দোঁহা

মেনোপজ

 


মৌমন মিত্র 

''ইন্টুমিন্টু চিঠি লিখতে যখন থার্ডক্লাস সব উপমা দিয়ে তখন কাকে অস্বীকার করতে? তোমার মেনোপজকে?'' ব্রাত্য বসুর 'মুখোমুখি বসিবার' নাটকে সন্দীপ স্ত্রী তিস্তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কথাটা বলেছিল, মনে পড়ে? কিংবা  'পারমিতার একদিন' ছায়াছবির পারমিতা তার স্বামীকে শাশুড়ির মেনোপজের কথা বলতেই উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারের ছেলে কেমন চমকে যায়। মায়ের সম্পর্কে এই ধরণের কথা শুনতে চায় না।

নারীজীবনের শারীরিক, মানসিক চরম সত্য মেনোপজ। এ এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত। অথচ যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বের এই গুরুত্বপূর্ণ চৌকাঠ সম্পর্কে আজও অনেকেই অসহিষ্ণু, অজ্ঞ। ফলে মহিলাদের জীবনে মেনোপজ হয়ে যায় অবচেতন মনের এক অন্যতম ক্রাইসিস। 

একটা বয়সের পর মহিলাদের ওভারির ভিতর ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে যায়, মেন্সট্রুয়েশন বন্ধ হয়ে যায়। ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন হরমোন নিঃসরণও বন্ধ হয়। যখন তখন হট ফ্লাশ, রাতে অত্যাধিক ঘেমে যাওয়া, ক্লান্তি, চিড়চিড়ে মেজাজ, অনিয়মিত পিরিয়ড, ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস সবই মেনোপজের লক্ষণ। এই ধরণের উপসর্গ দীর্ঘদিন চলতে থাকলে শরীর ও মনে প্রভাব পড়ে। 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে শারীরিক এই জেন্ডার-এজিজমের জন্য ওয়ার্কপ্লেসেও প্রভাব পড়ে। যোগ্যতা থাকা সত্বেও অনেক মেয়ে এই কারণে ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পড়ছে। কর্ম জীবনে তৈরি হয় অবসাদ। এ ছাড়া সন্তান এতদিনে বড় হয়ে গিয়েছে। ফলে তাদের জীবনেও মায়ের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন কমতে থাকে। অনেকক্ষেত্রেই সন্তান কলেজ কিংবা চাকরি সূত্রে অন্য শহরে চলে গিয়েছে। বিদেশে প্রতিষ্ঠিত অথবা বিবাহিত। তখন মনের মধ্যে বাসা বাঁধে একধরনের নিঃসঙ্গতাবোধ। নিজের অজান্তেই তৈরি হয় 'এম্পটি নেস্ট সিন্ড্রোম '। খাওয়াদাওয়া, সাজপোশাক, জীবনের দৈনন্দিন কাজগুলো একঘেয়ে মনে হয়। ইরিটেশন জন্ম নেয় মনের গভীরে। এ সময়ে নিজেকে অসহায়, অযাচিত, বিষাদগ্রস্ত, মনে হতে থাকে ক্রমশ। সবটাই মেনোপজাল সিনড্রোম। 

তাই বলে নিজেকে অনাকাঙ্খিত ভেবে ডিপ্রেশনে ভুগবেন না। এই সময় মন ভাল থাকাটা খুবই জরুরি। নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া শখ, হবি, ইচ্ছেগুলোয় মন দিন। দেখবেন মনের মেনোপজ জনিত মিক্সড ফিলিং অনেকটাই পজিটিভ ভাবনায় পরিণত হবে। এখনই তো সঠিক সময়। জীবনে 'স্পেস' তৈরি করে নিন। সেলাই, গার্ডেনিং, নাচ, গান, নাটক আরও অনেক ধরণের হবি থাকে যৌবনে। পড়াশুনো, চাকরি, সংসার করতে করতে মেয়েরা ভুলে যায় সেইসব। সেই ইচ্ছেগুলোকে পুনরায় জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন। 

মিড লাইফে পরিবারের সদস্যরা মুখ ফিরিয়ে নিলে জীবন অন্যরকম হয়ে যায়। মনের ভিতর উথাপাতাল হতে থাকে। মনে হয়, এদের জন্য জীবনের শখ, হবি স্যাক্রিফাইস করেছিলাম? অনেক মহিলাদের এ সমস্ত বুঝতে সময় লেগে যায়। বাড়িতে স্বামীরাও মনের এই নতুন ফেজকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে চায় না। তখন প্রফেশনাল কাউন্সিলিং করতে হয়। 

মেনোপজ হলেই কি যৌন জীবনের ইতি? যৌন জীবন না-থাকলে তাঁর পাশের পুরুষটি তাঁকে ভালবাসবে না? এ সব ভেবে প্রায়ই মন অস্থির হয়ে ওঠে অনেকেরই। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। প্রথমত যেই পুরুষ আপনার যৌন দিকটাই গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন, সে আপনার শরীরকেই কেবল ভালবাসতে পেরেছেন। আপনাকে নয়। সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। কেননা মহিলাদের পরিচয় শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদন এবং পার্টনারকে সেক্সসুয়াল প্লেজার দেওয়া নয়। অযথা ভয় পাবেন না। 

তবে, সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কন্টেন্ট পুরুষদের যৌন ভাবনাকে অনেক প্রগতিশীল করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনার শরীরের হরমোনাল চেঞ্জগুলোকে তাঁরা গুরুত্ব দিতে শিখছেন। 

এটা বোঝা দরকার। আগের আপনিটারও ক্রমশ সময়ের সঙ্গে খানিকটা বদল ঘটতে পারে সেটা এখন সমাজের স্বাভাবিক সত্য হয়ে উঠছে। আপনার থেকে তাঁরা আগের সেই কর্ম দক্ষতা আশা করে না হয়তো। তবে কিছু পরিবারে পুরুষ উদাসীন, আঘাত করে মহিলাদের মানসিকভাবে, তাঁদের বোঝাতে হবে যে, এই সময়টা জীবনের একটা সাময়িক ফেজ। বছর দুই পরই পরিস্থিতি বদলে যায়। পরিবার পাশে থাকলে মহিলারা অনেক বেশি মানসিক দৃঢ়তায় সময়টার সঙ্গে লড়াই করতে পারে। তাই, পরিবারের সমর্থন জরুরি। সম্পর্ক সহজ হয়ে উঠলে দাম্পত্যে প্রভাব পড়ে না। এ ছাড়া পুরুষদের অ্যান্ড্রপজের সময়টা স্ত্রী প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই মেনে নেন। মেয়েদের মানসিক গঠনে প্রথম থেকেই শরীরের চেয়ে মনটাই প্রায়োরিটি পায়। ফলে মহিলাদের কাছে পুরুষ জীবনের প্রৌঢ়ত্ব স্বাভাবিকভাবেই একটা স্বাভাবিক ফেজ। 

ইন্টারন্যাশনাল মেনোপজ গাইডলাইন অনুযায়ী হরমোন রিপলেসমেন্ট মেনোপজের অন্যতম চিকিৎসা। মনের মধ্যে এই চিকিৎসা করানোর ইচ্ছে থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সম্প্রতি এই চিকিৎসা পাঁচ বছরেরও কম সময়ে করা যায়। সঙ্গে এজ অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ডায়েট, এক্সারসাইজ, সঠিক পরিমাণ ঘুম এবং স্ট্রেস কমাতে হবে।  

অনেক মহিলা মেনোপজাল সিনড্রোম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পরিবারের কথায় এইচআরটি চিকিৎসা করাতে চান। হরমোনাল চিকিৎসা সবার শরীরের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই স্বামীরা অযথা চাপ দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে - এটা ভাবতে হবে। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব স্পেস থাকে। সেই স্পেসে তাঁর নিজস্ব কিছু সিদ্ধান্ত থাকে। সেটাই তাঁর স্বকীয়তা। 

ডায়েটে আসি। নানা নিউট্রিশনিস্টদের মতে, মেনোপজাল সময় ফুড হ্যাবিট কিছুটা বদলে যাবে। খাবারের তালিকায় খানিকটা রাশ টানতে হয় ঠিকই। তবে, অত্যধিক রেস্ট্রিকশন না থাকলেও চলে। ডায়েটে রাখুন প্রচুর পরিমাণ সবজি, নানা রঙের ফলমূল, ভাল প্রোটিন। বাড়িতে পাতা দই, কমলালেবু, টফু কিংবা ছানা খেতে পারেন। ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন। খাদ্য তালিকায় ক্যালশিয়াম, আইরন, ভিটামিন-ডি রিচ খাবার রাখুন। সময়মতো শরীরের ভিটামিন, মিনারেল, আইরন চেক করা থাকলে ডাক্তার পরামর্শ দিতে পারবেন আপনার শরীরে পরিমিত পরিমাণ খাবার কতটা প্রয়োজন।

 শাকসবজি, ফল, ডাল, শস্য, লিন মিট  এবং ডেয়ারি – প্রতিটি ফুড গ্রুপ থেকে প্রতিদিন খাবার খেতে পারেন। তার সঙ্গে সঠিক পরিমাণ এক্সসারসাইজ। আর, তার সঙ্গে? 

অনেকটা আদরমাখা জীবন। মানছি জীবনের এই পর্যায় এসে দাম্পত্যে, বন্ধুত্বে একঘেয়েমি আছে, কিন্তু এই একঘেয়েমির মধ্যেও লক্ষ করবেন, থাকে এক ধরণের কমফোর্ট জোন। হয়তো যৌবনের আগুন নেই। আগের মতো সম্পর্কটায় জৌলুস নেই। নেই তো নেই। ক্ষতি কী? 

পুরনো সম্পর্কের আরাম অস্বীকার তো করা যায় না। স্পার্ক ফিরিয়ে আনতে একসঙ্গে রেস্তরাঁয় খেতে যেতে পারেন, একটা সন্ধে নাটক অথবা কোনও প্রদর্শনী দেখে এলেন। সেই আগের মতো। একে অপরের হাতের ওপর হাতটা থাকলে মনে মনে যেন আশ্বাস থাকে, ও রয়েছে আমার পাশে। থাকবেও। এটা ভাবতে পারলেও অনেকখানি সুরাহা সম্ভব। যতই ঝগড়াঝাঁটি, মান-অভিমান থাক না কেন, নিজেদের মধ্যে কেয়ারিং ভাবটা থাকলেই কোনও চিন্তা নেই। 

বিবাহবার্ষিকীর দিনটা ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু দিনের শেষে সে হার্টের ওষুধটা আপনার জন্য আনতে ভোলে না তো? আজ স্পর্শে উত্তেজনা হারিয়ে গেলেও, স্বস্তি রয়ে যাবে চিরটাকাল। সেই তো জীবনের 'একটুকু ছোঁয়া '।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন