“উল্টে দেখি, পাল্টে দেখি
দেশের মাটি খুঁড়ে দেখি —
অনতিকাল পরে শেষ হয়ে যায় গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসব। কালের নিয়মে শেষ হতেই হয়। সব শুরুর-ই তো শেষ থাকে। রোদে-জলে ফিকে হয়ে আসে প্রতীকচিহ্নের ছায়া, শেষ হয়ে যায় হরেক রঙের খেলা। কত কথা, তরজা, শোরগোল সব থিতিয়ে পড়ে সময়ের স্রোতে। রঙ পাল্টে যায় মসনদের। আমার ভিতর বেড়ে-ওঠা কোনও এক মূক কিশোর আজও হরিণের মতো চপল গতিতে, স্থির বিশ্বাসে খুঁজে চলে সেই অলীক ছায়া। যার নাম গণতন্ত্র। অনেকটা রূপকথার মতো শুনতে লাগে। উৎসব শেষ হলে সাধারণ মুখগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়! পড়ে থাকে শুধু একটা তন্ত্র। যে তন্ত্রের গোলকধাঁধায় আমার ভিতর বেড়ে-ওঠা সেই কিশোরের স্বর ক্রমশ মৃয়মাণ হতে হতে মিলিয়ে গেছে। তবু সে মূক কিশোর খুঁজে ফেরে গণতন্ত্রের ছায়া। সে এখন নিঃশব্দে দানা ছড়ায় সেই সব রংবেরঙের পাখিদের, যাদের নাম ছিল ‘প্রতিশ্রুতি’। এতদিনে অবশ্য কিশোরটি অবশ্য জেনে গেছে ভোট ফুরলেই ‘প্রতিশ্রুতি হুস্…’! তবু গণতন্ত্রের সেই অলীক ছায়ায় নিজেকে আপাদমস্তক ভিজিয়ে নেবার দুর্নিবার ইচ্ছা তার। অথচ প্রতিদিন তাকে ছিঁড়ে ফেলে মধ্যবিত্ত জীবনের কাটাকুটি খেলা। মূল্যবৃদ্ধি, কর্মহীনতা আর প্রহসনের ‘ত্রিফলা’। কখনও কখনও সেই রঙিন পাখিদের এই ত্রিফলায় বিঁধতে ইচ্ছা হয় তার। অথবা সুযোগ পেলেই চাওয়া পাওয়াদের বেঁধে নিতে পারে দোতারায়। সে ভাবে – যে ছায়ার পরিধিতে খেলা করত, গেয়ে উঠত প্রতিশ্রুতি, সেই ছায়ায় বসে সেও তো পারত দিন কাটাতে বাউলের মতো সহজ সুরে। ফুলের মতো সহজ ছন্দে ফুটে ওঠার কথা ছিল জীবনের। এই ছায়াহীন বেঁচে থাকা যেন গত জন্মের অভিশাপ ! যে সব চাওয়া-পাওয়া ছিল নিতান্ত সাধারণ, জীবনের অধিকার — অথচ সে সব দাবি এড়াতে পারে না সংঘাত, রক্তবৃষ্টির প্রবল ছাট। রাজনৈতিক অস্থিরতার সর্বগ্রাসী পরিসর। রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং রংয়ের মোহনির্ভর উন্মাদনা প্রতিনিয়ত খেয়ে ফেলে কিশোরের ভাষা, স্বপ্ন এবং অস্তিত্ব। দিন চলে যায় সাদায়-কালোয়। আমার ভিতরে মনের খেয়ালে লালিত মূক কিশোর সেই কল্পিত ছায়াকে উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে। জীবনভর শুধুই কি ফাঁকি? হাওয়ায় কথা মিলিয়ে যাবার মতোই কি ভূখণ্ড থেকে চিরদিনের জন্য মিলিয়ে যাবে বহুকল্পিত সেই গণতন্ত্রের ছায়া? প্রশ্নগুলো আহ্নিকগতির মতো ঘুরপাক খায় আমার মনে। এদিকে দিনের পর মাস, মাসের পর বছর চলে যায়… ফিরে আসে গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসব।
