রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়
তখনো ময়লা আলোর আকাশ পুরোপুরি ফর্সা হয়ে ওঠেনি। ভোর হতে না হতেই রোজ উঠে সারা গ্রাম টইটই করে বেড়ানো সুজাউদ্দিন মোল্লার দীর্ঘদিনের স্বভাব। কোথায় নতুন পুকুর কাটা হল, কোথায় খালের মুখ বুজে এসেছে, কার জমিতে কেমন ফসল হয়েছে, কোথায় গাছপালা কেটে রাস্তা তৈরী হচ্ছে, মাতনডিহি ড্যাম তৈরীর খবরও সুজাউদ্দিনই প্রথম দিয়েছিল গ্রামের প্রধানকে। সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছিল, এ নিয়ে জেলাশাসকের দপ্তর পর্যন্ত যাওয়া হবে। মাতনডিহিতে বাঁধ দিলে, এই সারেংবাজার গ্রাম তো নদীর জল প্রায় পাবেই না। আবার যখন বাঁধ জল ছাড়বে, তখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত জলে ভেসে যাবে গ্রাম। কিন্তু যখন দেখা গেল যে বিশাল মাতনডিহি জলাধার তৈরী করা হচ্ছে এবং সেখান থেকে একটা যোগাযোগবাহী খাল গ্রামের নদীতে এসেই পড়ছে, তখন গ্রামবাসীরা কিছুটা শান্ত হল। গ্রামের প্রধান সাগিরুদ্দিন লস্করের বেশী বয়স নয়। সে সুজাউদ্দিনকে খুবই সম্মান করে। আসলে বয়সের কারণে সুজাউদ্দিনের অভিজ্ঞতা এবং গোটা গ্রামে প্রভাব দেখার মত। সাগির বলে, “চাচা, আপনার সক্রিয় থাকাটা এ গ্রামের পক্ষে মঙ্গলের।”
বড় ফাটলটার সামনে দাঁড়িয়েছিল সুজাউদ্দিন একা। ভেতরদিকে ঘন কালোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন হাঁ করে গিলে খেতে আসছে। কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়। একটু সরে গেলেও আরেকটা ওরকমই ফাটল। এপাশে, ওপাশে, চারদিকে মাটি ফেটে গেছে ভয়ানকভাবে। সুজা বসে মাটির গায়ে হাত বোলাতে থাকে। হঠাৎ যেন মিহি কান্নার মত একটা ধ্বনি শোনা যায়! কেউ কি কাঁদছে? কে কাঁদছে? আশেপাশে তো কেউ কোত্থাও নেই! তাহলে কি ফাটলগুলোর ভেতর থেকেই…
এখনো ঘুম ভেঙে ওঠেনি গ্রামের হতভাগাগুলো। চাষবাস নেই আজ কতদিন। মদ্দাগুলো বহুদূরে শহরের প্রান্তিক এলাকায় কাজ করতে যায় একটা ভাগাড়ে। সেখানে ফেলে দেওয়া পশুদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হাড়, চামড়া এসব আলাদা করার কাজ করাচ্ছে কোন একটা কোম্পানি। ভালোই পয়সা দিচ্ছে। এদিকে লাঙল, কাস্তেয় জং পড়তে বসেছে। কিন্তু পেট তো চালাতে হবে, তাই বাপ ঠাকুরদার কাজ ছেড়ে একাজে লেগেছে গ্রামের বেশীরভাগই। বড় ঘেন্নার কাজ, প্রথম প্রথম গা গুলিয়ে বমি উঠে আসত। ঘনঘন শরীর খারাপও হয়। সেসব উপেক্ষা করতে পারলে পয়সাকড়ি ভালোই পাওয়া যায়। আতুপুতু করে পেটে কিল মেরে বসে থাকার তো কোন মানে হয়না। সুজা বুঝতে পারে এ গ্রামের ব্যাটাছেলেগুলো এই কাজ করতে করতে স্বাস্থ্য হারাবে, দুর্বল বাচ্চার জন্ম দেবে, শরীরে বাসা বাঁধবে মারণরোগ, নেশা করতে বাধ্য হবে সারাদিন ধরে এ জঘন্য কাজের ধকল কাটাতে। সংসারগুলো টিঁকবে কিভাবে! কিন্তু কে শুনবে ওর কথা! অন্য কোন বিকল্পের খোঁজও তো নেই।
সুজা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেটা আসলে একটা নদী। গ্রাম চিড়ে চলে গেছে। দু পাড়ের মানুষের কাছেই এ নদী মায়ের মত। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গ্রামের প্রাণ। ক্ষেতগুলো যখন টাটকা সবুজ ফসলে ভরে উঠত নদীর জল পেয়ে, নদীরও আনন্দ হত, অনাবিল হাসিতে আলো হয়ে থাকত তার মুখশ্রী। সুজাউদ্দিন তখন তাগড়া জোয়ান। সারাদিন, সারামাস হাড় ভাঙা খাটনি খেটে যখন ক্ষেত ভরিয়ে তুলত, সে আনন্দ বলে বোঝানোর নয়। রফিক মাঝির নৌকো বয়ে যেত নদীর ঢেউয়ে, গ্রামের কুঁচোকাঁচাগুলো জলে নামলে আর উঠতে চাইত না। গ্রামের মেয়ে বউরা স্নান করতে এলে সেসময়ে পুরুষদের আসা নিষেধ ছিল। সুজার সব মনে পড়ে যায়। সবাই বলে পুরোনো বটগাছের মত গ্রাম আগলে বসে আছে সুজা বুড়ো। থাকবে নাই বা কেন? এই যে এত বছর অবধি আল্লাতালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে – কেন? ও মনে মনে ভেবে নেয়, এই আগলে থাকার জন্যই হয়ত।
রোদটা আজ তেতে উঠবে বোঝা যাচ্ছে সকাল থেকেই। সুজার ছেলেটা রেলের গেটম্যানের চাকরি জুটিয়েছিল কিভাবে যেন! গোটা গ্রাম তো অবাক! শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে থাকত মোরসালেমের সামনে। তারও তখন কী ডাঁট! খাগি রঙের জামার কলারে রঙীন রুমাল, চোখে সানগ্লাস, চুলে টেরি, গুটখা মুখে মোরসালেম যখন সাইকেল নিয়ে এসে দাঁড়াতো, সে এক দেখার মত দৃশ্য! সুজা দুচোখভরে দেখত লায়েক ছেলেকে। ভাবত, মোরসালেমের বিয়ে দেবে। বাচ্চাকাচ্চা হবে। এতেই নজর লেগে গেছিল কিনা কেজানে! সেদিন লাস্ট ট্রেনের সিগনাল হয়ে যাওয়ার পর মোরসালেম গেট ফেলেছিল সময়েই। এবার ওর ছুটি। হঠাৎ একটা দানবীয় আওয়াজে কেঁপে উঠল চারপাশ। গুডস ট্রেনটা কিভাবে যেন লাইন থেকে সরে গেল। একটা কম্পার্টমেন্ট উল্টে গিয়ে পড়ল সটান গুমটিঘরের ওপরই। মোরসালেম চেষ্টা করেও নিজেকে সঠিক সময়ে সরাতে পারল না। রেল কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিবারের একজনকে চাকরি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আশি বছরের বৃদ্ধকে কিভাবে…
মোরসালেমের সেই লায়েক ছবিটা তুলে রাখেনি কেউ। একমাত্র সুজাউদ্দিনের মনশ্চক্ষুতেই আজও দৃশ্যমান সে ছবি। সুজা ওদের বলেছিল, “চোখের দৃষ্টি তো গেছে কবেই। আর ছবি রেখে হবে কি? বরং বেটা আমার এখানটাতেই থাকুক।“ এই বলে বুকের দিকে দেখাতো সে। শূন্য খাঁচার ভেতর থেকে একটা হু হু করা বোধ বের হয়ে আসত। সেই বোধ কারো বন্ধু নয়, শত্রুও নয়, সে শুধু একা হতে ডাকে।
যেদিন বৃষ্টি শুরু হল, সেদিন কেউই বুঝতে পারেনি সর্বনাশের ইঙ্গিত। পোড়খাওয়া সুজাউদ্দিন বুড়োর কিন্তু ভালোলাগেনি। যদিও ও কাউকে কিছুই বলেনি। এতদিন পর বৃষ্টি যেন আদরের স্পর্শে ভিজিয়ে দিতে ডাকছে মাটিকে। আর মাটি তীব্র অভিমানে ফিরিয়ে দিচ্ছিল প্রতিটি সংবেদ। কিছুতেই ভিজে উঠছিল না। বাষ্প উঠছিল মাটি থেকে। সকলের খুশী আর ধরেনা। বউরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল, যাক মানুষটাকে ওই আপদের রোজগার করতে আর যেতে হবেনা। আবার মাঠে যাবে সকালবেলা। দুপুরে খাবার পৌঁছে দেবে বউ। পুরুষালি ঘামের গন্ধে ম ম করবে চারপাশ, কেমন একটা ঘোর লেগে যাবে, ছায়ায় বসে ভাত বেড়ে দেবে বউ। গ্রাম আবার সবুজ হয়ে উঠবে। এরপর ধান কাটা, ঝাড়াই বাছাই, বস্তায় ভরে রাখা…আবার আগের মত হাড়ভাঙা খাটনি খাটতে খাটতে ক্লান্ত হওয়ার অথৈ আনন্দ!
যেদিন বৃষ্টি শুরু হল, সেদিনই ভাগাড়ের কাজ বন্ধ হয়ে গেল, কারণ এই নরকে এই পরিস্থিতিতে কাজ চালানো যায়না। কোম্পানী সবাইকে কিছু টাকা দিয়ে ছুটি দিয়ে দিল। রোদ উঠলে আবার আসতে বলে দিল। পুরুষেরা উপার্জনের পন্থা হারিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। চাষবাস শুরু করলেই তো আর পেট ভরে যাবেনা! অতগুলো দিন এইকটা টাকায় চলবে? কিন্তু বৃষ্টি যে থামছেই না। তিনদিন হয়ে গেল। একইরকমভাবে হয়ে চলেছে। সুজাউদ্দিন স্পষ্ট বুঝতে পারল একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে।
নদীর কাছে গিয়ে দেখা গেল, বেশ টইটম্বুর হয়ে উঠেছে নদীটা। পুকুর, খাল, বিলও ভরে উঠেছে। এবার সবার যেন দুশ্চিন্তা হতে শুরু করল। কারণ এই একটানা বৃষ্টিতে যদি মাতনডিহি ড্যাম জল ছেড়ে দেয়, তবে তো বন্যা হয়ে যাবে! সুজা বিড়বিড় করে, “ওরে তোরা তৈরী থাক। আসছে, সে আসছে।” নেপাল জল ঠেঙিয়ে দেখতে এসেছে সুজা বুড়ো আছে কেমন। গিয়ে দেখে, খোলার চালে ফুটো ছিল, সেখান দিয়ে জল পড়ে মুড়ি, ছাতু সব ভিজে গেছে, নেতিয়ে যেন কাদা। চোখে ভালো দেখেনা বলে সময়মত সরাতেও পারেনি। সেকথা বুড়োকে বলতে, বুড়োর মনে পড়ল – মোরসালেমটাও তো সরাতে পারেনি নিজেকে! সুজাউদ্দিন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে দাওয়ায়। এ যে মুড়ি, ছাতু নষ্ট হয়ে যাওয়ার দুঃখ নয়, নেপাল ছোঁড়াটা বুঝল না। ও বুড়োর জন্য কিছু খাবার আনতে যাবে, এমনসময় দেখতে পেল দাশু পাগল জলে ছপাত ছপাত করে দৌঁড়তে দৌঁড়তে আসছে, আর চীৎকার করে বলছে – “জল ঢুকছে, জল ঢুকছে”। মানে মাতনডিহি বিপদসীমা অতিক্রম করার মুখে দাঁড়িয়ে এই কান্ডটা ঘটাতে বাধ্য হল। নেপাল কি করবে ভেবে না পেয়ে আরও জোরে পা চালালো। কিন্তু কোমর পর্যন্ত জলে কি ইচ্ছে করলেও তাড়াতাড়ি করার জো আছে! মুহূর্তের মধ্যে ওর গলা অবধি জল হয়ে গেল। নেপাল সাঁতরাতে লাগল বাড়ির দিকে।
গ্রামের সব বাড়িই ডুবে গেছে। মসজিদে জল ঢোকেনি দেখে অনেকেই ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। দেখাদেখি শিব মন্দিরের দরজাও খুলে দেওয়া হয়েছে সবার জন্য। সেখানেও অনেকে গিয়ে ঢুকেছে। আজ ঈশ্বরের সময় হয়েছে বোধহয় মানুষের জন্য কিছু করতে পারার। বাড়িগুলো থেকে হাড়ি-পাতিল, হাঁস, মুরগী, ছাগল ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে গেছে কে জানে! সুজাউদ্দিনের ঘরেও জল ঢুকে গেছে। ও আর কোথায় যাবে। ওখানেই বসে রইল। বসেই রইল, নড়ল না। খেয়াল করার কেউ নেই।
কদিন বাদে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে স্পীড বোট এল গ্রামে। সবাই হুড়োহুড়ি করে দুহাত ভরে নিচ্ছে। খাবার, জল, ওষুধ, বেবিফুড, পুরোনো পরিষ্কার জামাকাপড়। যারা এসব দিতে এসেছিল, তারা ছবি তুলছে পুরো পরিস্থিতির। হঠাৎ খায়রুন্নেসার খেয়াল হল, সুজা বুড়ো তো এসে নিতে পারবে না। তাহলে? নেপাল সেদিন গিয়ে যা দেখে এসেছে বলল এবং আর সময় করে উঠতে না পারার ব্যর্থতায় দুঃখপ্রকাশও করল আন্তরিকভাবে। নেপাল আর আমিরুল বুড়োর জন্য জিনিসপত্র নিয়ে জল ভেঙেই দিতে চলল বুড়োর বাড়ির দিকে। গিয়ে দেখে…
একটুকরো মাটিও জেগে নেই, যেখানে বুড়োর জন্য সাড়ে তিন হাত একটা গর্ত খুঁড়তে পারা যায়। অগত্যা বাঁশের আংটায় আটকে থাকা পচে ওঠা মৃতদেহটিকে ভাসিয়ে দেওয়া হল জলের তোড়ে…
অনেকক্ষণ পর নেপাল আর আমিনুলের চোখের সামনেই একঝাঁক কাক নেমে এল সে ভাসমান শরীরের ওপর।
_