শুভাঙ্কুর মিত্র
লাল্টু: শুভ নববর্ষ।
পুচু: রাস্তা ছাড়ো।
লাল্টু: কিসের এতো তাড়া?
পুচু: মন্দিরে যাচ্ছি।
লাল্টু: মন্দিরে গেলে, গত বছরের খারাপ দিনগুলো ভুলে যাওয়া যাবে?
পুচু: আলোকিত হওয়ার দায় কি শুধু আমার মনের একার?
লাল্টু: কেমন আছ?
পুচু: ভালো আছি বললে তুমি খুশি হবে না।
লাল্টু: বছরের প্রথম দিনে, মিথ্যে বললে, ঠাকুর রাগ করবেন।
পুচু: তুমি যে সবজান্তা নও, দুই বছরেও কেউ তোমায় বোঝায়নি দেখছি।
লাল্টু: আমি নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছি।
পুচু: কি?
লাল্টু: বুঝিয়েছি, তুমি ফিরবে।
পুচু: আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, কী মনে হচ্ছে?
লাল্টু: কাজল পরেছো! তোমায় কিন্তু বলেছিলাম, এটা তোমায় তেমন মানায় না।
পুচু: চোখের ভাষাটা পড়তে পারলে, বুঝতে পারতে, আমি কি চাই!
লাল্টু: ওই কাজলের বাউন্ডারি টপকে ঢুকতে পারলাম কই?
পুচু: আমার কোনোকিছুই কি তোমার কোনোদিন ভালো লেগেছে?
লাল্টু: কেন বোঝো না, একটা টলটলে শিশির বিন্দুর ভেতরে ডুব দেবো বলে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করতেই, ওই কাজলের বাউন্ডারিতে ধাক্কা খেয়ে আবার পপাত ধরণীতল হতে হয়।
পুচু: সেটা সত্যি হলে খুশি হতাম। কোনো ষাঁড় জাতীয় মর্কট, রাস্তা আটকাতে পারতো না!
লাল্টু: এই টিসু পেপারটা দিয়ে চোখটা একবার মুছে নেবে?
পুচু: খবরদার! কাছে আসবে না।
লাল্টু: বেশ। তাহলে আর একবার চেষ্টা করি । ওমা, এতো ঘূর্ণিঝড়! ল্যান্ডফল হওয়ার অপেক্ষায়। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে।
পুচু: ঠিক উল্টো। সাহারা মরুভুমি। চোখে এখন আর জল আসে না।
লাল্টু: সেকি! আরব সাগরের বাষ্পীভূত ঘূর্ণিঝড় হঠাৎ দিকভ্রান্ত হয়ে আফ্রিকায় পাড়ি দিলো কীভাবে?
পুচু: আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
লাল্টু: বলতে এসেছিলাম, তোমাকে হারিয়ে ফেলে আবার ফিরে পাওয়ার মধ্যেকার সময়ে, আমি একটা অন্য আমিকে খুঁজে পেয়েছি।
পুচু: আমাকে ফিরে পেয়েছো, এমন ভুল ধারণা হলো কি করে?
লাল্টু: এই তো বললে, তোমার চোখে আর জল আসে না।
পুচু: তাতে কি প্রমাণ হলো?
লাল্টু: আমরা দুজনেই যখন মরু সাহারায় পথ হারিয়েছি, একসাথে পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
পুচু: নিজে কাঁদতে পারো না বলেই, এমন কষ্ট দিতে পারো!
লাল্টু: জানি তো, তোমার অনেকদিনের ইচ্ছে, আমরা দুজনে একসাথে হাতে হাত ধরে কাঁদি।
পুচু: একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
লাল্টু: করো।
পুচু: হঠাৎ করে কেন এমন হয়ে যাও তুমি?
লাল্টু: নেশায়। তোমাকে নিজের করে নেওয়ার নেশায়। বড়ো মারাত্মক এই নেশা!
পুচু: নেশাটা এখনো আছে না গেছে?
লাল্টু: বুঝতে শিখেছি, প্রেমের চঞ্চলতায় ফুলকে গলার মালায় আঁকড়ে ধরে রাখলে, সে ফুল শুকিয়ে যায়।
পুচু: আর কি কি নতুন উপলব্ধি হলো, শুনি?
লাল্টু: শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া / শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া
পুচু: পাষান হৃদয়ে কি ঝড় উঠেছে?
লাল্টু: আমার বুকে হাত দিয়ে দ্যাখো।
পুচু: শান্ত। নিস্তরঙ্গ।
লাল্টু: চোখে জল নেই বলে, হৃদয়ে ঢেউ উঠবে না?
পুচু: এবার কিন্তু অবাক হচ্ছি।
লাল্টু: সেদিন চলে যাওয়ার সময়, মনে হয়নি তোমায় ছাড়া, আমি একটা মৃত কঙ্কাল মাত্র?
পুচু: হ্যাঁ, হয়েছিল।
লাল্টু: তাহলে গেলে কেন?
পুচু: তোমায় ভারমুক্ত করতে।
লাল্টু: মন কিন্তু বলেছিলো, তুমি ফিরবে।
পুচু: দুটো বছর! অনেক দেরি হয়ে গেছে।
লাল্টু: যদি আমাদের গড় আয়ু সত্তর বছর হয়, দুটো বছর খুব বেশি কি?
পুচু: নিজের দেখানো স্বপ্ন, নিজেই ভেঙে চুরমার করে দেওয়াতে, তোমার জুড়ি মেলা ভার।
লাল্টু: আমার বুকে হাত দিয়ে দ্যাখো।
পুচু: কি?
লাল্টু: কম্পন। 7.5 রিখটার স্কেল!
পুচু: কই, কিছু শুনতে পাচ্ছি নাতো?
লাল্টু: হৃদয়ের টেক্টোনিক প্লেটগুলোতে নৈঃশব্দ লেপে দেওয়া থাকে।
পুচু: এ কী, তোমার চোখে জল কেন? তুমি না বললে শুকিয়ে গেছে?
লাল্টু: কখনও কি ঘুড়ি উড়িয়েছ?
পুচু : ছোটবেলায়।
লাল্টু: সুতোয় টান পড়লে ঘুড়ি আবার নিচে চলে আসে।
পুচু : জানি। দেখেছি।
লাল্টু: আমার হৃদয়ে টান পড়েছে।
পুচু: যদি আবার ওসব শুরু করো?
লাল্টু: সাত বছরে, কতবার বলেছি, আর কখনো হবে না।
পুচু: বছরে সাত বার কাঁদিয়েছো আমায়!
লাল্টু: ওটা অন্য আমি! চলো এক সুতোয় আবার পেঁচিয়ে যাই।
পুচু: তোমাকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়!
লাল্টু: সুতোর শক্তিতে বিশ্বাস রাখো। আজ থেকে আমি তোমার সেই সুতোয় বাঁধা ঘুড়ি।
পুচু: আর আমি?
লাল্টু: তুমি আমার হৃদয় কাননের জুঁই ফুল, আমার প্রেম-গগনের ধ্রুবতারা।
পুচু: না, না। একদম কাছে আসবে না। উফফ…আজকাল পারফিউমও কি সিগারেট দিয়ে তৈরী হয়?
লাল্টু: সিগারেটের গন্ধ তো তোমার ভালোলাগতো!
পুচু: গন্ধ ভালো লাগে বলিনি। বলেছিলাম, সিগারেট হাতে তোমাকে গভীর চিন্তায় ডুবে যেতে দেখতে আমার ভালো লাগে।
লাল্টু: ছেলেদের শৃঙ্গার সামগ্রীর কদর করতে শেখো! এটা ভ্যানিলা-টোবাকো। তোমার ল্যাভেণ্ডারের চেয়ে ঢের ভালো।
পুচু: দুইবছর হয়ে গেলো...তুমিই সরস্বতী পুজোয় কিনে দিয়েছিলে ।
লাল্টু: সাথে মেটে রঙের লিপস্টিক! তোমাকে বেশ মানাতো!
পুচু: ওটা অনেকদিন পরিনি।
লাল্টু: কেন?
পুচু: সব সাজ তো সবাইকে দেখানোর জন্য নয়।
লাল্টু: বেশ।
পুচু: ল্যাভেণ্ডার তোমার ভালো লাগে না, এটা জানা ছিলো না।
লাল্টু: তখন ভালো লাগতো! এখন আর লাগে না।
পুচু: পছন্দগুলো সময়ের সাথে সাথে কেমন বদলে যায়!
লাল্টু: আমরা নিজেরাই নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করি প্রতিনিয়ত! মেটামরফোসিস মানে রূপান্তর তো মানুষেরও হয়!
পুচু: কাফকা পড়তে দিয়েছিলাম তোমায় একদিন!
লাল্টু: পড়েছি। নিজেকে পোকাই মনে হতো তখন।
পুচু: এখন কি মনে হচ্ছে? অতিমানব?
লাল্টু: নাহঃ! মানুষ! যে ভুল করে ক্ষমা চাইতে পারে।
পুচু: ক্ষমা চাইতে দুই বছর লেগে গেলো?
লাল্টু: এটা একটা প্রসেস । সবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা, আমি কি আর কেন? তারপরে উপলব্ধি করা, কি ভুল আর কেন ভুল। তারপরে আসে ক্ষমা চাওয়া।
পুচু: তাই বলে দুই বছর?
লাল্টু: অনেক কিছু ভুল একসাথে করা হয়েছে বলেই, অনেক কিছু ঠিক কাজ একসাথে করতে সময় লাগে।
পুচু: কাফকার পরে এবার ভগবতগীতা!
লাল্টু: এর মধ্যে, এক বছর সাত মাস কিন্তু তুমি, ভাইব্রেশন মোডে ছিলে।
পুচু: মানে?
লাল্টু: কথা বলতে না। শুধু রাগে কেঁপে কেঁপে উঠতে।
পুচু: রাগ নয় হতাশা!
লাল্টু: আরো একবার ক্ষমা করা যেত না?
পুচু: না।
লাল্টু: কারণ?
পুচু: তোমার নিজেকে চেনার দরকার ছিলো।
লাল্টু: সে তো তোমারও অহংকারটা ঝেড়ে ফেলার দরকার ছিলো!
পুচু: আবার শুরু করলে! নাহঃ! তোমার সাথে থাকা অসম্ভব।
লাল্টু: কতদিনের?
পুচু: কি, কতদিনের?
লাল্টু: এবার যদি ব্রেকাপ হয়, সেটা কতদিনের হবে?
পুচু: আগেরটা কতদিনের ছিলো যেন?
লাল্টু: এক বছর দুশো বারো দিন তিন ঘন্টা সাতান্ন সেকেন্ড।
পুচু: অতক্ষন পারবো না।
লাল্টু: মন্দিরে কতো সময় লাগবে?
পুচু: কেন?
লাল্টু: এখন তোমার শাড়ির ভাঁজ নষ্ট করতে চাই না।
পুচু: তোমার তো শুধু, ওই।
লাল্টু: এক ঘন্টা পরে, মন্দিরের বাঁ দিকের গলিটায় থাকবো। শুভ নববর্ষ।
পুচু: হবে না। মা থাকবে।
লাল্টু: শুভ নববর্ষ।
পুচু: বলছি তো, মা থাকবে।
লাল্টু: নববর্ষের শুভেচ্ছা।
পুচু: উফফফ। ঘামে ভেজা, এই কটকটে লাল পাঞ্জাবিটা ছেড়ে এসো। আর স্নান করে ওই দারচিনির গন্ধওয়ালা পারফিউমটা...
লাল্টু (চলে যেতে যেতে): কাজলটা মুছে নিওওওও!
পুচু (চেঁচিয়ে): শুভ নববর্ষওওওওওওও...