দোঁহা

মেনোপজ (ঋতুঅবসান): কিছু ভাবনা, কিছু প্রশ্ন


 
অঙ্গনা

একজন ব্যক্তি যে শরীরে স্ত্রী-প্রজননতন্ত্র নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে অর্থাৎ সাধারণ ভাষায় যাকে আমরা জন্মসূত্রে নারী বলে থাকি এবং দৈহিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বয়ঃসন্ধিকালে যার মাসিক ঋতুচক্র শুরু হয় তার
ক্ষেত্রে মেনোপজ বা ঋতুজরা অনিবার্য একটি ঘটনা। নারীর ঋতুচক্র যেহেতু সরাসরি প্রজনন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত তাই সমাজের চোখে ঋতুদর্শন এবং
ঋতুঅবসান এই দুই ঘটনারই বিশেষ গুরুত্ব আছে। ঋতুচক্রের সঙ্গে যৌনতার
বিষয়টিও সম্পৃক্ত। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা নারীর যৌনতা— যৌনচাহিদা,
যৌনক্ষমতা ঋতুচক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত এই অর্থে যে নারীর
প্রজননক্ষমতা আর যৌনতা বা যৌনক্ষমতা সমার্থক বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ
যতদিন কোনও মেয়ে রজঃস্বলা হয়, যতদিন সে ঋতুমতী হয় ততদিন তার
প্রজননক্ষমতা থাকে তার মানে ততদিনই তার যৌনক্ষমতা থাকে। মেনোপজ বা ঋতুঅবসান ঘটে গেলে আর নারীর যৌনজীবন বলে কিছু থাকে না।

প্রজননকেন্দ্রিক
যৌনতার ধামাধারি সমাজের পক্ষে এই ধারণা পোষণ করা এবং প্রচার করা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে বাস্তব সেরকম নয়। ঋতুজরাগ্রস্ত নারীর
যৌনচাহিদা শেষ হয়ে যায় না, যৌনজীবনেও যবনিকা পতন ঘটেনা। শরীরে হরমোনের
পরিবর্তনের ফলে তার যৌনজীবন হুবহু আগের মত না থাকতে পারে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে মেনোপজ মানে নারীর যৌনজীবনের ইতি। একবিংশ শতকে নারীর যৌনঅধিকার স্বীকৃতি লাভের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা ধীরে ধীরে বদলানোর সময় এসেছে।

এখনও আমাদের সমাজ প্রধানত প্রজননকেন্দ্রিক। এই সমাজে যৌনসম্পর্ক বা
যৌনক্রিয়া বলতে আজও প্রধানত বিষমকাম অর্থাৎ বিপরীত যৌন/লিঙ্গ-পরিচয়
বহনকারী ব্যক্তিদের মধ্যেকার যৌনসম্পর্ক বোঝায় এবং সেই যৌনসম্পর্কে
অবশ্যই পুরুষ থাকে কেন্দ্রে। অন্যভাবে বললে, এই যৌনতার কাঠামোয়
যৌনক্রিয়া বলতে নারী পুরুষের সঙ্গম অর্থাৎ পুরুষের লিঙ্গ নারীর যোনিতে
প্রবেশকে বোঝানো হয়। সঙ্গমই যৌনসহবাস এবং চরম সুখানুভূতির আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত। এই ভাষ্য অনুসারে, নিজের যোনিতে পুরুষের লিঙ্গ ধারণ করাতেই
নারীর স্বর্গসুখ। তাই ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে যৌনতা উপভোগ্য কিনা অর্থাৎ
ওই সময়ে পুরুষ সঙ্গম করলে যৌনসুখ ভোগ করতে পারে কিনা তা নিয়ে চলে নানা
জল্পনা। নারীর ঋতুচক্রের  সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে পুরুষের যৌনসুখ বা যৌনতা উপভোগ করার বিষয়টি। গর্ভধারণ এড়িয়ে যৌনতা উপভোগ করতে হলে
পুরুষকে হয় কনডম ব্যবহার করতে হয় নয়ত নারী সঙ্গীর ঋতুচক্রের অন্তর্গত গর্ভধারণের ন্যূনতম সম্ভাবনাময় দিনগুলোর (সেফ পিরিয়ডের) জন্যে অপেক্ষা
করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীকেই গর্ভনিরোধক কোনও উপায় গ্রহণ করতে হয় গর্ভধারণ এড়ানোর জন্যে। যার অর্থ, পুরুষের প্রজননবর্জিত যৌনসুখের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নারীকেই নিতে হয়। কিন্তু নারীর স্বতন্ত্র যৌনতার স্বীকৃতি এখনও সাধারণ্যে গৃহীত নয়; যৌনতার ভাষ্য এখনও
আবর্তিত হয় পুরুষের যৌনতাকে কেন্দ্র করে। মেনোপজের ফলস্বরূপ নারীর যোনি কতখানি পুরুষের লিঙ্গ প্রবেশের উপযুক্ত থাকে তার নিরিখে যৌনজীবনের,
যৌনসুখের মূল্যায়ন চলতে থাকে। নারীর যোনিপথ পিচ্ছিল রাখার উপযোগী নানা ওষুধ, মলম, জেল ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়, বাজারে সুলভ হয়। পুরুষকে চরম
যৌনসুখ দিতে পারা যেখানে নারীর যৌনজীবনের সার্থকতা সেখানে তো এসব কিছুই অতি স্বাভাবিক। আজকের ‘জাগ্রত' নারী নিজেই যোনি পিচ্ছিলকারী মলম-জেল কেনে এবং ব্যবহার করে।

এতো গেল সমাজের কথা। সমাজের অনুশাসনকে আপন করে নেওয়া ব্যক্তি— সে পুরুষ
হোক বা নারী— তাদের কথা। কিন্তু নারীর যৌনস্বাধীনতার আস্বাদ কি পাওয়া যায় তাতে? মেনোপজ বিষয়ে আজও অনেক মহিলার মুখে শোনা যায় এই উচ্চারণঃ
“ওসব জ্বালা চুকেবুকে গেছে”। অনেক মেয়ে/মহিলার কাছেই মাসিক ঋতুচক্র একটা বোঝা, প্রতিবন্ধকতা। মাসের ওই কয়েকটা দিন বাড়তি এক উৎপাতের মতোই। কারণ ঋতুচক্রের সঙ্গে যুক্ত নানা সামাজিক বিধিনিষেধ ছাড়াও অনেককেই ভোগ করতে
হয় অনেক রকম শারীরিক ক্লেশ, অস্বস্তি। ঋতুস্রাবের দিনগুলো ছাড়াও পিরিয়ড শুরু হবার ৭-১০ দিন আগে থেকে চলতে থাকে পিএমএস (pre-menstrual syndrome) জনিত বিভিন্ন শারীরিক-মানসিক উপসর্গ। এই সমস্ত কিছু থেকে রেহাই
পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হয় মেনোপজের। কিন্তু জৈবিক নিয়মে যে বয়সে
একজন নারীর ঋতুঅবসান ঘটে ততদিনে পার হয়ে যায় তার জীবনের অর্ধেকের বেশি
সময়। অনেক ক্ষেত্রে কোনও  স্ত্রী-রোগের চিকিৎসায় হিসটেরেকটমি করা হলে
নির্ধারিত বয়সের আগেই ঋতুচক্রের অবসান ঘটে, বন্ধ হয় রজঃস্রাব জনিত
রক্তপাত। কাজেই দেখা যাচ্ছে, মেনোপজ বা ঋতুঅবসান ঘটানোর দিনক্ষণ নির্ধারণ
করার উপায় আজকের পৃথিবীতে মানুষের করায়ত্ত, ঋতুজরা আজ মানুষের
নিয়ন্ত্রণাধীন— পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর নয় ।

এই অর্থে মেনোপজ দু’রকম একথা বলা যেতেই পারে— প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক আর
কৃত্রিম বা স্বেচ্ছাকৃত। প্রকৃতির নিয়মে ঘটা ঋতুজরা যদি হয় অমোঘ তাহলে কৃত্রিম মেনোপজ কেন ‘কাঙ্ক্ষিত’ বলে বিবেচিত হতে পারে না? ঋতুঅবসানে যদি নারী রেহাই পায় যন্ত্রণা, কষ্ট থেকে, আলগা হয় যদি তার পায়ের বেড়ি তাহলে স্বেচ্ছায় ঋতুজরাকে বরণ করার অধিকার নারী দাবি করতেই পারে। তাতে নারীর যৌনস্বাধীনতা অর্জন করার যাত্রায় এক ধাপ এগোনো যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে প্রখ্যাত অস্ট্রেলীয় নারীবাদী জারমেইন গ্রিয়ার-এর কথা। ২০১৯ সালের ৮ মার্চ 'দ্য হিন্দু' পত্রিকায় প্রকাশিত এক
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “I say, let’s stop menstruation. Let’s get rid of all this blood. We can’t afford it.”

এই প্রস্তাব পেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শোনা যাবে নানা আশঙ্কার কথা-হিসটেরেকটমি হলে নারীর শরীরে এবং মনে ঘটতে পারে নানা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যা ক্ষতিকারক হতে পারে। বেশ তো। তাহলে বিজ্ঞান
গবেষণা করুক যাতে সেই সব হানিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থেকে নারীর শরীর ও মনকে মুক্ত রাখা যায়। নারীর নিজস্ব চাহিদার কথা মাথায় রেখে এবার থেকে হোক না কিছু গবেষণা। নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা আজ সব সমাজেই তো সমাদৃত আদর্শ!

কিন্তু মনে রাখতে হবে, নারীর যৌনস্বাধীনতার দাবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন— নারীর দেহের ওপর, তার জরায়ুর ওপর অধিকার বিষয়ক প্রশ্ন, সে প্রজনন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক কিনা অর্থাৎ সন্তানের জন্ম দিতে চায় কিনা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন, নারীর স্বেচ্ছায় মেনোপজ বা ঋতুচক্রের অবসানের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্ন। এই প্রত্যেকটি প্রশ্ন প্রজননকেন্দ্রিক সমাজের কাছে খুবই বিব্রতকর। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা যতই আজকাল উচ্চ কণ্ঠে ঘোষিত হোক না কেন প্রজনন ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজের হাত
থেকে নারীর হাতে ছেড়ে দিতে কোনও সমাজই এখনও প্রস্তুত নয়। এক্ষেত্রে
প্রজাতি সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে নানা সংশয়বাদ মাথা তুলবে। গর্ভপাতের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে নেমে নারীরা তা ইতিমধ্যে ভাল ভাবেই টের পেয়েছেন। নারীরা প্রজাতি সংরক্ষণ করতে অনাগ্রহী বা সোজা বাংলায় ‘বংশবৃদ্ধি’র বিরোধী, এমনটা ধরে নেবার নেপথ্যে কাজ করে কেমন মানসিকতা সেটাও গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। সেই আত্ম-সমীক্ষার ফলে প্রজননকেন্দ্রিক সমাজের
অমূলক ভয় এবং আশঙ্কা কমতে পারে। একমাত্র তাহলেই সমাজ নারীর ওপর, নারীর নিজস্ব বিচার-বিবেচনার ওপর আস্থা রাখতে পারবে, নারীর সিদ্ধান্তকে সম্মান
জানাতে পারবে এবং নারীর সর্বাত্মক স্বাধীনতাকে স্বীকার করতে পারবে নির্দ্বিধায়, নিশ্চিন্তে।

2 মন্তব্যসমূহ

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব স্পষ্ট ভাষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তুলে ধরেছেন আপনি। একজন নারীর নিজের দেহের যে এজেন্সী হারিয়ে ফেলেন সমাজ এবং রাজনীতির টানাপোড়েনের মাঝে ; এবং সেই এজেন্সী ফিরে পাওয়া যে কতটা গুরুত্তপূর্ণ এবং কঠিন !

    উত্তরমুছুন
নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন