দোঁহা

যারা আজ আশ্রয়হীন বিপন্ন-কপালে যাদের গ্রহণদোষ

 


পিয়াংকী 

(১)
পাতিল

'কোন নদীতে ডুইব্যা মরার লাইগ্যা উথালিপাথালি করতাসো কইন্যা, ধইন্য তোমার কলিজা, লও  নাওখান ভাসাইয়্যা দিয়া উদ্ধার করো আমারে'-

 অশ্বগন্ধা নারীর এ হেন উর্বরতা, ভাবলে নিমেষেই কেঁপে ওঠে শরীর। নদীর মতো মেয়েমানুষ  নাকি পথভ্রষ্ট কোনো পুরুষের চোখের নষ্টঘুম, কলিজার সংজ্ঞা বৈশিষ্ট্য লেখা থাকে কোন পুঁথিতে? নৌকার বিপরীতে অভিনয় করে আলেয়ার সমবয়সী কোনো এক আগুন। দাউদাউ জ্বলা তার উনুনের অগ্রভাগে কে যেন রেখে গেছে পাতিলভরা গঙ্গাজল। আশেপাশে ছিটিয়ে আছে আতপ। মৌন সমর্পণ সেরে করতলের মেঘ সরাতে সরাতে ঘন সন্ধ্যা হয়ে এল যখন তখন ওই মেয়ের কপাল জুড়ে দরগার মাটি কমলা সূর্য। 

যে পাতিলে রান্না হত কোনো এক বৈদিকযুগে, কাদামাটি ছেনে ত্রিমুখী চুলায় জ্বলে উঠত পাটকাঠির আগুন, আজ সেখানে শুধুই জল। বুকসমান জলে পাপ। ছেড়ে যাচ্ছে হাজার প্রজাপতি। পাতিল ভাঙছে, গড়ছেও অজস্রবার। স্থির জলরাশি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে গোড়ালি সমান দৈর্ঘ্য। আরাধ্য অথবা অর্জিত, পাতিল মাড়িয়ে যাচ্ছে যারা, প্রত্যেকেই বোবা। শব্দ-কম্পনে অনিরুদ্ধ বাসনা। ভাসানের হদিশ পেলে যেমনভাবে নদীর প্রান্তে জমে যায় ভিড় সেভাবেই পাতিলের গা ভরে থিক থিক করছে পিঁপড়ের দল। মানুষের ভিতর অন্ধকার, গোপন ডেরা, লজ্জাবাঁক। পিঁপড়ে ঢুকে যাচ্ছে সর্বত্র। দরজার বাঁদিকে এক বিরাট গর্ত,মাটি লাগা পা এসে ধুয়ে নিচ্ছে মানুষ। পাশেই কাঠচাঁপা, প্রত্যেকের চোখে জল। পোড়ামাটির পাত্রের গা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে মরণের অযুত সংলাপ। সামান্য ছাই আর... 

সামান্য বালিকার কলিজা শরীর ছাড়িয়ে এখন ব্রহ্ম মুহূর্তে। সে নাও ছাড়ে বাঁধে, পারাপারের পর চেয়ে নেয় পারিশ্রমিক। অশ্বগন্ধা মেয়ের গায়ে তাই মৎসবীজ। রাইকমলের নামে বরাদ্দ একটি জলপ্রপাত 

 (২)
পুরিন্দা

এক পুরিন্দা মেয়েমানুষ, ভিতর ভিতর একটি  অন্ধকার একাদশতম শত্রু একবিংশতিতম প্রণয় একত্রিংশত্তম স্বেচ্ছাসেবা আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা সামান্যকিছু মহুয়াফুল। নাভিশঙ্খতে সাপের বিষ, নষ্ট করে দিচ্ছে যাতায়াতের পিছল পথ। ওই পথেই পড়ে আছে যত কালো ছাই এবং  কালপুরুষের কোমরবন্ধনীর ক্ষুদ্রতম নক্ষত্রটি। মাড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে কিনা ভাবতে ভাবতে দেয়াল থেকে খুলে পড়ছে আস্তরণ। ফোঁপড়া জন্ম আর এক একর ধানজমি, সঞ্চয় বলতে এর চেয়ে বেশি একবিন্দুও নয়। 

এক পুরিন্দা ব্যাটাছেলে। ভিন্ন রাস্তা আর বিভিন্ন ঘর। ভিতরে পিঁপড়ে ঢুকে খুঁড়ে তুলছে মাটি, সেই মাটির মধ্যে লজ্জাবস্ত্র তুলসীতলা কিংবা গর্ভঋণ। ঋষি আসছেন, তার গায়ে মার্কণ্ডপুরাণের ঢেউ। অযুতসংখ্যক বসবাসের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বৃত্তাকার কক্ষপথ। সপ্তর্ষিমণ্ডল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন যারা তাদের কোমরজলে এক বাঁশের খুঁটি। এরপর  আস্তানা বাঁধা খুঁটির ওপর পরিযায়ী পাখি। মহাদেবের চরণে অর্পণ করা অশ্রুসিক্ত ত্রিপত্রে পরজন্মের অগ্রিম বনিবনা। 

এক পুরিন্দা অসুখ, বিষাদগ্রন্থে কাকাতুয়ার আওয়াজ, মন্দিরের  ঘন্টাধ্বনি আর পানকৌড়ির আগ্রাসী চোখ। রাজ্যের আগাছা সেই চোখের ভিতর। তাম্রপাত্রে সাদা ফুলের মতো ভাসমান যত কামনাবাসনা। খড়ের আঁটি থেকেই জন্ম নেওয়া বিকৃত আঙুল পেরোলেই মোক্ষলাভ। এখন সব বন্ধ।নির্দিষ্ট সময় অন্তর খুলে যাবে মিথোজীবী-দরজা। গন্তব্য থেকে ঠিক বিপরীতে উন্মাদ ঘুরে বেড়াবে ল্যাংটো আত্মা আর তার গা ছেঁকে ধরবে শয়ে শয়ে মাছি

এক পুরিন্দা জন্ম। পুঁটুলির ভিতর উঁকি দিচ্ছে জলরাশি বালিয়ারি ভ্রূণের অনুপাত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কতটা ওপরে এলে সূর্যাস্ত নেমে আসে বুকের পাঁজরে, তীব্র হয় মুহূর্তসুখ সেসব ইঙ্গিতে বোঝানো সম্ভব নয় বলেই পুরিন্দার মধ্যে একটি হরিণ শুয়ে আছে জড়সড় হয়ে। আরেকদিকে খোক্কশ অথবা  গিরগিটি, ছাউনি জুড়ে মায়ামায়া খেলা। পাঞ্চজন্য শাঁখের পাশেই স্তোস্ত্রপাঠের আসর।

...কী এই পুরিন্দা? মহাযোগী পুরুষ নাকি অলৌকিক উর্বারুকমিব? কোথায় এর সূত্রপাত আর অন্তিমযাত্রা?

...এই প্রতিটি পুরিন্দায় ধীরে ধীরে জেগে উঠছে তুমি অন্তর্ভুক্ত পদ্মবন এবং কালান্তক মৃত্যুসুখী পায়রা, বাকি যা কিছু সবটাই ওঁ সমন্বিত ধ্যানযোগ 

(৩)
গজাল 

ভাসানমঙ্গল সেরে সবে ডিঙি ছুঁয়েছে মেয়ে। অর্ধেক আঁচল তখনও লুটিয়ে আছে জল আর পাটাতনের মাঝের আড়ষ্ট ফাঁকে। কে টেনে নিচ্ছে এই উলঙ্গ পোশাক? বেঁধে ঝুলিয়ে দিচ্ছেই বা কোথায়? কড়িকাঠে প্রহর শেষের অবেলা। মেয়ের কাঁধ স্পর্শ করেছে পুরাণ অথবা প্রাচীন। ভেসে যাচ্ছে সবটুকু, ততক্ষণে ছিঁড়ে গেছে আঁচল আর ভিজে গেছে মন।
একহাত গজাল। একজন্ম যন্ত্রণা। আঘাত পারেনি মেয়ের গায়ে কাঁটা ফোটাতে, পারেনি নিম্নগামী ছায়ার আশ্রয় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। তবু কিছুটা নরম যোগাযোগের মতো পিছল হয়েছে পথ। গাঙচিল এসে ছিনিয়ে নিয়েছে মৃত্যুকথা। নির্দিষ্ট সময় পর থেমে গেছে ডিঙি। 
এইপারে এখন উৎসব। আতসবাজি রংমশাল আরও হাজার আলো। এইপারে ঘন বন দারুচিনি দ্বীপ কর্মফলের গাছ। টুপটাপ বোঁটা ছিঁড়ে খসে পড়ছে ফল।যন্ত্রণা নেই নেই অপেক্ষা। সান্দ্র তরলের ভেতর বদলে যেতে থাকা অবয়ব। গজালের সহচরী নেই কারণ ব্যথার কোনো দোসর নেই। অদৃশ্য ওঁ কিংবা গর্ভজাত কালের কপালে এখন শুধুই নৌকাজন্ম।

ভাসানগান ভাসানবাড়ি ভাসানসুখ। মেয়েটি নেমে গেছে। এখন কাঠের পাটাতনের ওপর তার আলতারাঙা পা। ডুবে যাচ্ছে জল। ভেসে উঠছে অন্তর্ভুক্ত পদ্মবন। ভেসে উঠছে না-পোড়া নাভি। এখানে বৈদুর্য এসেছে খামখেয়ালি মেজাজ নিয়ে, বিলিয়ে দিয়েছে স্বর্গসুখ। ধূসর বিষন্ন রাত। ছাই আর ছাই। সাপের ঘরটি সবচেয়ে নিরাপদ, সেখানে সবটুকুই পিচ্ছিল। 

মেয়ের গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। ভুলকথার গা ঘেঁষে কে বা কারা যেন রেখে গেছে শ' খানেক গজাল...

1 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন