা এবং মাংস সেবন করেন- তিনি প্রকৃত পক্ষেই শক্তি, কিন্তু তাঁকেই কেমন সরলীকরণ করে সমাজে পুজো করা হয়। নইলে নারী হয়ে তিনি চুল বাঁধেন না, জিভ বার করে পুরুষের ওপর দাঁড়িয়ে থাকেন- তাও আবার তাঁর “স্বামী”, তিনি কামেচ্ছা করেন, এতো মানাই যায় না। এই কারনেই তাঁর জিভের সাথে লজ্জার ভাবনা জুড়ে দেওয়া।

কাজেই, আমাদের সমাজের মূল সমস্যাগুলিকে সনাক্ত করতে হবে। শুধুমাত্র খবরের কাগজে নারী নির্যাতন দেখেই, এই “মা- বোনেদের” মান গেলো বলে রে রে করে উঠলেই হবেনা, আরও ব্যাপ্ত করতে হবে ভাবনা। মা, বোন ছাড়াও সমাজে অন্যান্য সম্পর্ক রয়েছে যাকে সঠিক ভাবে মেনে নিতে হবে, এবং মা বোনেদের ব্যক্তিগত পরিচিতি যে যথেষ্ট, কারোর সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়ে তাদের পরিচিতি তৈরি হয়না, সেটাও বোঝার সময় এসেছে। লিঙ্গ যেখানে পুরুষ- নারীর মধ্যে আবদ্ধ নেই, সেখানে সমাজের দ্বারা পিতৃতন্ত্র এবং homophobia এই ভাবে দীর্ঘদিন চলতে পারেনা। সমস্ত ঘটনার গভীরে গিয়ে তার মূলটাকে খুঁজে বার করতে হবে, সেখানেই তার লুকানো ষড়যন্ত্র ধরা পরবে। খালি ওপর ওপর দেখে সহজে সমাধান খুঁজলে চলবে না।
জানি না, কতটা পরিষ্কার করে কথাগুলো বলা গেল, তবু বলা গেল এই যা।

পুনশ্চঃ কলেজে পড়ার সময় নারীবাদী ভাবনায়, যার লেখা পড়ে ও বক্তৃতা শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছি, ডঃ সেঁজুতি দত্ত, এবং যার লেখা পড়েছি, শেফালি মৈত্র, দুজনকেই বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন