সুনির্মল বসু
বেলা পড়ে এলো, পশ্চিম আকাশ লালে লাল, নদীর জলে ঢেউ লেগেছে রক্তিম আভার। তখন হেমন্ত দিন, পাতা ঝরার কাল।
দেবদারু বন ছাড়িয়ে দোলনচাঁপার ফুল বীথি অতিক্রম করে ছাতিম ফুলের গন্ধ মাখানো বনপথে তুমি একলা চলেছিলে।
বাতাসে বনফুলের গন্ধ, পলাশ রঙে ভরা আকাশ,
পথে হল দেখা, আমিও তখন একা।
দিন শেষের গোধূলির আলো এসে পড়েছে তোমার মুখে, এমন সুন্দর রাতের জোসনা ভেজা মুখ আমি জীবনে দেখিনি,
কারো মুখে কোন কথা নেই।
সবুজ অরণ্যে সবটুকু আলো নিয়ে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে,
বললাম, তোমায় এত চেনা লাগছে কেন?
তাই নাকি?
যেন বহু দিনের চেনা, যেন কত জন্মের পরিচয়!
হয় মশাই, কখনো কখনো এমন হয়।
তোমার আকাশী রঙের শাড়ির আঁচল তখন বাতাসে উড়ছিল।
কাউকে খুঁজতে বেরিয়েছো?
ভালোবাসার মানুষ। কবে থেকে আমি একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ, ভালোবাসার মানুষ খুঁজছি।
ও, তাই বুঝি!
হ্যাঁতো।
আমি একজন ব্যর্থ মানুষ। আমার পায়ের তলায় জমি নেই।
কেন?
সাত বছর আগে নীলাঞ্জনা আমায় একলা ফেলে চলে গেছে।
যে চলে যাবার, সে তো থাকবে বলে আসেনি, একদিন ঠিক সে চলে যায়। ভালোবাসা থাকলে,
কেউ চলে যেতে পারে না।
আমি বুঝতে পারিনি।
সে ঠকেছে, তুমি নও। সে ভালোবাসার মর্ম বোঝেনি।
সেই থেকে আমি একা। আমার একলা ঘর। একটিমাত্র বারান্দা। একমাত্র আলো ছিল সে।
তোমার কোনো বন্ধু নেই?
গাছপালা রোদ্দুর, সূর্য তোরণ, আকাশের চাঁদ, সমুদ্রের ঢেউ, দুঃখী মানুষ আমার বন্ধু।
তুমি আমার পরিচয় জানবে না?
কে তুমি? আমার জীবনে, এমন অবেলায়?
আমি স্বপ্ন কুমারী। এই পৃথিবীর কেউ নই।
তোমার বাড়ি কোথায়?
আলোকবর্ষের ওপারে।
কি করে এলে?
পাহাড় ডিঙিয়ে ঝর্না পেরিয়ে।
কেন এলে?
মেঘ আনতে, পৃথিবীতে বৃষ্টি প্রয়োজন।
নীলাঞ্জনা আমার পৃথিবীটাকে মরুভূমি করে দিয়ে গেছে।
জানি তো। তুমি আমার সঙ্গে থাকো। আমার কাছে ভালোবাসার আলো পাবে।
সত্যি বলছো?
আমি কখনো মিথ্যা বলি না।
জানো, আমাকে কেউ কোনদিন ভালোবাসেনি, শুধু আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করেছে।
বোকা কোথাকার! ভালোবাসা দেবার, ভালোবাসা নেবার শক্তি সবার থাকে না।
কী সহজ করে তুমি জীবনকে বোঝো, আমি বুঝিনা।
আমার সঙ্গে থাকো। এমনিতেই সব বুঝতে পারবে।
আমাকে কেউ কখনো শেখায়নি, আমার ভুলগুলো কেউ ধরিয়ে দেয়নি।
জীবন শিখিয়ে দেবে।
তোমার সঙ্গে আমার আগে দেখা হয়নি কেন?
সময় হয়নি, তাই।
সবার জন্য সময় হয়, শুধু আমার জন্য সময় হয় না। এমন বৈষম্য কেন?
তোমার পরীক্ষা চলছিল।
কে পরীক্ষা নিচ্ছিলেন?
তিনি।
কে তিনি?
যিনি সবার মাথার উপর আকাশে থাকেন।
বুঝেছি। ঈশ্বর।
আকাশের মতো খোলা মন তাঁর, সমুদ্রের মতো বিশাল হৃদয়,
বুঝেছি, এখন জীবনের কি মানে হয়। কিন্তু এতদিন তুমি কোথায় ছিলে?
দূরে ছিলাম, কাছে এলাম।
তোমার সঙ্গে আমার আগে দেখা হয়নি কেন?
তাঁর ইচ্ছে। তোমার কান্না যেদিন তাঁর কাছে পৌঁছলো, তারপর আমি তোমার কাছে এলাম।
কেন এলে?
আলো জ্বালবো বলে। যেখানে আলো নেই, সেখানে আমি আলো জ্বালাতে আসি।
ক্ষমা করো, আমি কারো করুণা চাই না।
করুণা নয়, ভালোবাসা।
তুমি আমাকে ভালোবাসো?
বাসি তো!
আমি ভাবতেই পারছি না।
সবাই নীলাঞ্জনা নয়।
মানে?
আমার কাছে এসো, এত ভালবাসা পাবে, তুমি বেরোতেই পারবে না।
তুমি কী আগের জন্মে আমার জীবনে ছিলে?
ছিলাম তো। অন্যরূপে, অন্য সম্পর্কে, অন্য পরিচয়ে।
তাহলে স্বীকার করছো, একটা সম্পর্ক ছিল।
ছিলই তো।
সে আমার কপালে হাত রাখলো।
আমার শরীর জুড়ে শিহরণ! কী হল?
আমার সব মনে পড়ে যাচ্ছে।
কী মনে পড়ছে?
খিলান গম্বুজ ওয়ালা বিশাল প্রাসাদ, ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়ছে, তুমি ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে, নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আমি, তুমি আমায় দেখে হাসলে, ইশারায় ডাকলে, কাছে এসো।
সেই তো আমি তোমার কাছে এলাম।
সে হাসলো। যে হাসিতে আমি পাগল হয়ে যাই।
তুমি আমার সঙ্গে থাকো। আমাকে ছেড়ে যেও না।
উতলা হয়ো না।
মনে করবার চেষ্টা করো।
মনে পড়ছে, দুর্গা মন্ডপে প্রজারা দুর্গা ঠাকুর নিয়ে এলো। দর দালানে আলপনা দেওয়া হয়েছে। কত মানুষ। সামনে দীঘির জলে ভোরের আলো, বাতাসে জলের ঢেউ তিরতিরে ছায়াছবির মতো কাঁপছে। সামনে মাটির রাস্তা। আম গাছের নিচে হলুদ বনের ভেতর থেকে তুমি এগিয়ে আসছো।
এবার বুঝেছো, তোমার কত কাছাকাছি বরাবর আমি।
তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। তাহলে আমি বাঁচবো না। তোমাকে আমার চাই, চাই, চাই।
আমি তো তোমার সঙ্গে সব সময় আছি।
কখন দেখা পাবো? কখন আসবে?
প্রতি রাতে, যখন চাঁদ তোমার প্রথম জানালা ছেড়ে দ্বিতীয় জানালায় যাবে, তখন আমি তোমার কাছে আসবো।
আমাকে ভালবাসবে?
বাসবো তো!
আকাশ থেকে তখন জোসনা বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত্রির তৃতীয় যাম। দূর আকাশে চাঁদ। আকাশে ঘুম ঘুম তারারা।
আজ আসি।
তুমি কি আমার চোখের জল মুছে দেবে বলে এসেছিলে?
তোমাকে বিশ্বাস ফিরিয়ে দেবো বলে এসেছিলাম। বলতে এসেছিলাম, একমাত্র এই গ্রহেই ভালোবাসা আছে। নীলাঞ্জনাকে ভুলে যাও। ভালোবাসাকে খোঁজো।
আমি তোমার ভালোবাসা পেয়েছি। এই ভালোবাসা ফুলের রেনুর মতো পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেবো। কাল রাতে আবার এসো।
সে আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো।
বলল, ভালো থেকো।
ভোররাতে তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে আমি তাঁর মায়াময় শাড়ির আঁচল বাতাসে মিলিয়ে যেতে দেখলাম।
এবার কিন্তু আমার মনে হারিয়ে যাবার ভয়টুকু থাকলো না।