দোঁহা

মেনোপজ : লজ্জা নয়; বিবর্তনের অধ্যায়, যা জানতে হবে নারীকে

 


 তসমিনা খাতুন বুল্টি

প্রকৃতির নিয়মে একজন মানুষ কৈশোর যৌবন পার করে বার্ধক্যে উপনীত হয় এই চিরাচরিত নিয়ম। ঠিক একই রকম একজন নারী কৈশোর যৌবন পার হওয়ার যে সময় অর্থাৎ যৌবন ও বার্ধক্যের যে সন্ধিলগ্নের যে কাল নারী জীবনের একটা এক্স ফ্যাক্টর কাজ করে। 

একটু বিস্তারিত ভিন্নভাবে বিষয়টা যদি বলা হয় তা হলো - একটা সময় ছিলো যখন দাদিমা, পিসিমা, জ্যেঠিমাদের মুখে 'মাসিক' এর কথা কেউ বাড়ির ছোটো বাচ্ছাদের সামনে উচ্চারণ করতো না, দেখা যেত কত চুপিসারে কত কায়দা করেই বাড়ির ৭-৮ বছরের বালিকা থেকে ওনারা বিষয়টি লুকিয়েছে। বিশেষ করে জন্মসূত্রে যেহেতু আমি মুসলমান বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছি দেখতাম রমজান মাস চলাকালীন বাড়ির পিসিমা বড়মা রোজা রাখত না কিছুদিন তা প্রশ্নকরলে তার উত্তর কিন্তু  যথাযথ পেতাম না, ঠিক একই রকম আমার ব্রাহ্মণ বান্ধবী যখন তার মাকে গাজন বা শিবরাত্রি উপবাস করতেন না কেন এই প্রশ্ন রাখলে তার মায়ের কাছে সেও যথাযথ উত্তর পেতো না। যে ঘটনা দুটো বললাম তা আজ থেকে ১৭-১৮ বছর আগের, তাই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তির খাতিরে স্বাভাবিক বলা যায়, কারণ তখনও মানুষ যান্ত্রিকতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে বা হাতের নাগালে পেতে বহুযোজন দূরে ছিলো।

কিন্তু অস্বাভাবিকতা দানা বাঁধে এই একবিংশ শতাব্দীতে যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে দাঁড়িয়ে একজন নারীর অগোচরে যখন থেকে যায় সমস্যা সমাধান সচেতনতা সম্পর্কিত বিষয় যা নারীর জানা প্রয়োজন তা হল মেনোপজ বিষয়টি।

মেনোপজ হলো একজন মহিলার "মাসিক" স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। মেনোপজ ক্লাইম্যাক্টেরিক নামেও পরিচিত।  মেনোপজ হলো নারীর প্রজনন ক্ষমতার সমাপ্তি অধ্যায়। ডাক্তারের মত অনুসারে  ৪৫-৫৫ বছরের মধ্যে একজন নারীর মেনোপজ হয়ে থাকে।

তবে দেখা যায় একজন মহিলার মেনোপজের আগের বছরগুলিতে  'মাসিক'  অনিয়মিত হতে শুরু করে। মেনোপজের সময় বা কিছু আগে থেকেই একজন মহিলা নানারকম শারীরিক অসুবিধায় পতিত হন। যেমন গরমভাব অনুভব করা,  কাঁপুনি,  রাতে ঘাম, ঘুমের সমস্যা,  মেজাজের পরিবর্তন এছাড়াও উপসর্গের মধ্যে আছে যোনিপথের শুষ্কতা।

 The Daily star বাংলা সাক্ষাৎকারে ডা. রাশিদা বেগম বলেন - "মেয়েদের যখন প্রথম মাসিক শুরু হয় তখন সেটাকে বলে মেনার্কি আর যখন শেষ হয়ে যায় তখন সেটাকে বলা হয় মেনোপজ।  সাধারণত ১৩ বছর বয়সে একটি মেয়ের মাসিক শুরু হয় আর ৫১ বছর বয়সে তা শেষ হয়ে যায়।"

মেনোপজের মানসিক প্রভাব নিয়ে তিনি আরও বলেন - "অনেকে মেনোপজ মেনে নিতে পারেন না। বিশেষ করে যাদের তাড়াতাড়ি মেনোপজ হয়। সাধারণত ৪৫ বছর বয়স থেকে মেনোপজ হলেও অনেকেরক্ষেত্রে ৪০এর পরেই মেনোপজ হয়ে যায়। সে কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন অনেকে। যাদের সন্তান নেই বিশেষকরে সেই নারীদের ওপর মারাত্মক মানসিক প্রভাব পড়তে দেখা যায়।  কারো কারো ক্ষেত্রে ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস হয়, সে কারনে যৌন জীবনে প্রভাব পড়ে।"

আধুনিক যুগে বাস করলেও এখনও গ্রাম্য অঞ্চলে বা শহর অধ্যুষিত এলাকায় দেখা যায় অনেক নারীই আছেন যারা এই সব নিয়ে কথা বলতে সংকুচিত হন।

আমাদের ভাবতে হবে পরিস্থিতি স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এমন কেন?  একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে জন্মের মধ্যে দিয়ে মানুষ বংশ, জাতি,  মর্যাদা,  স্বদেশ সব লাভ করতে পারে।  কিন্তু কোনো মানুষ শিক্ষা তখনই লাভ করতে পারে যখন আমাদের রাষ্ট্র  সে শিক্ষা দেয় এবং দেশের মানুষই সে ব্যবস্থা সমস্ত জনগনের কাছে পৌঁছে দেয়।

সেজন্য দেখা যায় এখনো কোনো অঞ্চলে নারীরা তাদের শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন নয়, যেহেতু  তাদের জানার পরিধি সেই শিক্ষার আলোকে পৌঁছাতে পারেনি।

তাই সে নারীরা কখনো সে জীবন পদ্ধতিকে জানার চেষ্টা করেনি। কোনো নির্দিষ্ট দিন তারা নিজেদের পছন্দের তালিকায় রাখেনি।  বলা চলে সে অনুযায়ী নারী তার জীবনপথে চলার আকাঙ্খাও কোনোদিন পোষণ করেনি।

মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব তাই আমাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে নারীকে পূর্ন সচেতনভাবে গড়ে তোলা, একজন মেয়ে কৈশোর থেকে শুরু করে বার্ধক্যে কীভাবে সে নিজেকে নিয়ে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সুস্থ থাকবে।

তাই যান্ত্রিক রঙিন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দাঁড়িয়ে আমাদের উচিত মেনোপজ নিয়ে কোনো নারী সংগঠন NGO  যুক্ত হয়ে সমস্যা সমাধান সম্পর্কিত বিষয় প্রচার করা। বিশেষ করে যারা এখনো শিক্ষার আলোকে পৌঁছাতে পারছে না,  বা কম বেশি পৌঁছালেও তাদেরকে জানান দিতে হবে মেনোপজ কী, কখন হয়, কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এরকম সচেতনতা আনতে পারলে নারী তার শারীরিক বিষয়ের সঙ্গে মানসিকস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হয়ে থাকবে।

এই রকম  প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে কোনো কোনো  অঞ্চল ধরে প্রতিবছর যদি কোনো সংগঠন সরকারি সহায়তায় কোনো ক্যাম্প অনুষ্ঠিত করতে পারে অধ্যুষিত এলাকা গুলিতে তাহলে একজন নারী সচেতন হতে পারলে একটি পরিবারও শস্য শ্যামলা সুজলা সুফলাং হয়ে বংশ পরম্পরায় সুস্থ সামাজিক ভাবে এই পৃথিবীর বুকে ছাপ রেখে যাবে এবং আমরা সেই দিনরই আশা করি  সাহিত্যক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বন্দেমাতরম ' গানের একটি লাইন দিয়ে তা বলি...

 বন্দে মাতরম্             
সুজলাং সুফলাং               মলয়জশীতলাম
 শস্যশ্যামলাং মাতরম্।

পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষ কোনো না কোনো ভাবে রক্ষণাবেক্ষণের আওতা থেকে মুক্ত নয় এবং সে কোনো পরিমন্ডলের মধ্যে থেকে রক্ষকের দায়িত্ব লাভ করেছে, নারী সে দিক থেকে হলো গৃহের রক্ষক  এবং পুরুষ সন্তান - সন্ততির রক্ষক। তো সেইদিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পুরুষ তার নারীর শারীরিক ও মানসিকস্বাস্থ্যের খেয়াল রাখলে তবেই এই সমস্যার সমাধান একদিন বাস্তবায়িতহবে সম্পূর্ণ ভাবে,  একজন মহিলার পাশাপাশি একজন পুরুষকেও সেই সচেতনতা অবলম্বনের আওতায় আনতে পারলে তবেই পৃথিবী হবে সুন্দর।  


তাই শেষে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য - এর কথায় বলি...

"এই বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি।"





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন