সহেলী মিশ্র
‘মেনোপজ’ শব্দটার সাথে আজ আমরা হয়তো অনেকেই পরিচিত। কিন্তু কতখানি ভালো করে পরিচিত? রজঃস্রাবের মতোই নিঃশব্দে আসে ‘মেনোপজ’। আবার নিঃশব্দে বয়ে চলে যায়। পেছনে রেখে যায় শুধু একরাশ শরীরী ক্লান্তি, মানসিক চাপ, হতাশা, গ্লানি। যা আমাদের বারবার ভাবায়। কিন্তু এই ভাবনার কোন ভাষা নেই। আমরা আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও পিরিয়ডসের কথা, মেনোপজের কথা খোলাখুলি বলতে পারিনা। সমাজ বড্ড ভয় দেখায়। আমরা ভয় পাই। তবুও ঋতুমতী হওয়ার সাথে জড়িয়ে থাকে নব যৌবনের উদ্দামতা। থাকে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। কিন্তু ঋতুবন্ধ হওয়ার সাথে সাথে সমাজের কাছে নারীর দর পরে যায় এক-লহমায়। ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে ঋতুস্রাব পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাকেই মেনোপজ বলি। ভারতবর্ষ ছাড়াও আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ডের মত উন্নত দেশগুলিতেও মেনোপজ নিয়ে ছুঁতমার্গ রয়েই গেছে। একথা প্রমাণিত এখনও অধিকাংশ মহিলা তার এই অবস্থার কথা নিজের স্বামীকে পর্যন্ত জানাতে ইতঃস্তত বোধ করেন। ডাক্তার দেখানোর প্রসঙ্গই ওঠে না। ‘এই তো বেশ চলছে। এসব তো স্বাভাবিক। এর জন্য ডাক্তার-বদ্যির প্রয়োজন নেই’ এমন ভাবনা তো আমাদের সহজাত। ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার মুহূর্ত থেকে কেউ যেন কানে কানে বলে যায়, ‘এসব তোমার গোপন কথা। কাউকে জানতে দিতে নেই।’ আমি তবু মেয়েদের বলতে শুনেছি, ‘আমার পিরিয়ড হয়েছে।’ কিন্তু বিশ্বাস করুন, কোনোদিন কেউ বলেনা, ‘ আমার মেনোপজ শুরু হয়েছে বা আমি এটার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।’ সংসার-কর্মক্ষেত্র সবকিছু সামলে যখন জীবনে থিতু হওয়ার সময় আসে, ঠিক তখনই থাবা বসায় মেনোপজ। অনিদ্রা, খিটখিটে-মনোভাব, উচ্চ-রক্তচাপ মেনোপজের দোসর। সাথে তৈরি হয় অস্তিত্বশীলতার আশঙ্কা। মেনোপজ অস্টিওপোরোসিসের মত রোগ বয়ে নিয়ে আসে। এর প্রাথমিক উপসর্গ না থাকলেও খুব অল্প আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। এর ফলে কুঁজো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ব্যাস, এতটুকুই? মেনোপজকে শরীরে বন্দী করে আমরা দাঁড়ি টেনে দিই। আর মন? মনের খবর কজন রাখে? ঠিক যখন সঙ্গীর আকর্ষণ হারানোর আশঙ্কা একটু একটু করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে, সেইসময় ভেসে আসে কিছু উপদেশ– ‘এমা, কি মুটিয়ে গেছিস রে। একটু জিমে যা। এভাবে বাড়তে থাকলে তো দুদিন পর বেলুন হয়ে যাবি।’ খুব অবাক লাগে জানেন, কারণ সচরাচর এই কথাগুলো সমবয়সী মহিলাদের থেকেই শুনতে হয়। নিজেরাই যদি নিজেদের অবস্থা নিয়ে সচেতন না হতে পারি, তবে অন্যকে সচেতন করার অসম্ভব চেষ্টা না করাই উচিত। আর কিছু না হোক, মেনোপজ বিষয়ক নূন্যতম কাউন্সিলিংটুকু করানো যেতেই পারে। কিন্তু কর্তব্য, কর্মব্যস্ততা, ঊর্ধ্বশ্বাস-দিনযাপন এই সবকিছুর মাঝে আর ওসব নিয়ে ভাবার সময় কই? এমনই কোনো নিস্তেজ দিনে মেনোপজ এসে জানান দেয়, ‘সময় ফুরাল’। না ছুঁড়ি না বুড়ি অবস্থা। সময় বয়ে যায়। কিন্তু সময়ের দাগ রয়ে যায়। একসময় তো অপ্রাপ্তি আসে। এসে হানা দেয় বারবার মনের দরজায়। এই স্বল্প-জীবনে অপ্রাপ্তিটুকু নিয়ে কেন বাঁচব বলুন তো? দশ বছর বয়স থেকে সঙ্গী যে স্যানিটারি ন্যাপকিন, এক মুহূর্তের মধ্যে তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। শুধুই কি শরীরে প্রভাব পড়ে? মন ক্ষত-বিক্ষত হয় না? তবে কি সত্যিই মেনোপজের আগমন এবং বুড়িয়ে যাওয়া একে অপরের সমার্থক? না। তা আমরা ভাবব না। সময়কে মনে ধরতে না পারলে তার দাম কোথায়? সংসারের জাঁতাকলের চাপে একটু একটু করে অভ্যস্ত হতে হতে, ভালোটা নিজে না খেয়ে ছেলে-মেয়ে ও বরের পাতে দিনের পর দিন তুলে দিতে দিতে আমরা মেয়েরা কোথাও যেন নিজেদের সুখটুকু কুলুঙ্গিতে অবহেলায় তুলে রাখি। প্রতি মাসের নির্ধারিত চার দিনের রক্তস্রাব আর সেভাবে প্রভাব ফেলে না জীবনে। একইভাবে রজঃনিবৃত্তি হলেও আমরা তা নিয়ে বেশি মাতামাতি করতে পারিনা। মেনোপজ মাসিকের সমাপ্তি ঘোষণা করতে পারলেও জীবনকে থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তবে এবার একটু নিজের জন্য ভাবুন। নিজে ভাল না থেকে কি অন্যদের ভাল রাখা যায়? মেনোপজ দিনগত পাপক্ষয়ের প্রাথমিক লক্ষণ নয়। বরং আরেকবার নতুন করে নিজেকে চিনে নেওয়ার সুযোগ দেয়। যে কাজগুলো করা হয়নি যৌবনে, সেগুলো আর একবার শুরু করার চেষ্টা তো করাই যায়। গল্পে বুড়ি কুঁজো হয়ে গেছিল সে কথা তো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বাস্তবে তা হতে দিলে চলবে না। এবার আলোচনা হোক খোলাখুলি। নিজেদের সমস্যাগুলো বুঝতে হবে। সমাধানের চেষ্টা প্রথমে নিজেকেই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমি যদি আমার পাশে না দাঁড়াতে পারি তাহলে অন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। মেনোপজের অভিশাপের ট্যাবু কে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে রুখতে হবে স্থবিরতা। একদিন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে চিৎকার করার পর বাকি তিনশ চৌষট্টি দিন চুপিচুপি ফিসফাস করলে সব চেষ্টা মাঠেই মারা যাবে। তবে একদিনে তো সব বদলে ফেলা যাবেনা। এতদিনের সঞ্চিত সংস্কার যা আমাদের মনের স্তরে শুকনো রক্তবিন্দুর মত জমে জমে প্রাচীর তৈরি করেছে, তাকে ভাঙতে সময় লাগবেই। তবে হাল যখন ধরেছি তা ছাড়লে চলবে না। মেনোপজ সৌন্দর্যের শেষ নয়। মেনোপজ সম্ভাবনার শেষ নয়। মেনোপজ সময়ের শেষ নয়। মেনোপজ নতুন করে উপলব্ধির সেই স্তর যেখানে দাঁড়ালে জীবনকে নতুন করে উপভোগ করা যায়। নিজেকে নিয়ে আরও একবার ভাবা যায়। আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, মেনোপজের অভিশপ্ত উপাখ্যান ধুয়ে-মুছে সাফ করবই। এ লড়াই চালিয়ে যাব…