অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বইয়ের নামঃ জলপাইনগর, অথবা যে জনপদেরা হারিয়ে যায়
এই জায়গাতে এসেই নভেন্দু থমকাল। সে কোনওদিন নিজে বই লিখবে বলে ভাবেনি। ভাবলে পরেও তা প্রকাশ করার কথা তো দূরস্থান। তবু সে লিখেছে। আস্ত একটা গোটা বই লিখে ফেলেছে নভেন্দু সেন। অথচ তার ভবিষ্যৎ প্রাপ্তিস্থান যে কোথায় তা সে জানে না। নভেন্দুর অবাক বোধ হয়। এই কমবেশি ছয়-ফর্মার গদ্য-পদ্যের মিশেল, এদিক-সেদিকে সাদাকালো সিল্যুয়েট ছবির সমাহার। অথচ জলপাইনগর (অথবা) সেই হারিয়ে যাওয়া জনপদেরা নভেন্দুকে ক্রমাগত ভাবিয়ে যায়। এক ক্রমিক অথচ পুনারাবৃত্ত চলনে তাদের সেই হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। নভেন্দু সেন অস্ফূটে উচ্চারণ করে। গঙ্গার ঘাট বেয়ে সে দূরের দিকে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। অলস বিকেলে একমনে দাঁড় টেনে বয়ে যাওয়া ডিঙিটার মতো, তার গন্তব্য অনিশ্চিত। এই বই কোথাও টিকবে না। ডিঙি নৌকোটা থেকে হাফপ্যান্ট পরা দুটি শরীর ঝুপ করে কালো গায়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে।
মানুষ লেখে কেন? নভেন্দুর মনে যে প্রশ্নটা জাগেনি তা নয়। আজকাল বইমেলা চত্বরে ঘুরে বেড়ালেই তার কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হয়। পাঠকের চেয়ে যেন লেখকেরই ভিড় বেশি। লিখছে সকলেই। পড়ছে কম। যারা লিখছে, তারা হয়তো পড়ছে কেউকেউ। কিন্তু বাকিরা? বই এখন বিজ্ঞাপনের বস্তু। সেই তর্কের এপিঠ-ওপিঠ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু যে পিঠেই যে থাকুক না কেন, আজকাল যে বড় বেশি লেখা হচ্ছে সেকথা বোধহয় অস্বীকার করার নয়। নিজেকে দিয়ে নভেন্দু সেকথা বুঝতে পারে। ভালোবেসে আর কয় পংক্তি লেখে মানুষ? প্রকাশের নিশ্চয়তা ভিন্ন লেখে না কেউ। নভেন্দুর তাই নিজের ছয়-ফর্মাটাকে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়।
“এ বই তুমি ছাপবে না ?” অবাক চোখে প্রজ্ঞা জিজ্ঞেস করে। প্রজ্ঞা ওরফে পিপিএস – প্রজ্ঞাপ্রকৃতি সিং। নভেন্দুর বান্ধবী। ছোট পত্রিকা ‘তালমেঘ’এর সম্পাদক। প্রজ্ঞার পদবী দেখে মনে মনে অবশ্য অনেকেই সংশয় প্রকাশ করে। সিং, অথচ বাঙালী ধাঁচে সম্পূর্ণ সিংহ নয়। তাদের উদ্দেশ্যেই একথা বলার, পিপিএসের পরিবার প্রায় চারপুরুষ যাবৎ কলকাতায়। বাংলা ভাষাটা তাদের শিরায় ঢুকেছে অনেকদিন। প্রজ্ঞার দাদুই ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন কলকাতার এক শিক্ষিত ঘরের বাঙালী সুন্দরীকে। তার হাত ধরেই পঞ্জাবি হেঁশেলে ঢুকেছিল বাংলার পাঁচফোড়ন। বইয়ের তাকে আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছিলেন বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ। পিপিএসের বাংলা তাই ঝরঝরে পরিষ্কার। কোনও এক বছরে শীত-আগমনীর সময় যখন আসন্ন বইমেলা, তারই সঙ্গে তালমেঘের নতুন সংখ্যা নিয়ে পিপিএস বেজায় উৎসাহিত, ঠিক তখনই নভেন্দু এসে তাকে বলেছিল, “একটা লেখা লিখেছি জানিস!” […]
“এ বই তুমি ছাপবে না?” আবারও অবাক স্বরে প্রজ্ঞা তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি জানো কত সুন্দর হয়েছে এই প্রেজেন্টেশনটা? আমি কিন্তু শুধু লেখার কথা বলছি না!” নভেন্দু ঘাড় নাড়ে। ওরা দুজনে এসে বসেছিল হাওড়ার গোলাবাড়ি ঘাটের জেটিতে। সেখানে লোকজন নেই বিশেষ। শীত-রবিবারের বিকেল। পাশাপাশি প্রজ্ঞা আর নভেন্দু বসেছিল। মোবাইল-স্ক্রিনে, যান্ত্রিক পিডিএফের পাতা উলটিয়ে প্রজ্ঞা আবারও হাত বুলিয়ে দেখছিল নভেন্দুর নতুন ম্যানুস্ক্রিপ্ট। ‘জলপাইনগর, অথবা যে জনপদেরা হারিয়ে যায়’। কেবল নামটার উপরেই যেন হাত ছুঁইয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। নভেন্দু এর আগেও লিখেছে। তালমেঘেই লিখেছে। কিন্তু আগাগোড়া এমন একটা সৃষ্টি, যার একটা স্পষ্ট আয়তন আছে, পরিসর আছে – আর আছে বেশ অনেকক্ষণ ধরে হাতে নিয়ে পড়বার মতো এক আমন্ত্রণ, এমন রচনা তার এই প্রথম।
প্রজ্ঞা নভেন্দুর দিকে তাকাল।
“তুমি ভালো করে ভেবে বলছ তো?”
-“ভেবেই বলছি,” নভেন্দু জবাব দেয়।
এ বই ছাপাতে চায় না নভেন্দু। প্রজ্ঞার সঙ্গে তার মতে মেলে না। যা হোক একটা কিছু লিখে ছেপে দিলেই সেটা বই হয়ে যায় না। তর্ক করে নভেন্দু। প্রজ্ঞা তর্কে যেতে চায় না। সে কেবল আরও একবার পিডিএফে চোখ বোলায়। নিজের আর সমস্ত কাজের মতোই এই লেখার ক্ষেত্রেও নভেন্দুর যত্নভাব স্পষ্ট। কেবল পাতা, অক্ষর, আর অধ্যায়গুলিই সে পরপর সাজায়নি। মধ্যে মধ্যে সাজিয়েছে নিজের তোলা সাদা-কালো ছবি। তারই মধ্যে একখানি ছবি রঙিন। সব মিলিয়ে এক সম্পূর্ণতা। পিপিএস ঠিকই বলেছে। ‘জনপদ’কে কেবল বই বলা চলে না। আদতে এ এক সার্থক প্রেজেন্টেশন। তবু কথাটা উচ্চারণ করা মাত্রই প্রজ্ঞার নিজেকে কেমন যেন বাণিজ্যিক বলে মনে হয়।
ভাবনাটা সে দূরে তাড়াতে চায়। সে ফোন বন্ধ করে হাতের ভিতরে নেয় নভেন্দুর হাত। ইদানীং তাদের বন্ধুত্বটা, ক্রমশই যেন দূর মফস্বল স্টেশনের কোনও এক চায়ের দোকান, কুয়াশা-মাখা শীত-বেলার খোসা ছাড়ানো আধসিদ্ধ ডিম, তার ভিতরকার গরম, হলুদ হয়ে ওঠা সেই নরম কুসুমের মতো, একটু একটু করে ওম পেতে শুরু করেছে। ‘জনপদ’ নিয়ে নভেন্দু আর কোনও কথা বলে না। সে কেবল প্রজ্ঞার কাছ ঘেঁষে আরও একটু সরে আসে। দুজনের শরীরেই দুজনের উষ্ণতা এখন।
[…]
