দোঁহা

শরীরে হেমন্ত,জীবনে নয়

 


সুমি দত্তগুপ্ত

নারী ও তো প্রকৃতি, তাই তার জীবনেও পাতা ঝরার মরশুম আসে। কিন্তু সেই পাতা ঝরার হেমন্ত ঋতুকে নিজের জীবনে মেনে নিতে অনেক দ্বিধা, সংশয়, একাকীত্ব থাকে। আমি কি তবে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলাম, শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে গেলাম, আমার কাউন্টার পার্ট কি তবে অন্য প্রেমে আসক্ত হবে? কিছুদিন আগে পর্যন্ত এইরকম নানা ট্যাবু মেনোপজ কে নিয়ে মেয়েদের মনে প্রশ্ন তুলত।  তাই পেরি-মেনোপজাল পর্যায় থেকেই তাদের মনে আশঙ্কা দানা বাঁধত।

আর্থ সামাজিক কারণে বেশির ভাগ মেয়েরাই যখন  কর্মসূত্রে বাইরে বেরোতে শুরু করলো, নিজের প্রতি নজর দেওয়া কিংবা শরীরটাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল, তখন থেকেই মেনোপজ হয়ে উঠলো আর পাঁচটা জৈব শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মতোই একটি প্রক্রিয়া মাত্র। যা জীবনে আসবে এবং তাকে তার মতো করেই মেনে নিয়ে জীবন একটা উৎসব, কারাগার নয় একথা মনে রেখে চলা শুরু হল।

মেয়েদের ঋতুমতী হওয়াও যে উৎসব তা আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ শিখিয়েছে। ঋতুমতী হওয়ার পর আত্মীয়,স্বজন বন্ধু,বান্ধবকে নিয়ে হলদি স্নান Manjal Nirati Viza তামিলনাড়ু তে, Half saree function কেরালায়, Peddamanishi Pandaga অন্ধ্র প্রদেশে, ঋতু কলা সংস্কার কর্নাটকে,আর  tuloni biya আসামে প্রচলিত আছে। নববস্ত্র, অলঙ্কার, নারকেল পাতার অলঙ্কার পরিয়ে একেবারে বিবাহের সাজে তাকে সজ্জিত করা হয়। এই উৎসব অনুষ্ঠানের পর সাধারণত তাকে পাঁচদিন একটি ঘরে বন্দী রাখা হয়। উত্তর ভারতের মেয়েদের এইসময় রান্না ঘরে যাওয়ার অনুমতি নেই। গৃহদেবতাকে পূজা দেওয়ার ও অধিকার নেই। তাহলে এই নিয়ে কিছু যখন রাখ-ঢাক থাকলো না, তখন ঋতু বন্ধ হওয়ার উৎসব নাই বা থাকুক, তার নিজেকে আলাদা ভাবার ও তো কিছুই থাকে না। তাই ব্যাপারটা নিয়ে লুকোছাপারও কোনোও দরকার থাকে না।

আমরা এখন জানি, হঠাৎ করে কারও হট ফ্ল্যাশ হলে, দরদর করে অকারণে ঘামতে শুরু করলে, চট করে মেজাজের পরিবর্তন হলে, শান্ত স্বভাবের মেয়েটি হঠাৎ করে লোকের প্রতি মেজাজ হারালে, আমরা বুঝতে পারি, ওর কাঁধে পাশে আছির হাতের স্পর্শে বোঝাই। তাই জন্যই তো ১৮ই অক্টোবর দিনটি আন্তর্জাতিক মেনোপোজ দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যাতে মানুষটি নিজেকে একা না ভাবেন, একটু মনোযোগ, সহযোগিতা, ভালোবাসা পান। তার জীবনে আসা হেমন্তের আগমনে একটুও বিচলিত না হয়ে নতুন ছন্দে, নতুন আঙ্গিকে চলার পথকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন ।

এ তো গেল প্রথাবদ্ধ মেনোপজের কথা। কিন্তু জীবনে যাদের শারীরিক কারণে কৃত্রিম ভাবে মেনোপজ করাতে বাধ্য হন, ডাক্তারবাবুরা? এইবার আসি সে কথায়, যা আমার ব্যক্তিগত কথা।

বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরে স্বাভাবিক নিয়মে বাচ্চা হতে গিয়ে, হয়ে গেল ectopic pregnancy। গেল একটা ফ্যালোপিয়ান টিউব বাদ ।ডাক্তার আমার বাবা, আর হাসব্যান্ডকে বলেছিলেন, বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা আর প্রায় নেই। কিন্তু ওকে বলবেন না। ঠিক এই ঘটনার এক বছরের মধ্যেই আমি স্বাভাবিক ভাবে কনসিভ করলাম। সুস্থ,স্বাভাবিক সন্তান হওয়ার কয়েকবছর পরেই শুরু হল, আমার মাসে অনিয়মিত ঋতুস্রাব আর অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। চললো চিকিৎসা, হরমোনাল ড্রাগ শুধু আমার ওজন বাড়াতে শুরু করলো, ওষুধ বন্ধ করলেই আবার একই অবস্থা। হল endometreiosis অপারেশন। লাভ কিছুই হল না।

হঠাৎ একটি বহুল প্রচারিত মেয়েদের পত্রিকায় দেখলাম, একজন ডাক্তারবাবু বিলেত থেকে ফিরে Apollo হাসপাতালে বেলুন ইউটেরাইন সার্জারি করছেন এই অস্বাভাবিক রক্তক্ষয় থেকে মুক্তির জন্য। অন্যান্য ডাক্তারবাবুরা কেউ তখন আমার অল্প বয়েস, আর একটা বাচ্চার কারণে ইউটেরাস বাদ দিতে চাইছেন না। কিন্তু হরমোনাল ড্রাগ খেয়েও কোনও উপশম না হওয়াতে আমি বীতশ্রদ্ধ। হিমোগ্লোবিন আমার তখন 4। আমার স্বাভাবিক জীবন তখন নাজেহাল। সেই সময় আমি ওই ডাক্তারবাবুর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি আমায় বললেন আপনাকে আমি মিরেনা insert করবো আর একটি ইনজেকশন দেব যা আপনার ইউটেরাস, ওভারির কার্যকারিতা নষ্ট করে দেবে। বেলুনের মাধ্যমে ইনজেকশনটি যাবে, কোনও কাটা, ছেঁড়ার গল্প নেই। হলেও কিছু আপত্তি ছিল না। আমার নিজের জীবন তখন নিজের কাছে দুর্বিষহ। আর হিমোগ্লোবিন পার্সেন্টেজ এতো কম হওয়ায় আমার মাথা সবসময় ঘুরত, হাঁফ ধরে যেত, তলপেটে ব্যথা, আর ক্লট। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমি ওর কথায় রাজী হয়ে গেলাম। কলকাতায় তখন এই চিকিৎসা একেবারে নতুন, আমার বয়স তখন ৩৭। উনি আমাকে ভাবনা চিন্তা করতে বললেন। আর বললেন, আমাদের দুজনের স্বামী, স্ত্রীর সাথে তিনি দুটি সাইকোলজিক্যাল counselling এ বসতে চান। আমরা রাজি হয়ে গেলাম।

ঝুঁকি ছিল একটাই - আমাদের ব্যাপারটা পুরোপুরি অজানা ছিল। ডাক্তারবাবু বললেন, আপনার জীবন আগে, এটা ভাবুন। আপনাদের যৌথ জীবনে কোনো আঁচ পড়বে না। শুধু বন্ধ হয়ে যাবে  menstrual cycle। আপনার হিমোগ্লোবিন বাড়বে। তাই হল। একদিনের মধ্যে সব হয়ে গেল। তবে এরপরে উনি আমাকে হরমোন থেরাপি নিতে বলেছিলেন, কিন্তু তখন আমি থাইরয়েডের রোগী। আমাদের বাড়ির যারা বিদেশে আছেন চিকিৎসক হিসেবে, তারা আমাকে বারণ করায়, সেটা আমি নিই নি।আমি কোনো অসুবিধা ভোগ করিনি বললে ভুল হবে। এরপরই আমার হাই ব্লাডপ্রেসার হল। ৩৮ বছর বয়সে দুই চোখেই cataract হল। যেটা ডাক্তাররা বললেন, quite abnormal। কোনও ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আর সব দিক দিয়ে আপাতত ভালো আছি। অনেক বছর তো হল,ওই সংক্রান্ত অসুবিধা আর হয় নি।

এখন তো আমরা অনেক সচেতন, মেনোপজ যতটা না শারীরিক, বেশিটাই মানসিক। কাজে, বিশেষত নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলে। আপনি ভালো থাকবেন,পাশের মানুষগুলোকেও ভালো রাখতে পারবেন।

ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার, সুস্থ জীবন শৈলী, শরীরচর্চা, নিজের জন্য সময় দেওয়া,পরিবারের সাথে ভালো সময় কাটানো, নিজের হবিকে প্রাধান্য দেওয়া, ইচ্ছেগুলোকে ডানা মেলতে দেওয়া, ছুটিতে বেরিয়ে পড়া, সব মিলিয়ে একটা সুস্থ,সুন্দর জীবন চর্যা আমাদের মানসিক সুস্থতার ইঙ্গিত দেয়, ক্লেশ কমায়,একা হতে দেয় না। আমি শেষ হয়ে গেলাম, আমার নারী জীবন শেষ হয়ে গেল এই ভ্রান্ত অনুভব থেকে মুক্তি দেয়। জীবনের না পারা, প্রতিবন্ধকতাকে বড়ো করে না দেখে, আমি পারি, পারবো এটাকেই মূল উপজীব্য করলে অনেক ভালো বোধহয় থাকা যায়।

বিশেষত যারা একা জীবন বেছে নিয়েছেন, বা বাধ্য হয়েছেন, জীবনের এই পর্যায়ে তাদের একাকীত্ব বেশি, তাই তাদের নিজেদের সৃষ্টিশীল কাজে মনোযোগী হওয়া,স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া,মনের প্রতি যত্নশীল হওয়া, টুক করে বেরিয়ে পড়া, বন্ধু ও স্বজনবর্গের সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটানো, নিজের শখগুলোকে যাপনের অঙ্গ করে তোলা নিজের জন্যই খুব প্রয়োজন। বিষন্নতা, একাকীত্ব নয়, হেসে উঠুক জীবন,কারণ সে যে বড়ই সুন্দর, সে জীবন যতই হোক না কেন ফড়িঙের, দোয়েলের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন