মালবিকা মিত্র
সেকাল-একাল শুনলে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হই, ভাবি, আমি কি ঠিক ততটা বহুকাল দর্শী, যে এই নিয়ে কথা বলবো! তবে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব পার করে, এখন ছেষট্টি বছর বয়সে অন্তত কিছুটা সেকাল একাল বলার অধিকারী হয়েছি। সেটা সম্ভবত বছর চল্লিশ আগের কথা। কানপুরে সিসামউ নির্বাচন কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন দৌলত রাম। বাংলা থেকে আমি গিয়েছিলাম প্রচারের কাজে। এর একটা কারণ ছিল কানপুর হল জেকে সিংহানিয়ার শহর। ফলে একদা এই বাংলার বিখ্যাত শিল্প কেন্দ্র জেকে স্টিলের বহু শ্রমিক কর্মচারীরা তাদের মূলকেন্দ্রের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এছাড়াও রিষড়ায় জেকে স্টিলের উল্টো দিকেই আই ই এল (ইন্ডিয়ান এক্সপ্লোসিভ লিমিটেড), তার বহু শ্রমিক কর্মচারী কানপুরে আই ই এল এর সদর দপ্তরে বদলি হত। আর ছিল ইছাপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরির বহু মানুষ, যারা কানপুরে আর্মাপুর এস্টেটে গান এন্ড সেল ফ্যাক্টরিতে বদলি হত। ফলে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাঙালি পরিমণ্ডল ছিল। শাস্ত্রী নগর, পান্ডু নগর, লালবাংলা বস্তি, আর্মাপুর এস্টেট, জেকে কটন, জেকে জুট, এলগিন ওয়ান, এলগিন টু এই সব জায়গায় অসংখ্য বাঙালির বসবাস।
দেখেছি চমনগঞ্জ, মূলগঞ্জ বস্তিতে ঘরে ঘরে মহিলারা লাল ঝান্ডা সেলাই করছে। কোথাও বা সেই ঝাণ্ডায় প্রতীক চিহ্ন আঁকা হচ্ছে। বাচ্চারা সেসব রোদে শুকোচ্ছে, ভাজ করে গুছিয়ে রাখছে। বাবা কাকারা ঝাণ্ডার ডান্ডা তৈরি করার কাজে ব্যস্ত। কেউবা খবরের কাগজকে সুন্দর করে সমান করে সাজিয়ে রেখে ইট পাথর চাপা দিয়ে রাখছে রোদে। সেই কাগজে পোস্টার লেখা হবে, হাতে লেখা পোস্টার। রং আসবে স্থানীয় কোন শাড়ি কাপড় ছাপানোর কারখানা থেকে বাতিল হওয়া রং। আর ছিল জুটমিল ও কটন মিলের রং। মূলত সাদা কালো খবরের কাগজে, লাল, চকলেট, নীল এবং সবুজ দিয়ে লেখা হতো। লেখা রোদে শুকোচ্ছে, সেগুলোকে গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। এরপর আছে আবার, ঘরে আঠা বানানো, পাটের তুলি বানিয়ে, তাই দিয়ে পোস্টারে আঠা লাগানো। কত না কাজ। একটা সুবিশাল কর্মযজ্ঞ। আর আছে এই ঘর ওই ঘর থেকে ঘন ঘন চায়ের সাপ্লাই। মোট বাইশ দিন ছিলাম, এই ঘর ওই ঘরে খাওয়া দাওয়া।
এসবই বলছি একটি সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড। যার আর্থিক সামর্থ্য কম, কিন্তু জনশক্তি ও আবেগে অনেক বেশি। একটা পোস্টার বা একটা ঝান্ডা অসংখ্য মানুষের ত্যাগ পরিশ্রম ও আন্তরিকতার যৌথ ফসল। এর বিপরীতে সে যুগেই দেখেছি ওই কানপুরেই কংগ্রেস প্রার্থী কমলা দরিয়াবাদীর প্রচার। ছাপানো কিছু বিশালাকৃতির ব্যানার শহরে টাঙানো আছে। আর প্রত্যেক লাইট পোস্টে বা অনুরূপ সম্ভাব্য স্থানে, দলীয় পতাকা। এছাড়া অফসেটে ছাপানো অসাধারণ বর্ণময় পোস্টার, বিজ্ঞাপনের মত শোভা পাচ্ছে। জানেন ওখান থেকে পশ্চিমবাংলায় গণশক্তি পত্রিকায় একটা প্রেস রিপোর্ট করে পাঠিয়েছিলাম। একদম গ্রাউন্ড জিরো রিয়েলিটি। দৌলত রামের জয় সুনিশ্চিত, শেষে দেখলাম ৩৮ হাজার ভোটে দৌলত রাম হেরে গেলেন। মহল্লায় মহল্লায় দৌলত রামের সভা মিছিল, কারখানার গেট গুলোতে সভা মিছিল, শহরের রাজপথে সুবিশাল কেন্দ্রীয় মিছিল, আমাকে ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছিল।
পরে বুঝেছি, জমায়েত গণ অংশগ্রহণ আন্তরিকতা এই সব কিছুতে আমি দৌলত রামের সমর্থকদের একশো ভাগকেই প্রত্যক্ষ করেছি। বস্তির সমস্ত ঘরে তালা দিয়ে মিছিলে বেরিয়ে পড়েছে সপরিবার। অর্থাৎ ওই জনসমর্থনটা ছিল অপটিমাম লেভেল। কর্মী ভোটার পরিবার সব একাকার। বিপরীতে কংগ্রেস প্রার্থী একদিন একটা রোড শো করে, একটু হাত নেড়ে সকলকে শুভেচ্ছা ভাসিয়ে দিলেন আকাশে। ব্যাস তাতেই কাজ। সমর্থক কর্মী খুবই কম, পথে সেভাবে দেখাই গেল না। কিন্তু ভোটাররা ছিল ঘরে, তারা পথে নামেনি।
কানপুরের এই নির্বাচনী আবেগ ও কর্মকান্ড আমাকে পশ্চিমবাংলার ৬০-৭০ দশকের নির্বাচনকে মনে করিয়ে দিয়েছিল। বিপুল কর্মকাণ্ড, বিশাল মিছিল, গণ অংশগ্রহণ, গণ জমায়েত যখন আমাদের আত্মতৃপ্ত করছে, তখন কংগ্রেস দলের এত বিপুল ভোট পাওয়া ও বিপুল জনসমর্থন পাওয়া আমাদের অবাক করতো। কানপুরের পরে বুঝেছিলাম বিরোধী শক্তি তার সমগ্র আশা আকাঙ্ক্ষা আবেগ উজাড় করে দিয়ে লড়ে। অনেকটা এরিয়ান্স বা রাজস্থান, খিদিরপুর ক্লাবের মতো। কিন্তু শেষ জয়ের হাসিটা হাসে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান বা মহামেডান।
আমি আমার আলোচনায় বামপন্থী লাল ঝাণ্ডার কথাই বলছি। কারণ তারাই ছিল বিরোধী শক্তি। বিরোধী রাজনীতির একটা ধরন আছে। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে তার স্পষ্ট পার্থক্য। কিন্তু একবিংশ শতকের প্রথম কোয়ার্টারের প্রান্তে এসে দেখছি, বাম রাজনীতি বা বলা ভালো সরকার বিরোধী রাজনীতি তার সেই স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে। হাতে লেখা পোস্টার কার্যত দেখাই যায় না। কিছু দেয়াল লেখা চোখে পড়লেও, বহু ক্ষেত্রেই বোঝা যায়, সেগুলো পেশাদার শিল্পীকে দিয়ে লেখানো হয়েছে, পয়সার বিনিময়ে। পোস্টারে ও দেওয়াল লিখনে কি অসাধারণ ছড়া কার্টুন আগে দেখা যেত সেই সৃজনশীলতা আজ অনুপস্থিত। ভাবতে পারেন একটি বিরোধী দলের ওয়েবসাইটে তথ্য পরিবেশন করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এক মহিলা। দলে রক্ত মাংসের কর্মীর সংখ্যা কি এতটাই কমে গেছে?
কম্পিউটার ও প্রিন্টিং টেকনোলজির অস্বাভাবিক অগ্রগতির সুযোগ সব দলই নিতে চায়। সেই সুযোগ নিতে গেলে খরচা আছে। অতএব দলকেই ভাবতে হয় অর্থাগমের কথা। অথচ এমনটা বাম আন্দোলনে কখনো ছিল না। বরং একটা অহমিকা ছিল, ওরা অর্থ ও টেকনোলজির জোরে যে প্রচার করবে, আমরা জনশক্তির জোরে তাকে ছাপিয়ে যাব। আসলে সেই জন হেনরির বীরগাথা কোথায় যেন অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করতো। যা এখন করেনা। বুঝিবা এর একটা কারণ, সেই বিরোধী বামপন্থা মাঝে দীর্ঘদিন শাসকদলের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল। ফলে সে তার পুরনো গরিবের অহমিকা হারিয়েছে। সদ্য হারানো শাসক সুলভ মনোভাব ছাড়তে পারে নি। এখন এদের প্রচার দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, সেগুলো কোনো পেশাদার বিজ্ঞাপন সংস্থাকে দিয়ে তৈরি করা।
একাল সেকাল প্রসঙ্গে অবশ্যই যে দ্বিতীয় বিষয়টা মনে পড়ে তা হল প্রচার ও বক্তব্যে শালীনতার সম্ভ্রম রক্ষা করা। এটা এক বাক্যে সকলেই স্বীকার করে নেবেন যে, বর্তমানে এই শালীনতার বোধ অনেক কমে গেছে। আইন আদালত নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি সিবিআই ইডি রাজ্যপাল সবকিছু সম্পর্কে একটা ডোন্ট কেয়ার তাচ্ছিল্যের ভাব। কৈলাশ বিজয় বর্গীতো আহ্লাদে বলেই বসলেন, আমাদের বাহিনী, আমাদের সিবিআই, আমাদের নির্বাচন কমিশন, আমাদের রাজ্যপাল, দেখি এবার ভোটে কে কি করে। তা না হলে ভোটের মুখে রামনবমী শোভাযাত্রা আইনশৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে এই আশঙ্কায় হাইকোর্ট রায় দিলো, ২০০ জনের বেশি কোন জমায়েতে থাকবেন না। এরপরেও উত্তরবঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলে গেলেন, এবারের রামনবমী হবে অনেক বেশি ধূমধাম সমারোহ করে। সাথে সাথে দলীয় সাংসদ দীলিপ ঘোষ বললেন, মানুষের আবেগ কে রোধ করবে কে, দেখব। পঞ্চাশ হাজার লোকের মিছিল করবো, আমি নিজে থাকবো। এমনকি এক বিজেপি প্রার্থী চললো তরবারি নিয়ে শোভাযাত্রায়। এর পাশাপাশি আপনি স্থাপন করুন ৭০ দশকের নির্বাচন কমিশন ও হাইকোর্টের রায়। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন সিনহা ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এমনকি তার নির্বাচন খারিজ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল উত্তরপ্রদেশে ইন্দিরার জনসভায় মঞ্চের উচ্চতা বেশি ছিল। দ্বিতীয় অভিযোগ ওই মঞ্চ তৈরি করেছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। সেখানে খাদ্য জল ও বিদ্যুতের যোগান দিয়েছিল। অর্থাৎ প্রশাসনকে কাজে লাগানো ও সরকারি অর্থ খরচের অভিযোগ। তৃতীয় অভিযোগ ছিল সরকারি আধিকারিককে দলীয় কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পিএমও র একজন আধিকারিক ছিলেন যশপাল কাপুর। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী এজেন্ট হওয়ার আগেই ওই পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী জনসভায় ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের আগে তার ইস্তফা পত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। এই কারণে ইন্দিরা গান্ধী অপরাধী ঘোষিত হয়ে, ছয় বছরের জন্য নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নির্বাসিত হন। নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গুলির এই দৃঢ়তা একালে অনুপস্থিত।
একাল সেকাল প্রসঙ্গে অবশ্যই যে তৃতীয় বিষয়টা মনে পড়ে তা হল, প্রচার ও বক্তব্যে শালীনতা, সম্ভ্রম রক্ষা করা। এটা এক বাক্যে সকলেই স্বীকার করে নেবেন যে, বর্তমানে এই শালীনতার বোধ অনেক কমে গেছে। বসপা সাংসদকে যে ভাষায় বিজেপি সংসদের মধ্যে আক্রমণ করেছে, তা নজিরবিহীন। স্পিকার অন্ধ বধির হয়ে থেকেছে, আর বিজেপির দলীয় সাংসদরা প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছেন। রাহুল গান্ধীকে পাপ্পু সম্বোধন মনমোহন সিং কে মৌনমোহন বলা এমনকি অমর্ত্য সেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন হাভার্ড নয় আমি হার্ডওয়ার্কে বিশ্বাস করি। স্পষ্ট ঔদ্ধত্য প্রকাশ। আর প্রতিপক্ষ যদি কোন মহিলা হন তবে তার ভাগ্যে জুটে যায় আরো বেশি কিছু। সাংসদ মহুয়া মৈত্র, মন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটা হারে হারে টের পেয়েছেন। সেই অসভ্য সুর "দি ই দি ই ই…ওও দিদি"।
সে কালেও লিঙ্গ বৈষম্যের এই দৃষ্টান্ত রাজনীতিতে দুর্লভ ছিল না। তখন কংগ্রেস ভেঙে কামরাজের আদি কংগ্রেস ও ইন্দিরা গান্ধীর নব কংগ্রেস তৈরি হয়েছে। বামপন্থীরা পশ্চিমবাংলায় বলতো আদি কংগ্রেস ও মাদী কংগ্রেস। শুধু তাই নয়, সেই সময় নব কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক হয়েছিল গাই বাছুর। তখন সিপিআই ছিল কংগ্রেসের জোটসঙ্গী। সিপিএমের স্লোগান ছিল, দিল্লি থেকে এলো গাই...চোষে সিপিআই। ভাবুন রাজনীতিতে কি মারাত্মক লিঙ্গবৈষম্যের নমুনা। অতএব আমার চোখে কিছু ক্ষেত্র ছাড়া, বাকি তেমন কিছু ফারাক দেখি না একালে ও সেকালে।