ফাঁকা অন্ধকার ছাদটার উপর দুজনে দাঁড়িয়ে। “আমি তোমাকে বারণ করেছিলাম,” শান্ত গলায় বলে নভেন্দু। তার পরনে একখানি ধূসর জিনসের প্যান্ট, খাদির পুরনো পাঞ্জাবি। উসকোখুসকো চুল। তবু শরীরে কোনওরকম উত্তেজনা নেই। কেবল তার শান্ত স্থির দুটি চোখ, সাদা শাড়ি, কালো ব্লাউজ, আর হালকা মেটাল জুয়েলারিতে সাজানো স্নিগ্ধ অবয়বটির উপরে নিবদ্ধ। পিপিএস অথবা প্রজ্ঞাপ্রকৃতি নামের মেয়েটি মুখ তুলে তাকায়। “বারণ করেছিলাম,” আবারও বলে নভেন্দু। প্রজ্ঞা এখনও কোনও জবাব দেয় না। তার ভিতরকার লুকিয়ে থাকা পঞ্জাবি গোঁ ধরে থাকা মেজাজের ব্যাকুল জিনটা মাঝেমাঝেই অধৈর্যে আঁকুপাঁকু করে ওঠে কেমন। তবু সে নিজেকে সংযত রাখে। প্রজ্ঞা মনে করে না এই বই ছেপে সে কোনও ভুল করেছে। এই বইয়ের সম্পূর্ণতা নিয়ে তার কোনও সংশয় নেই। তালমেঘ থেকে নিজস্ব প্রকাশনায় এত ভালো কোনও বই এর আগে ছেপে বেরয়নি। যদিও, বাণিজ্যের পাশাপাশি সে সত্যিই মন থেকে চেয়েছিল নভেন্দুকে চমকে দিতে। তার হাতে প্রেস থেকে গরম ছেপে আসা বইটার প্রথম কপি তুলে দিতে। বইমেলার মাঠেই সে সুযোগ এসেছিল। কেবল মেলার টেবলে আর একটিও কথা বলেনি নভেন্দু। সেই নিস্তব্ধতা দেখেই প্রজ্ঞা বুঝতে পেরেছিল বিপদ আসন্ন। অন্ধকার ছাদের উপর এখন সেই অন্ধকার আরও তীক্ষ্ণ, তীব্র, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। প্রজ্ঞা নভেন্দুর হাতে হাত রাখতে চায়।
নভেন্দু হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। “আহ!” অস্ফূটে একটা শব্দ হয়। হাত ছাড়াতে গিয়ে প্রজ্ঞার ডানহাতের ধাতব বালাটায় নভেন্দুর কব্জির হাড় গিয়ে লেগেছে। যদিও ‘আহ’টুকু বাদ দিয়ে আর কোনও শব্দ হয় না। “জিনিসটা আমার কাছে এখনও সম্পূর্ণ নয়। প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা শব্দকে আমি নতুন করে লিখব ভেবেছিলাম। একটা সৃষ্টি এত সহজে মাটি, রঙ, কাঠামোয় সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না পি,” নভেন্দু স্পষ্ট উচ্চারণে কথাগুলো বলে যায়। “কাজটা আমি ভালোভাবে করতে চেয়েছিলাম।” “আর তারপর? আরও বড় কোনও পাবলিশারের কাছে, আরও বড় একজন লেখক হয়ে পাবলিশড হতে চেয়েছিলে, তাই না?” পঞ্জাবি গোঁ’কে আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না। নভেন্দু সচকিতে মুখ ফেরায়, “কি বললে?” দূরে কোথাও, কারোর বাড়িতে ঝনঝনিয়ে কাচ ভাঙার শব্দ হয়। প্রজ্ঞার সমস্ত শরীরটাকে মনে মনে একবার অনুভব করে নভেন্দু। সে বুঝতে পারে তার প্রতিটা হাড়, প্রতিটা মাংসপেশির বুনন, কঠোর, শক্ত হয়ে উঠেছে। একবার সে প্রজ্ঞার হাত চেপে ধরে, শেষবার। লোহার বালাটার উপর। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায়।
আরও অনেক রাত্তিরে হঠাৎ সেই ছাদেরই উপর দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে। পোড়া কাগজের গন্ধ ছড়িয়ে যায়। পরদিন যারাই বা তালমেঘের টেবলে এসে ‘জনপদ’এর খোঁজ করে, সংগ্রহ করতে চায় – তাদের প্রত্যেককেই নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়। নভেন্দুকেও আর তালমেঘের টেবলে দেখতে পায়নি কেউ।
[…] জলপাইনগর, অথবা যে জনপদেরা হারিয়ে যায়।
পাহাড়ে পিচফুলের ভোর।
কার্লাকে ভালোবেসে শুভময় এতদিন অপেক্ষা করেছে। আজ সেই দিন।
পূর্ব-পরিকল্পনা মতোই ওদের এই নিংচি পিচ উৎসবে আসা। পূর্ব তিব্বতের এই শহরে এখন পাহাড়-জোড়া পিচফুলের রঙ। সেখানেই কার্লা-শুভময়ের পারস্পরিক ব্যক্তিগত ব্যাচেলরেট। পর্তুগালের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে প্রথম আলাপ কার্লার সঙ্গে শুভময়ের। তারপর সেখান থেকে লণ্ডনের হাই এণ্ড অথবা অস্ট্রিয়ার কোনও অজানা দুর্গপ্রাকারের ইতিহাস। নিউফাউণ্ডল্যাণ্ড। কার্লা-শুভময়ের প্রেম মহাদেশ, মহাসাগর পেরিয়েছে। নিংচি থেকে ফিরেই ওদের বাগদান-অনুষ্ঠান। রাত যত বাড়ে নিংচির উষ্ণতাও ততই হিমাঙ্কের নীচে নেমে যায়। এই মাঝ-এপ্রিলেও। হোটেলের ঘরে দামী শম্পাইন বলে রেখেছিল শুভময়। ডিনার শেষে কার্লাকে চমকে দেওয়ার প্ল্যান। ওরা আলিঙ্গনবদ্ধ হয়। খুঁজে দেখে পরস্পরের ঠোঁট। মখমলি কাপড় আর স্নিগ্ধ ত্বক। চারপাশ অগোছালো হয়ে পড়ে। তারপর টেবলে এসে বসে দুজন। জানলার বাইরে অন্ধকার রাত।
ঘরের সব আলো নেভানো। কেবল মসৃণ মোমবাতির শিখার মতো একটি বৈদ্যুতিন ল্যাম্প জ্বলছে। শুভময় তার প্যান্টের পকেট থেকে ছোট একটা বই বের করে আনে। কার্লার দিকে বাড়িয়ে দেয়। “পড়ো তো একবার,” শুভময়ের চোখ জ্বলজ্বল করে। জনপদেরা শেষমেশ হারায় না বোধহয়। বরং ঘুরেফিরেই তাদের বৃত্তীয় চলন। একাদিক্রমে, বারংবার। “এটা আমার কাকার লেখা। হি রোট দিস হোয়েন হি ওয়াজ ইন কলেজ। বাট হি ডিডন্ট ওয়ান্ট টু পাবলিশ।”
‘জলপাইনগর’। কার্লার পড়তে এতটুকুও অসুবিধে হয় না। এম ফিলের সময় প্রফেসর শুভময় সেনের তত্ত্বাবধানেই তার গবেষণা; আর সেই সন্দর্ভের মূল বিষয় ছিল ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’। তাছাড়াও,
কার্লা জিজ্ঞেস করে, “প্রকাশ করতে চাননি মানে? এটা তো প্রকাশিত বই,” পাতাগুলো সে আবারও তার আঙুলে করে উলটিয়ে দেখে। সরসর করে পাতাগুলো সরে যায়। তার অবাক বোধ হয়। মাঝের একেকটা পাতায় যেন অবাক, অনিয়মিত সাদাকালো সিল্যুয়েট; আর তারই সঙ্গে যেন ঠিক নিক্তিতে মেপে সযত্নে সাজানো, নির্বাচিত অক্ষরের সুখ। পিচফুলের রঙ। এক অদ্ভুৎ মোলায়েম রস।
“তুমি কি বলছিলে যেন?” কার্লা থেমে যায়। “ওঁর বান্ধবী ওনাকে না জানিয়েই বইটা প্রকাশ করে। সেই কারণেই শেষমেশ সেই সম্পর্ক টেকেনি। এরপর সেই বান্ধবীও নাকি রাগে-দুঃখে এই বইয়ের তখনও অবধি পড়ে থাকা সমস্ত কপিগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে...কিন্তু” একটা শ্বাস ফেলে শুভময়, “আমার কাকাই বোধহয়, প্রকাশের বিষয় প্রথম থেকে শেষ অবধি চরম আপত্তি জানালেও, অন্তিম-অবচেতনের প্ররোচনায় একটা অন্তত প্রকাশিত কপিকে...”
-“ইউ মিন টু সে, সারা পৃথিবীতে এই বইটার একটা, মাত্র এই একটাই কপি রয়েছে!” কার্লার গলায় এক বিস্ময়-মিশ্রিত ভালো-লাগা।
শুভময় মৃদু হাসে। সে জানত এই বিশেষ, একক উপহার, কার্লার মনে ধরবে। দামী শম্পাইনের চেয়েও এ সুন্দর।
সে নিজেও কার্লার হাতের উপরে হাত রাখে। তলায় আটকে থাকে বহুকাল বাক্সবন্দী কাগজের গন্ধ লেগে থাকা জনপদের জলপাইনগর। “আমাদের বিয়ের পর তুমি আমাকে একদিন দেখা করাতে নিয়ে যাবে তোমার এই কাকার সঙ্গে?” শুভময়ের চোখে চোখ রেখে কার্লা জিজ্ঞেস করে। শুভময় কোনও জবাব দেয় না। নভেন্দু সেন বহুদিন প্রয়াত। তিনি জলে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। দমবন্ধ হয়ে আসা এই সমাজব্যবস্থায়। তিনি বোধকরি দূরে, এর চেয়েও বহুদূরে, চিরতরে পালাতে চেয়েছিলেন।
[***]
কয়েক হাজার মাইল পেরিয়ে ভ্যাঙ্কুভারের এক নির্জন কাফের উষ্ণতায় পিপিএস একলাটি বসে থাকেন। তাঁর বয়স বেড়েছে। কিন্তু তাই বলে অস্তিত্বে লাবণ্য কমেনি তাঁর।
স্বামীর ফিরতে দেরী হয়। ঘরে বসে, একা একা আর ভালো লাগে না। তাই পিপিএস বাড়ি থেকে বের হয়ে, বাড়ির খুব কাছেই এই কাফেটিতে এসে বসেন। একখানি বই সামনে খুলে রাখেন। আবারও মলাট মুড়ে তাতে হাত বোলান। আর তিনমাসও বাকি নেই। তারপরেই কার্লার বিয়ে। শুভময় ছেলেটিকে তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে। একবারই মাত্র শুভময়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। তবু প্রথম আলাপেই তাকে বেশ চৌখস বলে মনে হয়েছে তাঁর। তিনি আবারও বইটা হাতে তুলে নেন। বাইরে গোধূলি রঙ।
অজান্তেই কেমন উদাস হয়ে পড়েন প্রজ্ঞাপ্রকৃতি সিং। কিভাবে যেন রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-বর্ণ-স্পর্শ, ইন্দ্রিয়জাত এমন অনেক অনুভূতির উৎস ও প্রতিক্রিয়াসকল, তাঁর আবেগ-মস্তিষ্কের অন্তরতম কুঠুরিতে সগর্বে, সবেগে, বন্যার জলের মতোই ভেসে আসতে চায়। তিনি অস্ফূটে উচ্চারণ করেন, “জলপাইনগর।”
“অথবা যে জনপদেরা হারিয়ে যায়।”
বাইরে বসন্তের সুবাস।
ভ্যাঙ্কুভারের সর্বস্বতাতেও পোড়া বাংলাকে এখন মনে পড়ে পিপিএসের।