ধীমান ব্রহ্মচারী
ভাষা অর্থাৎ মানব জাতি যে বাহনের মাধ্যমে কথা বলে, দৈনন্দিন জীবনের সব কিছুর মুলেই এই ভাষা। স্থান বা অঞ্চল অথবা দেশ অনুযায়ী ভাষার পরিবর্তন আছে, আছে রূপ। এপ্রসঙ্গে বলি-হেনরি সুইট, একজন ইংরেজ ফোনেটিশিয়ান এবং ভাষা পণ্ডিত, বলেছিলেন: “ভাষা হল শব্দের সাথে মিলিত বাক-শব্দের মাধ্যমে ধারণার প্রকাশ। শব্দগুলি বাক্যে একত্রিত হয়, এই সংমিশ্রণটি ধারণাগুলির চিন্তার উত্তর দেয়। "আমেরিকান ভাষাবিদ বার্নার্ড ব্লচ এবং জর্জ এল. ট্র্যাগার নিম্নলিখিত সংজ্ঞা প্রণয়ন করেছেন: "একটি ভাষা হল স্বেচ্ছাচারী কণ্ঠস্বর প্রতীকগুলির একটি সিস্টেম যার মাধ্যমে একটি সামাজিক গোষ্ঠী সহযোগিতা করে। "ভাষার যেকোনো সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা অনেকগুলি অনুমান তৈরি করে এবং অনেকগুলি প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রথমটি, উদাহরণস্বরূপ, "চিন্তার" উপর অত্যধিক ওজন রাখে এবং দ্বিতীয়টি একটি বিশেষায়িত, যদিও বৈধ উপায়ে "স্বেচ্ছাচারী" ব্যবহার করে।
আমাদের ডঃ রামেশ্বর শ্ব ভাষার ইতিহাস নিয়ে নানান কথা বলেছেন। আমাদের বাংলা ভাষার প্রবাহ, গতি-প্রকৃতি, ব্যবহার -প্রয়োগ এবং এরই পাশাপাশি শুধুমাত্র বাংলা ভাষা নিয়েই তিনি ভাষা এবং সেই ভাষার নানান উপভাষার(Dialect)কথা বলেছেন। আর এই উপভাষার সঙ্গে সঙ্গেই আবার কথ্যভাষা(Vocal language)এবং অকথ্য ভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছে।
গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস একটি (সম্ভবত ব্যঙ্গাত্মক) গল্প বলেছিলেন যেখানে মিশরের রাজা প্রথম সামটিক (রাজত্বকাল ৬৬৪-৬১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ) একটি শিশুকে তার উপস্থিতিতে উচ্চারিত একটি শব্দও না শুনে লালনপালন করেছিলেন। এক সময় এটি তার অভিভাবকের কাছে ছুটে যায় যখন সে কিছু রুটি নিয়ে আসে, "বেকোস, বেকোস" বলে ডাকতে থাকে; এটি, রুটির জন্য ফ্রিজিয়ান শব্দ বলা হচ্ছে, প্রমাণ করেছে যে ফ্রিজিয়ান ছিল প্রাচীনতম ভাষা। এই ধরনের অ্যাকাউন্টের নির্বোধতা এবং অযৌক্তিকতা অন্য সময়ে অন্য কোথাও এই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করেনি। খ্রিস্টান ইউরোপে হিব্রু বাইবেলের ভাষা হিসাবে হিব্রু ভাষার অবস্থান(ওল্ড টেস্টামেন্ট) হিব্রু সম্পর্কে বহু শতাব্দী ধরে বৈধ ভিত্তি দিয়েছে, যে ভাষায় ঈশ্বর আদমকে সম্বোধন করেছেন বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, সমস্ত মানবজাতির মাতৃভাষা হিসাবে।
"ভাষা বিপন্নতা" শব্দটির সাথে আমাদের পরিচিত হতে সময় লাগতেই পারে, যে ঠিক কী রকমের 'বিপন্নতা'? আবার 'ভাষা' বলতে প্রথমে নিজের মাতৃভাষাকেই সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে রাখব।অর্থাৎ এটা বুঝতে পারছি একটি ভাষার ক্রমশ আয়ু কমে আসা। সেই ভাষার ব্যবহার কমতে থাকা! অথবা সেই ভাষার অবলুপ্তির সম্ভাবনা! আর এই প্রসঙ্গে একটি বক্তব্য তুলে আনছি-"ভাষার শিষ্টাচার সামাজিক শিষ্টাচারেরই একটি অঙ্গ। অর্থাৎ দুজন বা একাধিক সামাজিক মানুষ একত্রিত হলে, তাদের মধ্যে শত্রুতার কোনও সম্পর্ক না থাকলে, আচরণে যে শিষ্টাচার ও সৌজন্য প্রত্যাশিত, ভাষা ব্যবহারেও তার প্রতিফলন ঘটে। শত্রুতা থাকলে তো কোনও শিষ্টাচারের প্রশ্নই নেই, সেখানে ভাষাপ্রয়োগ গালাগালের চেহারা নেওয়ার কথা, এবং তাতেও হয়তো আদানপ্রদান থেমে থাকে না। শত্রুতা না থাকলেও কোনও কারণে দূরত্ব বা অবজ্ঞা বা বিদ্বেষ থাকতেই পারে, ফলে এক জন আর-একজনকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতেই পারে। এই 'এড়িয়ে যাওয়া', এবং 'আমি তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছি তা বুঝিয়ে দেওয়া'র নানা রকম অভিব্যক্তি আছে, কথা ছাড়াই অপমান প্রকাশের নানা ভঙ্গি আছে। কিন্তু আপাতত আমাদের আলোচনা কথা বলার শিষ্টাচার নিয়ে। কথা বলা একটি সামাজিক কাজ। আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি, তা সাধারণত দু-মুখো, আদানপ্রদান-ধর্মী। একজন বক্তা থাকে, এক বা একাধিক শ্রোতা থাকে। একাধিক বক্তা হলে কথা শোনার অসুবিধে হয, এ সম্বন্ধে আমরা পরে বলব। ভাষার এই যে আদান-প্রদান, দ্বিপাক্ষিক, তার নাম কথাবার্তা বার্তালাপ, ইংরেজিতে conversation. এই কনভারসেশন নিয়ে কিছু পণ্ডিতি আলোচনা আছে, কিন্তু আমরা সেই পণ্ডিতি আলোচনায় পরে পৌঁছোব। আগে কিছু সাধারণ বুদ্ধির কথাই বলে নিই।
স্বগতোক্তি ছাড়াও এক-পাক্ষিক ভাষা ব্যবহার প্রচুর হয়, তা আমরা প্রায়ই দেখি। ক্লাসে শিক্ষক পড়াচ্ছেন, মঞ্চে রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতা করছেন, সেমিনারে বক্তা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী মন্ কী বাত বলছেন বা রেডিয়োর বক্তৃতা শুনছি-সবই একমুখী ভাষাচরণ, দ্বিমুখী নয়। আগে কথকতা, ব্রতকথা-তাও ছিল এইরকম। মা-ঠাকুমার গল্প বলাও তাই। কিন্তু এর মধ্যে কিছু হল আগে তৈরি হওয়া কথা, গল্প, ব্রতকথা ইত্যাদি। আবার কিছু ভেবেচিন্তে গুছিয়ে লেখা, রেডিয়োর বক্তৃতা যেমন। "(ভাষা সুখ, ভাষা দুঃখ)। তাহলে শুধুমাত্র ভাষার বিরাট একটা পাণ্ডিত্য দিয়ে যে ভাষার ব্যবহার বাড়বে, তা কিন্তু নয়।
আদিম মানুষের ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন ইশারা বা ইঙ্গিত লোপ পেয়ে যে ধ্বনি(sound) প্রকাশ পেল এবং ধ্বনিই পরবর্তীতে স্থান ও অঞ্চল ভেদে ভাষার রূপ পেল সেই ইতিহাস খুব একটা সুখকর ছিল না। সেই ভাষায় (পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা-প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা)যে আজ হাজার হাজার বছর ধরে পরিবর্তিত হয়ে আজকের পৃথিবীব্যাপী প্রায় দশ হাজার ভাষায় স্থায়ীত্ব পেয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। আসলে যেকোন দেশের বা রাষ্ট্রের ভাষা সেই দেশের মানুষের মুখের ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। বেদের ভাষা থেকে শুরু করে আমাদের নিজেদের আজকের ভাষার ইতিহাস বিরাট এক কালপর্ব। এই পর্বগুলোতেই ঘটেছে পরিবর্তন। আমরা যে ভাষায় কথা বলি, সেটা ঠিকই বাংলা ভাষা, কিন্তু এই ভাষার অস্তিত্ব আজ সংকটে। আজকের আধুনিক সভ্যতার আমরা এতটাই সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর যে কোনোভাবেই আমরা এই সময়ের ভাষাকে উপেক্ষা করতে পারি না।
তবে এতো কিছুর পরও স্বাভাবিকভাবে বলতেই পারি ভাষা চলমান এক প্রবাহ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিনিয়ত পরিবর্তন এবং ব্যবহার। তাই আজকের সময়ে ভাষার যে পরিবর্তিত রূপ যেটা, বাংলার সাহিত্য - সংস্কৃতিতে ভয়ানক ভাবে প্রয়োগ হয়েছে বা হচ্ছে সেটা ভাষার এক প্রকাশ অপব্যবহার বলতেই পারি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা তাহলে কোন ভাষাকে গ্রহণ করব আর কাকে বর্জন। সাধারণ সাহিত্য বা শিল্প বা সংস্কৃতির অন্যতম বাহন কিন্তু ভাষা। আমরা যেভাবে হুতোমী ভাষার পাশপাশি বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথের ভাষা পেয়েছি,এবং তারও পর শরৎচন্দ্রের, বিভূতির, মানিকের পর কমল কুমার মজুমদার বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর সাহিত্য ভাষা- এসব কিন্তু একদিনে আসেনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই এই ভাষার প্রবণতা ও প্রবাহ পরিবর্তিত হয়েছে। তাহলে ভাষার গুণ কী হাওয়া দরকার? অথবা কেউ বলতেই পারেন ভাষার প্রয়োগ কী হাওয়া দরকার?-এগুলোর পেছনে যেমন যুক্তি আছে তেমনই আবার বিপক্ষ যুক্তিও আছে অনেক। একদিকের চিন্তকরা যেমন মনে করেন সাহিত্যের ভাষা বিশুদ্ধ হাওয়া খুবই দরকার। অন্যদিকে অনেকে ভাবেন না সমকালীন ভাষায় সেই সময়কার সাহিত্য সৃষ্টি বা লেখা বা প্রয়োগ খুবই জরুরি। তানাহলে যদি এই মতের পক্ষেই যুক্তি রাখি তাহলে বলব, আজকের সময়ে লিখিত কোনো উপন্যাসের ভাষা যদি বিদ্যাসাগরী বা হুতোমীভাষা হয় তাহলে সেই সাহিত্য পাঠকহীন হয়ে পড়বে। তাই সমসাময়িক ভাষার ব্যবহারই মনে হয় বিধিসম্মত। কিন্তু এখনকার ক্ষেত্রে এই ভাষার মাধুর্য বা সৌন্দর্য পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আমরা ছোট ছোট লেখায় বা সাহিত্যে বা সিনেমায় অকথ্য ভাষার প্রয়োগ দেখি। ফলত কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই ভাষা প্রকাশ্যে গ্রহণ যোগ্যতা হারাচ্ছে।
এখন দুটো দিক আমাদের ভাবতে হবে। আমরা কোন ভাষা ব্যবহার করব আর কোন ভাষা বর্জন করব। এই সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে বলতে যে ভাষায় আমরা কথা বলি, কাজ করি অর্থাৎ একটি বৃহত্তর পরিসরে যে ভাষাকে নিয়ে নানা জায়গায় নানা ভাষায় নানা ভাবে মানুষ প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন, সেই ভাষা তাঁর মাতৃভাষা বা কথ্যভাষা হতেই পারে, কিন্তু সেটা সাহিত্য ভাষা নয়। একটি বিরাট গোষ্ঠীর বৃহত্তর অঞ্চলের যেই স্থান বা অঞ্চল সেই দেশের প্রাণকেন্দ্র বা শিল্পনগরী বা বাণিজ্যিক শহর, সেই শহরের ভাষায় সাধারণত সেই দেশের বা রাজ্যের বা অঞ্চলের প্রধান বা মুখ্য ভাষা হিসেবেই গ্রহণ হয়। সেখানে বিভিন্ন প্রান্তিক গ্রাম ও অঞ্চল থেকে আসা দৈনিক মানুষের ভাষা, কতিপয় অঞ্চলের এক আঞ্চলিক ভাষা প্রভৃতি। সুতরাং এখন ভাষা বাহক বা ভাষা ব্যবহারকারী আগে তাঁকে সেই প্রধান শহরের ভাষা, সেইখানে ব্যবহৃত সাহিত্য ভাষা, সেইখানের সংস্কৃতিতে বা কথায় বা সঙ্গীতে অথবা বিরাট একটা কর্ম জীবনের ভাষা বুঝতে জানত হবেই হবে।
সমকালীন ভাষার ব্যবহার নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের বা দেশের নাগরিক সমাজ ও সভ্যতার ব্যবহৃত ভাষা ব্যবহারের ওপর। কিন্তু প্রথমেই যেহেতু বলেছিলাম, ভাষার বিপন্নতা অবশ্যই অবশ্যম্ভাবী - এর বড় কারণ আজকের ইন্টারনেটযুগীয় ব্যবস্থা। তাই যদি একটি আলোচনায় বা আমাদের সকাল থেকে বাইরে বেরিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত যে আমরা শুধুমাত্র মৌনতা বা একাগ্রতা নিয়ে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলি বা মাতৃবুলি আওড়ায় তা কিন্তু নয়। নিজের প্রান্তিক শহরের স্টেশন থেকে বৃহত্তর কোনো নাগরিক সভ্যতায় সতেরো তলা কর্পোরেট বিল্ডিং এর ওপরে একটা কোম্পানির সারা কাজকর্ম সামলাতে যে শুধুমাত্র একক ভাবেই নিজ মাতৃভাষার প্রয়োগ হবে তেমনটা একদমই নয়। আর এভাবেই আজকের দ্বিবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কোনো ভাষার ক্ষেত্রেই বিপন্নতা আটকানো সম্ভবপর নয়। কালের নিয়মে সকল ভাষাসমূহের বিপন্নতা অবশ্যম্ভাবী।