রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়
সেদিনই তিনি লিখতে শুরু করলেন…
এমন একটি বাক্য দিয়ে শুরু হওয়া প্রতিবেদনের ঢাল বুঝতে হলে অনুভবের তরল গড়িয়ে দিতে হয়, দেখা যাক কোনদিকে যায়, কতখানি যায়…কিছুতেই শেকল থেকে বেরোতে না পারা এ অবরুদ্ধ চেতনার কাছে সবকিছু গচ্ছিত রেখে নিশ্চিন্ত থাকার ভাণ করতে হয়…কান্না পেয়েছিল সেদিন…বোকার মত? হয়ত…
নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে নিতে শেখা সেই পর্বের অমোঘে কেঁপে উঠেছিল অন্দরদালান...তিরতিরে বালিকা বয়স! মা যে কতকিছু বুঝিয়েছিল! সেই মুহূর্তে খারাপ লেগেছিল ভোরবেলা ফুল তুলতে যেতে নিষেধাজ্ঞার কারণে। বাবন ডাকতে এসেছিল। মা ওকে বলে দিয়েছিল-বান্টি কদিন ফুল তুলতে যাবেনা রে, ওর শরীর ভালো নেই। আমার শরীর খারাপ হয়েছিল কি? হ্যাঁ সাঙ্ঘাতিক পেট ব্যাথা করেছিল। গা গুলিয়ে উঠেছিল। কেন বুঝতে পারিনি বলে ভয় পেয়েছিলাম। অথচ মা নির্বিকার। ছোটকাকীকে বলতে শুনেছিলাম-বান্টিটাও বড় হয়ে গেল, দিদি। আস্তে আস্তে সেই চিরন্তন চক্রে অঙ্গাঙ্গী হয়ে যাওয়া, যেভাবে এতদিন ধরে চলেছে তাবৎ মেয়েরা। সময়ের গোলক গড়াতে গড়াতে ক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকার এই অর্জন থেকে কি পেলাম। একেবারেই যে কিছু পেলাম না, এও ঠিক নয়। আমি বিস্তারিত হয়েছি, বিভক্ত হয়েছি, বিন্যস্ত হয়েছি সংসারময়। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি।
লালসা-লালায়িত নয়, তবু মানুষটাকে জানাতে তো হয়ই, কোন একদিন জানতে পেরে বলতেই পারে – “আমাকে বলনি তো! কোন সমস্যা নেই তো? ডক্টরের কাছে একবার ঘুরে এসো। আচ্ছা আমিই নিয়ে যাবো নাহয়। শুনেছি এসময় অনেকরকম ট্রমা আসে। দিলখুশ হয়ে থেকো।“ কিংবা “ও তাই নাকি! এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেলে!” কিংবা “মানে আর কিছু করা যাবেনা, তাই তো?” কিংবা “দিন ফুরলো অস্তাচলের ঘাটে…(এরপরই একটা গভীর চুমু দিয়ে) – কই! একইরকম স্বাদ তো!” ইত্যাদি…
কিছুদিন আগেই দেখা পল্লবী যোশীর Painful Pride-মুভির কথা মনে পড়ছে। পূজা ভাটেরও একটা ওয়েবসিরিজ আছে না? Bombay Begum! এসব ভাবতে ভাবতে বিমর্ষ হয়ে পড়ার মুহূর্তকে গুঁড়ো করে নেহার কল ঢোকে। “কি হয়েছে রে? তোর ভয়েসটা অন্যরকম শোনাচ্ছে!” “নাঃ কিছু না, বল, কি খবর?” “আচ্ছা তোর কি এখনও পিরিয়ড হচ্ছে?” চুপ করে থাকার সংবেদ নেহাকে উত্তর যোগায়। পাগলী আনন্দে চীৎকার করে বলে – ওয়েলকাম ডিয়ার টু দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ‘উই, আওয়ার্স ওন'! আমি, দীপিকা, পৌলমী, রীনা, সুস্মিতা সবাই এই ক্লাবের মেম্বার হয়ে গেছি। তুই বাকী ছিলি। ওয়াও! এবার আমরা নিজেদের জন্য নিজেরা বাঁচব। এগ্রি?” প্রকান্ড একটা ইতিবাচক ঢেউ এসে আলাদা করে নিয়ে যাচ্ছে আমার চেনা দুনিয়া থেকে, ভয় পেয়ে চীৎকার করতে গিয়ে দেখি উল্লাসে টগবগ করছে আমারই ভেতর থেকে কে যেন! একটা কল ঢোকে, বেচারা হাজব্যান্ড! “আমার আজ ফিরতে একটু দেরী হবে।” “আমারও।” “মানে, কোথায় যাবে তুমি?” “আমি তো তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি? করেছি কি?” ঠিক এতখানির জন্য প্রস্তুত ছিলনা বোধহয়। চমকে গিয়ে বলল, “ইটস ওকে।” যদিও শেষে হাসির ছোঁয়া স্পষ্ট বুঝতে অসুবিধে হলনা।
বাড়ি ফিরে দেখি আমার আগেই ফিরেছে। নিজেই চা বানিয়ে নিয়ে টিভির সামনে।
“ঘুমিয়ে পড়েছো?” একথার উত্তর না দিয়ে গভীর ঘুমের ভান করে পড়ে থাকাটিকে পরে কখনো আদর করে দেওয়া যাবে। বেশ অনেকক্ষণ পর যখন একটা ডায়েরী নিয়ে লিখতে বসলাম, গলগল করে কলমের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে শব্দরা…ওরা এতদিন ছিল কোথায়! কেনই বা চুপ করে ছিল অন্দরদালানে! ওরা কি জানত একদিন সময় হবে ওদের নিয়ে বসার! ওরা কি জানে! সত্যি যখন ঘুমের রেণু ভরে উঠছে চেতনার অবতলে, তখন একটি চেনা স্পর্শে ভিড় করে আসে অচিন সংশয়। যা ছিল এতদিনের অধিকার, আজ কেন তাকে অনুমতির অপেক্ষা করতে হবে! সম্পর্কে এই দ্বিধা ঘনিয়ে আসা কিসের ইঙ্গিত বয়ে আনে! ঘুম কখনো সাঁকো তুলে নেয় পারাপারের। সে এক দৈব আসঙ্গ। সে এক নিরন্তর পালকে পালকে ছেয়ে যাওয়া ছোট্ট আকাশ। আকাশ মানেই তো আর অবিরাম উড়ানের নয়!
একদিন ওদের সামনে লেখাটা পড়লাম। তার কিছুক্ষণ পরই বিকেল নেমে আসবে কোলকাতার আকাশরেখা জুড়ে। আলোর মত অন্ধকারে ঢেকে যাবে সারাদিনের যাবতীয় হৈচৈ, অথৈ অব্ধি গিয়ে ফিরে আসতে হয় ভেবে মনখারাপ হয়ে পড়বে। সুস্মিতা একটা আইডিয়া দিল। এই লেখাটা একটা নামী পত্রিকায় পাঠাতে হবে। আমার ইতস্তত ভাবকে পাত্তা না দিয়েই ওরা ডেয়ারিং হয়ে উঠল। পাঠানো হয়ে গেল। আমাদের জীবন থেকে ফিসফিস চলে গেছে। সবটাই সোচ্চার ও সোমত্ত। এ এক অন্যরকম রূপকথার ভেতর দিয়ে চলেছি সকলে। দুপাশে লাল নীল গাছ, গাছে গাছে রঙীন পাখিরা, তাদের কাকলিতে নেমে আসে আনন্দের অধ্যবসায়। সময় কেটে যাচ্ছে হু হু করে।
বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। ভুলেও গেছি সেই লেখাটার কথা। হঠাৎ একদিন পত্রিকা দপ্তর থেকে কল করে জানালো লেখাটি সিলেক্টেড হয়েছে। শুধু একটা সেল্ফ ডিক্লারেশন দিতে হবে – এ আমারই লেখা। আমি লিখলাম এ আমার লেখা নয়, আমার মত সব মেয়েদের লেখা, তারপর ‘মেয়েদের’ কেটে ‘নারীদের’ লিখলাম, তারপর ‘নারীদের’ কেটে ‘মানুষের’ লিখে লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালোলাগল। মেয়ে থেকে মানুষ হয়ে উঠতে প্রায় পঞ্চাশ বসন্ত লেগে গেল।
“অপূর্ব হয়েছে লেখাটা। আরও লেখো।"
মনে হল আমার সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাকে মিথ্যে করে দিল এই যে পুরুষ, সে-ই তো আমার পরম, আমার প্রার্থিত। নেহাদের এসব জানানোর প্রয়োজন নেই। তাছাড়া এই বিপ্লব আমাকে খুশী করেছিল কিনা জানিনা! আমি কি কখনো জানতে চেয়েছি আমার কাছে? কেন আমি নিজেকে প্রশ্ন করিনি? মনে পড়ে গেল সেই কবে পড়া একটা কবিতার লাইন – “আমার সমস্ত গোপন শর্তে তোমার ছায়া!” আড়চোখে দেখলাম আয়না আমার দিকে তাকিয়ে আছে আলতো হাসি হাসি মুখ করে!