দোঁহা

গল্প হলেও সত্যি

 


সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

'কলা স্বয়ম ইক য়াত্রা হ্যায়। এহি অন্ত্ তক্ য়াত্রা হি উসকি মঞ্জিল হ্যায়।'

গান-পাগল ছেলেটি। ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায় সবসময়। কখনো নাট্য-গীত মন্ডলীর পিছে, কখনো অভঙ্গ গায়ক-দলের সঙ্গে, আবার কখনো বা বিয়েবাড়ির ব্যান্ড-বাজার সাথে। গানের সুর ভেসে আসলেই হলো! কি যে হয়ে যায় ছেলেটির কে জানে! তম্বোরার সুর, মৃদঙ্গের বোল, খঞ্জরী-মঞ্জিরার ঝংকারে আত্মহারা হয়ে যায় যেন! বাহিরের সুর ডাকে অন্তরের সুরকে। সব ভুলে পিছু নেয় ওদের। চলতে চলতে ছোট পায়ে যখন আর শক্তি থাকে না, ঘুমিয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। রাস্তা চিনে আর ফিরে আসতে পারেনা। মা কেঁদে মরে। বাবা গুরুরাজাচার্যা  যোশীজীর হয়রানির এক শেষ। এর আগে দু'বার পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। অনেক কষ্টে ফিরে পেয়েছেন ছেলেকে।
কর্নাটকের বাগলকোট জেলার একটি ছোট শহর গডগ। বিদ্যালয়ের সংস্কৃত শিক্ষক গুরুরাজাচার্যা যোশী। সবাই 'যোশী মাস্টার' বলে ওনাকে।
শেষমেশ অনেক ভেবে  সমস্যার সমাধান করেন তিনি নিজেই। ছেলের সব জামার পিছনে লিখে দেন - 'যোশী মাষ্টারারা মাগা'
(যোশী মাস্টারের ছেলে)।

'জীবন সংঘর্ষ্-ময় গতি কা হি নাম হ্যায়!'

গদগ থেকে ট্রেন চলেছে বিজাপুরের দিকে। টিকিট পরীক্ষক ধরেছে এক বালককে। বয়স বছর দশ-এগারো। টিকিট নেই তার কাছে। 
–'কোথায় যাবি? বাড়ি থেকে নিশ্চয়ই পালিয়েছিস তুই?'
–'মা ঘি কম দিল কেন?' 
কাঁচুমাচু হয়ে জানায় ছেলেটি। 
মা খেতে বসে ঘি কম দিয়েছে। তাই ঝগড়া করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। 
তবে 'যানা তো তয় থা, ঘি তো সির্ফ ইক বহানা থা, যানে কা পক্কা থা!'
আসলে সে চলেছে গোয়ালিয়রে গুরুর সন্ধানে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতে চায়। স্কুল পালিয়ে রেকর্ডের দোকানে বসে গান শুনে শুনে শিখেছে কিছুটা। 
 'পিয়া বিন্ নাহি আওত চৈন-'

সাম্প্রতিককালে উস্তাদ আবদুল করিম খাঁ সাহেবের বসন্ত্ রাগে গাওয়া এই রেকর্ডটি শুনে পাগল হয়ে গেছে সে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে গাইলে ওনার মতো গাইবে আর তালিম নিলে ওনার কাছেই নেবে। 
–'আচ্ছা-
এত গান ভালবাসিস তো শোনা দেখি!'
টিকিট-পরীক্ষক জিজ্ঞাসা করেন। 
একের পর এক বিভিন্ন রেকর্ডের গান অবিকল গেয়ে শুনিয়ে দেয় ছেলেটি। মুগ্ধ হয়ে শোনে ট্রেনের যাত্রীরা। 
'মুন্দরি মোরি কাহে কো-
গান গান গান গুণ গাবে-'
ঠুমরি,ভজন,খেয়াল  শুনিয়ে সে পৌঁছে যায় বিজাপুরে। সেখান থেকে পুণে। পকেট ফাঁকা। ভাগ্য ভাল থাকলে, সঙ্গীত-বোদ্ধা টিকিট পরীক্ষক হলে ছেড়ে দেয়। নতুবা যেতে হয় জেলে। প্রায় মাস দেড়েক পরে সে খান্ড্ওয়া হয়ে পৌঁছায় গোয়ালিয়রে। গোয়ালিয়র এস্টেটে যারা গান শেখে তাদের একবেলা খেতে দেওয়া হয়। বছর দেড়েক সেখানে আধপেটা খেয়ে কিছুদিন উস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ সাহেবের কাছে তালিম নিতে লাগে। উস্তাদজী ব্যস্ততার কারণে বেশী সময় দিতে পারেন না। ছেলেটি আবার বেড়িয়ে পড়ে 'আনদেখি আনজানি রাহোঁ পর'। কোলকাতা, দিল্লি ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ঠোক্কর খেতে খেতে অবশেষে পৌঁছায় জলন্ধরে।  অন্ধ গায়ক ভক্ত্ মঙ্গদরামের কাছে ধ্রুপদ শিখতে শুরু করে। 
প্রতি বছর হরিবল্লভ সঙ্গীত সমারোহে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সঙ্গীত বিশারদ আসেন সেখানে। ছেলেটি কি করে, তানপুরা নিয়ে পিছনে বসে যায় সবার সাথে।
 
বিণায়ক রাও পটবর্ধন নামে এক ব্যক্তির সাথে আলাপ হয় সেখানে। 
সব শুনে তিনি সেই ছেলেটিকে সঠিক মার্গ-দর্শন দেন। 
-'তুমি এখানে কি করছো? তোমার বাড়ির কাছে কুন্ডগোলে পন্ডিত সওয়াই গন্ধর্ব আছেন। তিনি উস্তাদ আবদুল করিম খাঁ সাহেবের শিষ্য। তুমি তার কাছে গিয়ে তালিম নাও।'
মা সরস্বতী এতদিনে প্রসন্ন হন। 
যাঁর রেকর্ড শুনে যোশী মাস্টারের ছেলে জীবনে এতবড় ঝুঁকি নিয়েছিল, তাঁর শিষ্যের কাছে তালিম নেওয়া শুরু হয়। এ তো গেল প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানো। বাকিটা ইতিহাস!

'ইক ধুন থী, ইক লগন থী, অসম্ভব কো সম্ভব বনানে কি...'

সন:-১৯৩৫-১৯৩৬
অভিনেতা পাহাড়ি স্যান্যালের বাড়িতে একটি কিশোর আসে কাজের সন্ধানে। ফাইফরমাশ খাটার জন্য রাখা হয় তাকে। পাহাড়ি বাবুর বাড়িতে প্রায়ই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসে তখন।  তিনি নিজেও লক্ষ্মৌর নামী-দামী সঙ্গীত বিশারদদের কাছে তালিম-প্রাপ্ত। তাই রিহার্সালও চলে বাড়িতে। গানের আসরে সবসময় সেই ছেলেটিকে বসে থাকতে দেখেন পাহাড়ি বাবু। নাম জিজ্ঞাসা করায় সে বলে, 'যোশী'।

এরপর অতিবাহিত হয় প্রায় ৩০টি বছর। এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে পন্ডিত ভীমসেনজীর স্বতন্ত্র গায়কী ও অসাধারণ রাগ পরিবেশনে মন্ত্রমুগ্ধ পাহাড়িবাবু দেখা করতে যান গ্রিনরুমে। 
–'চিনতে পারছেন?'
জিজ্ঞাসা করেন পন্ডিতজী। স্মরণে আসেনা পাহাড়ি বাবুর। 
–'আমি যোশী! আপনার বাড়িতে কাজ করতাম একসময়।' 
–'কি বলছেন?'
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান পাহাড়ি স্যান্যাল! 
–''হ্যাঁ, আমি-ই সে! 
*পন্ডিত ভীমসেন যোশী!*'
কি পরিমাণ নিষ্ঠা, অধ্যাবসায় ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকলে এই স্তরের আমূল পরিবর্তন জীবনে বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয় একজন মানুষের পক্ষে!

'যো জি কো ভাতা হ্যায় ওহি সঙ্গীত বন জাতা হ্যায়!

একবার এক সাংবাদিক পন্ডিত ভীমসেন যোশীজীর বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে দেখেন উনি চোখ বন্ধ করে 'অমর-প্রেম'  ছায়াছবির একটি গান 'কুছ তোহ্ লোগ কহেঙ্গে' শুনছেন।
–'আপনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিশারদ হয়ে ফিল্মের গান শুনছেন?'
সাংবাদিক অবাক হয়ে পন্ডিতজী কে জিজ্ঞাসা করেন। তখন তিনি হেসে মজা করে বলেন, 
–'ভাগ্যিস সঙ্গীতের তালিম নেয়নি কিশোর! তাহলে আমাদের যে কি হতো!কি সুন্দরভাবে রাগ খমাজ কে রাগ কলাবতীর সাথে মিশিয়ে দিয়েছে! এত কঠিন গান! অথচ কত সাবলীলভাবে গেয়েছে!'

আরও একজনের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি তখন বলেন, 'যে আর.ডি বর্মনের গান শোনেনা সে সঙ্গীতের কিছু বোঝে না।'
সত্যিই তো! যে গান হৃদয় ছূঁয়ে যায় তার আবার কোনো বিভাজন হয় নাকি! হৃদয়ের সুর বাঁধা পরে একসূত্রে। সৃষ্টি হয় নতুন সুরের। 
'মিলে সুর মেরা তুমহারা তো সুর বনে হামারা।'

'মেরা গায়ন হি মেরি ব্যক্তিত্ব কি অভিব্যক্তি হ্যায়!'

সন:- ১৯৫২
গুরু সওয়াই গন্ধর্বজী মারা যাবার কিছুদিন পর পুণেতে ওনার স্মরণ সভায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওনার শিষ্যরা এক এক করে রাগ পরিবেশন করেন। 
সর্বশেষ স্টেজে ওঠেন পন্ডিত ভীমসেন যোশীজী। ওনার সুযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম। 
রাগ টোড়ি। 
আলাপে খরজে সুর লাগান তিনি। 
মনে হয় বুঝি মেঘ ডাকল কোথাও। বুকের ভিতরেও বোধহয়। 
হঠাৎ পুরো অডিটোরিয়ামের পরিবেশ পাল্টে যায়। 
বন্দিশের মাঝে তান শুরু হয়। সাত-স্বরের সোপান বেয়ে উঠে চলেছেন তিনি। তার-সপ্তকের কোমল ধৈবত ছুঁয়ে হঠাৎ ফিরে আসছেন। এবার বুঝি স্থায়ীতে ফিরবেন! কিন্তু না আবার চলেছেন সোপান বেয়ে। এ যেন দৈত্যের কন্ঠস্বর চলেছে স্বর্গের চাবিকাঠির খোঁজে। ভীমনাদ চলেছে অনাহত নাদের সন্ধানে! 
অবাধ গতিতে-আরোহণ-অবরোহণে-
নিপুণভাবে  কোমল-কড়ি স্বর-সমূহের সাথে সন্তর্পণে পঞ্চম কে ব্যবহার করে-
গমকের দমকে গমগম  করে ওঠে চারিদিক। অদ্ভুত এক অনুভূতি- 
স্বজন হারানোর বেদনা যেন গ্রাস করে সবাইকে। গায়ন শেষে পুরো অডিটোরিয়ামে পিন-পতন-নীরবতা। সবার চোখে জল! বৃষ্টি কি শুধু প্রকৃতিতে ঝরে! বেশ কিছুক্ষন সবাই চুপ করে বসে থাকে। এ কি 'আনমোল' গুরুদক্ষিণা পেলেন আজ পন্ডিত সওয়াই গন্ধর্বজী!  সমগ্ৰ ভারতবর্ষ যেন আবার ফিরে পেল মিঞা তানসেন কে।
'সাগর কি গহরাই, আকাশ কি উঁচাই কিসনে নাপি হ্যায়।
সঙ্গীত কা ধর্ম্ সঙ্গীত হোতা হ্যায়। ইসমে জাতপাত নেহি হোতি।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন