মিঠুন মুখার্জী
গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের প্রধান অধিকারগুলির মধ্যে একটি হলো ভোটদানের অধিকার। প্রত্যেক আঠারো বছর বয়সী ছেলে ও মেয়ে প্রথম ভোট দেওয়ার অধিকার লাভ করে। পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশের ন্যায় আমাদের ভারতবর্ষেও রয়েছে ভোট দেওয়ার অধিকার। আগেকার দিনে ও এখনকার সময়ে ভোট দানের মধ্যে রয়েছে ঢের পার্থক্য। এখন ভোটদানে নানান দুর্নীতি এবং দুষ্কৃতীরা ভোট দানে নানান বাঁধা দানের চেষ্টা করে। বিরোধী দলের ভোটারদের ভোট তারা ভয় দেখিয়ে নিজেরা দিয়ে দেয়। স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রথম লোকসভার ভোট দানের প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল ২৫শে অক্টোবর ১৯৫১ থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের মধ্যে। সমগ্ৰ ভারতবর্ষে বেশ কয়েকবার ভোট হয়। লোকসভার ভোট, বিধানসভার ভোট, পঞ্চায়েত ভোট। এছাড়া পৌরসভাগুলিতে পৌরসভার ভোট হয়ে থাকে। সমস্ত ভোটদান প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য আছে নিবার্চন কমিশন। ভোটদানের বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে ভোটে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের নমিনেশন গ্ৰহণ, সুষ্ঠু আচরণ বিধি নির্ধারণ, ভোট দানের দিন ও সময় , ভোট গণনা প্রক্রিয়া, পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। ভোট দান এখন ভারতীয়দের কাছে উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া এদেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থণ করে চলে। রাজনৈতিক নেতাদের ভয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করে না তারা। এ যেন 'জমিদার ও বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধের কৃষকদের মতো অবস্থা। যাদের ভোট পেয়ে সকলে নেতা - মন্ত্রী হন তারাই ভোটের পর তাদের চেনেন না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা তো বলেনই না, ভোটের আগে দেওয়া হাজার হাজার প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ দেওয়ার কোনো প্রয়োজনও বোধ করেন না তারা।
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কেন্দ্রের ও রাজ্যের ভোট গুলি আসে। এই পাঁচ বছর কোনো জায়গার বেহাল অবস্থা হলে কিম্বা সাধারণ মানুষের প্রয়োজন হলে দূরবীন দিয়ে সমস্ত সাংসদ, বিধায়ক, পঞ্চায়েত মেম্বার, পৌরসভার কাউন্সিলরদের খোঁজ করতে হয়। এই পাঁচ বছর এরা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন। তাদের লোক দেখানো কিছু কাজ থাকে যেগুলো না করলে পরের বছর সাধারণ মানুষের বাড়ি যেতে পারবেন না। তাই নামমাত্র সেগুলো করে থাকেন। তবে কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা সত্যি সত্যি সাধারণ মানুষদের জন্য আজীবন প্রাণপাত করেন। প্রতি মুহূর্তে মানুষের খবর নেন, আপদে - বিপদে মানুষের পাশে থাকেন। তারা প্রকৃতই সমাজ সেবক। কিছু নেতা আছেন যারা নিজের বাড়ির আপন মানুষ জনদের পাশেই থাকেন না, অথচ ভোটে দাঁড়িয়ে সমাজ সেবা করার জন্য পাগল হয়ে ওঠেন। টিকিট না পেলে কান্না করেন, অভিমান করেন দলের প্রধানদের উপর। আবার কেউ কেউ টিকিট পাওয়াটাকেই বড় করে দেখেন, তারা দলকে ভালোবাসেন না। ভোটের টিকিটের জন্য তারা বারবার দল বদল করতেও দুবার ভাবেন না। যে ভাবে হোক দেশের মানুষের সেবা করতেই হবে।
এখনকার দিনে সমস্ত প্রকার ভোট দান একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয় এই উৎসবে। দেশের সাধারণ মানুষ ঠিক মতো খেতে না পেলেও ভোট করা বন্ধ হয় না। সারাবছর মানুষকে সামান্য টাকা দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভোট কেনার চেষ্টা করে থাকেন। অথচ শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা বছরের পর বছর বেকার। চাকরির দেখা নেই। রাজনৈতিক নেতাদের বউ-ছেলে-মেয়েদের অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা। রাজনীতিতে আসার পাঁচ - দশ বছরের মধ্যে বহুগুণ অর্থ ও সম্পদ বেড়ে যায়। যেহেতু তাদের হাতে ক্ষমতা সেহেতু এদের বলার কেউ নেই। আগেকার দিনে রাজনীতি করে সহজে এত সম্পত্তি হতো না। দীর্ঘদিন রাজনীতি করে কিছুই পান নি এমন মানুষও আছেন।
এখন ভোটের দিন ঘোষণার দিন থেকে সমস্ত রাজনৈতিক দলের ভোট প্রস্তুতি শুরু হয়। দলের কর্মীরা ও নেতারা বাড়ি বাড়ি ক্যাম্পেনিং করতে যায়। এমন ভাব দেখান যে সারাবছর তাদের সমস্ত সুখ-দুঃখের সঙ্গী তারা। ভোটের প্রার্থী ঘোষনার পর প্রার্থীকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি যান কর্মীরা। প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায় শহর থেকে গ্ৰামে। অন্যের নিন্দা করে, একে অপরের দলকে সমালোচনা করে নিজের দল ও নিজেকে সর্বদা এগিয়ে রাখতে চান। তবে সবাই জানেন সব দলের নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভালো থাকে। কোনো কোনো দলের সদস্যরা পাঁচ বছর ডুমুরের ফুল হয়ে যায়। ভোটের সময় হঠাৎ তাদের আবির্ভাব ঘটে। সব জেনে শুনেও সাধারণ মানুষ ভোট দিতে যায়। বাংলায় একটি গান খুবই জনপ্রিয় 'মানুষ শালা মাথামোটা ভোট দিতে যায় নেচে।' আগেকার দিনে ভোটে জিতে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হওয়া নেতাদের সংখ্যা এখনকার থেকে অধীক ছিল।
ভোট বিভিন্ন দফায় অনুষ্ঠিত হয়। কখনো তিন দফায়, কখনো পাঁচ দফায়, কখনো সাত দফায়। আবার কখনো কখনো ছোটখাটো ভোট গুলি এক-দুই দিনে হয়ে থাকে। এখন দেখা যায় ভোটের আগে বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক দলেরা কর্মীসভা করেন। আবার এলাকা ভিত্তিক মানুষদের জন্য খাওয়া - দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এটা ভোট নেওয়ার একটি পদ্ধতি। আগেকার দিনে রাজনৈতিক দলেদের এখনকার রাজনৈতিক দলের মতো এতো টাকা ছিল না। ফলে দল চালানোই ছিল কষ্টসাধ্য, মানুষকে খাওয়াবার কথাই আসে না।
ভোটের দিনগুলিতে সকাল বেলা থেকেই এখন সমস্ত এলাকা ও মানুষের মধ্যে বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। আগেও যেত। তবে মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে। ঝামেলার ভয়ে বাড়ি থেকে মানুষ কম বেরোয়। ভোট উপলক্ষে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই বন্ধ থাকে। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট দেওয়া হয়। কারো কারো সকাল সকাল ভোট দেওয়ার তাড়া থাকে, আবার কেউ বাড়ির সব কাজ শেষ করে ভোট দিতে যান। বয়স্ক ভোটারদের বাড়ি থেকে টোটো-ভ্যানে করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরা নিয়ে আসেন। বুথের সামনে থাকে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যরা। প্রত্যেক বুথে একজন করে প্রিসাইডিং অফিসার থাকেন ভোটদান প্রক্রিয়ার জন্য। তাছাড়া আরো দু-তিন জন নিবার্চন কমিশনের সদস্য থাকেন পুরো বিষয়টি সহযোগিতার জন্য। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একজন করে সদস্য বুথের মধ্যে ভোটার লিস্ট নিয়ে উপস্থিত থাকেন। সঠিক ভোট দেওয়ার প্রতি এরা সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।
প্রাচীন কালের সঙ্গে বর্তমান সময়ের ভোটদান পদ্ধতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। আগে ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়া হতো, বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির জন্য ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) -এর মাধ্যমে ভোট দেওয়া হয়। ভোট গোনাও হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে খুবই দ্রুত। ফলে তাড়াতাড়ি ভোটের ফলাফল জানা যায়। আগে ব্যালট পেপারে ভোটগুনে ফলাফল জানাতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। ভোটিং মেশিনে কোনো সমস্যা আছে কি না তাও এখনকার দিনে জানা যায়। তবে আগেকার দিনের সঙ্গে এখনকার দিনে একটি বিষয়ে মিল পাওয়া যায় সেটা হল ছাপ্পা ভোট। তখনও ছাপ্পা ভোট ছিল এখনো ভয় দেখিয়ে কিম্বা প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভোটে দুর্নীতি করা হয়। তাছাড়া এখন ভোট বিশেষজ্ঞদের মোটা টাকা দিয়ে ভোটে কিভাবে জেতা যায় তার মাস্টার চাল অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরা চেলে থাকেন। এটা আগে হত না। যে রাজনৈতিক দলের টাকা বেশি তারা জেতার জন্য মুড়ি মুড়কির মতো টাকা খরচ করে থাকে।
আজকালকার দিনে ভোটে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতারা হেলিকপ্টারে করে প্রচার সারে। কেউ কারো থেকে কম নয়। এ বলে আমায় দ্যাখ ও বলে আমায়। আগেকার দিনে ভোটে সব দলের নেতারা এই সুযোগ পেতেন না। কারণ অর্থনৈতিক সামর্থ ছিল না। বতর্মানে ভোটের আগে টিকিট পাওয়ার জন্য দল পাল্টানোর উৎসব চলে। কে কোন দলের তা মাথায় রাখা খুবই কঠিন হয়ে যায়। আজ যে অন্য দলের সদস্যদের গালিগালাজ করত কাল তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। রাজনৈতিক নেতাদের প্রকৃতই কোনো নীতি থাকে না। এই ব্যাপারটা আগেকার দিনে হত না। দলের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল নেতাদের।
পরিশেষে বলা যায় বর্তমানে গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধি হয়ে সাধারণ মানুষেরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে বিরাট সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এক রাজনৈতিক দলের লোকেরা অন্য রাজনৈতিক লোকেদের সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত করতে পারছেন না। ব্যক্তি সম্পর্ক রাজনীতির উপর নির্ভর করছে। ফলে সুমধুর সম্পর্কগুলো তিক্ততায় পরিণত হচ্ছে। আগেকার দিনে ব্যক্তি সম্পর্কে ও রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তায় চলত। ব্যক্তি সম্পর্ক ছিল সবথেকে বড়। এখন ভোট দিতে যেতে কোথাও কোথাও মানুষ ভয় পায়। গণতান্ত্রিক উৎসবে সামিল হয়ে কেউ বা অকালে প্রাণ দিচ্ছে। প্রত্যেক ভোটে বহু সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীরা বলী হচ্ছে। প্রত্যেক সরকার এ বিষয়ে উদাসীন। সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য তারা দিতে জানে না।
