প্রদীপ ঘোষ
ডক্টর শাসমলের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ওঁরা ফুটপাতে কেবল দাঁড়িয়েছে, তৎক্ষনাৎ বছর দশেকের বাচ্চা ছেলেটি ওঁদের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সামনেই ফুটপাতের ধার ঘেঁষে রোল চাউমিনের দোকানদার তেড়িয়া হয়ে বাচ্চাটিকে মারতে উদ্যত হতেই বুঝতে বাকি রইলোনা ধাক্কা দেয়ার অপকর্মটিও এরই। দীপ্তেন্দু এগিয়ে গিয়ে লোকটির হাত চেপে ধরলো "হচ্ছেটা কী? একবার বাচ্চাটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন আবার চড় মারতে চাইছেন, হোয়াটস্ দ্য হেল ইজ গোয়িং অন"।
দোকানদার খানিকটা ভ্যাবাচাকা খেয়েছে। "দেখুন-না এখন টিফিন টাইম দোকানদারির সময়, বাচ্চাটা কাস্টমারদের সমানে বিরক্ত করে চলেছে"। "তাই বলে আপনি..."। সঙ্গের মহিলাটি দীপ্তেন্দুর স্ত্রী ভাস্বতী, স্বামীর হাত টেনে বললো "ছেড়ে দাও ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই"। বাচ্চাটার কাছে গিয়ে মাটি থেকে দাঁড় করিয়ে বললো "তোর লেগেছে বাবু ?" বাচ্চাটিকে ছুঁতে-ই ভাস্বতীর শরীরে নিউরন থেকে নিউরনে আবার সেই ইলেকট্রিক শক ; বিজবিজ চিড়িকচিড়িক। বাচ্চাটি দু'দিকে ঘাড় নাড়লো, লাগেনি। "তোর খিদে পেয়েছে? খাবি?" এবার বাচ্চাটি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তে দোকানদারকে বললো "ওকে এক প্লেট চাউমিন দিন"। দীপ্তেন্দুকে ইশারা করতে দাম মিটিয়ে দিল।
বাচ্চাটা খাচ্ছে, ওর চোখ থেকে জল ঝরছে নাক থেকে শিকনি। নিজের রোমালটা বাচ্চাটির দিকে এগিয়ে ভাস্বতী বললো "বাবু তোর চোখমুখ মুছে নিয়ে তারপর খা"। বাচ্চাটির চাহনিতে কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই প্রণামের জলছবি। চোখমুখ মুছতেই ধুলো ময়লার পরতের আড়ালে টকটকে ফর্সা মুখাবয়ব প্রস্ফুটিত। নীলাভ চোখের মণিতে ভাস্বতী মায়াবিষ্ট হয়ে হেসে ফেলতেই বাচ্চাটিও অনির্বচনীয় স্বর্গীয় হাসি ফিরিয়ে দিল। হাত নেড়ে টাটা করে ওঁরা নিজেদের গাড়িতে উঠে বসলো। অতনু খেয়াল করেছে হঠাৎই ভাস্বতীর মুখটা সেদিনের মতোই ফ্যাকাসে, কারণটা বোধগম্য হয়নি। এতক্ষণ-তো স্বাভাবিক-ই ছিল, যাকগে বাড়িতে গিয়েই জিজ্ঞাসা করবেখন।
অনেকরকম জিজ্ঞাসাবাদ পরীক্ষানিরীক্ষার পরে ডক্টর শাসমল অতনুকে জানালেন "আপনার স্ত্রীর ব্যাপারটা স্কিৎজোফ্রেনিয়া নয়। ইলিউশন, হ্যালুসিনেশন...যাইহোক, প্রেশক্রিপশনে লিখে দিয়েছি আপনি ওঁর ইলেক্ট্রো-এনসেফালোগ্রাফি করিয়ে নেক্সট উইকে আসুন। আমি এন্টি-সাইকোটিক মেডিকেশন দিয়ে রাখলাম। সেরকম বুঝলে প্রয়োজনে হিপনোথেরাপিস্টের কয়েকটা সিটিং-এ ঠিক হয়ে যাবেন আশাকরি। দু'জনকেই বলছি দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই"।
পরে অতনুর হঠাৎ মনে পড়লো, ডক্টর শাসমল একান্তে জিজ্ঞাসা করেছিলেন "এছাড়া অন্যকোনো অতিপ্রাকৃত বা আশ্চর্যজনক ঘটনার কথা, হতে পারে ওঁর ছোটবেলার, আপনাদের বিবাহের পূর্বেকার কোনো ঘটনা আপনার জানা আছে?" ওঁদের বিবাহ বাসরেই-তো হাসিঠাট্টায় ভাস্বতীর পিসিমণি বলেছিলেন, একবার নাকি ধুবুলিয়ায় ওঁদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ভাস্বতী ঘুমের ঘোরে দোতলার শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে একফার্লং, প্রায় সাড়ে ছ'শোফিট দূরে পুকুর ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাত দিয়ে পারের নরম মাটি খুঁড়ছিলো। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। ওঁর পিসেমশাইয়ের খুব সকালে উঠে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই পায়চারি করার অভ্যাস তিনিই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে পুকুরে নেবে কিশোরী ভাস্বতীকে কোলে তুলে এনে সকলকে জানান। সারা বাড়িতে হইচই। সরজমিনে সকলে গিয়ে পুকুরের নরম মাটিতে বাচ্চার আঙুলের আঁচড়ের দাগ বাদে ভাস্বতীর হাতে কাদায় মাখামাখি দেখছে। সেকথা ভাস্বতীকে বলতে বলেছিল ওর কিছুই মনে পড়ছেনা। ভাগ্যিস সেটা ফেব্রুয়ারি মাস পুকুরের জল শুকিয়ে হাঁটুজল, নইলে বড়সড় বিপত্তি ঘটতেই পারতো। ডক্টর জিজ্ঞাসা করলেও এই ঘটনার কথাটা বলা হয়নি, ইশশ্।
বিয়ের এতগুলো বছরের মধ্যে অতনু কখনও ভাস্বতীর মধ্যে কোনোরকম বৈকল্য বা আচারআচরণে অস্বাভাবিক চারিত্রিক বিচ্যুতি লক্ষ্য করেনি। মাস চারেক আগে ঘাটশিলা বেড়াতে গিয়েই বিপত্তির শুরু। তারপর থেকেই ভাস্বতী চোখ বন্ধ করলেই এমন কিছু মানুষের মুখচ্ছবি দেখতে পায় যাদের সঙ্গে বাস্তবতায়, আত্মীয়তা সূত্রে, স্কুল-কলেজে, পাড়াতুতো, কোনোভাবেই পূর্ব পরিচিত নয় কেউ-ই। আর ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস্ করে কী-যে বলে ভাস্বতীর বোধের অগম্য। সঙ্গে আবছা একটা বিশালাকৃতির বাড়ি। আগে জমিদার বর্ধিষ্ণু বিত্তশালী পরিবারদের যেমনটা হতো। তিনমহলা শরিকানি বাড়ি। বিশাল গম্বুজ, ফ্লোর গুলো রাজস্থানের সাদাকালো চৌকো মসৃণ মাকরানা পাথরের, এপর্যন্ত ।
যদিও এখন বিভিন্ন জাতির মিশ্র-সংস্কৃতি কিন্তু মধ্যযুগে ঘাটশিলা বাঙালি দ্বারা-ই শাসিত ছিল। পরবর্তীতে ধলভূম রাজবংশ দ্বারা একপ্রকার স্থানচ্যুত। ধারাগিরি ফলস্, বুরুডি লেক, পঞ্চপাণ্ডব পাহাড়, রঙ্কিনীদেবীর মন্দির, চিত্রকূটের শিবমন্দির, বিভূতিভূষণের বাড়ি গৌরীকুঞ্জ, সুবর্ণরেখার তীরে রাতমোহনা সবমিলিয়ে ভারিসুন্দর পর্যটনকেন্দ্র। ফুলডুংরী টিলায় উঠলে সমস্ত ঘাটশিলা শহর পরিলক্ষিত। এছাড়াও অনেক দর্শনীয় স্থান। কিন্তু বহুপুরনো প্রকাণ্ড যে রাজকীয় লজ বাড়িটিতে আমরা উঠেছিলাম তার সামনে কেয়ারি করা সুন্দর বাগান। লন পেরিয়ে কালো বর্ডারের চকচকে লাল শানের উঠোনে দাঁড়িয়ে বাড়িটির গথিক স্থাপত্যের গোলগোল গম্বুজ অলিন্দ-খিলান দরজা-জানালার জাফরি মায় আর্চের ওপরে নীল সবুজ হলুদ কাচের নকশা দেখতেদেখতে ভাস্বতী বলেছিল "অতনু এই বাড়িটা আমার ভীষণই চেনা। এই উঠোনে পা-রাখতেই জানো আমার মাথায় ক্যামন বিজবিজ চিড়িকচিড়িক করে ঘাড় থেকে মেরুদণ্ড বেয়ে সারা শরীর ছড়িয়ে পড়লো। আমার শরীরটা অবশ লাগছে"। বলতে বলতেই মাটিতে বসে পড়েছিল।
জনসংখ্যা যত বাড়ছে বাজার অর্থনীতির কম্পিটিশনে ইঁদুর দৌড়ও তত, মানুষের মানসিক রোগভোগও পাল্লা দিয়ে প্রকট। মানসিক চিকিৎসকদের চেম্বারে ভিড় উপছে পড়ছে। একজন ভালো ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াও দুষ্কর; ফলতঃ অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখাতে এসে অফিস যাওয়া হলোনা। খাওয়া দাওয়ার পরে ভাস্বতীকে অতনু জিজ্ঞাসা করলো "ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে গাড়িতে লক্ষ্য করলাম তোমার মুখটা থমথমে; কী ব্যাপার বলতো?" "বললে তুমি বিশ্বাস করবেনা; বাচ্চাটিকে যেই-না মাটি থেকে তুলে ধরেছি আমার শরীরে আবার আশ্চর্যজনকভাবে ঘাটশিলার বাড়িতে পা-রাখার সময়কার একই অনুভব অনুভূত হয়েছিল"। অতনু বুঝিয়েছিল- "ওটা তোমার মনের ভুল। অবদমিত সন্তান আকাঙ্ক্ষার কারণে"। কথা ঘোরাতে ভাস্বতী বললো "আজ যখন তোমার অফিসে যাওয়া হল-ই না, তখন চলোনা পাঠান দেখে আসি?" অতনুর অমিতাভ বচ্চন, নাসিরুদ্দিন শাহ, কমল হাসান ছাড়া আর কাউকেই ভালো লাগেনা; শাহরুখ খানকেও নয়। তবু নিজেদের টোনাটুনি সংসারের এই গুমোট ভাবটা কাটাতেই নিমরাজি হয়ে গেল। সকাল দুপুরের প্রেক্ষিতে বিকেল সন্ধ্যাটা মন্দ কাটেনি। ওঁরা ফিল্ম দেখে লেকমল বার্বিকিউ থেকে বুফে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরেছিল।
গত চারমাসে মানসিক টানাপোড়েনে ওঁদের দাম্পত্যজীবন স্টেশনের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষারত দু'জন যাত্রী মাত্র। প্রয়োজন ব্যতিরেকে কথাবার্তাই হয় খুব কম আর শারীরিক অন্তরঙ্গতার-তো প্রশ্নই ওঠেনা। আজকের রাত কিন্তু ওঁদের ফুলশয্যার দিনের মতোই উপভোগ্য ছিল। ভোরের দিকে ভাস্বতী অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলো। অতিস্বল্প পরিচিত, দুপুরের সেই ছেলেটি বলছে "মা-আমি আবার তোমার কাছে-ই ফিরে আসছি"। কিছু একটা বলতে চাইছিল পরিবর্তে গলা থেকে গোঁ-গোঁ শব্দটুকুই শুধু বেরিয়েছিল। ভাস্বতীর গলা শুকিয়ে কাঠ, ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড় করে বিছানায় বসে দেখলো অতনু ঘুমে কাতর। খুব মায়া হলো, স্বপ্নের কথা বলে বেচারার টেনশন বাড়াতে চায়নি। ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে শুয়ে পড়লো। পরেরদিন অতনু অফিসে বেরনোর পরেই ভাস্বতী গতকালের অকুস্থলে। সেই দোকানির কাছে এসে "ভাই গতকাল দুপুরে আপনি যে বাচ্চাটিকে মারধোর করছিলেন আজকে ওকে দেখছি না তো? কোথায় গেলে ওর দ্যাখা পেতে পারি বলবেন?" দোকানি ছেলেটি বললো "সত্যি বলতে দিদিভাই ওকে আগে কখনও দেখিনি। ছেলেটি সম্ভবত এই অঞ্চলেরই নয়। ওরা কচুরিপানার মতো। কোনো জলা, নদীপথ উজিয়ে ভেসে অন্যকোনো ঘাটে নোঙর গাড়ে। আবার অনেকে ভাসতে থাকে-তো ভাসতেই থাকে তাদের-তো সাহিল, তীরের নাগাল পাওয়া-ই ভার। আশ্চর্যের কথা কী জানেন? আপনাদের চলে যাবার পরপরই ছেলেটিও ভোঁ-ভাঁ। প্লেটের খাবার তেমনটাই পড়েছিল"। সামান্য দোকানির দার্শনিক কথায় গভীর জীবনদর্শন। তবে শেষের কথাগুলোয় ভাস্বতীর পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠেছিল। বাড়ি ফিরে লাইট অফ্ করে শুয়ে ছিল খাওয়াদাওয়া না-করেই। কখন-যে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়ালই ছিলনা। সন্ধ্যায় অতনু বাড়ি ফিরে কয়েকবার বেল টিপে সাড়া না-পেয়ে ডুপ্লিকেট কী-দিয়ে ল্যাচ খুলে ভাস্বতীকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে ডাকাডাকি করেনি। ওয়াশরুম হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিজেই কফি বানিয়ে খেতে খেতে টিভি দেখছিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে হয়তো টিভির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে ডাইনিং এসে বুঝলো অতনু অনেক আগেই অফিস থেকে ফিরেছে। অপরাধীর মতো মুখ করে বললো "শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল জানো, তাই আর কী..." স্বপ্ন, সকালে ছেলেটির সন্ধানে গেছিলো ইত্যাদি ঘুণাক্ষরেও অতনুকে কিছুমাত্র বলেনি। কী না কী ভাববে...
যদিও খিদে পেয়েছিল তবু ভাস্বতীও ফ্রেস হয়ে কফি খেয়ে কিচেনে। অতনুকে বলে বলে হয়রান, চিমনিটা অকেজো হয়ে গ্যাছে নতুন একটা না-কিনলেই নয়। সারাতে এসে মিস্ত্রি বলে গিয়েছিল "ক'দিন চলবে বলতে পারছিনা, বৌদি দাদাকে বলুন নতুন একটা কিনে নিতে"। ভাস্বতী লুচি আর কালোজিরে কাঁচা লঙ্কা ফোড়নে সাদা আলুর তরকারি রান্না করছে, অতনুর অত্যন্ত প্রিয় সঙ্গে গতকাল কিনে আনা ডেজার্টে ডিনার।
আজকেও ভোর রাতে ভাস্বতী অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলো যা কারো সাথেই এমনকি অতনুকেও শরিক করবার নয়। পরপর দু'দিনের স্বপ্নের কথা বললে অতনু মায় ডক্টর শাসমল দু'জনেই ধরে নেবেন ভাস্বতী নিশ্চিতভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন।
প্রত্যেকটি মানুষ আসলে একা একটি নির্জন দ্বীপের মতো যার পরতে-পরতে গভীর অরণ্য, জলাশয়, ফ্লোরা ফনার পূর্বাপর নিজের-ই বিবিধ পুর্নজন্মের-ই গল্প বোধহয়। কোথাও বানভাসি কোথাও-বা মনের থিতিয়ে পড়া পলিতে নূতন চরা। স্বপ্নে ঘাটশিলার নিজেদের বাড়ি, বসবাসকারী তিরিশ অধিক বড়-ছোট সদস্য-সদস্যা বিভিন্ন জনের জলচল তাবাদে ঠাকুর, চাকর, দারোয়ান, গাড়োয়ানে সকলের সম্মিলিত চ্যাহেলপ্যাহেল আজন্মের পরিচিত চলন্তিকা ছবিরমতো স্পষ্ট দৃশ্যমান। ভাস্বতী এ-মহল সে-মহলে নূপুরের নিক্কনে মহলে ঘুরেফিরে একেবারে পেছনে দশবিঘার পুকুরঘাটের সিঁড়ির চাতালের দু'ধারে হোয়াইট মার্বেলের বিশাল ময়ূরপঙ্খী রোয়াকে এসে থমকাল। এতদিন চোখ বন্ধ করলেই যাঁদের মুখগুলো দেখতে পেতো তাঁরা সকলেই এখানে থমথমে মুখে জটলায় বলাবলি করছে "জলে ডুবেই মারা গ্যাছে"। ভাস্বতী সবাইকে ঠেলেঠুলে উঁকি দিতে দেখলো দশ-এগারো বছরের মৃত ছেলেকে সিঁড়ির চাতালে শুয়িয়ে রাখা পাশেই একজন স্ত্রীলোক বিষাদের চিত্রার্পিতা সম্ভবত ছেলেটির-মা। একেবারে সামনে গিয়ে দেখলো দু'চোখের কোলবেয়ে জল শুকিয়ে মজানদীর মানচিত্র। আরে! এতো ও নিজেই আর মৃতছেলেটি ওরই আদরের ধন ভূমা, ভূমেন্দ্র নারায়াণ চৌধুরি। ভাস্বতী ধড়ফড় করে জেগে উঠলো। এসি ষোলোতে তাও ঘেমেনেয়ে একশা।
এরপর ঠিক দু'মাস বাদে আগামীকাল অতনু-ভাস্বতীর অষ্টম বিবাহবার্ষিকী। গত আটবছরে ওঁরা সন্তানকামনায় সবরকম চেষ্টা-চরিত্র করেছে। একাধিক ডাক্তার এমনকি বিশ্বাস না-থাকলেও বাধ্যবাধকতায় জ্যোতিষীদেরও দ্বারস্থ হয়েছিল। গতমাসের ঋতুচক্রের গণ্ডগোলকে ভাস্বতী পাত্তা দেয়নি, কিন্তু এমাসেও যখন রজঃস্রাব হয়নি, ওদের সোসাইটির উল্টোদিকে কেমিস্টশপ থেকে প্রেগন্যান্সি-কিট এনে পরীক্ষা করেই নিশ্চিত হয়েছে। অতনু ফ্ল্যাটে ঢুকে এটাচিটা শু-রেকের ওপরে রেখেছে, জুতো পর্যন্ত খুলতে পারেনি ভাস্বতী সটান ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অতনুর বুকে মুখ ঘষতে লাগলো। অতনু তো হতভম্ব! জিজ্ঞাসা করলো, "তুমি আজকে ওষুধ খেয়েছিলে তো?" ভাস্বতী বললো "ওসব কিছু নয় গো। আর আমাদের ডক্টর শাসমলের কাছেও যাবার দরকার নেই। সাইকিয়াট্রিস্ট নয়, আমাদের দরকার একজন গাইনোকলজিস্ট। অতনু উই'য়ার গোয়িং টু বি প্যারেন্টস্, ইটস্ আ ফ্যাক্ট, ডিয়ার হাবি"। স্বাভাবিক, এখন দু'জনের মনেই আনন্দের জোয়ার। ভাস্বতী বললো, "আমাদের ছেলে হবে দেখে নিও...আমি নামও ঠিক করে ফেলেছি জানো; অতনু-ভাস্বতীর ছেলে অনুভব"। "আমাদের ছেলেই হবে তুমি কীভাবে সিওর হচ্ছো?" "আছে মশাই, এখন সবকিছু বললে তুমি আবার টেনশনে পড়ে যাবে। অনুভব না আসা পর্যন্ত সেসব গল্প আপাতত তোলা থাক"।