মালবিকা মিত্র
বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝু-প্ ঝু-প্ ঝুপ্
দস্যি ছেলে গল্প শোনে, একেবারে চুপ।
তারই সঙ্গে মনে পড়ে, মেঘলা দিনের গান-
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান।।
কবে বৃষ্টি পড়েছিল, বান এলো সে কোথা-
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল কবেকার সে কথা!
তিন কন্যে বিয়ে করে কী হলো তার শেষে!
না জানি কোন নদীর ধারে, না জানি কোন দেশে,
কোন ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিলো গান-
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদে এলো বান।।
এই বানের কথায়, কোথাও কোন বীভৎসতা নেই, হাহাকার নেই। কি সুন্দর একটা ক্লান্তিহীন কর্মহীন ছবি। যেমনটা বৃষ্টির দিনে হয়ে থাকে। কোন ব্যস্ততা নেই, দস্যি দামাল শিশুও দিদিমা ঠাকুমার কোলের কাছে জড়ো হয়ে গল্প কথা শোনে। সেই কোন এক বছরের বানভাসিতে ঘরের চালায় আব্বুজান আর এক জলঢোঁড়া একসাথে, পুরো এক রাত্তির কাটিয়েছিল। দুজনেই দুজনকে সারারাত ভয়ের চোখে দেখে গেছে, কিন্তু কেউ কারো দিকে এগোয় নি। বর্ষায় বানভাসি মানেই প্রথমত নিচু অঞ্চলের নদী খালের ধারের মানুষের অন্য কোথাও একটু দূরে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেওয়া। আবার যার উঁচু ঘরের যারা, তারও ব্যস্ততাহীন, যা আছে ঘরে চালে ডালে ফুটিয়ে সঙ্গে কিছু ভাজা হলে তো কথাই নেই। যার অনেক আছে সেও বৃষ্টির দিনে কর্মহীন। বানভাসি পথ ঘাটে বের হয় না, ঘরেই রাজকীয় আহার গ্রহণ করে আনন্দের ছুটি কাটায়। কিন্তু সেও ব্যস্ততাহীন। ক্লান্তিহীন কর্মহীন দিন আনি দিন খাই অবস্থা যার সে তো প্রকৃত কর্মহীন। শুধু দিন আনা হয় না বলে, রান্নার ঝামেলা থেকেও মুক্ত। পেটে গামছা বেঁধে, এক ঘটি জল খেয়ে পড়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ স্বভাব শিল্পী তাই বৃষ্টির বর্ণনাটাও বানভাসি চিত্রটাও তার কলমে নরম মোলায়েম হয়ে রূপকথার ছবির মত ধরা পড়ে। ধরা পড়বেই তো। তিনি যে স্বভাব শিল্পী। মৃত্যুও তো তার লেখায় এভাবেই ধরা পড়ে, সুন্দর হয়ে। তা না হলে "মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান", কত আলতো করে বলতে পারেন "প্রাণের পরে চলে গেছে সে, বসন্ত বাতাসটুকুর মতো" বলেন "যেখান থেকে হেঁটে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে" তীব্র যন্ত্রণায় কত কোমল পরশ বুলিয়ে দেয়। যন্ত্রণার উপশম ঘটে। তিনি যখন বানভাসি ছবি আঁকেন সেই বানভাসি ছবিও একই রকম ভাবে বীভৎস নয়।
স্কুলে দেখেছি, যখনই আকাশে মেঘ করবে ভয়ঙ্কর কালো হয়ে চারদিক আঁধার ঘনিয়েছে, হাওয়া সবেমাত্র ছেড়েছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সে কি উল্লাস। হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো। আমি চিৎকার করি ওরে তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। আর তারা বাইরে বৃষ্টি ফোঁটা গায়ে মুখে মেখে নিয়ে খিলখিলিয়ে লুটিয়ে পড়ে। পরমানন্দে লাফাতে থাকে। আমি মেঘের গর্জনে, বাজের আওয়াজ এ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি, কিন্তু যাদের নিয়ে ভয় করছি, তারা যে আপন ভোলা বাঁধনহারা, জলের ভেতরে নেচে চলে উদ্দাম উল্লাসে। ফলে বানভাসিতে যখন দামোদর এসে ঘর, ঘরকন্না লোপাট করে দেয়, সেই ভয়ংকর চিত্র এই শিশু ভোলানাথদের কাছে ভয়ংকর নয়। তাকে খেলার উপকরণে পরিণত করে। "...ধেয়ে এলো দামোদর, দামোদরে হাঁড়ি কুড়ি..." সব ভেসে যায়, বানভাসির ভয়ঙ্করতাও। খেলার ছন্দে বানভাসি নিজেই তার ভয়ঙ্করতা হারায়।
বেশ মনে আছে নিম্নবিত্ত পরিবারে ছোটবেলায় একটানা বর্ষা ও নদী খাল উপচে যাওয়া। তার মধ্যে ঘরে সবাই জড়ো হয়ে আছি। চালে ডালে ফুটিয়ে খিচুড়ি এক পরম প্রাপ্তি। তারই মধ্যে প্রতিবেশী দস্যি ছেলে নিতাই, আমারই বয়সী, এক বিরাট মশারি নিয়ে প্লাবিত মাঠে সারাদিন মাছ ধরেছে। বেশ কিছুটা মাছ, পুঁটি খলসে মোড়লা ল্যাটা চিংড়ি এসব পাঁচমিশালী মাছ দিয়ে গেল এক টাকায়। মায়ের হাতে খিচুড়িটা আরো বেশি জমে গেল, মাছ ভাজা সহযোগে। জানাই আছে বর্ষা হবে, খাল বিল নদী ভরে উপচে যাবে, প্লাবিত হবে, কারোর কোন কাজ থাকবে না। কম-বেশি দিন আনা দিন খাওয়া পেশার সকলেই ওই কদিন মৎস্য শিকারি। দুঃসাহসী কিছু দরিয়ার দানো, তারা প্রবল স্রোতে একটা উঁচু জায়গা থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তারপর অদ্ভুত কৌশলে ভাসতে ভাসতে চলেছে একটা নির্দিষ্ট জায়গায়, যেখানে জলের ওপর ঝুঁকে পড়া একটা গাছের ডাল ধরে উঠে আসছে। আবার গিয়ে সেই উঁচু জায়গা থেকে জলে ঝাঁপাচ্ছে। আমাদের মত ভীতুরা হাঁটু জলে কোমর জলে দাঁড়িয়ে ওদের বীরত্ব ও সাহস উপভোগ করছি। আমি বলতে চাইছি বর্ষায় কি কি হবে, কি কি হতে পারে, এসব জানাই ছিল। তার জন্য খুব বেশি বিচলিত হতাম না। বরং উপভোগ করতাম। সেই দৃশ্যটা মনে করুন প্রবল বর্ষণে আঁচল দিয়ে আড়াল করে দুর্গা অপুকে আগলে রেখেছে আর তার সাথে আওড়ে চলেছে এই বৃষ্টি কমে যা, লেবু পাতা করমচা।
রাঢ় বাংলায় বর্ষা বানভাসি আসে আশীর্বাদ হয়ে। মানুষের জানাই থাকে সঙ্গে কিছু বিপর্যয় ও ভোগান্তি নিয়ে আসবে। সেগুলোকে সামলেও নিতে হবে। কিন্তু কদিন পর বান চলে যাওয়ার পর মাঠে মাঠে শুরু হয়ে যাবে আবার ব্যস্ততার মুহূর্ত । জীবন যাপনের সাথে কদিনের বানভাসি অবস্থাটাকে মানুষ মানিয়ে নিয়ে ছিল। ওটাও যাপনের অন্তর্গত বা বলা ভালো অনুষঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ছে যদি কেউ লক্ষ্মীপূজোর পাঁচ সাত দিন পর কেদার বদ্রি গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী এতদঞ্চলে গিয়ে থাকেন, নিশ্চয়ই দেখেছেন মানুষের ভেতর একটা বিরাট ব্যস্ততা রয়েছে। দেখেছি বহু দোকান ঝাপ বন্ধ করেছে।বিভিন্ন সামগ্রী গাছের ডালে টাঙিয়ে রাখছে। ঝুলিয়ে রাখছে। প্রচুর পরিমাণে গাছের শুকনো ডাল লকড়ি জ্বালানি হিসেবে ঘরে মজুদ করছে। অনেক দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন করেছিলাম কি ব্যাপার? ওরাই বলল, কালীপুজোর পর থেকে এই সমস্ত অঞ্চল বন্ধ হয়ে যাবে। মোটা বরফের পুরু চাদর ঢেকে ফেলবে সমস্ত পাহাড়কে। সবাই তখন নেমে যাবে নিচের দিকে উত্তরকাশীতে, ধারাসু, হৃষিকেশে। শুধু কিছু মানুষ, কিছু সাধু-সন্ত যারা থেকে যাবেন, তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী গুছিয়ে রাখা চলছে। এটাই তো স্বাভাবিক একটা জানা বিপদ বা বিপর্যয় নিয়মিত পর্যায় ক্রমে তা আসে এবং তার সম্পর্কে আগাম সতর্কতা গ্রহণ চলে। মানুষ সেটার সাথে মানিয়ে নিয়েছে। সেই শুষ্ক ছোটো নদীর কথা মনে করুন, যেখানে শীত গ্রীষ্মে-
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।
আর তারপরেই কবি দেখেন :
আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভরো ভরো
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর
মহা বেগে কলকল কোলাহল ওঠে
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কুলে বনে বনে পড়ে যায় সারা
বর্ষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।
কারোর ভেতর এটা নিয়ে হাহাকার নেই, হাহুতাস নেই, বরং উৎসবের আনন্দ, সত্যেরে লও সহজে।
বেহুলা বাংলা জানে তার ভবিতব্য। বানভাসি তোর নদীর বুকে আমরা লখিন্দর। কিন্তু এই বানভাসি চিত্রটা কৃত্রিমভাবে একটা ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। যেটাকে আমাদের সৃষ্ট বলা যায়। কেন বলছি কথাটা, সেটা একটু খোলসা করি। ফি বছর এই বানভাসি আটকাতে নদী খালের দুই পাড় বাঁধ দিয়ে উঁচু করা হলো। যাতে জল দুই কুল প্লাবিত করতে না পারে। প্রথমদিকে এটা সম্ভব হল, কারণ বেশ উঁচু করে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বাঁধ বরাবর চলার পথ করা হয়েছে। নানা গাছ লাগিয়ে মাটিটাকে শক্ত করার ব্যবস্থা হয়েছে। দু'বছর তো বেশ, বানভাসি হলো না দেশ। কিন্তু বৃষ্টির যে জলটা আগে অতি সহজে ওই নদী বা খালে নেমে যেত পাড় উঁচু হবার ফলে জল এখন জমে থাকে। সহজে নামতে চায়না। বানভাসি আটকানোর এটাই সমস্যা।
সমস্যা দুই, প্রতিবছর বানভাসির মধ্য দিয়ে নদী উগড়ে দিত বালি পলি দুই কুলে জমিতে। এখন বানভাসি আটকানোর ফলে নদী আর পলির উদ্গীরণ করে না। জমির যে স্বাভাবিক উর্বরতা বছর বছর পুনর্নবীকরণ হতো সেটা আর হয় না। এখন জমিতে কৃত্রিম সার প্রয়োগ করে উর্বরতা বাড়াতে হয়। এদিকে বানভাসি তো বন্ধ হল, ফলে নদীর গর্ভে জমে উঠল পলি বালি। নদীগর্ভ উঁচু হলে কয়েক বছর বাদে আবার বানভাসি প্লাবন। বাঁধ আরো উঁচু করা হলো। এর ফলে যেটা হল এখন আর নদীতে নামতে হয় না, নদীতে উঠতে হয়। কারণ বসত ভিটের জমি থেকে নদীগর্ভটাই উঁচু হয়ে গেছে। বানভাসি তো বন্ধ হলো, কিন্তু আগে প্লাবনের জল দু পাঁচ দিন পরে নেমে যেত। এখন সে নেমে যাবে কোথায়? গ্রামের পথঘাট বসত ভিটেতে জমে থাকে, আরো প্রাণান্তকর অবস্থা।
সমস্যা তিন, নদী উপকূলে কোথাও ভারী বৃষ্টিপাত হলো না, জল প্লাবিত হলো না, মোটামুটি সবটাই স্বাভাবিক মাপে ছিল। কিন্তু অন্যত্র ভিন রাজ্যে নদীর উৎসে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হলো। বাঁধের পক্ষে ওই বিপুল জলরাশিকে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একসময় বাধ্য হয়ে জল ছেড়ে দেওয়া হলো, মাইথন, পাঞ্চেৎ, ডিভিসি, থেকে এক লক্ষ কিউসেক, এক লক্ষ পঁচিশ হাজার কিউসেক, দেড় লক্ষ কিউসেক। আচমকা এত বিপুল পরিমাণ জল ছাড়ার ফলে প্রবল জলের তোড় ও গতিবেগ নদীর দু কূলকে প্লাবিত করে ভয়ংকর হয়ে ভেঙ্গে দেয় পাড় বাঁধ। বৃষ্টি না হয়েও, ভিন রাজ্যে বৃষ্টি হওয়ার কারণে, সেই জলের আকস্মিক চাপ বানভাসির একটি ভয়ংকর রূপ। কোথাও বৃষ্টি নেই, ঝড় নেই, আশঙ্কা নেই, নিশ্চিন্তে সবাই ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ বাঁধভাঙ্গা জল ঢুকতে শুরু করল। কারণ মাইথন পাঞ্চেৎ ডিভিসি জল ছেড়েছে। এই বানভাসি আকস্মিক ও ভয়ঙ্কর। কোনো প্রস্তুতি থাকে না। কুকুর আর গরু গুলোর ডাকে ঘুম ভাঙে। মেঝেতে মাদুর পেতে শোয়া বাপ সবার আগে টের পায়। ঘরে জল ঢুকছে। চৌকির ওপর বৌ বাচ্চাকে জাগায়। দরকারী জিনিস পত্র আড়ায় তুলে রাখা শুরু হয়। মা একটা একটা করে জিনিস উপরে তুলে দেয় বাবার হাতে। আধো অন্ধকারে জেগে উঠে শিশু বোঝেনা, কি ঘটছে। তারপর মাকে দেখতে পায়, নিচে থৈথৈ জল দেখতে পায়। "মোর বাপে গেলা কই" ভাবতে থাকে। "হ্যাষে দেহি বাপে ওই আড়ার উপর উইঠ্যা মালপত্র গুছায়।" এই বানভাসিটা অপ্রত্যাশিত।
নাগরিক জীবনে আর একটা বানভাসি আমরা সম্মুখীন হচ্ছি। ধরুন লেকটাউন, ওটা শহরের বেসিন এলাকা। ওটাতেই গড়ে উঠেছে নগরী। বেসিন বলতে ঢালু কড়াই এর মত জায়গা। ওখানে আশপাশের জল জমা হওয়ার কথা। আর সেখানেই গড়ে উঠেছে উন্নয়ন। উপনগরী গড়ে উঠেছে সল্টলেক ট্যাংরা তপসিয়া ভাঙ্গড়, কি অদ্ভুত, নিম্ন জলাভূমি অঞ্চলে গড়ে ওঠা সব দামি মূল্যবান উপনগর। তার সাথে আছে, নগরী মানেই ওয়াল টু ওয়াল কংক্রিটে বাঁধানো। এক ফোঁটা জল মাটিতে চুঁয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। শহরের জল যে জলাভূমিতে এসে জড়ো হতো সেই জলাভূমিতেই শহর গড়ে উঠেছে। একটু বৃষ্টি হলেই একতলায় জল ঢুকে যায়। সেক্টর ফাইভেও জল। এর সাথে মনে রাখতে হবে, নগরায়ন মানেই বড় বড় রাস্তা, উঁচু আল এর মত হয়ে, সমগ্র অঞ্চল গুলিকে খন্ডিত করেছে। তার ফলে স্বাভাবিকভাবে জলের যে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা সেটা বিনষ্ট হচ্ছে। আবদ্ধ হয়ে থাকছে জল। কোথাও কোথাও সাত দিন দশ দিনেরও বেশি। সল্টলেকে এ তো বানভাসী নয়। এ মনুষ্য সৃষ্ট সভ্যতার অপজাত। অথবা অপজাত নয় এটাই সভ্যতার মুখ।
পাহাড়ি এলাকায় যে সমস্ত ঝর্ণাধারা সেইসব ধারা একের সাথে আরেক মিশে শত সহস্র ধারা একত্রিত হয়ে জন্ম নেয় একটি পাহাড়ি নদী পাহাড়ে রাস্তা হবে, রাস্তা চওড়া হবে, বাড়িঘর তৈরি হবে, হোটেল মল তৈরি হবে, রিসর্ট - টানেল - পার্ক কতকিছু আয়োজন। অতএব ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটাও, পাহাড়তো মাখন এর মধ্যে ছুরি চালানো নয়। আমার ইচ্ছেমতো মাপ মতো ফাটেনা। পাহাড়ে অসংখ্য, প্রয়োজনের বাইরে, অতিরিক্ত ফাটল তৈরি হচ্ছে। বোল্ডার ঢিলে হচ্ছে। বৃষ্টির সময় এইসব ফাটল ফাঁক দিয়ে জলস্রোত জড়ো হতে থাকে। তারপর হঠাৎই একসাথে সেই জলস্রোতের জলের চাপে পাহাড়ের ঝুঁড়ো নুড়ি মাটি খসে গিয়ে আচমকা একটা অজানা জলস্রোত আগ্রাসী রূপ নিয়ে এগিয়ে আসে। আমরা বলি হড়পা বান। আসলে কতগুলি জ্ঞ্যত জলস্রোত বা ঝোড়া সম্মিলিতভাবে কোথায় কোথায় নদীতে পড়ছে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানা আছে। কিন্তু এই অজ্ঞাত ফাটলগুলো। যেগুলো নতুন নতুন জলস্রোতের উৎস তৈরি করছে সেটা পূর্ব অভিজ্ঞতায় নেই। পাহাড়কে পাহাড়বাসি নষ্ট করে নি। পাহাড়কে সাবেক কালের তীর্থযাত্রিও নষ্ট করেনি। তারা ভয়ংকর ক্লেশ সাধন করে, বহু কষ্টে পাহাড়ের চলাফেরা করতো। কিন্তু চার চাকার গাড়ি পাহাড়ের মাথায় উঠবে, তার জন্য চওড়া রাস্তা হবে, পর্যটক আসবে অনেক। তাদের জন্য দোকানপাট হোটেল রিসর্ট বিনোদন হবে। পাহাড় এতে নষ্ট হয়েছে। এগুলোর ফলশ্রুতি আজকাল বহুশ্রুত হড়পা বান।
একালে বানভাসীর কত না রূপ। কিন্তু সেই রূপগুলি কমবেশি সবই মনুষ্যসৃষ্ট বা সভ্যতার অপজাত। তাহলে আসুন এ প্রসঙ্গে মহেশ ও সরিতার গল্প বলা যাক। গল্প নতুন কিছু নয়, অনেকেরই জানা, পুরনো। বিহার ঝাড়খণ্ডে কিছু নদী যেগুলি বৃষ্টির জলপুষ্ট। শোন নদী, চম্পা, গন্ডক, এরা বৃষ্টির জল পুষ্ট। বর্ষা হলে এরা বিহারকে প্লাবিত করে। আবার বর্ষা শেষ হলে এতদঞ্চলে শুষ্ক খরার প্রাবল্য। মহেশ ও সরিতা প্রাচীন ইতিহাস চর্চা করে দেখেছেন, প্রাচীনকালে এই সমস্ত অঞ্চলে বন্যার প্রাবল্য ছিল না। ব্রিটিশ আমলেই এই অঞ্চলে খরা ও বন্যার উপদ্রবএ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ রাজ্যের বাইরে জন মজুরের কাজ করতে যায়। অথচ আগে তারা যেত না। তারা দেখলো বন্যা প্রবণ ওই নদীগুলি থেকে অজস্র খাল কেটে নিয়ে দূরবর্তী গ্রামগুলিতে জলাধার সৃষ্টি করে সেখানে জল সঞ্চয় করত। এভাবে খাল থেকে শাখা খাল কেটে ওই অঞ্চলে জালের মতো বিস্তার করেছিল। অসংখ্য খাল এবং জলাধার। বর্ষায় যখন জলের আধিক্য ওই খাল দিয়ে বাড়তি জল গিয়ে ভরে ফেলত জলাধার। এর ফলে গ্রামে বানভাসি সমস্যা সামলে দেওয়া যেত। তারপর বর্ষা মিটে গেলেই এই ধরে রাখা জল ব্যবহার করে প্রাত্যহিক কাজ কৃষি কাজ সবই চলত। খরা সমস্যা এর ফলে মোকাবিলা করা সহজ হতো। এই খাল ও জলাধার গুলিকে বলা হত আহর এবং পইন। চল্লিশটি গ্রাম কে একত্রিত করে, সেই গ্রামের মানুষদের স্বেচ্ছা শ্রমে, কাটা হয়েছিল মোট প্রায় ২০০ কিলোমিটার খাল। এর সাথে খনন হয়েছিল অসংখ্য বড় বড় জলাধার। যে অঞ্চলে কর্মসংস্থান হতো না, মানুষ চলে যেতো অন্যত্র জন মজুরী করতে। সেই গ্রামের মানুষ গ্রামেই চাষবাস করে। এমন চল্লিশটা গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল শব্দোগাঁও।
কিন্তু সভ্যতার পেটে ঘি সয় না। তাহলে তো ডিপ টিউবওয়েল, জলের রাজনীতি, বিদ্যুতের রাজনীতি, এসব অচল হয়ে যাবে। অতএব মহেশ ও সরিতাকে মরতে হলো সভ্যতার মাফিয়া দের হাতে। তারা দেখেছিলেন, প্রাচীনকালের এই আহর পইন পদ্ধতি, ব্রিটিশ শাসনে ধীরে ধীরে উপেক্ষিত হয়ে খাল গুলি বুজে গিয়েছিল। জলাধার গুলি পরিত্যক্ত জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। অথচ গান্ধীজীর লক্ষ্যই ছিল এই ছোট ছোট আঞ্চলিক রিসোর্সগুলিকে ব্যবহার করে স্বনির্ভর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা তৈরি করা। কিন্তু ছোট স্থানীয় প্রকল্পে অতি সামান্য পয়সার বিনিয়োগ হয়। অতি সামান্য ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন হয়। কোন উচ্চমাথা বা ক্ষমতা বিশিষ্ট প্রশাসনের দরকার হয় না। কিন্তু সর্দার সরোবর বাঁধ বা ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধ তৈরি করতে হাজার হাজার কোটি টাকা, বড় বড় সরকারি অফিসার, ম্যানেজমেন্ট এবং সর্বোপরি লোক দেখানো সাফল্য আছে। আর ভাবুন ৫৬ হাজার কোটি টাকার কাটমানি কি বিপুল পরিমাণ হতে পারে। অতএব গান্ধীর পঞ্চায়েতি রাজ কল্কে পাবেনা এটাই স্বাভাবিক।
বানভাসীর ও বয়স আছে শৈশব কৈশোর যৌবন বার্ধক্য আছে। প্রাচীন যুগে এমনই বানভাসি হত, কিন্তু তার সাথে মানুষ সার্থক ভাবে মানিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। যাকে বলি সফল অভিযোজন। ধীরে ধীরে এই বানভাসীটা কৃত্রিমতায় পরিণত হলো। একটা চরম ভয়ংকর রূপ নিয়ে আজ সভ্যতা বুঝি শেষ লগ্নে। বানভাসিও তার যৌবন লাভ করেছে সমস্ত কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বানভাসির প্রকাশ। চেন্নাই শহর, কেরল, মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরু সর্বত্র , এমনকি আমেরিকা, জার্মানিতে বান ভাসি চেহারাটা একটা খ্যাপা পাগলের মত ধাইছে। পুরাণে এক মহা প্লাবনের মধ্য দিয়ে একটা যুগের সমাপ্তি ঘটেছিল বলে শোনা যায়। নারায়ন তখন মৎস্য অবতার হয়ে পরিত্রাতা হন। মৎস মনুকে বিধ্বংসী বন্যা সম্পর্কে পূর্ব সতর্ক করে। পাকে পৃথিবীর সমস্ত শস্য ও জীবসমূহকে একটি নৌকায় জড়ো করতে বলেন বন্যার ক্ষণ উপস্থিত হলে মৎস্য মনু সপ্তর্ষি ও অন্য জিনিসপত্র সমেত নৌকাটিকে টেনে নিয়ে রক্ষা করে। প্লাবণ শেষ হলে, যা দিয়ে নতুন করে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। আমরাও বুঝি সেই মহাপ্লাবণের দিকে, সেই মহা সমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছি।