দোঁহা

ভাষার আত্মীয়তা না আত্মীয়ের দখলদারি?

 


ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
 
ভাষার বিপন্নতার রূপ পাল্টে যেতে থাকে বারবার, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিপন্নতার কারণ বদলে যায়, হয়তো বা একাধিক বিপন্নতার মধ্যে তীব্রতার উঁচু নীচ ভেদাভেদ থাকে। এতসব কিছুর মাঝে শুধু বিপন্নতার অস্তিত্বটা বেঁচে থাকে। বাংলা ভাষা আজকের হিন্দি বা ইংরেজি ভাষার যে আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার রূপও আগের থেকে অনেকাংশেই বদলে গিয়েছে। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে পঞ্চাশের দশকে যেভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিকল্পিত পথে বাংলা ভাষাকে পিষে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, সেই একই প্রচেষ্টা এখনো হয়ে চলেছে। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে শাষণতান্ত্রিক ও আইনতান্ত্রিক পথে বাংলা ভাষার উপর খাড়া নেমে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এদেশে। কিন্তু, গত পঞ্চাশ বছরে নব্য-উদারবাদের আগমন, ভার্চুয়াল মিডিয়ার উত্থান, দেশীয় রাজনীতির পালাবদল এসব হাজারো কারণের জন্য ভাষাগত আগ্রাসন বাস্তবায়িত করার বহু নতুন পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। মাথায় বন্দুক ঠেকানো ছাড়াও মানুষকে ভয় পাওয়ানোর বা দাবিয়ে রাখার অসংখ্য কৌশল বিক্রি হচ্ছে এখন বাজারে। সেইরকমই একটি উপায় হল বাঙালিরই মনে ইনজেকশনের মতো বাংলা-বিদ্বেষের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া। 

সেই কাজখানা প্রবলভাবেই হয়ে চলেছে বাংলা ভাষার মধ্যে নীরবে অন্য ভাষার ঢুকে পড়ার মাধ্যমে। ইংরেজি বা হিন্দি ভাষার শব্দ, গঠনশৈলী, প্রয়োগের ধরণ বেখাপ্পা ভাবে সেঁধিয়ে যাচ্ছে বাংলার মধ্যে। এই সেঁধিয়ে যাওয়াটা বাংলা ভাষী নন এমন মানুষেরা করছেন, এসব কল্পনা করে মিথ্যা প্রবোধ পাওয়ার কোনো মানেই হয়না। আমরা বাংলায় কথা বলা মানুষেরাই আমাদের রোজকার কথার মধ্যে দিয়ে অন্য ভাষাকে সূচ হয়ে ঢুকে চেপে বসার সুযোগ করে দিচ্ছি। ফলত যে বাংলা ভাষার রং-রূপ পাল্টে যাচ্ছে, তার থেকেও বড়ো চিন্তার বিষয় হল সে অন্য কারোর নকল করে অন্যের মতো হওয়ার জন্য নিজেকে বদলাচ্ছে। 
 
আর ঠিক এইখানেই মূল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। একটা ভাষা কোনো স্থাবর অস্তিত্ব নয়। সে যুগের সাথে সাথে, বিবিধ পরিচয়ের মানুষের হাতে পড়ে, অন্যান্য ভাষার প্রভাবে, অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে নিজের রূপ পাল্টে ফেলবে সেটাই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষার মধ্যে ফারসি থেকে শুরু করে আরবি, উর্দুর আসা যাওয়া বহুকাল ধরেই এই ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ঠিক এইখানটাই আমাদের এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।  ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে শেষ হয় দুই ভাষার ও সংস্কৃতির কাছাকাছি আসা আর ঠিক কোথা থেকে শুরু হয় একটি ভাষার উপর অন্য একটি ভাষার জুলুম!
 
আজকাল দেখা যাচ্ছে, একটাই বাক্যের কিছুটা বাংলায় বলে বাকিটুকু অন্য ভাষায় বলার প্রবণতা। নাগাড়ে কথা বলা হতে থাকলে বারবার দুই বা তিনটে ভাষার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকার অভ্যাসও যথেষ্ট নজরে পড়ে। প্রশ্ন হল অতীতে যেভাবে বাংলার রূপ বদলেছে চর্যাপদের বাংলা থেকে নবজাগরণের বাংলায়, রাবীন্দ্রিক বাংলা থেকে ষাটের বাংলায়, উচ্চবিত্তের বাংলা থেকে দলিতের বাংলায়; অধুনা যেসব পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, সেগুলোকেও কী ওই একই বিভাগের অংশ বলে দেখতে হবে? নাকি বুঝতে হবে যে বাংলা ভাষী জনগোষ্ঠী আসলে এই ভাষাটির সঙ্গে সংযোগ হারাচ্ছে, আর তাই-ই অন্য ভাষার দাপাদাপির রূপে প্রকাশিত হচ্ছে? 

দ্বন্দ্বের আরেকটি অক্ষে দাঁড়িয়ে রয়েছে উদারীকরণের আদর্শ এবং ভাষার বহুতার ধারণা। একটি ভাষার শরীরে একাধিক ভাষা বাস করে। সেই একাধিক ভাষার মধ্যে যেমন নিম্নবর্গীয় ভাষার জায়গা আছে, তেমনই নিম্নবিত্তের ভাষার জায়গা আছে; যেমন মফস্বলের ভাষার জায়গা আছে, তেমনই হাজারো উপভাষার জায়গাও আছে। কোনোরকম পরিশীলিত, একরৈখিক বাংলার এককাট্টা মূর্তি তৈরী করে, তার সঙ্গে অমিল পেলেই 'গেল গেল' রব তোলার মধ্যে একটা নিজেকে কেন্দ্রে বসানোর মানসিকতা কাজ করে থাকে। একটা ভাষাকে যেমন তার বিভিন্ন রূপের প্রতি সহনশীল হতে হয়, তেমন-ই অন্য ভাষার প্রভাবে পাল্টে যাওয়ার প্রতিও খোলা মন ধরে থাকতে হয়। 

আজকের যে খিচুড়ি ভাষা আমরা শুনতে পাই, তাও বাংলা ভাষার বহুতার একটা অংশ এবং কোনো বিশেষ বাংলাকে স্ট্যান্ডার্ড বানিয়ে নিয়ে, সেই খিচুড়ি ভাষাকে দাবানোর চেষ্টা করাটাও এক প্রকার সঙ্কীর্ণ মনের পরিচয় দেয়। তাছাড়া যে জনগোষ্ঠীর মানুষরা বা যে ব্যক্তি মানুষেরা বিশুদ্ধ বাংলা বলেন না, তাদের বাংলাকে ডাস্টবিনে ফেলারও অধিকারও কারোর নেই | 

কিন্তু এই ভাষাগত দরকারি উদারতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে বিপদের বীজ। মনে প্রশ্ন জাগে, এই পরিবর্তন কী বাংলার স্বাভাবিক পরিবর্তন নাকি অন্য কোনো এক বৃহত্তর ভাষাগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ হয় ওঠার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা? এই অবচেতন থেকে উঠে আসা খিচুড়ি ভাষার আড়ালে আসলে কী নিজের ভাষার সঙ্গে শিক্ষার্থী পর্যায় থেকে যথেষ্ট পরিচয় না থাকার বাস্তব রূপ লুকিয়ে রয়েছে? কোথাও কী এদেশের আঞ্চলিক ভাষা বলে হীনমন্যতা কাজ করছে? নাকি বাংলা ভাষাটা নিজের পরিচয়ের একটা অংশ বলে ভাবতেই চাইছেন না কেও যার ফলে তার প্রতি টান তৈরী হচ্ছে না? 

যদি আমরা ধরেও নিয়ে যে এই পরিবর্তন বা নতুন ধরণের ভাষার ব্যবহার সার্বিকভাবেই দুই বা একাধিক ভাষার মধ্যে স্বাভাবিক আদান প্রদানের ফসল, তাহলে প্রশ্ন ওঠে বাংলা ভাষা থেকে হিন্দি ভাষা কতটা কী গ্রহন করছে? সারা ভারতে যে ভারতীয় ইংরেজী ভাষা বলা হয়, সেই ভাষা বাংলার মতো আঞ্চলিক ভাষা দ্বারা আদৌ কতটা প্রভাবিত? ভাষার স্বভাবগত আদান প্রদানে হিন্দি বা ইংরেজি ভাষার গঠনশৈলী, ব্যবহার, ইত্যাদি কতটা পাল্টেছে বাংলার সংস্পর্শে এসে? 

আসলে আইনগত বা শাসনতান্ত্রিক আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে যে জমি দখলের লড়াই ঘটে না, সেই লড়াই চলে অত্যন্ত সূক্ষ, চোখে এড়িয়ে যাওয়া, নিত্যদিনের ঘটনার মধ্যে। উদার অর্থনীতির প্রভাব যত বাড়বে, সহজ আদান প্রদানের উপায় যতটা বিকশিত হবে এবং ভিন্ন সংস্কৃতির কাছে আসার সুযোগ যত বাড়বে, ততই বিস্তৃত হবে এই দ্বন্দ্বের পরিচয়। মিশ্র সংস্কৃতি আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যেকার লাইনটা বড়োই সুক্ষ। এই দ্বিমুখী সমস্যার মধ্যে দিয়ে কী উপায়ে বেরিয়ে আসা যায়, তার উপর অনেকাংশে নিভর করবে আজকের বাংলার বিপন্নতা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন